মত দ্বিমত
ব্যক্তির আগে দল, দলের আগে দেশ

ব্যক্তির আগে দল, দলের আগে দেশ। যদি এই কথাটি সত্যিই আমাদের মনের কথা হয়, তবে এখনই সময় নিজের দিকে তাকানোর। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যাবাদী এবং অশিক্ষিত ধান্দাবাজদের মনোনয়ন দিয়ে দেশকে আর বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। রাজনীতি আজ ব্যবসা হয়ে গেছে, ক্ষমতা মানে এখন লুটপাটের প্রতিযোগিতা। অথচ দেশের মানুষ আরেকটা সুযোগ চায়— এমন নেতৃত্বের, যারা দেশকে ভালোবাসে, কাজ জানে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নয়, ফলাফল দিতে পারে।
আজ আমাদের প্রয়োজন দক্ষ, সুশিক্ষিত, প্রভাবশালী এবং আন্তর্জাতিক মানসচেতন কর্মী-নেতা, যারা নিজের কর্মদক্ষতা ও সততা দিয়ে সমাজের উন্নয়ন করবে, নাগরিকদের উপর বোঝা হবে না। দেশ ভালো থাকলে দলও ভালো থাকবে; আর দল ভালো থাকলে ব্যক্তিও সম্মান পাবে— এটাই রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃত পথ। বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ পরিসংখ্যানের খেলা। জিডিপি-র হার, রপ্তানির অঙ্ক, রেমিট্যান্স— সবকিছু শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু গ্রামে গিয়ে দেখা যায় বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। চাকরি নেই, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ভয়াবহ।
এখন দরকার দক্ষতা-ভিত্তিক অর্থনীতি। যেখানে তরুণরা হবে উৎপাদনের চালিকাশক্তি, যেখানে বিদেশে শ্রম পাঠানোর বদলে দেশেই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারি প্রকল্পে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, ব্যাংক লুটেরাদের বিচার করতে হবে, এবং উদ্যোক্তাদের প্রকৃত উৎসাহ দিতে হবে— তবেই অর্থনীতি হবে স্থিতিশীল, আত্মনির্ভর ও টেকসই।
শিক্ষা আজ পেশা নয়, প্রতিযোগিতা। স্কুল-কলেজে মুখস্থবিদ্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিকরণ, শিক্ষকতার পেশায় অবমূল্যায়ন— এভাবে কোনো জাতি আলোকিত হয় না। আজ আমাদের দরকার এমন শিক্ষা যা চিন্তা করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়, মানুষ হতে শেখায়। প্রত্যেক ছাত্রকে বাস্তবজ্ঞান ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষককে রাজনীতির চাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের মূল কৌশল হিসেবে ধরতে হবে। শিক্ষাকে মানবিক ও মুক্তচিন্তার চর্চার জায়গায় ফিরিয়ে আনা ছাড়া জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। যে দেশ নিজের সংস্কৃতি হারায়, সে দেশ নিজের আত্মাকে হারায়।
আজকের বাংলাদেশে সংস্কৃতি রাজনীতির যন্ত্র হয়ে গেছে। সংগীত, নাটক, সাহিত্য, চলচ্চিত্র—সবখানেই বিভাজন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রকে সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের কাজ হাতে নিতে হবে। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতি থেকে মুক্ত করতে হবে, শিল্পীদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। কারণ সংস্কৃতি শুধু বিনোদন নয়— এটি জাতির বিবেক, সহনশীলতা ও মানবিকতার মূলভিত্তি। বাংলাদেশে এখন অসুস্থ মানুষ নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থাই অসুস্থ। সরকারি হাসপাতালগুলিতে ওষুধ নেই, বেসরকারি হাসপাতালে খরচ অসহনীয়। মানুষ চিকিৎসা নয়, মর্যাদা হারাচ্ছে।
এখন সময় এসেছে জনসেবা ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ার— যেখানে প্রতিটি ইউনিয়নে থাকবে নার্স-নেতৃত্বাধীন ক্লিনিক, টেলেমেডিসিন, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, এবং ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নীতি। স্বাস্থ্যসেবা হবে মানবিক—এটাই নাগরিক রাষ্ট্রের পরিচয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি এখন তরুণ প্রজন্ম, আবার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিও তারা। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। তারা যদি নিজের প্রতিভা ও শক্তি কাজে লাগাতে না পারে, তবে হতাশা সমাজে বিস্ফোরণ ঘটাবে। এখন সময় দক্ষতা-কেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের। প্রতিটি জেলায় টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ভোকেশনাল শিক্ষা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও স্থানীয় শিল্প পুনরুজ্জীবনের কর্মসূচি নিতে হবে।
দেশে কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারলে কেউ আর বিদেশে শ্রম বিক্রি করতে যাবে না— তখন বাংলাদেশ সত্যিকারের শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। দুর্নীতি এখন কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক মহামারী।
দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে রেখেছে, আর সাধারণ মানুষ প্রতিদিন মর্যাদাহানির শিকার হচ্ছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের অংশগ্রহণ। মনোনয়ন দেওয়ার আগে শিক্ষা, সততা ও সামাজিক অবদান যাচাই বাধ্যতামূলক করতে হবে। দ্রুত বিচারব্যবস্থা চালু করতে হবে, দুর্নীতির মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
প্রতিটি সরকারি প্রকল্পের অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। জবাবদিহিতা ছাড়া উন্নয়ন কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে— বাস্তবে নয়। এখন সময় নতুন রাজনৈতিক চিন্তার— যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র মানুষ, দলের নয়; যেখানে নেতৃত্ব মানে সেবা, শাসন নয়। মনোনয়ন দিতে হবে সেইসব মানুষকে যারা রাজনীতি নয়, কর্ম দিয়ে দেশ গড়তে চায়। যাদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ, যাদের মস্তিষ্কে পরিকল্পনা, আর হৃদয়ে দেশপ্রেম।
অ্যাওনেক্স: ব্ল্যাকবক্স মনিটরিং— দেশ ও নেতৃত্বের জবাবদিহির নতুন দিগন্ত
আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি শুধু আমাদের জীবনকেই সহজ করেনি, রাষ্ট্র পরিচালনাকেও দিয়েছে নতুন দৃষ্টিকোণ। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে এখন দরকার এক নতুন ধরনের নজরদারি ব্যবস্থা — যেখানে ক্ষমতা মানে দায়িত্ব, আর নেতৃত্ব মানে নাগরিক আস্থার প্রতিশ্রুতি। এই উদ্দেশ্যেই প্রস্তাব করা হচ্ছে “মেমোরিবল আর্কাইভ ও ডিজিটাল ব্ল্যাকবক্স সিস্টেম”—একটি প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং ব্যবস্থা, যা প্রতিটি নির্বাচিত প্রতিনিধির কাজ, সিদ্ধান্ত ও জনসম্পৃক্ততা নথিবদ্ধ রাখবে তাদের দায়িত্বকাল জুড়ে। যেমন বিমানের ব্ল্যাকবক্স যাত্রীদের নিরাপত্তার নীরব সাক্ষী, তেমনি রাষ্ট্রের ব্ল্যাকবক্স হবে জনগণের বিশ্বাসের রক্ষক।
১. উদ্দেশ্য ও সারমর্ম
এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো রাজনীতিকে স্বচ্ছ ও নাগরিকমুখী করা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কীভাবে কাজ করছেন, কোথায় ভুল হচ্ছে, কোথায় সাফল্য—সব কিছু নিরপেক্ষভাবে সংরক্ষিত থাকবে এই ব্ল্যাকবক্সে। এটি হবে একধরনের “নৈতিক আয়না”, যাতে জনগণ দেখতে পাবে তাদের প্রতিনিধি সত্যিই জনগণের সেবায় নিয়োজিত কি না।
২. ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন
প্রথম পর্যায়ে কয়েকটি জেলা বেছে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা হবে। রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণে এই প্রকল্পের ফলাফল দেখা হবে। এরপর ধীরে ধীরে পুরো দেশজুড়ে বিস্তৃত হবে। এটি কোনো দমননীতি নয়, বরং সহযোগিতার উদ্যোগ—যাতে ভালো রাজনীতিবিদদের মর্যাদা আরও বাড়ে, আর দুর্নীতি বা অপব্যবহার রোধ করা যায় প্রমাণসহ।
৩. প্রযুক্তি সহজভাবে
এই ব্ল্যাকবক্স একধরনের সুরক্ষিত ডিজিটাল লগবুকের মতো। রাজনীতিবিদের কাজের নথি, সরকারি প্রকল্প, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, জনসেবা কার্যক্রম ইত্যাদি এখানে সংরক্ষিত থাকবে। সব তথ্য থাকবে নিরাপদ ও পরিবর্তন-অযোগ্য। কেবল অনুমোদিত সংস্থা ও আদালত প্রয়োজনে এসব তথ্য দেখতে পারবে। জনগণের জন্য থাকবে একটি সাধারণ অনলাইন পোর্টাল—যেখানে তারা দেখতে পারবে তাদের এলাকার জনপ্রতিনিধির কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ।
৪. তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা
প্রত্যেকটি তথ্যের উৎস, সময় ও প্রেক্ষাপট সংরক্ষিত থাকবে যেন কেউ মিথ্যা তথ্য যোগ বা বাদ দিতে না পারে। তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে—এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কারও ব্যক্তিগত জীবন উন্মোচন করা নয়, বরং দায়িত্বের সীমারেখায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
৫. আইন ও নীতি
এই ব্যবস্থাকে সফল করতে হবে আইনি কাঠামো ও নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এজন্য একটি স্বাধীন মনিটরিং কমিশন গঠন করা হবে, যেখানে থাকবে নাগরিক প্রতিনিধি, বিচারিক সদস্য ও প্রযুক্তিবিদরা। যদি কোনো রাজনীতিবিদ দুর্নীতি বা অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এই ব্যবস্থার অংশ হবে না।
৬. মূল্যায়ন ও প্রভাব
ছয় মাসের পাইলট প্রকল্প শেষে দেখা হবে—দুর্নীতি কতটা কমেছে, কাজের গতি বেড়েছে কিনা, জনগণের আস্থা কেমন। যদি দেখা যায় সরকারি প্রকল্পে অপচয় কমে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি আসে এবং নাগরিক সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়, তবে সেটিই হবে এই উদ্যোগের প্রকৃত সফলতা।
৭. মানবসম্পদ ও বাজেট
এই প্রকল্পে কাজ করবেন দেশীয় তরুণ প্রযুক্তিবিদ, তথ্য বিশ্লেষক, আইনি বিশেষজ্ঞ ও ফিল্ড অফিসাররা। এর ফলে শুধু রাজনীতির নয়, কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়নেও আসবে নতুন দিগন্ত।
৮. ঝুঁকি ও সমাধান
রাজনৈতিক বাধা বা প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ আসতেই পারে। তাই প্রকল্পের পরিচালনায় সব দলের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যেন এটি কোনো দলের নয়—পুরো জাতির উদ্যোগ হয়ে ওঠে। নিয়মিত স্বাধীন অডিট হবে, যাতে নাগরিকের আস্থা অটুট থাকে।
৯. সাফল্যের মাপকাঠি
যদি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারি ব্যয়ের অপচয় অন্তত ৩০% কমে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়সীমা কমে এবং নাগরিক আস্থা সূচক বাড়ে—তবে বোঝা যাবে বাংলাদেশ সত্যিই এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।
১০. শেষ কথা
এই প্রকল্প শুধু প্রযুক্তি নয়—এটি একটি মানসিক বিপ্লব। যেখানে নেতৃত্ব আর ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব। যেখানে নাগরিক কণ্ঠস্বরই রাষ্ট্রের শক্তি। একটি স্মার্ট ব্ল্যাকবক্স হয়তো রাজনীতিবিদের ভুল ঠিক করতে পারবে না, কিন্তু এটুকু নিশ্চয়তা দেবে—ভুল আর চিরদিন গোপন থাকবে না।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com

মত দ্বিমত
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ও দর্শন

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে আমার মন স্বভাবতই ছুটে যায় বাবা-মার কাছে। কারণ পৃথিবীর কোনো শ্রেণিকক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পাঠশালার আগে আমার শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঘরেই—মায়ের আঁচল আর বাবার শাসনের ভেতর দিয়ে।
আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, শিক্ষার সূচনা বই কিংবা বোর্ডে নয়—বরং ঘরের ভেতরেই। ‘প্রথম শিক্ষা মায়ের কোলেই শুরু হয়’—এই সত্য ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতাই স্বীকার করেছে। প্রাচীন ভারতীয় গুরুকুলে যেমন সন্তানকে প্রথম পাঠ শেখাতেন মা, তেমনি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসও বলেছিলেন—“কোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি জানতে চাইলে দেখো, সেই রাষ্ট্রের শিশুরা কেমন শিক্ষা পাচ্ছে।” আর সেই প্রথম শিক্ষালয় হলো পরিবার।
আজ ভোরে সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, পাঁচ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস আসছে। ভাবতে লাগলাম—প্রতিবছর আমরা কত শিক্ষাবিদকে স্মরণ করি, অথচ যাঁদের হাত ধরে আমাদের চরিত্র, নীতি আর মানবিকতার ভিত গড়ে ওঠে, সেই বাবা-মা সম্পর্কে কত সামান্যই বলা হয়!
আমার শৈশবের শিক্ষা ছিল ভিন্নধর্মী। মা ছিলেন স্নেহময়ী ছাত্রীসুলভ শিক্ষক। লেখাপড়ায় সাহায্য করতেন, কিন্তু খাওয়ার সময় অঙ্কে গড়মিল করতেন। আমি এক চামচ ঝোল চাইলে, তিনি ঝোলের সঙ্গে মাছের টুকরো ঢুকিয়ে দিতেন। বাবার কাছে চাইলে তিনি উল্টো বলতেন—“যতটুকু পেয়েছো, সেটা আগে শেষ করো, পরে দেখা যাবে।” মাকে রাগ করে ইংরেজিতে কিছু বললে তিনি হেসে দিতেন—মনে হতো কিছুই বোঝেননি। কিন্তু বাবা ঠিকই বুঝতেন; ভুল ইংরেজি বললে কান ধরে শাসন করতেন। মা ছিলেন বেশ মিথ্যেবাদী—না খেয়ে বলতেন খেয়েছি, খিদে নেই, তোরা খেয়ে নে। পরে বুঝেছি, খাবার কম হলে উনি আমাদের আগে খাওয়াতেন। বাবা ছিলেন কিছুটা সত্যবাদী—নিজের ক্ষুধা গোপন করে বলতেন, “তোমরা খাও, আমি পরে খাবো।” মা ছিলেন বোকা, কলুর বলদের মতো রান্নাঘরে ঢুকে আর বেরোতে পারেননি। জীবন কাটিয়েছেন কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। বাবা ছিলেন কঠিন, ঝড়-বৃষ্টি-রোদে সংসারের ভার কাঁধে নিয়েছেন।
বাবা-মা দুজনেই ছিলেন পাহারাদার। সন্ধ্যা হলে বাড়িতে না ফিরলে খবর ছিলো। সংসার চালিয়েছেন নীরবে, আমাদের কষ্ট বুঝতে দেননি। কখনো নির্লজ্জ, কখনো বেহায়া হয়ে আমাদের ঘরের বিছানা পর্যন্ত গুছিয়ে দিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন কেমন চলছে জীবন।
মায়ের কমনসেন্স ছিল কিছুটা কম, বাবার একটু বেশি। মা প্লেট ফাঁকা দেখলেই খাবার ভরতেন, বাবা বলতেন— ‘অতিরিক্ত খেয়ো না।’ মা ছিলেন কেয়ারলেস—নিজের যন্ত্রণা ভুলে যেতেন। বাবা ছিলেন কেয়ারফুল—সংসারের ভার টেনে নিতেন চুপচাপ। মনে হতো দুজনেই ছিলেন আনস্মার্ট। মা দামী শাড়ি-গয়না পরতেন না, বাবা গাড়ি-বাড়ি-আড্ডা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তবুও তাঁরা আমাদের স্বপ্ন বড় করতে শতভাগ সাহায্য করেছেন।
দুজনেই ছিলেন স্বার্থপর—নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, নিজেদের ঘাম ঝরিয়ে পরিবারের স্বপ্ন গড়তে। তাঁরা জীবনভর আমাদের দিয়েছেন শুধু ভালোবাসা। আর আমরা সন্তানরা? কষ্ট দিয়েছি, অবহেলা করেছি, অথচ তাঁরা বদলাননি। প্রতিদিন আমাদের জন্য একই দোয়া, একই মায়া। বড় হয়েও আমরা তাঁদের উপেক্ষার বোঝা চাপিয়েছি। তবুও বাবা-মা প্রার্থনায় বসে আমাদের জন্য হাত তুলেছেন। সারা জীবন তাঁরা শুধু একটাই প্রতিদান চেয়েছেন—দিনে একবার হলেও সন্তানের মুখে শুনতে চান, ‘মা’ বা ‘বাবা।’
আমরা কতটা নির্বোধ! মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক, বাবা তাঁর সবচেয়ে বড় ছায়া। আসলে মা-বাবা কী জিনিস, সেটা সেই বোঝে যার কাছে তাঁরা নেই। বাবা-মার শাসনের ভিন্নতা আমি বড় হয়ে বুঝেছি। মানুষ হতে হলে কী শিক্ষা, কেন শিক্ষা, শিক্ষার ধরন কেমন হবে—এই প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন। হয়তো সেই ভিন্নতার কারণেই আমি বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ের সীমা পেরিয়ে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার পথে হাঁটতে পেরেছি।
আমার বাবা বাংলাদেশ পুলিশের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ আমলে, শেষ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে। তাঁর জীবন ছিল শৃঙ্খলা, ত্যাগ আর সংগ্রামের প্রতীক। মা সামলেছেন পুরো পরিবার, পাশাপাশি সমাজকল্যাণেও যুক্ত থেকেছেন নিঃস্বার্থভাবে।
গতকাল সহধর্মিণীর সঙ্গে বাবা-মাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। আলোচনার শেষে আমি বলি— ‘আমার বাবা-মা অতি সাধারণ পরিবেশে থেকেও আমাদের এতগুলো ভাই-বোনকে সৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছেন, যেন পুরো পৃথিবীর অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আমাদের জন্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা জীবনের প্রায় শেষ বিশ বছর বাংলাদেশ এবং ইউরোপ—দুই নাগরিকত্বেই কাটিয়েছেন, যা একটি গরীব পরিবারের জন্য সত্যিই বিরল।’
আমার সহধর্মিণী মারিয়া সরাসরি উত্তর দিলেন— ‘তাঁরা ডিজার্ভ করেন। তাঁদের ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তোমাদের বিশ্বনাগরিক বানিয়েছেন। তাঁদের জীবন ব্যতিক্রম হবে, এটাই স্বাভাবিক।’ কথাটা শোনার পরই আমার মধ্যে অজানা দায়বদ্ধতা আরও গভীর হলো। আসলে বাবা-মা শুধু অভিভাবক নন, তাঁরা জীবন্ত পাঠ্যপুস্তক। প্রতিটি ছোট কাজে লুকিয়ে থাকে বড় শিক্ষা। মায়ের নিঃশব্দ ত্যাগ আমাকে শিখিয়েছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। বাবার কঠোর শাসন আমাকে শিখিয়েছে নীতি, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ। দুজনের মিলিত শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে মানুষ হওয়া—শুধু ডিগ্রি পাওয়া নয়।
আজকের দিনে সন্তানরা বাবা-মাকে বোঝা ভাবে, প্রযুক্তির ভিড়ে তাঁদের শিক্ষা ভুলে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে—স্কুল-কলেজের জ্ঞান হয়তো চাকরি এনে দেবে, কিন্তু বাবা-মার শিক্ষা চরিত্র গড়বে। আর চরিত্র ছাড়া জ্ঞান অন্ধ। তাই যতদিন বাবা-মা জীবিত, তাঁদের শিক্ষাকে সম্মান করতে হবে। কারণ তাঁরা আমাদের প্রথম শিক্ষক, এবং মৃত্যুর পরও তাঁদের শিক্ষা আমাদের জীবনে পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
আমি এই লেখাটি আমার বাবা-মার জন্য লিখেছি। তবে এটিকে উৎসর্গ করছি বিশ্বজুড়ে সকল বাবা-মাকে—যাঁরা আমাদের হৃদয় দিয়ে শিখিয়েছেন দৈনন্দিন শিক্ষা, মানবিক শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা, যোগাযোগের শিক্ষা এবং সর্বোপরি নীতি ও নৈতিকতার শিক্ষা। বাবা-মা আমাদের জন্য শুধু শিক্ষক নন; তাঁরা আমাদের জীবনের প্রথম ও চিরন্তন পথপ্রদর্শক। তাঁদের ভালোবাসা, ত্যাগ এবং শিক্ষা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ছায়ার মতো থাকে—যা আমরা হয়তো বুঝি না, কিন্তু যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আজ যাঁদের বাবা-মা নেই, তাঁদের জন্য এই স্মৃতি হোক সান্ত্বনার আলো—কারণ তাঁদের রেখে যাওয়া শিক্ষা ও দোয়া অদৃশ্য আশ্রয়ের মতো আজও আমাদের পথ দেখায়।
আর যাঁদের বাবা-মা বেঁচে আছেন, তাঁদের জন্য এই লেখা হোক এক মৃদু স্মরণ—একবার হলেও মায়ের হাত ধরে বলুন, “তুমি আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক”, বাবার চোখে চোখ রেখে বলুন, “তুমি আমার জীবনের প্রথম দিশারি।” কারণ শেষ পর্যন্ত, আমরা সবাই একই সত্যে এসে দাঁড়াই— বাবা-মা চলে যান, কিন্তু তাঁদের শিক্ষা থেকে যায়; ভালোবাসা ম্লান হয় না, বরং সময়ের সাথে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে তাই আমার শ্রদ্ধা প্রথমেই বাবা-মার প্রতি, যাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে গুরুজনদের সম্মান করতে হয়। এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতা “শিক্ষাগুরুর মর্যাদা”-এর শেষ দুটি লাইন: আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।
এই কবিতায় শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশিত হয়েছে। বাবা-মা এবং শিক্ষক —উভয়ই আমাদের জীবনের প্রথম ও চিরন্তন পথপ্রদর্শক। তাঁদের শিক্ষা ও ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে চলমান থাকুক আজীবন।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
ভারত–লন্ডন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও জনগণের অনুপস্থিতি

৫ আগস্ট ২০২৪—অনেকেই এই দিনটিকে ভেবেছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের দিন হিসেবে। প্রত্যাশা ছিল, এই দিনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে শাসনতন্ত্রের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। দেশ স্বাধীন হলো না, বরং রাষ্ট্রকে দুই টুকরো করা হলো। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হলো বটে, কিন্তু তাঁকে ভারত পাঠানো হলো। ফলাফল? একদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অন্যদিকে শেখ হাসিনা—ভারত থেকে এখনো তাঁর দল ও সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এই সিদ্ধান্ত ছিল ভয়াবহ ভুল। তাঁকে সরানো হলো, কিন্তু সমাধান করা হলো না। দল ও প্রশাসনের অনেকেই এখনো তাঁকেই নেত্রী মনে করছে, তাঁকেই অনুসরণ করছে। ফলে দেশের শাসনতন্ত্র কার্যত বিভক্ত হয়ে গেছে—অর্ধেক চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনায়, অর্ধেক চলছে শেখ হাসিনার প্রভাবমুক্ত নয় এমন প্রশাসনের অধীনে। এই দ্বৈত নেতৃত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রকে অচল করে দিয়েছে।
আরেকদিকে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন লন্ডন থেকে তারেক রহমান। ভারত থেকে শেখ হাসিনা, লন্ডন থেকে তারেক রহমান—“ডিজিটাল বাংলাদেশ” যেন দুই প্রবাসী কেন্দ্র থেকে চালিত হচ্ছে। অথচ দেশের ভেতরে কার্যকর নেতৃত্ব নেই। বাইরে থেকে নির্দেশনা আসছে, কিন্তু ভেতরে সমস্যার সমাধান করার মতো উপস্থিত নেতৃত্ব নেই। এই কারণেই বলা যায়—দেশের বারোটা বেজে গেছে।
জনগণ কে?
আমরা সবসময় বলি—জনগণ এটা চায় না, জনগণ এটা মেনে নেবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—জনগণ কে?
•বিএনপি কি জনগণের দল নয়?
•জামায়াত, আওয়ামী লীগ বা অন্য সব দল কি জনগণের অংশ নয়?
•তাহলে দলগুলো বাদ দিয়ে আর কে আছে, যে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে—“আমি জনগণ”?
বাস্তবে সত্যিকারের জনগণের ভূমিকায় যারা আছে, তাদের সংখ্যা খুবই কম। তারা আছে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন, সংগঠিত নয়। ফলাফল হলো—জনগণের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু জনগণের জন্য কাজ করা হচ্ছে না। অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না—যদি না আমরা ডেসপারেটলি চেষ্টা করি।
দুর্নীতি, অনীতি ও বিভক্ত প্রশাসন
আজ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল দুর্নীতি, অনীতি, লুটপাট, চাঁদাবাজিতে নিমগ্ন। প্রশাসন বিভক্ত—কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে, কেউ শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত। এক্ষেত্রে “হাড়ি ভেঙে দই পড়েছে, বিড়ালের হইছে বাহার”—এই প্রবাদটাই সঠিক। সবাই নিজের সুবিধা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি।
ভুলটা কোথায় হলো?
•শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হলো, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা হলো না।
•তাঁকে ভারত পাঠানো মানে তাঁর প্রভাবকে সরানো নয়—বরং বাইরে বসে তাঁকে আরও রহস্যময় ও শক্তিশালী করা হলো।
•তারেক রহমানও একইভাবে লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করছেন—যা দেশের ভেতরে নেতৃত্বশূন্যতার জন্ম দিয়েছে।
•দুই প্রবাসী নেতা ডিজিটালি দল চালাচ্ছেন, আর দেশে সাধারণ মানুষ পড়েছে নেতৃত্বশূন্য ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে।
দেশকে জনগণের করতে কী চেষ্টা দরকার?
১. জনগণের সক্রিয় উপস্থিতি তৈরি করা: দল নয়, নাগরিক প্ল্যাটফর্মকে শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে টাউন-হল, নাগরিক কমিটি, নিরপেক্ষ জনমত সংগ্রহ শুরু করতে হবে।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ: দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা নথিভুক্ত ও প্রকাশ করতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য আইনি ও সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে।
৩. ছোট সেবা দিয়ে আস্থা ফেরানো: পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এই খাতে স্থানীয় উদ্যোগ দেখাতে হবে। এতে জনগণ বুঝবে—কেউ তাদের জন্য কাজ করছে।
৪. স্বচ্ছ নেতৃত্ব ও জবাবদিহি: জনগণের নামে রাজনীতি নয়, জনগণের কাজে রাজনীতি। স্বচ্ছতা ছাড়া আস্থা আসবে না।
৫. বহির্বর্তী প্রভাব থেকে বের হওয়া: ভারত ও লন্ডন থেকে ভার্চুয়াল নেতৃত্বের পরিবর্তে স্থানীয়, জনগণকেন্দ্রিক নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। দেশের ভিতরে সমাধান তৈরি করতে হবে, বাইরে নয়।
আজকের বাংলাদেশে ত্রৈমুখী নেতৃত্ব, বিভক্ত প্রশাসন, দুর্নীতিগ্রস্ত দল এবং “জনগণ” নামের এক অদৃশ্য সত্তা—সব মিলিয়ে রাষ্ট্র অচলাবস্থায়। শেখ হাসিনা ভারতে বসে প্রভাব চালাচ্ছেন, তারেক রহমান লন্ডন থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আর দেশে আন্দোলন করছে ছোট দলগুলো। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতায় আছড়ে পড়েছে। যে দেশে সবাই কোনো না কোনো দলের সমর্থক, যে দেশে কেউ ভুল স্বীকার করে না, অন্যায়ের পর অনুশোচনা নেই, শুধু জনগণের নামে দায় চাপানো হয়—সেই দেশ কিভাবে জনগণের হতে পারে?
পরিবর্তন একদিনে হবে না। তবে ছোট ছোট নাগরিক উদ্যোগ, স্থানীয় স্বচ্ছ নেতৃত্ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পথ নেই। যদি আমরা চেষ্টা না করি, তাহলে জনগণ সবসময় কেবল শ্লোগানেই থেকে যাবে—কাজে নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব ও অঙ্গীকার ছিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধান করা, শাসনতন্ত্রে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। জবাবদিহিতার অভাব, সিদ্ধান্তহীনতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। শেখ হাসিনার মনোনীত প্রেসিডেন্ট আজও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন—ফলে সরকারের বৈধতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রকে রক্ষা করা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা; কিন্তু তারা যদি সত্যিকারের নিয়ন্ত্রণ ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে সঙ্কট সমাধানের কার্যকর নেতৃত্ব নিতে পারতেন, কিন্তু তাঁর পদক্ষেপ সীমিত থাকায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটেনি। তাই এখন জরুরি একটি ন্যায্য রূপান্তর—যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো টিকে থাকবে, কিন্তু তাদের ভেতরে থাকা দুর্নীতি, লুটপাট, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা অন্য অপরাধে দণ্ডিত নেতৃত্বকে কঠোরভাবে বাদ দিতে হবে। দল হচ্ছে জনগণের সংগঠিত অভিব্যক্তি; তাদের সম্পূর্ণ অস্বীকার করা গণতন্ত্রকেই অস্বীকার করা।
অতএব, প্রয়োজন এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেখানে থাকবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব, নিরপেক্ষ প্রশাসন, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী এবং তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই সরকারকে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় থাকতে হবে, যেন প্রতিটি সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ, যাচাইযোগ্য এবং জনগণের কাছে ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ হয়। কেবল এভাবেই দলীয় অস্তিত্ব রক্ষা করে অপরাধী নেতৃত্বকে ছাঁটাই করা সম্ভব, এবং গড়ে তোলা সম্ভব একটি নতুন শাসনব্যবস্থার ভিত্তি—যেখানে জনগণের আস্থা ফিরবে, রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আসবে এবং ভবিষ্যতের নির্বাচন হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক। এর পরেই জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তাদের প্রকৃত সিদ্ধান্তের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
যেখানে প্রতিভা নষ্ট হয়, সেখানে জাতি হারে

আমি ফেসবুকের তর্ক-বিতর্কে সচরাচর অংশ নিই না, তবে নানা পোস্ট চোখে পড়ে। কিছু পড়ি, কিছু মনে দাগ কেটে যায়, আবার কিছু নিজের পেজে রেখে দিই শিক্ষণীয় বিষয় বা চিন্তার খোরাক হিসেবে। সম্প্রতি এমনই একটি পোস্ট আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে:
“আমার বাবা বলতেন, ভাতে গরীব হলে সমস্যা নেই। কিন্তু জাতে গরীব হলে সমস্যা। জাতে গরীব মানুষগুলো ভয়ঙ্কর হয়।
বাবা আরও বলেছেন, ফকিরকে ভিক্ষা দেওয়ার সময় তোমাকেও ফকিরের সমান দাঁড়াতে হবে। এদের ক্ষেত্রে মানবতা দেখালে, ফকির তোমাকে বন্ধু ভেবে বসবে এবং সুযোগ বুঝে তোমাকেই ধ্বংস করবে।”
এই লেখার শেষে আরও বলা হয়েছে:
“চব্বিশের পাঁচ আগস্ট বাঙালি জাতি নতুন শিক্ষা পেয়েছে। যে সাকিব আল হাসানের জুতা টানার যোগ্য নয়, সে যদি দখলকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়, তবে সে সাকিবকে দমিয়ে রাখতে চাইবে। এ ধরনের জাতের ফকিরদের স্থান ইতিহাসের ডাস্টবিন।”
এটা পড়ে মনে হলো—এটা আসলে গভীর কোনো বিশ্লেষণ নয়, বরং তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ।
সাকিব ও আসিফ : দুই ভিন্ন প্রতীক
সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি, সাকিব আল হাসান এবং আসিফ মাহমুদ ভুঁইয়াকে ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে। এদের নিয়ে যেমন নিজেরা পরস্পরের সাথে ঠেলাঠেলি করছে, তার চেয়েও বেশি করছে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম।
সাকিব এবং আসিফ—দুজনেই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। একজন খেলাধুলার জগতে অসাধারণ মেধা ও পরিশ্রমে পৌঁছেছেন শিখরে; অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তির আন্দোলনে, নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে গোটা জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রামে নেমেছেন।
আমরা ভুলে যাই—একজন ক্রিকেটার একদিনে তৈরি হয় না। সাকিবের সাধনা, দক্ষতা, পারফরম্যান্স তাকে কোটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছে। আবার ভুলে যাই—আসিফ মাহমুদের মতো তরুণরা প্রশাসনের ব্যর্থতার জায়গায় দাঁড়িয়ে জাতিকে স্বৈরাচারী দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছে। এ কাজ তুচ্ছ নয়, বরং ঐতিহাসিক।
জাতির সংস্কৃতি ও অবক্ষয়
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একটি দুঃখজনক প্রবণতা আছে:
কাউকে অপছন্দ হলেই গালিগালাজ, কুরুচিপূর্ণ পোস্ট আর অবমাননাই হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়ার ভাষা। সমালোচনা থাকে, কিন্তু তা হয় না সৃজনশীল। ফলে ব্যক্তি নয়, জাতির সম্পদই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাকিবকে রাজনীতির খেলায় টেনে আনা হলো—এটা কেন হলো, কার দায় ছিল, তার উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু একজন জাতীয় সম্পদকে এভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা বেদনাদায়ক। একইভাবে আসিফ মাহমুদদের মতো ত্যাগী তরুণদের অবমূল্যায়ন মানে জাতির আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা।
পাকা আমের রূপক
একটি আম যখন ধীরে ধীরে পাকে, তখন সেটি জাতিকে পুষ্টি দিতে পারে। কিন্তু যদি তার সঠিক ব্যবহার না হয়, তবে সেটি পচে যায়, নষ্ট হয়, পোকামাকড় খেয়ে ফেলে।
আমরা জাতি হিসেবে সেই পাকা আমগুলোকেই কাজে লাগাতে পারছি না। প্রতিভা, মেধা ও সাহস—সবই আছে আমাদের। কিন্তু সঠিক ব্যবহারের অভাবে সেগুলো নষ্ট হচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই।
ড. ইউনূস একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং মুরব্বি, ভেবেছিলাম তিনি পারবেন পাকা আমগুলোকে কাজে লাগাতে। যখন তিনি বলেছিলেন—“একটি পচা বাংলাদেশকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলব”—আমি মুরব্বির কথা বিশ্বাস করেছিলাম। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর!
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
বাংলাদেশ জন্মেছে জনগণের স্বপ্নে, কোনো পরিবারের জন্য নয়।

রাজতন্ত্রের পতনের পর সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এসেছে মুক্তির আশায়। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের স্বপ্ন বারবার পরিবারতন্ত্রের শিকলে ভেঙে গেছে। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরীফ পরিবার, ভারতে নেহরু–গান্ধী পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বান্দারনায়েক ও রাজাপাকসে পরিবার—সব জায়গায় পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শেখ হাসিনা, এবং এখন জিয়া পরিবার থেকে তারেক রহমান—বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি।
বারবার বলা হচ্ছে—পরিবার নয়, জনগণই গণতন্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি। অথচ আমরা সে পথে না গিয়ে বারবার পথভ্রষ্ট হচ্ছি। পরিবারতন্ত্র মানে হলো ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তর, যেখানে জনগণের ইচ্ছা নয়, বংশপরিচয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করে। এর ক্ষতিকর প্রভাব স্পষ্ট: যোগ্যতার পরিবর্তে আনুগত্য রাজনীতিতে প্রাধান্য পায়, প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হয়। দুর্নীতি ও দলীয়করণ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ গণতন্ত্র থেকে বিমুখ হয়ে যায়। যখন রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক হয়, তখন গণতন্ত্র রাজতন্ত্রের ছদ্মবেশে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনা উন্নয়নের নামে কিছু প্রকল্প দেখালেও তাঁর শাসনের চিহ্ন হিসেবে দেখা যায় বিরোধী দমন, ভোটাধিকার হরণ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার দলীয়করণ এবং দুর্নীতি ও ভয়ের সংস্কৃতি। একজন বাবা হারা শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত দেশ হারা হলেন—এটাই পরিবারতন্ত্রের নির্মম পরিণতি। তার পতন প্রমাণ করে, পরিবারতন্ত্র যতই শক্তিশালী মনে হোক, একদিন তা ধসে পড়বেই।
শেখ হাসিনার ব্যর্থতা কি বিএনপিকে নতুন দিশা দিয়েছে? দুঃখজনকভাবে না। বিএনপির ইতিহাসে জিয়া পরিবারকেন্দ্রিকতা বরাবরই প্রবল। খালেদা জিয়ার পর এখন তারেক রহমানকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা চলছে। তিনি জনগণের আস্থা বা রাজনৈতিক যোগ্যতায় নয়, বরং বংশপরিচয়ের কারণে এগিয়ে আসছেন। শেখ হাসিনাকে পরিবারতন্ত্রের দায়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে, সমালোচনা চলছে, কিন্তু বিএনপি যদি একই ফাঁদে পা দেয়, তাদের বৈধতা কোথায় দাঁড়াবে—ভাবা দরকার।
বিশ্ব ইতিহাস সাক্ষী। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার সামরিক অভ্যুত্থানে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবার পতনের পর দেশ দেউলিয়া হয়েছে। ভারতে গান্ধী পরিবারের প্রভাব কমে আঞ্চলিক নেতৃত্ব শক্তিশালী হয়েছে। গবেষণাও বলছে, ডাইনাস্টিক রাজনীতি অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে, দুর্নীতি বাড়ায়, জনগণের আস্থা কমায়। এক ব্যর্থতা থেকে যদি শিক্ষা না নেওয়া হয়, তবে সেই ব্যর্থতাই নতুন ব্যর্থতার জন্ম দেয়। বাংলাদেশ আজ সেই দুষ্টচক্রেই বন্দি।
বিএনপির অতীত শাসনকাল দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। সরকারি তহবিল ও প্রকল্প বরাদ্দে অসদাচরণ এবং অনিয়ম বেড়েছে। বিরোধী দলের ওপর গুম, খুন এবং নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দমন করা হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় কাজে ব্যবহার হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে যে গুম-খুন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ঘটেছে, এর মাত্রা আসলেই কমেছে কি না—সেটা বলা কঠিন।
শেখ হাসিনার পতনের পর গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্যবাঁধনের সুযোগে বিএনপি দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে শুধু চাঁদাবাজি ও ধান্দাবাজিই বৃদ্ধি করেনি, বরং জনগণের আস্থা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিক কাঠামোকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের অপকর্ম চালিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলেও সরকারি তহবিল ও প্রকল্প বরাদ্দে অসদাচরণ এবং অনিয়ম বেড়েছে। ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর রাজনৈতিক চাপ, হয়রানি এবং ভয় পরিস্থিতি আরও জোরদার হয়েছে।
এই দুষ্টচক্র ভাঙার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে—নেতৃত্ব নির্বাচন হোক ভোট ও মেধার ভিত্তিতে, বংশের নয়। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে—প্রার্থীর যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা ও অতীত প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হোক। ক্যাম্পেইন অর্থায়ন সংস্কার করতে হবে—রাজনৈতিক তহবিলের উৎস প্রকাশ করা হোক। নেপোটিজম বিরোধী আইন কার্যকর করতে হবে—প্রশাসনে স্বজনপ্রীতির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ করতে হবে—পরিবার ছাড়া সমাজের নানা স্তর থেকে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে—তাহলেই নাগরিকদের কণ্ঠস্বর নিশ্চিহ্ন হবে না।
বাংলাদেশের জনগণের সামনে আজ মূল প্রশ্ন হলো, আমরা কি আবারও পরিবার বনাম পরিবার খেলায় বন্দি থাকব, নাকি জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে তুলব? শেখ হাসিনা পরিবারতন্ত্রের কারণে দেশ হারালেন। বিএনপি যদি একই পথে হাঁটে, তার ফলাফলও ভিন্ন হবে না। এখন সময়—নতুন শিক্ষা নেওয়ার। পরিবার নয়, জনগণ; বংশ নয়, যোগ্যতা। অন্যথায় ইতিহাস বারবার আমাদের শিখিয়ে দেবে, কিন্তু আমরা বারবার একই ভুলে পতিত হব।
শেষে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক জাতির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাস নীতি অপরিহার্য: নেতৃত্ব নির্বাচন হোক যোগ্যতা, নৈতিকতা ও জনমতের ভিত্তিতে। শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, যাতে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার রাজনীতি ও প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সর্বোচ্চ রক্ষা করতে হবে। যুব ও নতুন নেতৃত্বের বিকাশে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে।
মনে রাখতে হবে যে সত্যিকারের গৌরব আসে না স্লোগান বা বংশীয় ক্ষমতা থেকে। গৌরব আসে সততা, ন্যায়বিচার এবং জনগণের সেবার মধ্য দিয়ে। দুই দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তির ছায়ায় জাতি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এই সত্য মেনে, নতুন পথ খুঁজে বের করাই আমাদের একমাত্র মুক্তি।
আজ সময় এসেছে—সৎ, সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের। যারা বংশ বা দলের নয়, দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। আগামী প্রজন্মের অধিকার একটি মর্যাদাশালী বাংলাদেশ—গড়ে উঠবে নৈতিকতা, সততা ও উদ্যোগের ভিত্তিতে, রাজবংশীয় অহংকারে নয়। আসুন, অতীতের অন্ধকার ভেঙে নতুন নেতৃত্বের পথ খুলে দিই—যারা আমাদের জাতিকে আশা, মর্যাদা এবং অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নেবে। কারণ দুটি অবিচ্ছিন্ন পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য আমরা বারবার রক্তক্ষরণ করতে জন্মায়নি—আমরা জন্মেছি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সংকটে দেশ: বন্ড মার্কেট বিকাশের প্রয়োজনীয়তা ও দিকনির্দেশনা

বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দুই দশকে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে আর্থিক কাঠামো এখনো ব্যাংক-নির্ভর, যেখানে কর্পোরেট বন্ড মার্কেট কার্যত অনুপস্থিত। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য শক্তিশালী বন্ড বাজার অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশের বিকাশ নানা কারণে বাধাগ্রস্ত। এই প্রেক্ষাপটে বন্ড মার্কেটের গুরুত্ব, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা, প্রধান প্রতিবন্ধকতা, সাম্প্রতিক নীতি উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ এবং করণীয় নীতিগত সংস্কার ও ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতির একটি। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, প্রবাসী আয় এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ ইতিমধ্যে একটি মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে দেশের আর্থিক কাঠামোতে বড় একটি দুর্বলতা রয়ে গেছে-একটি কার্যকর ও শক্তিশালী বন্ড মার্কেটের অনুপস্থিতি।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীন কিংবা ভারত তাদের প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে বন্ড মার্কেটকে অর্থনৈতিক কাঠামোর অন্যতম মূল স্তম্ভে রূপান্তর করেছে, সেখানে বাংলাদেশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীল। এর ফলে –
•ব্যাংকিং খাতের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হচ্ছে,
•দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সীমিত হয়ে যাচ্ছে,
•আর্থিক খাতে বৈচিত্র্যের অভাব দেখা দিচ্ছে।
বন্ড মার্কেটকে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সবচেয়ে কার্যকর উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে-
•যুক্তরাষ্ট্র: বিশ্বের বৃহত্তম বন্ড মার্কেট, প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আকারের (SIFMA, ২০২৩)।
•ভারত: কর্পোরেট বন্ড বাজার GDP-র ১৭% (RBI, ২০২২); গত দশকে বাজার প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
•মালয়েশিয়া: ইসলামিক সুকুক বাজারে বিশ্বসেরা; দেশটির মোট বন্ড মার্কেটের ৬০% সুকুকভিত্তিক।
•ভিয়েতনাম: সাম্প্রতিক কর প্রণোদনা ও নিয়ন্ত্রক সংস্কারের ফলে কর্পোরেট বন্ড বাজার জিডিপির ১৫% এ উন্নীত হয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে কর্পোরেট বন্ড বাজার জিডিপির ১% এরও কম (বিএসইসি, ২০২৪) । এই ব্যবধান দেশের আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটকে মূলত দুটি অংশে ভাগ করা যায়-সরকারি বন্ড বাজার এবং কর্পোরেট বন্ড বাজার। দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে এই দুটি বাজার গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবে উভয় ক্ষেত্রেই সীমিত কার্যক্রম এবং নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।
সরকারি বন্ড বাজার
সরকারি বন্ড বাজার বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে স্থিতিশীল অংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজেট ঘাটতি পূরণ এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নিয়মিতভাবে ট্রেজারি বিল (T-Bill) এবং ট্রেজারি বন্ড (T-Bond) ইস্যু করে।
•T-Bill সাধারণত ৩, ৬ এবং ১২ মাসের জন্য ইস্যু হয়, আর T-Bond দীর্ঘমেয়াদি (২ থেকে ২০ বছর) প্রকল্প অর্থায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়।
•সরকারি বন্ড প্রধানত ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, পেনশন ফান্ড এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ক্রয় করে থাকে।
•যদিও সরকারি বন্ড ইস্যু হয়, তবুও সেকেন্ডারি মার্কেট খুব সীমিত, ফলে বিনিয়োগকারীরা সহজে বন্ড বিক্রি বা ক্রয় করতে পারেন না।
•সুদের হার বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। সরকারি বন্ড সাধারণত নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বেশি।
কর্পোরেট বন্ড বাজার
বাংলাদেশে কর্পোরেট বন্ড বাজার কার্যত অনুপস্থিত। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কর্পোরেট বন্ডের সংখ্যা হাতে গোনা। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো বেক্সিমকো গ্রীণ সুকক (২০২১), যা দেশের প্রথম গ্রিন সুকুক। তবে এ ধরনের উদ্যোগ এখনও ব্যতিক্রমী এবং ধারাবাহিক নয়।
•বড় কর্পোরেট সংস্থা সাধারণত ব্যাংক ঋণকে প্রাধান্য দেয়, কারণ এটি সহজলভ্য এবং ঝুঁকিমুক্ত।
•নিয়ন্ত্রক জটিলতা, কর কাঠামো, এবং সেকেন্ডারি মার্কেটের অভাব কর্পোরেট বন্ডের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
•ফলশ্রুতিতে, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য বেসরকারি খাত এখনও প্রধানত ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীল, যা ব্যাংক খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে।
সরকারি বন্ড বাজার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থিতিশীল এবং নিরাপদ হলেও, খুচরা বিনিয়োগকারীর জন্য প্রায় অপ্রাপ্য। কর্পোরেট বন্ড বাজার প্রায় অনুপস্থিত, ফলে দেশের অর্থনৈতিক খাতে বিনিয়োগের বিকল্প সীমিত। শক্তিশালী নীতি সংস্কার, কর প্রণোদনা এবং সেকেন্ডারি মার্কেট উন্নয়ন ছাড়া কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট বিকাশে চ্যালেঞ্জ
১. ব্যাংক-নির্ভর আর্থিক কাঠামো -ব্যাংকগুলো কর্পোরেটদের সহজে ঋণ দিয়ে থাকে, ফলে তারা বন্ড ইস্যুর পথে আগ্রহী নয়।
২. সেকেন্ডারি মার্কেটের অভাব – সক্রিয় মার্কেট মেকার না থাকায় বন্ড সহজে ক্রয়-বিক্রয় করা যায় না।
৩. তথ্য স্বচ্ছতার ঘাটতি- অনেক কর্পোরেট নির্ভরযোগ্য আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করে না। ক্রেডিট রেটিং কার্যকর হলে ও সবসময় আস্থা তৈরি করে না।
৪. নিয়ন্ত্রক জটিলতা বিএইসির অনুমোদন প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
৫. বিনিয়োগকারীর মানসিকতা -দ্রুত মুনাফার জন্য বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারকে অগ্রাধিকার দেয়, বন্ডে আগ্রহ সীমিত।
৬. কর কাঠামো – উৎসে কর, স্ট্যাম্প ডিউটি ও অন্যান্য চার্জ বন্ড বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে ।
৭. ডেরিভেটিভ মার্কেটের অনুপস্থিতি – ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য হেজিং টুলস না থাকায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে না।
৮. কুপন রেট এ যুক্তি নির্ভর পার্থক্য বাংলাদেশে কর্পোরেট বন্ডে বিনিয়োগে উদ্বৃত্ত করার জন্য, কর্পোরেট বন্ড (ঝুকি নির্ভর) এবং এড়াঃ. ট্রেজারী বন্ড (ঝুকি মুক্ত) এ-ইন্টারেস্ট রেট অথবা কুপন রেট এ যুক্তি নির্ভর পার্থক্য থাকা উচিত।
-৯. ক্রেডিট রেটিং এজেন্সীর উপর নির্ভরতা বিশাসযোগ্য এবং গ্রহনেযোগ্য লোকাল ক্রেডিট রেটিং এজেন্সীগুলোর উপর নির্ভরযোগ্যতা বাড়াতে হবে।
১০. High Risk ওয়েটেড এসেট বন্ডে বিনিয়োগে High Risk ওয়েটেড এসেট- যেটি কিনা ১২৫% থেকে কমিয়ে আনতে হবে।
সাম্প্রতিক নীতি উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী এবং টেকসই করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই পদক্ষেপগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, বাজারের কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর আস্থা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
•বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির যৌথ টাস্কফোর্স গঠন।
•গ্রিন বন্ড ও ইসলামিক সুকুক ইস্যুর উদ্যোগ।
•ইলেকট্রনিক বন্ড ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম চালুর প্রক্রিয়া, এটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং খুচরা বিনিয়োগকারীদের জন্য বন্ড ক্রয় ও বিক্রয় সহজ করবে।
•অবকাঠামো বন্ডের পাইলট প্রকল্প।
সাম্প্রতিক নীতি উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটকে সক্রিয় করার দিক দিয়ে একটি ইতিবাচক সূচনা। তবে কার্যকর এবং ব্যাপক প্রভাবের জন্য আরও নীতি সংস্কার, কর প্রণোদনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও খুচরা বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
•ভারত: কর্পোরেট বন্ডে কর ছাড়, বাধ্যতামূলক রেটিং এবং সহজ ট্রেডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারকে তিনগুণ বাড়িয়েছে।
•মালয়েশিয়া: ইসলামিক সুকুক বাজারকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎসে পরিণত করেছে।
•ভিয়েতনাম: কর প্রণোদনা ও বিশেষ নিয়ন্ত্রক কাঠামোর মাধ্যমে জিডিপির ১৫% পর্যন্ত কর্পোরেট বন্ড বাজার তৈরি করেছে।
•চীন: সরকারি উদ্যোগে বন্ড মার্কেট দ্রুত প্রসারিত হয়েছে; পেনশন ফান্ড ও বীমা খাতকে বন্ডে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য দেশের প্রমাণিত নীতি থেকে প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে, নিজস্ব প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো উন্নয়ন এবং সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে। বাংলাদেশে কর্পোরেটরা সহজ সমাধান হিসেবে ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভর করছে। কিন্তু এর ফলে-
•ব্যাংকের উপর ঋণের চাপ বাড়ছে,
•দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প অর্থায়ন সীমিত হচ্ছে,
•বিনিয়োগকারীদের বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং নীতিগত সুপারিশ
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, একটি শক্তিশালী ও টেকসই বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে তিনটি মূল উপাদান অপরিহার্য:
১.নীতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্কার
২.কর প্রণোদনা
৩.সেকেন্ডারি মার্কেটের সক্রিয়তা
উপরোক্ত অন্তর্দৃষ্টি বিবেচনা করে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নলিখিত নীতিগত সুপারিশ প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য:
১.নীতিগত সংস্কার: বন্ড ইস্যু সংক্রান্ত নিয়ম ও প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ, দ্রুত এবং স্বচ্ছ করা।
২.কর প্রণোদনা: উৎসে কর এবং স্ট্যাম্প ডিউটি হ্রাসের মাধ্যমে বন্ড ইস্যুকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা।
৩.সেকেন্ডারি মার্কেট উন্নয়ন: কার্যকর মার্কেট মেকার তৈরি এবং ইলেকট্রনিক ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করা।
৪.স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: কর্পোরেট ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী প্রকাশ এবং ক্রেডিট রেটিংকে বাধ্যতামূলক করা।
৫.প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করা: পেনশন ফান্ড, বীমা কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডকে বন্ডে বিনিয়োগে নীতিগত প্রণোদনা প্রদান।
৬.খাতভিত্তিক বন্ড ইস্যু: গ্রিন বন্ড, ইসলামিক সুকুক এবং অবকাঠামো বন্ডকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ প্রকল্পের জন্য তহবিল নিশ্চিত করা।
৭.বিনিয়োগকারী শিক্ষা ও সচেতনতা: খুচরা বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন।
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট আরও স্থিতিশীল, স্বচ্ছ ও টেকসই হয়ে উঠতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের বিকল্প পথ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং ব্যাংককেন্দ্রিক আর্থিক কাঠামো কর্পোরেট বন্ড বাজারের সম্প্রসারণকে সীমিত করছে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগের বৈচিত্র্যময় বিকল্প সৃষ্টির জন্য একটি সক্রিয়, স্বচ্ছ ও টেকসই বন্ড মার্কেট অপরিহার্য।
একটি শক্তিশালী বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংক, কর্পোরেট সেক্টর এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও খুচরা বিনিয়োগকারীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যথাযথ নীতি সংস্কার, কর প্রণোদনা, সেকেন্ডারি মার্কেট উন্নয়ন এবং বিনিয়োগকারীর সচেতনতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামী দশকে একটি স্থায়ী, কার্যকর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
এ ধরনের উন্নয়ন শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের জন্য তহবিল নিশ্চিত করবে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও টেকসই করবে, বিনিয়োগের বিকল্প পথ সম্প্রসারিত করবে এবং সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য একটি দৃঢ় আর্থিক কাঠামো স্থাপন করবে । সুসংগত নীতি প্রয়োগ ও বাজার প্রণোদনার মাধ্যমে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্তরের বন্ড মার্কেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতের আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকবে।
মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান, পরিচালক, এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। ই-মেইল: obayad77@gmail.com