মত দ্বিমত
হেরেছো কি মরেছো
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠেছে। যদি আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা অনিবার্যভাবে হার স্বীকার করতে বাধ্য হব। কিন্তু এটি কি শুধুই ব্যক্তিগত পরাজয়ের গল্প? না। এটি একটি সমষ্টিগত মনস্তাত্ত্বিক ধ্বস, যা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সম্পর্ক ভাঙায় এবং সমাজের অন্তর থেকে আশা শুষে নেয়। যেখানে দুর্নীতি, অত্যাচার, অবিচার এবং মিথ্যা অভিযোগ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ সেগুলো দেখার সুযোগ এবং সাহস খুঁজে পাচ্ছে না, সেখানে অস্থিরতা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে হৃদয়ে। এই অস্থিরতা কাটাতে আমাদের সকলকে একযোগে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং সকল ষড়যন্ত্র ভেঙে দিতে হবে।
পরাজয়ের মনস্তত্ত্ব ও সমাজের ভাঙন
পরাজয়ের অনুভূতি যত গভীর হবে তত বেশি মানুষ আত্মরক্ষার পথ গ্রহণ করবে। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে জন্ম নেয় সন্দেহ, প্রতিহিংসা এবং ভুল বোঝাবুঝি। যখন প্রত্যেকে শুধু নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই করে, তখন সহানুভূতির জায়গা শূন্য হয়ে পড়ে। পরিবারিক দ্বন্দ্বে ভালোবাসার বদলে ঘৃণা জমে। ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক দ্বন্দ্বেও মিশ্র আবেগ সমাজকে ভিতরের দিকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে। আর কেউ যদি বলে আমি শুধু হেরেছি, তুমি কি একটুও হারোনি, তখন সেই প্রশ্নই আস্থা ভাঙায় এবং সবচেয়ে ভয়ানক ভূমিকা নেয়।
মুক্তির পথ: নীতি, কৌশল ও অনুশীলন
মুক্তির পথ কেবল স্লোগানের ইস্যু নয়। এটিকে নীতি, কৌশল এবং ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত অপরিহার্য।
১. স্বচ্ছতা
অভিযোগ যদি প্রকাশ্য না হয় এবং তদন্ত স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে না হয়, তাহলে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও গুজব আগুনের কাজ করবে। দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ তদন্ত ব্যবস্থা গড়তে হবে।
২. সহমর্মিতা
দোষীদের বিচার করতেই হবে, কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখার আগ্রহ হারালে পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সহমর্মিতা ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
৩. সংহত আন্দোলন
ভাগ হয়ে থাকা প্রতিবাদ ভাঙনই বাড়ায়। পরিকল্পিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নীতিভিত্তিক আন্দোলনই টেকসই পরিবর্তন আনতে পারে। পাশাপাশি আইনি ও নৈতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করে ক্ষমতার অপব্যবহার দমন করতে হবে।
রাষ্ট্র যন্ত্রের ওপর বিশ্লেষণ
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে মৌলিক কাঠামোগুলো প্রয়োজন, সেগুলো আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কেন পৌঁছেছে? কীভাবে সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব? নির্বাচন কি একমাত্র সমাধান? বাংলাদেশ আদৌ নির্বাচন সম্পর্কে সচেতন ছিল কি? একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অবকাঠামো কিভাবে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে?
রাষ্ট্রযন্ত্র কী
রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে আমরা বুঝি আইনপ্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান, নির্বাহী বিভাগ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী কাঠামো এবং তথ্যমাধ্যম। এগুলো একত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখে। যখন এই স্তরগুলো দুর্বল হয়, তখন রাষ্ট্র কেবল নামমাত্রই থাকে। তখন নীতি, ন্যায় ও দায়িত্ববোধ ভেঙে পড়ে এবং দুর্নীতি ও শক্তির অপব্যবহার সমাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বসে যায়।
নির্বাচন কি সমাধান
নির্বাচন একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া, কিন্তু এটি নিজে এককভাবে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোকে শুধরাতে পারে না যদি পরিবেশ নিরপেক্ষ না থাকে। নির্বাচন যদি হয় কেবল ফর্মালিটি, ভোটচুরি ও প্রভাবের মাধ্যমে পরিচালিত, তাহলে তা জনগণের আস্থা হারায়। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ন্যায্য, মুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে না পারলে নির্বাচন কেবল আড়ম্বর হয়ে থাকে।
নির্বাচন সম্পর্কে সচেতনতা
বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ভোটাররা নির্বাচনকে অনেক সময় শুধু একটি ইভেন্ট মনে করেন, যেখানে কাগজে চিহ্ন দেয়া হয়। সচেতন নাগরিক হওয়ার মানে হলো প্রার্থীর নীতি যাচাই করা, তাদের অনুপ্রেরণা বোঝা, এবং ভোটের ফলাফল ধরে রাখার দায়বদ্ধতা পালন করা। এই সচেতনতা গড়ে ওঠে মিডিয়ার স্বাধীনতা, নাগরিক শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিচারব্যবস্থার স্বতন্ত্রতার মাধ্যমে। যখন এগুলো দুর্বল থাকে, তখন নির্বাচনও দুর্বল হয়।
দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অবকাঠামো ও জনগণের শাসন
দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামো জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বরং তা ক্ষমতাসীনদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ দেয় নিজের অবস্থান দীর্ঘায়িত করার। দুর্নীতি নীতিগত স্বার্থ বিকৃত করে এবং নাগরিকের বিশ্বাস ধ্বংস করে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সততা, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক নীতি। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের ভেতরে স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে, তাহলেই বাহ্যিক নির্বাচনে সঠিক প্রতিনিধিত্ব সম্ভব।
রাষ্ট্রযন্ত্র রক্ষার প্রস্তাবনা
১. বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা শক্তিশালী করা, বিচারব্যবস্থা হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক চাপমুক্ত।
২. নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশাসন নিশ্চিত করা, প্রযুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে উন্মুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৩. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্যের মুক্ত প্রবাহ, তথ্য যাচাই ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
৪. দমনমূলক আইন পর্যালোচনা, সমালোচনা ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার রক্ষায় আইনগুলো পুনর্গঠন করতে হবে।
৫. নাগরিক শিক্ষা ও অংশগ্রহণ, ভোটের মূল্যবোধ, নীতিগত বিচার ও জনগণের অধিকার বিষয়ে শিক্ষা বাড়াতে হবে।
৬. অডিট ও জবাবদিহি কাঠামো শক্তিশালী করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর অডিট ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নিয়ম চালু করতে হবে।
৭. সংগঠিত ও নীতিভিত্তিক অভ্যন্তরীণ আন্দোলন, বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের বদলে কৌশলগত, শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে.
সমাপ্তি
হেরে যাওয়া মানে মরে যাওয়া নয় এই সমসাময়িক ভাবনাটিকে আমাদের ভাঙতে হবে। পরাজয় যদি আত্মসমর্পণ হয়, তা সমাজকে ধ্বংস করবে। কিন্তু পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, কথা বলার দরজা খোলা রাখি, এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনরুজ্জীবিত করি, তবে সেই একই পরিস্থিতিই হতে পারে মুক্তির পথ। রাষ্ট্রের যন্ত্রকে রক্ষা করা শুধু প্রশাসনিক কাজ নয় এটি সামাজিক চুক্তি রক্ষা করা। এর জন্য প্রয়োজন ন্যায়, স্বচ্ছতা এবং সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ।
রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
দুইবার দেশের বিজয় এনেছি, এবার কি হবে পরাজয়?
১৯৭১ – বিজয়ের অন্তর্নিহিত শিক্ষা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি রাষ্ট্রের জন্ম নয়—এটি ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় ও মানবিক ন্যায়ের পুনর্জন্ম। সেই যুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় তখন কোনো অত্যাচার, কোনো শাসক, কোনো বাহিনীই টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীনতার অর্থ তখন কেবল পতাকা নয়, বরং মানুষের সম্মান, অধিকার এবং জীবনের নিরাপত্তা।
২০২৪ – গণঅভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সূচনা
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর আবারও বাংলাদেশের রাস্তায় ফুটে উঠেছে প্রতিরোধের আগুন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একটি অগ্নিকণিকা, যা মুহূর্তেই রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। যুবসমাজের রক্ত, ছাত্রদের সাহস এবং জনতার নির্ভীক সমর্থনেই পতন ঘটে স্বৈরাচারী সরকারের। এবারের বিজয় বন্দুক নয়—মানুষের বিশ্বাস, ঐক্য ও সত্যের শক্তিতে অর্জিত।
রক্ত, সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই অভ্যুত্থান ছিল রক্তাক্ত, তবুও তা ছিল ন্যায়ের পথে। শত শত প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে একটি নতুন ভোরের আশায়। সেনাবাহিনী শেষ মুহূর্তে সংযমের ভূমিকা নেয়, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকৃতি জানায়। বিশ্ব এবার তাকিয়ে আছে—বাংলাদেশ কীভাবে নিজের ভবিষ্যৎ লিখবে।
নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
দেশ যখন বিশৃঙ্খলার মুখে, তখনই আবির্ভূত হন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একদিকে আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতীক, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের আশার মুখ। তার নেতৃত্বে শুরু হয় নতুন বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা—দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার অঙ্গীকার। তবে তাঁর সামনে আছে বড় চ্যালেঞ্জ—রাজনীতির বিষাক্ত সংস্কৃতি ও দীর্ঘদিনের পচন।
দুর্নীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পুনর্গঠন
বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বহু বছর ধরে দুর্নীতি ও অনিয়মে আক্রান্ত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো—একটি স্বাধীন ও কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, এবং সরকারি প্রশাসনে প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্র নিজের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে না, সে রাষ্ট্র কোনোদিনই সত্যিকারের স্বাধীন নয়।
ভারতের ভূমিকা ও আঞ্চলিক বাস্তবতা
ভারত সবসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে আগ্রহী এক প্রতিবেশী। ২০২৪–এর পর ভারতের অবস্থানও নীরব পর্যবেক্ষক থেকে কৌশলগত সহযাত্রীতে রূপ নিতে পারে। তবে বাংলাদেশের উচিত নিজস্ব স্বার্থ ও সার্বভৌম নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া—বন্ধুত্ব বজায় রেখে নির্ভরশীলতা নয়, বরং পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করা।
আমেরিকার ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সমর্থন জানালেও বাস্তবতা হলো—তাদের স্বার্থও নীতির অন্তরালে লুকিয়ে থাকে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের অবস্থান ধরে রাখা। অন্ধ অনুকরণ নয়—দৃঢ় কূটনৈতিক ভারসাম্যই এখন সময়ের দাবি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: নতুন রাষ্ট্রচিন্তার তিন দিক
একটি জাতি এখন মোড় ঘুরিয়েছে। সামনে তিনটি পথ—
প্রথমত, সংস্কার, ন্যায়বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা করে সীমিত পরিবর্তনের বাস্তবমুখী পথ। তৃতীয়ত, বিভাজন ও অনৈক্যের কারণে আবারও অচলাবস্থায় পতন।
কোন পথ বেছে নেবে বাংলাদেশ—এটাই আজকের মূল প্রশ্ন।
রাষ্ট্রপুনর্গঠনের করণীয় ধাপ
প্রথম ৬ মাসে নাগরিক নিরাপত্তা, আইনি স্থিতি ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ছয়–আঠারো মাসে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। আঠারো–ছত্রিশ মাসে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বড় নীতি সংস্কার আনতে হবে। এই রোডম্যাপই হতে পারে একটি টেকসই রাষ্ট্রের ভিত্তি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি: বাস্তববাদ ও মর্যাদা
ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেও বাংলাদেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশীয় অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক সম্মান ও জাতীয় স্বার্থনির্ভর। একটি ছোট রাষ্ট্রও যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তবে কোনো পরাশক্তিই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
মূল প্রশ্নগুলোর বাস্তব পর্যালোচনা
ড. ইউনূসকে সরানো মানে কেবল একজন ব্যক্তিকে নয়—একটি আশা ও আস্থার প্রতীককে সরানো। বাংলাদেশ কোনো পরাশক্তির অঙ্গরাজ্য হবে না, যদি সে নিজের আত্মসম্মান ও জনগণের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস রাখে। তরুণদের নেতৃত্ব, ন্যায়ের রাজনীতি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি গড়বে।
সমাপ্তি: দ্বিতীয় স্বাধীনতার আহ্বান
১৯৭১ ছিল স্বাধীনতার প্রথম জন্ম, ২০২৪ তার আত্মার পুনর্জন্ম। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা কেবল সরকারের পরিবর্তন নয়—এটি এক মানসিক বিপ্লব, যেখানে নাগরিক নিজেই রাষ্ট্রের মালিক। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার মানুষের সততা, সাহস ও ঐক্যের ওপর। আমরা যদি নিজেদের দায়িত্ব বুঝি, তবে এই দেশ আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে—সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলোর পথে।
স্বাধীনতার অব্যাহত যাত্রা
বাংলাদেশ এখনো জন্ম নিচ্ছে— প্রতিদিন, প্রতিটি মানুষের সিদ্ধান্তে। ৭১ আমাদের দিয়েছে ভূখণ্ড, কিন্তু ২০২৪ আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে আত্মার আয়না। “স্বাধীনতা কোনো সমাপ্তি নয়, এটি এক অবিরাম যাত্রা। আর বাংলাদেশ সেই যাত্রায় আজ নিজের নাম, ভাষা ও আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে।” আজ সময় এসেছে প্রতিটি নাগরিকের ভেতরের বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলার—কারণ সত্যিকারের স্বাধীনতা তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন জনগণ জেগে ওঠে রাষ্ট্র হয়ে।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
দুর্নীতির গহ্বর থেকে রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম, সময়ের দাবি
যাদের কাছে দেশ পরিচালনার জন্য কিছুই নেই, শুধু দুর্নীতি ছাড়া, তারা কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে? হ্যাঁ, বলছি বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের কথা। স্বৈরশাসনের পতনের পর দীর্ঘ চৌদ্দ মাস কেটে গেল, অথচ দেশের স্থিতিশীলতা আজও ফেরেনি। কারণ একটাই: দুর্নীতিবিরোধী স্লোগানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিবাজদের আসল মুখ।
যাদের নেই সৃজনশীল শিক্ষা, নেই সামাজিক দায়িত্ব, নেই কোনো দেশগঠনের দৃষ্টি—তাদের হাতে শুধু ধান্দাবাজি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, হানাহানি ও সন্ত্রাস। এই মানুষগুলোই এখন রাষ্ট্র চালায়! তারা যদি সত্যিই দেশ পরিচালনা করতে পারতো, তাহলে শেখ হাসিনা ষোল বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতো না।
যদি ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে না দাঁড়াতো, তাহলে কি সম্ভব হতো এই দুর্নীতিবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা? একটি দরিদ্র দেশের মানুষ যখন তেল আনতে নুনের খরচ যোগাতে পারে না, তখন সেই দেশের শাসকশ্রেণি যদি বিলাসিতা, ঘুষ ও অরাজকতায় মত্ত থাকে—এটা কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নয়, এটি জাতির আত্মহনন।
আমরা আসলে কী করছি? আমাদের রাজনীতি আজ আত্মবিনাশের পথে, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সেই পচনের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝতে পারছি কেন ভারত আমাদের বারোটা বাজাচ্ছে! এটা ভারতের দোষ নয়—আমরাই সুযোগ তৈরি করছি, আর তারা তা দক্ষতার সাথে কাজে লাগাচ্ছে। ভারত আমাদের প্রতিপক্ষ নয়, আমাদের দুর্বলতার দর্পণ। যে জাতি নিজস্ব নীতি ও মর্যাদায় টিকে থাকতে পারে না, তাকে অন্য কেউ কখনো সম্মান করবে না।
যে সকল দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা বলে তারা বাংলাদেশের ভাগ্য বদলাবে, তারা আসলে নিজেদের ভাগ্য মজবুত করার খেলায় ব্যস্ত। কারণ না আছে তাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, না আছে নীতিনিষ্ঠ পরিকল্পনা, না আছে শক্তিশালী অর্থনৈতিক রিজার্ভ। তাহলে এইসব দুর্নীতিবাজদের পিছনে সময় নষ্ট করে কোনো সমাধান আসবে? কী মনে হয়?
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। রেমিটেন্স যোদ্ধারা বিদেশে প্রতিনিয়ত সমস্যার মুখে পড়ছে। আগামী দিনে যদি শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়, রেমিটেন্স কমে যায়—তখন কী হবে এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার? একটি জাতির জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়, এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে এক প্রকার নির্বাসন।
গণতন্ত্রের ভণ্ডামি ও বাস্তবতার প্রশ্ন
বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্র এক প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে নির্বাচন মানে টাকা, অস্ত্র, আর ভয় দেখানোর প্রতিযোগিতা। রাজনীতি মানে পরিবারতন্ত্র, যেখানে জনগণ কেবল দর্শক আর ভোট কেবল একদিনের মঞ্চনাটক।
এই ভণ্ড গণতন্ত্রের কারণে প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, ন্যায়বিচার বিক্রি হয়েছে, এবং সমাজে নৈতিকতার জায়গা দখল করেছে ধান্দাবাজি ও ভয়। গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ, যখন নেতৃত্ব জবাবদিহি করে; যখন রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দক্ষতা, সততা ও দূরদৃষ্টি থাকে। বাংলাদেশে আজ সেই তিনটি জিনিসই অনুপস্থিত।
তাই গণতন্ত্র নয়—এই দেশের দরকার শৃঙ্খলা, কঠোরতা, এবং বাস্তব উন্নয়নবাদী রাষ্ট্রনীতি। বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র একেবারেই অচল। যে দেশে নির্বাচন মানে অর্থ আর অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, যেখানে রাজনীতি মানে পরিবারতন্ত্র আর দুর্নীতির সমীকরণ, সেখানে গণতন্ত্র নামের নাটক কেবল লুটপাটের বৈধ লাইসেন্স ছাড়া আর কিছু নয়। পশ্চিমা মডেল আমাদের জন্য নয়—আমাদের প্রয়োজন শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও কঠোর রাষ্ট্রচিন্তা। আর এখানেই চীনের পথ বাংলাদেশের জন্য আশার আলো।
চীন কোনো দিবাস্বপ্নের দেশ নয়—চীন হলো প্রমাণ, যে সুশাসন মানে বক্তৃতা নয়, কাজ। সেখানে দুর্নীতি করলে মৃত্যুদণ্ড হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করলে নিজ দলের মধ্যেই বিচার হয়, এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ হয় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে, নির্বাচন কমিশনের নাটক বা তোষণ দিয়ে নয়। বাংলাদেশে এই দৃঢ়তা নেই, কারণ এখানে সবাই দায় এড়িয়ে বাঁচতে চায়। এখানে কেউ চায় না জবাবদিহিতা, কারণ জবাবদিহি মানেই দুর্নীতির পর্দা উন্মোচন।
চীন তার জনগণকে দিয়েছে বাস্তব উন্নয়ন—বিদ্যুৎ, শিল্প, প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান। ওরা সময় নষ্ট করেনি স্লোগানে, তারা সময় দিয়েছে পরিকল্পনায়। বাংলাদেশকে এখন সেই পথেই যেতে হবে। যেখানে দুর্নীতি হবে রাষ্ট্রদ্রোহ, যেখানে নেতার কাজ হবে সেবা, লুট নয়। চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক মানে শুধু বিনিয়োগ নয়, মানে একটি শৃঙ্খলিত প্রশাসনিক কাঠামো শেখা।
আমাদের দরকার developmental authoritarianism—একটি এমন প্রশাসনিক কাঠামো, যা দুর্নীতির নরম সুরে নয়, কঠোর বাস্তবতায় কাজ করে। চীনের শৃঙ্খলা বাংলাদেশের জন্য ওষুধের মতো। আজ যে রাষ্ট্রে স্কুলে ঘুষ, হাসপাতালে দালালি, আদালতে কেনাবেচা, সেখানকার রোগ একটাই—দুর্নীতি। এই রোগে ওষুধ লাগবে; আর এই ওষুধের নাম ‘state discipline’। পশ্চিমা গণতন্ত্র বলবে, “মানবাধিকার।” কিন্তু যে দেশে মানুষ নিজের অধিকারই জানে না, সেখানে মানবাধিকার শুধু মশকরা। প্রথমে দরকার রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা, পরে আসবে মানবাধিকার।
চীনের মডেল বাংলাদেশে আনতে হবে তিন ধাপে –
প্রথম, প্রশাসনে শূন্য সহনশীলতা নীতি; দ্বিতীয়, দলীয় রাজনীতি থেকে আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করা; তৃতীয়, পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও স্থানীয় উৎপাদনমুখী রাষ্ট্রনীতি।
চীন এগুলো করেছে বলেই তাদের গ্রামের মানুষ আজও উন্নয়নের সুফল পায়। বাংলাদেশের মানুষ পায় না, কারণ উন্নয়ন মানে এখানে দলীয় ঠিকাদারি আর মিডিয়ার প্রচার। এখন সময় এসেছে—পশ্চিমা অনুকরণ বন্ধ করে এশীয় বাস্তবতার পথে হাঁটার। যদি সত্যিই বাংলাদেশকে আমরা বাঁচাতে চাই, তাহলে চীনের থেকে শিখতে হবে কীভাবে দুর্নীতিকে কবর দিতে হয়, কীভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে কঠোর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এই দেশের মাটিতে এখন আর স্লোগান নয়—প্রয়োজন লোহার শাসন, কাঠামোগত সংস্কার এবং নতুন রাষ্ট্রদৃষ্টি।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সত্যের দেয়াল ভাঙতে পারেনি কেউ
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার এজেন্সি অফিসারদের বিরুদ্ধে আদালতে হাজিরা-এক নতুন ন্যায়যাত্রার সূচনা
এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার জাগরণ
বাংলাদেশে ‘গুম’ শব্দটি কেবল একটি অপরাধ নয়, এক নিঃশব্দ আতঙ্কের প্রতীক। হঠাৎ মানুষ হারিয়ে যেত, পরিবার জানত না তারা জীবিত না মৃত, অথচ রাষ্ট্রের নীরবতা ছিল আরও ভয়াবহ। কিন্তু এবার সেই নীরবতার দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছে। আজ আদালতে হাজির হয়েছেন ২৫ জন সেনা সদস্য, যারা হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ একাধিক গুম ও গোপন বন্দিশালার ঘটনায় অভিযুক্ত। এটি শুধুই বিচার নয়—এটি সেই রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার সূচনা, যা এতদিন শুধু জনগণের কণ্ঠে ছিল, নীতিনির্ধারকের হাতে নয়।
দেয়ালে লেখা সত্য, রঙে ঢাকা মিথ্যা
তদন্তে উঠে এসেছে, হুম্মাম কাদের চৌধুরী যখন গুম অবস্থায় ছিলেন, তিনি সেলের দেয়ালে নিজের নামের সংক্ষিপ্ত চিহ্ন “HQ” লিখে রেখেছিলেন। পরবর্তী তদন্তে দেখা যায়, সেই লেখাটি আর নেই। দেয়াল নতুন রঙে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবুও ভিডিও কলে হুম্মাম বলেন, “হ্যাঁ, এই দেয়ালেই আমি HQ লিখেছিলাম।” দেয়ালের প্রলেপ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সাদা রঙের নিচে সেই লেখার ছায়া এখনও রয়ে গেছে—যেন মুছে ফেলার চেষ্টা করেও মুছে যায়নি সত্য।
টাইলস, দরজা ও নিখোঁজ সত্য
ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনা অনুযায়ী, তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি টাইলস করা সিঁড়ি বেয়ে একটি রুমে নেওয়া হতো। গুম কমিশন প্রথমে যায় এবং দেখে—টাইলস নেই, বাম পাশে কোনো রুমও নেই। কিন্তু আরও খোঁজে দেখা যায়, টাইলসের দাগ রয়ে গেছে, এবং দেয়ালের বাম দিকে আসলেই একটি বন্ধ দরজার চিহ্ন। দেয়াল ভেঙে বের করা হয় সেই লুকানো দরজা, আর সেখানে পাওয়া যায় ভাঙা টাইলসের অংশ — যা আরমানের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। সেই টাইলসের ভাঙা টুকরো যেন দেশের ভাঙা ন্যায়বোধের প্রতীক—যা আজ আবার জোড়া লাগছে।
প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টায় প্রমাণ আরও স্পষ্ট
হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই এসব স্থানে দ্রুত রঙ ও পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। লক্ষ্য ছিল—প্রমাণ মুছে ফেলা। কিন্তু যতই ঢেকে দেওয়া হয়েছে, সত্য ততই ফুটে উঠেছে। গুম কমিশনের সদস্যরা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে “আয়নাঘর” পরিদর্শন করেন। যারা একসময় এসব কেন্দ্রকে “গুজব” বলেছিল, আজ তারা নিশ্চুপ, কারণ দেয়ালের ভেতরেই লুকানো ছিল মানবতার অপরাধের সাক্ষ্য।
এক নজিরবিহীন বিচার
আজ যখন ২৫ সেনা সদস্য আদালতে হাজির হয়েছেন, এটি কেবল একটি আইনি ঘটনা নয়—এটি ইতিহাসের পাতা বদলে দেওয়ার সূচনা। বাংলাদেশে প্রথমবার এজেন্সি অফিসারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। একসময় যাদের হাতেই ছিল ভয় ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, আজ তারা জবাবদিহির মুখোমুখি। এটাই গণতন্ত্রের প্রথম নিঃশ্বাস, দীর্ঘ অন্ধকারের পর।
এক বৈশ্বিক আহ্বান
আজকের বাংলাদেশ আর একা নয়। আমরা পৃথিবীর নাগরিক—Global Citizen—যারা একই ন্যায়ের মানদণ্ডে বিশ্বাস করি। ন্যায়বিচার কোনো ভূখণ্ডের সম্পত্তি নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির আত্মার দাবি। আমরা বিশ্বাস করি, অপরাধী কে, কোন দলে, কোন পদে — তা বিবেচ্য নয়; ন্যায়বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ, অটল ও মানবিক। এই বিচার শুধু ভুক্তভোগীর জন্য নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যাতে তারা কখনো আবার দেয়াল-ঢাকা রক্ত বা মিথ্যা রঙের ভেতর নিজেদের হারিয়ে না ফেলে।
আমাদের দায়িত্ব
আজ যখন প্রমাণ মিলছে, বিচার শুরু হচ্ছে — তখন সমাজের প্রতিটি স্তরে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সচেতন থাকা, সাহসী থাকা, সত্যের পাশে থাকা। আমরা যেন ভুলে না যাই—রাষ্ট্র মানে কেবল সরকার নয়; রাষ্ট্র মানে আমরা সবাই। সুতরাং, আমরা প্রত্যেকে যদি ন্যায়ের অংশীদার হই, তবে অন্যায় আর টিকবে না। আমরা যদি চুপ থাকি, মিথ্যা টিকে থাকবে। আমরা যদি কথা বলি, সত্য বাঁচবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশ এখন এক নতুন প্রভাতের মুখে দাঁড়িয়ে। গুম, নির্যাতন, ভয়, অন্ধকার—সবকিছুর ওপরে উঠতে হলে আমাদের প্রয়োজন মানবতার সাহস। এই বিচার প্রক্রিয়া যেন কেবল প্রতিশোধের নয়, বরং ন্যায় ও সংস্কারের প্রতীক হয়। আমরা শুধু বাংলাদেশের নাগরিক নই, আমরা পৃথিবীর নাগরিক—Global Citizen—যাদের দায়িত্ব সত্যকে রক্ষা করা, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো, এবং প্রমাণ করা যে—অপরাধ থেকে কেউ মুক্ত নয়, ন্যায়বিচার কারও করুণায় নয়, এটি মানবতার অধিকার।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
নির্বাচনের নামে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের ভন্ডামি বন্ধ করো
বাংলাদেশ আজ এক বিভ্রমে দাঁড়িয়ে—আমরা কি সত্যিই নির্বাচন চাই, নাকি দুর্নীতিবাজদের আরেকটি সুযোগ দিতে চাই নিজেদের ভাগ্য ছিনিয়ে নেওয়ার? জনগণ আজ ক্লান্ত, বিভ্রান্ত ও হতাশ। জনগণ ভোট চায় না—তারা চায় ন্যায়, সততা ও জীবনের নিরাপত্তা। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা চায় নির্বাচন, কারণ সেটিই তাদের দুর্নীতির বৈধতার শেষ আশ্রয়।
দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ক্ষমতার লোভে, নানা উপায়ে দুর্নীতির শিকলে জড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, দখল, ডাকাতি ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে জড়িত ছিল। এএসপি ও প্রশাসনের অংশবিশেষ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে—তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনভাবে লিপ্ত, যেন দুর্নীতি এক নতুন পেশা। জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক হিংসা ও দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে—একটি ধর্মভিত্তিক দলের নাম ব্যবহার করে তারা জনগণের বিশ্বাসকে অপমান করেছে। আর রাষ্ট্রক্ষমতার কিছু অংশ এই দুর্নীতিকে দমন না করে বরং উস্কে দিয়েছে, শুধু জনগণকে বোঝাতে যে বিএনপি বা অন্য কেউ আরও ভয়ঙ্কর। এই প্রতারণা, এই রাজনীতির নাটক আমাদের জাতিকে নিঃস্ব করে ফেলেছে।
আজ আমরা রাষ্ট্র হিসেবে পথভ্রষ্ট। আমাদের শাস্তি দরকার—কিন্তু শাস্তি কাকে দেবো? রাজনীতিবিদদের? প্রশাসনকে? নাকি নিজেদের, যারা সব জেনেও চুপ থেকেছি?
আমি একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমি সেই দেড় কোটি মানুষের একজন, যারা দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে। আমরা বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরাই, আর আমাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি টিকে থাকে। আমাদের টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে—আর আমরা ঘামে ভেজা পোশাকে দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা করি। আমরা চাই না আমাদের পরিশ্রমের টাকা রাজনৈতিক চোরেরা গিলে ফেলুক। আমাদের কথা শুনতে হবে, কারণ আমরা দেশের হাল ধরে রেখেছি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, প্রশাসন, এবং তথাকথিত নেতৃত্ব—সবাই এখন এমনভাবে নিস্তেজ হয়ে গেছে যেন দেশটা কারো নিজের নয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে, শুধু সরকার নয়—রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ঝুঁকিতে পড়বে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস—যাঁকে একসময় অনেকেই আশার প্রতীক ভাবতেন—তিনিও আমাদের হতাশ করেছেন। যদি তিনি সত্যিই এসব অনিয়ম, এই দুর্নীতির গভীরতা না জানেন, তবে তিনি অন্ধ; আর যদি জানেন, কিন্তু নীরব থাকেন, তবে তিনি এই যুগের সবচেয়ে বড় নৈতিক প্রতারক। তবুও, আমি এখনো বিশ্বাস করি—যদি তিনি সত্যিকারের নৈতিক সাহস দেখাতে পারেন, তবে তাঁর নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে পারে, যেখানে সব দলের প্রতিনিধি থাকবে, কিন্তু কোনো দলীয় দখল থাকবে না।
এই সরকার থাকবে ১ থেকে ২ বছর—এই সময় হবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সময়। এই সময় হবে দুর্নীতির বিচার, প্রশাসনের সংস্কার, এবং জনগণের চেতনা পুনর্জাগরণের সময়। এই সময় হবে বাংলাদেশের পুনর্জন্মের সময়।
এরপরই সম্ভব হবে একটি সৎ, ন্যায়ভিত্তিক নির্বাচন। জনগণ তখন ভোট দেবে, কিন্তু ভয় নয়—বিবেক দিয়ে।
যারা দুর্নীতিতে বিশ্বাস করে, তারা ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। আমার মত কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধা ভয় পায় না। আমরা জানি—ভয় যদি জিতে যায়, তাহলে দেশ হারাবে সম্মান, হারাবে আত্মা। আমরা দেশপ্রেমিক, আমরা সৃজনশীল, আমরা সচেতন। আমরা চাই বাংলাদেশ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াক বিশ্ব মানচিত্রে—একটি সৃজনশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে।
এই জাতি যদি এখনো জেগে না ওঠে, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আজ সময় এসেছে, দুর্নীতিবাজদের পতন ঘটানোর—আর জনগণের, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের, পরিশ্রমী মানুষের কণ্ঠকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করার।
এটাই সময়। এটাই সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। ভয় পেও না—নইলে দেশ হারাবে, আর আমরা হারাবো আমাদের মর্যাদা।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দায়, দুর্নীতি ও আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক অদ্ভুত রীতি গড়ে উঠেছে— দেশের যেকোনো ব্যর্থতা, দুর্নীতি বা অন্যায়ের দায় যেন সবসময় এক দলের ঘাড়েই পড়ে। যেন এ দেশের অন্য কারও কোনো পাপ নেই, কোনো অপরাধ নেই, কোনো দায় নেই। দেশে একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে— “সব মাছে গু খায়, ঘাউরা মাছের দোষ হয়।” এই প্রবাদটাই যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার খোলামেলা প্রতিচ্ছবি।
গত পাঁচ দশকের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ক্ষমতার মসনদে বসা প্রতিটি নেতা— শেখ মুজিব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা— সবাই কখনও না কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অন্যায় আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন। তবু আজ যখন ইতিহাসের বোঝা তোলা হয়, তখন সেই সব দোষের ভার যেন একচেটিয়াভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— সব অপরাধ কি এক দলের?
দেশে যে রাজনৈতিক দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, প্রশাসনিক অনাচার আর জনগণের প্রতি অবিচার চলেছে, তার মূল শেকড় তো বহু গভীরে — সব দলের শাসনকালেই এর জন্ম, বিকাশ, আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। তাহলে কেন আজও এই জাতি সেই একই “ঘাউরা মাছের দোষ” সংস্কৃতির শিকার? বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক রসাতলে নেমে গেছে, যেখানে ক্ষমতার লোভ, দুর্নীতির প্রলোভন, এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অদৃশ্য কিন্তু প্রাণঘাতী চক্র। আর সেই চক্রের ভেতরে থেকে সব দলই যেমন অপরাধে জড়িত, তেমনি নিজেদের দায় এড়াতে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত।
আসুন, একটু জানি দেশের প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রীদের কুকর্ম ও তার ফলাফল সম্পর্কে
শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২–১৯৭৫)
কুকর্ম: একদলীয় শাসনব্যবস্থা (BAKSAL) প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, জাতীয় রক্ষী বাহিনীর (Jatiya Rakkhi Bahini) মাধ্যমে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। তিনি এক নায়কতন্ত্র শাসন কায়েম করেন — শতভাগ ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্রের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
ফলাফল: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল অফিসারের হাতে নিহত হন।
জিয়াউর রহমান (১৯৭৭–১৯৮১)
কুকর্ম: সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, সরকারি তহবিলের অপব্যবহার, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার অপব্যবহার। দলীয় স্বার্থে সামরিক প্রশাসনকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেন।
ফলাফল: ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (১৯৮২–১৯৯০)
কুকর্ম: সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, সংবিধান স্থগিত, নির্বাচনী প্রহসন, বিরোধী আন্দোলন দমন, ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অবক্ষয়। জনগণের কণ্ঠরোধ করে নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেন।
ফলাফল: তীব্র গণআন্দোলনের চাপে ক্ষমতা হারান; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সমালোচনার মুখোমুখি থাকেন।
খালেদা জিয়া (১৯৯১–১৯৯৬, ২০০১–২০০৬)
কুকর্ম: দুর্নীতি মামলা (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, গ্যাটকো), রাজনৈতিক সহিংসতা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নেপথ্য অভিযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও দলীয় সন্ত্রাস।
ফলাফল: দেশে ব্যাপক অস্থিরতা বৃদ্ধি; সেনা হস্তক্ষেপের পর ক্ষমতা হারান ও দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে অচল অবস্থায় থাকেন।
উৎস: আমার নিজের দেখা।
শেখ হাসিনা (২০০৯ – ২০২৪)
কুকর্ম: ছাত্র আন্দোলন দমন (১৪০০+ নিহত), গুম, নির্যাতন ও রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক মামলা, দুর্নীতি (পদ্মা সেতু, মেঘনা–গোমতি সেতু, পূর্বাচল প্লট বরাদ্দসহ), সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগের উপর দমননীতি। তিনি একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠেন— যেখানে দেশ, দল ও পরিবার একাকার হয়ে গেছে।
ফলাফল: আইনি অভিযোগ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও ক্ষমতা ত্যাগ করেননি; শেষপর্যন্ত ‘সেফ একজিট’ চুক্তিতে ভারতে আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই নেতাদের কুকর্মের প্রতিফলন আজও সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে রক্তক্ষরণের মতো দৃশ্যমান। কেউ ক্ষমতার নেশায় মানুষ হত্যা করেছে, কেউ জাতির সম্পদ লুটেছে, কেউ স্বাধীনতার নামে স্বাধীনতাকে বন্দি করেছে। অনেকে তাদের অপরাধের ফল ভোগ করেছে—কেউ গুলিতে নিহত, কেউ জনগণের রোষে অপদস্থ, কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হলো—একজনও স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেননি। যেন ক্ষমতা তাদের কাছে এক ঈশ্বরত্ব, যার জন্য জীবন, নীতি, এমনকি দেশকেও উৎসর্গ করা যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোর আচরণে তাই এক ধরনের বেহায়া নির্লজ্জতা ও নৈতিক দেউলিয়াত্ব স্পষ্ট। জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ নেই, লজ্জা নেই, আত্মসমালোচনার ক্ষমতাও নেই। রাজনীতি এখন আর সেবা নয়, এক নির্মম প্রতিযোগিতা— কে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, কে বেশি নিষ্ঠুর, কে ক্ষমতার চাবিকাঠি বেশি শক্ত করে ধরে রাখতে পারে। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি, এবং প্রশাসনিক অপব্যবহারের এক অন্ধকার যুগ সৃষ্টি করেছে, যেখানে রাষ্ট্রের শান্তি, ন্যায় ও স্থিতিশীলতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।
উপরে তো কেবল সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে টপ লেভেলের কিছু নেতার নাম, কিন্তু ভাবুন—যে অসংখ্য নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধ, দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে, তারা দিব্যি বিদেশে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। কেউ লন্ডনে, কেউ দুবাইয়ে, কেউ কানাডায়—সবাই নিরাপদ, অথচ দেশের আইন তাদের নাগাল পায় না।
প্রশ্ন জাগে—বিশ্বজুড়ে যখন আইনের এক জাল আছে, ইন্টারপোল নামের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে, তখন গত ৫৪ বছরে তারা কি একজনকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে? না, একটিও না। কেন? কারণ, বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা এতটাই দুর্বল, দলনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত যে বিশ্বের কোনো দেশই আজ বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চায় না।
যখনই কোনো সরকার ক্ষমতা হারায়, তখনই হাজারো মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রশাসনিক নিপীড়নের শিকার হয় পরাজিত পক্ষ। ফলে সত্য-মিথ্যা, অপরাধ-অভিযোগ— সবই মিশে গেছে এক অনিশ্চিত ধোঁয়াশায়। এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে—আমরা জাতি হিসেবে কতটা দুরবস্থার শিকার, আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।
আমরা এখন এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার বন্দি, যেখানে অপরাধীরা পালিয়ে যায়, কিন্তু ন্যায়বিচার পালানোর পথ খুঁজে পায় না। এখন যেমন সব দোষ শুধু আওয়ামী লীগের ওপর চাপানো হচ্ছে, তার কারণ যেমন;
১. দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীন থাকা: দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে জনগণের প্রত্যাশা বাড়ে, হতাশাও বাড়ে। তাই সরকারের প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রতিটি ক্ষোভ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের দিকেই ধাবিত হয়।
২. মিডিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা:বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলোর একাংশ রাজনৈতিক হিসাবেই সব দোষ একপাক্ষিকভাবে প্রচার করে। তথ্যের চেয়ে আবেগ, যুক্তির চেয়ে প্রতিশোধ প্রবল।
৩. জনমতের মনস্তত্ত্ব: জনগণ প্রায়ই ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করতে চায় না; বরং বৃহত্তম ও দৃশ্যমান শক্তিকে দোষারোপ করাই সহজ। আওয়ামী লীগ সেই দৃশ্যমান শক্তি—তাই দোষারোপের ভার তার ঘাড়েই পড়ে।
৪. প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন: বাংলাদেশ আজ সেই প্রবাদটির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি— “সব মাছে গু খায়, ঘাউরা মাছের দোষ হয়।” সবাই অপরাধ করেছে, সবাই কুকর্মে জড়িত, কিন্তু দৃশ্যমান ও ক্ষমতাধর ঘাউরা মাছের ঘাড়েই এখন দোষের সমস্ত ভার চাপানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি কোনো একক ব্যক্তি বা দলের সমস্যা নয়—এটি পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির মজ্জাগত রোগে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা, সুবিধা, আর ব্যক্তিগত স্বার্থের অন্ধ নেশায় আজ রাজনীতি নীতিহীন, প্রশাসন জবাবদিহিহীন, আর জনগণ নিরুপায়।
•রাজনৈতিক স্বার্থ: ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোধী দল—সকলেই নিজেদের সুবিধার জন্য দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছে। একে অপরকে দোষারোপ করলেও বাস্তবে তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
•আইনি দুর্বলতা: বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট, তদন্ত সংস্থা ভীত, আর আইনের প্রয়োগ বেছে বেছে করা হয়। ফলে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা রাষ্ট্রদুর্বৃত্তি—সবই পার পেয়ে যায় ক্ষমতার ছায়াতলে।
•ভয় ও রাজনৈতিক চাপ: ক্ষমতাধর নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটি “রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র” বলে আখ্যা দেওয়া হয়, আর সেই অজুহাতে আইনি নীরবতা জারি থাকে। ফল—ন্যায়বিচারের বদলে ভয়ই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের নীতি।
•ফলাফল: শেখ হাসিনার শাসনকাল এই সংস্কৃতির চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও তোষণনীতি তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু সেই সুরক্ষাই দেশকে আজ দুর্নীতির এক অশেষ চক্রে বন্দি করে ফেলেছে। তবে শ্রীলঙ্কা প্রমাণ করেছে—জনগণ যদি জাগে, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক টিকতে পারে না। সেখানে মানুষ রাস্তায় নেমে একসময় সর্বশক্তিমান রাজাপাক্ষেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাদের এই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক জাগ্রত জাতির গর্জন।
বাংলাদেশও ইতিহাসে এমন গণজোয়ার দেখেছে—স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে, কিন্তু দুর্নীতির শিকড় রয়ে গেছে অটুট। কারণ, আমরা শাসক বদলেছি, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে পারিনি। যতদিন পর্যন্ত জনগণ সত্যিকার অর্থে নৈতিকভাবে সজাগ, ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় হবে না—ততদিন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সহিংসতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বন্দি রাখবে।
এখন কী করা উচিত?
১. দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কার: রাজনীতি হতে হবে সেবা, ক্ষমতা নয়। দলের আগে দেশ, আর দেশের আগে ন্যায়বোধ।
২. সততা ও স্বচ্ছতা: প্রশাসন ও দলীয় কাঠামোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে, কোনো সংস্কারই টেকসই নয়।
৩. আইন ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা: বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে—ন্যায়বিচার যেন কোনো দলের নয়, জনগণের অধিকার হয়।
৪. নাগরিক সচেতনতা: জনগণকে বুঝতে হবে, নীরবতা মানেই অপরাধের পক্ষে থাকা। প্রতিটি নাগরিককে দুর্নীতি ও অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান নিতে হবে।
৫. জনগণের অংশগ্রহণ: শুধু নির্বাচনে নয়—রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পর্যায়ে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে গণচাপই হতে হবে দুর্নীতিবিরোধী অস্ত্র।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আজ এক নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে— ক্ষমতা কখনও কাউকে ন্যায়বান করেনি, বরং দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। এই দেশে অনেক নেতা নিহত হয়েছেন, কেউ স্বৈরাচারের পতনে অপমানিত, কেউ বিদেশে নির্বাসিত, কেউ আজও গোপনে অপরাধের দায় বহন করছে। কিন্তু একটিও ব্যতিক্রম নেই—কেউ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেননি।
ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন, কিন্তু বাংলাদেশে নেতারা ব্যর্থতাকেও সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এ যেন এক বেহায়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে লজ্জা নেই, নীতি নেই, কেবল ক্ষমতার প্রতি অন্ধ আসক্তি। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা— সবাই ক্ষমতার মোহে একই অপরাধ করেছেন, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন নাম নিয়ে। এ যেন এক দীর্ঘ শৃঙ্খল—একটি জাতির নৈতিক পতনের জীবন্ত ইতিহাস।
পাঁচ দশকের বাংলাদেশের রাজনীতি আমাদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে— আমাদের নেতাদের রাজনীতি এখন নীতিহীনতা, ক্ষমতার লালসা ও জনগণের আস্থা হারানোর প্রতীক। ভোট চুরি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হত্যা, গণহত্যা—এসব কেবল অতীতের কাহিনি নয়; আজও এগুলো দেশের শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতা। যারা একসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল, তাদের কুকর্মের ফলেই জন্ম নিয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাজে বিভাজন, আর ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই অন্ধকারের মাঝেও এখনো একটি আশার আলো জ্বলছে।
বাংলাদেশ এখনো পথ হারায়নি—যদি আমরা চাই, আমরা পারি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। যা এখন করা জরুরি
১. গণতান্ত্রিক সংস্কার বাস্তবায়ন: দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে প্রতিটি নেতা ও দলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়—প্রত্যেক শাসককে তার কর্মের দায় নিতে হবে।
২. আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা: বিচার যেন আর কোনো দলের বা ক্ষমতার নয়, কেবল সত্য ও জনগণের হয়। দোষী নেতা, যে দলেরই হোক, আইনের সামনে সমানভাবে দাঁড়াবে—এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।
৩. সচেতন ও সক্রিয় জনগণ: জনগণই রাষ্ট্রের মালিক—এই চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, যখন জনগণ জাগে, দুর্নীতি পালায়। বাংলাদেশেও সেই শক্তি আছে, শুধু ঐক্য আর সাহসের প্রয়োজন।
৪. দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি: রাজনীতিকে পুনরায় নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধে ফিরিয়ে আনতে হবে। সাংবাদিক, প্রশাসক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী—প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে সৎ থাকতে হবে। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কেবল সরকারের নয়, সমগ্র জাতির।
বাংলাদেশের পাঁচ দশকের ইতিহাস আমাদের শেখায়— ক্ষমতার মোহ শেষ পর্যন্ত কাউকে রক্ষা করেনি। শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত সকল শাসকের কুকর্মের ফলাফল এক— মৃত্যু, নির্বাসন, অস্থিরতা ও জনগণের বিশ্বাস হারানো। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি কিছুই শিখিনি? দেশকে শান্তির পথে ফেরাতে এখনই প্রয়োজন সততা, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং জনগণের একাগ্রতা। আমাদের ভোট, আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের সাহস— এই তিনই পারে বাংলাদেশকে দুর্নীতি, লোভ আর স্বৈরাচারের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করতে। কোনো অপরাধই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে একটি দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেখিয়েছে, জনগণ চাইলে ক্ষমতার অপব্যবহার থামানো যায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে— আজকের বাংলাদেশে কত শতাংশ মানুষ সত্যিই দুর্নীতিমুক্ত? আমরা কি নিজেরাই দুর্নীতির অংশ হয়ে যাচ্ছি না অজান্তেই? যে জাতি নিজের নৈতিকতার কাছে সৎ, সেই জাতির পথ কেউ রোধ করতে পারে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে—সৎ, সাহসী এবং ঐক্যবদ্ধ নাগরিকদের হাতে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com



