মত দ্বিমত
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ: প্রশ্ন, গোপনীয়তা ও জনআস্থার সংকট

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান, যার কেন্দ্রে রয়েছে কিছু মৌলিক প্রশ্ন—যেগুলোর উত্তর না পাওয়া মানে জাতির সামনে একটি অন্ধকার পথ খোলা রাখা। জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে: কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, এবং কে বা কারা এখন প্রকৃত ক্ষমতার মালিক?
গণআন্দোলনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক পর্বের অবসান ঘটলেও, নীতিনির্ধারকদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি জনগণের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে সেনাপ্রধান এবং সংশ্লিষ্ট সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে যেভাবে নীরবতা বজায় রাখা হয়েছে, তা শুধু দুঃখজনক নয়, বরং তা রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনার ‘সেফ এক্সিট’ ইস্যু, কিছু রাজনৈতিক নেতার দেশত্যাগে সেনা ক্যান্টনমেন্টের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতা, এবং পরবর্তীতে ভারতের সঙ্গে কৃত্রিম উত্তেজনা তৈরি—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, একটি অদৃশ্য ও অগোচর ক্ষমতাকাঠামো বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট পথে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে গণতন্ত্রের চেয়ে “নিয়ন্ত্রিত স্থিতিশীলতা”কেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, জাতির সামনে এই গোপন অধ্যায়গুলোর সত্য প্রকাশ করা। সত্যকে প্রকাশ্যে না আনলে ইতিহাসে যেমন বিভ্রান্তি তৈরি হয়, তেমনি জনগণের আস্থাও স্থায়ীভাবে ক্ষুণ্ন হয়। ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের নীরবতা বা ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যেখানে তিনিই বহুবার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন, সেখানে এই সন্ধিক্ষণে তার সক্রিয়তার অভাব বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
নির্বাচন প্রশ্নে কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতৃত্বের যে অনীহা বা নিরবতা দেখা যাচ্ছে, তা কেবলমাত্র রাজনৈতিক সংকট নয়—এটি একটি রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার সংকটও। জনগণ এখন এমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রশ্ন করা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের সমান; অথচ প্রশ্নের উত্তর না পেলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত।
সুতরাং, এখন সময় এসেছে একটি নিরপেক্ষ, শক্তিশালী এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তদন্ত কমিশন গঠনের—যা সেনাপ্রধান, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিদেশি সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কিত যাবতীয় গোপন অধ্যায় জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। একইসাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা ও গণমাধ্যমের স্বাধীন অভিমত প্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এই জাতি অনেক কিছু সহ্য করেছে, এখন সে প্রশ্ন করছে। প্রশ্নের উত্তর না দিলে ইতিহাস নিজেই একদিন তার বিচার করবে। তবে এখানে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলেই চলবে না—দাবি করতে হবে জোর গলায়। তাই আজ সময় এসেছে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা ও জবাবদিহির মুখোমুখি করার।
প্রথমত, সেনাপ্রধান ও সংশ্লিষ্ট সামরিক নেতৃত্বের গোপন তৎপরতা আদৌ কি তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের পরিসরের মধ্যে পড়ে? যদি পড়ে না থাকে, তবে এই বিষয়ে স্পষ্ট তদন্ত হওয়া প্রয়োজন—স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে, যা কেবল সামরিক নয়, বেসামরিক পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী হিসেবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। সংবিধান অনুযায়ী তিনিই সামরিক বাহিনীর প্রধান, তাহলে এই “গোপন রাষ্ট্রচালনা”র দায়ভার থেকে কি তিনি মুক্ত? তার কাছ থেকে কি কোনো জবাবদিহি আশা করতে পারি?
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর নিরবতা কী নির্দেশ করে? এটি কি ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার কৌশলগত প্রতিযোগিতা, না তারা আদৌ জানে না কীভাবে জনগণের পক্ষ নিতে হয়? একথা ভুলে গেলে চলবে না, রাজনীতি যদি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তবে তা দখল হয়ে যায় অদৃশ্য শক্তির হাতে। আজ জনগণ এই রাজনৈতিক নেতাদের কাছে জবাব চায়—তাদের ভূমিকা কি ছিলো, কোথায় তারা দাঁড়িয়ে আছেন?
তৃতীয়ত, জনগণের কী কিছুই বলার নেই? এই রাষ্ট্র তো তাদেরই; এই ভূখণ্ড, এই সংবিধান, এই পতাকা—সবই জনগণের। তাহলে কেন তারা শুধুই দর্শক হয়ে থাকবে? আমাদের দাবি করতে হবে—স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক অবস্থান পুনর্ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক দলের জবাবদিহিতা এবং রাষ্ট্রপতির স্পষ্ট অবস্থান।
আমাদের দাবি স্পষ্ট:
১. একটি নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন হোক—যা সেনা নেতৃত্ব, শেখ হাসিনার সেফ এক্সিট, ভারতের ভূমিকা ও রাজনৈতিক দলের নিরবতা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করবে।
২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা ও পুনঃগঠন।
৩. রাষ্ট্রপতির একটি প্রকাশ্য বিবৃতি, যাতে তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করবেন—গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে তিনি দাঁড়ান, না নীরব প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে থাকবেন।
৪. রাজনৈতিক দলগুলোর যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও অবস্থান স্পষ্ট করা।
৫. জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ—শান্তিপূর্ণভাবে, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে—জনসভা, গণশুনানি, এবং তথ্যের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।
শেষ কথা, ইতিহাস অপেক্ষা করে না। যারা আজ নীরব থাকবেন, কাল ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন। আর যারা আজ প্রশ্ন করছেন, তারা আগামীর ভিত্তি নির্মাণ করছেন।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

মত দ্বিমত
সামান্য কিছু বালু আমেরিকা থেকে আনতে দিলো না, অথচ…

সামারে সুইডেনে পাকিস্তানি আম পাওয়া যায়, খেতেও বেশ ভালো। ছোটবেলায় বাংলাদেশে গ্রামেই বেশি সময় কেটেছে। আম, জাম, লিচু, কাঠাল, খেজুরের রস—এসব ছিলো সেই বেহেস্তের খাবারের মতো, যাকে বলে অমৃত। তো বহু বছর দেশের বাইরে থাকতে থাকতে দই-এর সাধ ঘোলে মেটাতে হয় মাঝেমধ্যে। যার ফলে সামারে আমদুধ দিয়ে মুড়ি খাওয়ার সাধ জাগে। আম যেমনই হোক, তা মেলে, তবে সেই মুড়ি কোথায়? শেষে স্টকহোমের একটি বাংলাদেশি দোকান থেকে মুড়ি কিনলাম। ওমা! মুড়ি তেলে ভেজেছে, কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। দোকানে গিয়ে বিষয়টি বলতেই ভদ্রলোক বললেন, “বাংলাদেশ থেকে এগুলোই আসে।” আমি শুধু বললাম—ঘটনা কী? শাকসবজি, মাছ-ফলে ফরমালিন, মুড়িতে তেলের গন্ধ, মসলায় ইটের গুঁড়া—এসব সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে কীভাবে এলো? ভদ্রলোক হেসে বললেন, “যেভাবে আমরা এসেছি ভাই।” আমার আর বলার কিছু ছিল না।
পরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। সম্ভবত ১৯৯৬ সালের দিকে ছুটিতে গিয়েছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলসে। সাগরের বালু এত পরিষ্কার এবং সাদা দেখে মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার কথা। মাকে দেখেছি পরিষ্কার বালু গরম করে চাল দিয়ে মুড়ি ভাজতে। ভাবলাম, কিছু বালু সুইডেনে নিয়ে যাবো। যে ভাবনা, সেই কাজ। ব্যাগ ভরে কয়েক কেজি বালু নিয়ে লস এঞ্জেলস বিমানবন্দরে হাজির। চলছে চেকিং—নানা ধরনের প্রশ্ন: ব্যাগে কী আছে, কে প্যাক করেছে, অস্ত্রপাতি আছে কি না ইত্যাদি। ব্যাগের ওজন একটু বেশি হয়ে গেছে। কিছু ওজন কমাতে হবে অথবা অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে।
আমি ডেস্কে জিঙ্গেস করলাম, “কত?”
উত্তরে বলল, “২০০ ডলার।”
ভাবলাম, তাহলে কিছু বালু রেখে যাই। একটু সাইডে গিয়ে বালু ঢালছি আরেকটি পলিথিনের ব্যাগে। হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির। তারা জিজ্ঞেস করল, “এটা কী? কোথা থেকে এলো?” আমি সব বললাম। পুলিশ তো হতবাক! বলল, “জীবনে অনেক কিছু চোরাচালান হতে দেখেছি, কিন্তু বালু চোরাচালান এই প্রথম। তবে কী নিয়মকানুন আছে, সেটা জানা নেই। তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, তদন্ত করতে হবে।”
আমি বললাম, “আরে ভাই, এটা খাঁটি বালি, কোনো ভেজাল নেই। আমি নিজে হাতে সাগর থেকে তুলেছি।”
পুলিশ বলল, “তবুও পরীক্ষা করতে হবে। অন্য কিছু এর সঙ্গে জড়িত আছে কিনা তা জানতে হবে। রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদ পাচার—এটা তদন্তের বিষয়।”
আমি তো হঠাৎ অবাক! ঘাম ছুটে গেল শরীরে। এ যেন মহাবিপদ! এদিকে প্লেন ছেড়ে দেবে, ফ্লাইট মিস হবে, সাথে বালু চোরের খেতাব, জেল-জরিমানা—আর কত কী! আমি আছি আমার রাজ্যে—কে কী বলবে, কী হবে না হবে এসব নিয়ে। এরমধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এল। হঠাৎ কোনো যান্ত্রিক সমস্যার কারণে প্লেন এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে—এটাও কেউ এসে জানিয়ে গেল। একটু স্বস্তি পেলাম, কিন্তু আমার কী হবে সেটা নিয়ে ভাবছি।
কর্তৃপক্ষের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। আমার পরিচয়সহ সব ঘটনা জানার পর বিষয়টি বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দিলো, তবে বালু রেখে দিল। শুধু বললো, রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবে নেওয়া উচিত নয়। যদিও বালুর বিষয়ে প্লেনে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, তবুও নিতে পারবে না। আমি মনে মনে ভাবলাম—তুই তোর বালু নে, আমার আর মুড়ি ভাজার শখ নেই। বালু রেখে চলে এলাম।
ঘটনাটি পরে সুইডেনে এসে আলোচনা করেছি, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আর ভাবিনি। যদিও সেদিন লস এঞ্জেলস বিমানবন্দরে আমার বারোটা বাজতে গিয়েছিল, ভাগ্যিস মানসিক চাপ, শ্বাসকষ্ট আর ঘাম ছাড়া অন্য কোনো বিপদ হয়নি। তবে আমদুধ দিয়ে মুড়ি খাওয়ার শখ সেদিন লস এঞ্জেলসের বিমানবন্দরে রেখে এসেছি।
ভেজাল খাবার এড়াতে এবং দেশি খাবারের টান মেটাতে আমি এখানে নিজের মতো কৃষিপণ্য উৎপাদন করি। তবে আম আর ধান এখনও উৎপাদন সম্ভব হয়নি। সময়-সুযোগ হলে চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। আজ হঠাৎ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ—পাথর উত্তোলন আর সেগুলো রাতারাতি শেষ হয়ে যাওয়ার খবর পড়ে সেই দিনের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। মনে হলো, বেচারা দেশবাসীর হয়তো ঘর-দুয়ার সাজানোর শখ হয়েছিল পাথর দিয়ে—যেমনটি আমার হয়েছিল বালু দিয়ে মুড়ি ভাজার। প্রকৃতির সম্পদ লুট করে যেমন দেশ ফাঁকা হয়, তেমনি ভেজাল খাবারে মানুষের মনও শূন্য হয়ে যায়।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
চব্বিশের শহীদদের ত্যাগ, গ্রামীণ সমাজের রূপান্তর এবং ভারতের প্রভাবমুক্ত এক স্বতন্ত্র বাংলাদেশের পথনকশা

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০২৪ সাল কেবল একটি রাজনৈতিক বর্ষপঞ্জি নয়—এটি এক রক্তাক্ত অথচ গৌরবময় অধ্যায়, যা আমাদের জাতীয় চেতনায় স্থায়ীভাবে খোদাই হয়ে গেছে। এ বছর আমরা দেখেছি—কীভাবে এক তরুণ বুক চিতিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে, কীভাবে গ্রামীণ সমাজের নৈতিক ভিত্তি নড়ে গেছে, এবং কীভাবে জাতীয় রাজনীতি এখনও বিদেশি প্রভাবের ছায়ায় বন্দি। এই তিনটি প্রবাহ আলাদা হলেও, একসঙ্গে তারা আমাদের সামনে এক অনিবার্য প্রশ্ন তোলে—আমরা আসলে কতটা স্বাধীন?
১৬ জুলাই ২০২৪, রংপুর শহরে ছাত্রনেতা আবু সায়েদ পুলিশের সামনে দাঁড়ালেন—জেনে যে এর পরিণতি হতে পারে মৃত্যু। তবুও তিনি পিছু হটলেন না। মুহূর্তেই পুলিশের গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সেই মুহূর্তে আন্দোলনের চরিত্র বদলে যায়—এটি আর কেবল কোটা সংস্কারের দাবি নয়; হয়ে ওঠে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানুষের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের লড়াই। গুলির শব্দ, ধোঁয়া, রক্তের গন্ধ উপেক্ষা করে মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল—“মেরেছে একজন, দাঁড়িয়েছে দশজন।”
কিন্তু সেই রক্তের মূল্য এখনও পরিশোধ হয়নি। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিহত হয়েছে ৬০০ থেকে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ।
• জাত্রাবাড়ি গণহত্যা: এক দিনে ৫২ জন নিহত—পরিকল্পিত গুলিবর্ষণ।
• চাঁখারপুল হত্যাযজ্ঞ: খোলা রাস্তায় বেছে বেছে হত্যা।
• আশুলিয়া অগ্নিদগ্ধ হত্যাকাণ্ড: জীবন্ত মানুষকে আগুনে পোড়ানো।
এসব হত্যাকাণ্ড শুধু দমন নয়—এগুলো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নগ্ন রূপ। আজ সেই শহীদ পরিবারগুলো কোথায়? অনেকেই চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে; বহু পরিবার এখনও ন্যায়বিচার পায়নি। আমরা কি ভুলে গেছি—তারা আমাদের জন্য দাঁড়িয়েছিল?
তাদের গল্প শুধু শহরের রাস্তায় গুলির শব্দে সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রতিধ্বনি পৌঁছেছে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। এই গ্রামগুলোও বহন করছে সময়ের ক্ষতচিহ্ন—যেখানে ত্যাগ, আশা আর ভয়ের ইতিহাস নদীর মতো বয়ে চলেছে।
গ্রাম যেন এক উদার নদী—যার স্রোতে জন্ম নিয়েছে নানা চরিত্র ও স্বভাব। কোনো স্রোত ছিল স্বচ্ছ ও শান্ত, যা সমাজকে পুষ্ট করেছে; আবার কোনো স্রোত ছিল ঘোলা ও উত্তাল, যা শান্তিকে ভেঙে দিয়েছে। এক সময় এই গ্রাম থেকে উঠে এসেছিল আলোকবর্তিকা—যারা ধর্ম, সমাজসেবা ও শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিল, দিয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের স্বপ্ন। কিন্তু সময়ের স্রোত বদলেছে। সেবামুখী নেতৃত্বের জায়গা দখল করেছে ভয়, দমননীতি ও শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর এই গ্রাম তার সবচেয়ে বিপজ্জনক সৃষ্টিকে দেশের সামনে হাজির করেছে—যার উত্থান যেন শুকনো মাঠে দাবানল। আগুন স্থানীয়ভাবে শুরু হলেও, ধোঁয়া ও তাপ গ্রাস করতে পারে পুরো দেশকে।
স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনীতি বহিরাগত প্রভাবের ছায়া থেকে মুক্ত হয়নি। ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাদের আশীর্বাদ কামনা, এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি উদাসীনতা—আজকের প্রজন্মের জন্য এক গুরুতর হুমকি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য হলেও, স্বাধীনতার পর প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা কি নিজেদের স্বার্থে স্বাধীন? বন্ধুত্ব মানে অনুগত হওয়া নয়; স্বাধীনতা মানে নিজের পথ নির্ধারণের ক্ষমতা। ২০২৪ সালের নির্বাচন দেখিয়েছে—রাজনীতিতে বিদেশি প্রভাব কতটা গভীরে ঢুকে গেছে। বিরোধী পক্ষের অভিযোগ, সরকার ভারতের সমর্থন পেতে নির্বাচনকে কলুষিত করেছে। জনগণের স্লোগান ছিল স্পষ্ট—“দেশটা কারো বাপের নয়।” কিন্তু স্লোগান যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন স্পষ্ট রোডম্যাপ—জনগণের স্বার্থকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনা, বিদেশি প্রভাবমুক্ত স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা, সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে কূটনীতি চালানো, এবং বহুমুখী অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি।
২০২৪ সালের সাহসী সন্তানেরা প্রমাণ করেছেন—স্বাধীনতা একবার অর্জন করলেই চিরস্থায়ী হয় না; প্রতিদিন তা রক্ষা করতে হয়। গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তন শিখিয়েছে—নৈতিক নেতৃত্ব হারালে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি সমানভাবে দূষিত হয়। এই দূষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে হবে, আর তার ভিত্তি শুরু হয় একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে মাথা উঁচু রাখতে হবে—হাত পেতে নয়। এই মর্যাদা রক্ষার প্রথম ধাপ হলো একটি প্রকৃত স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন। বর্তমানে বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো—ইসি প্রায়ই সরকারের ছায়াতলে পরিচালিত হয়, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, আর অভিযোগ তদন্তে কার্যকর ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে নির্বাচন হারায় বিশ্বাসযোগ্যতা, আর গণতন্ত্র তার মূল ভিত্তি হারায়।
সুইডেনসহ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যা সরকার বা রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত। তাদের মূল দায়িত্বসমূহ হলো—
• ভোটার তালিকা নিয়মিত ও নিরপেক্ষভাবে হালনাগাদ করা
• ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
• সব প্রার্থী ও দলের জন্য সমান সুযোগ দেওয়া
• নির্বাচন আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা
• নির্বাচন-পরবর্তী বিরোধ দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে নিষ্পত্তি করা
• নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন ও পুলিশ কমিশনের সরাসরি অধীনে রাখা
• ফলাফল ঘোষণার পুরো প্রক্রিয়া জনসাধারণের জন্য দৃশ্যমান রাখা
বাংলাদেশের জন্য করণীয় প্রস্তাব
বাংলাদেশে একটি প্রকৃত নিরপেক্ষ ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নিচের নীতিমালা অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত—
১. সংবিধান সংশোধন করে ইসির পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
২. প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগে বহুদলীয় পরামর্শক কমিটি গঠন
৩. ইসির অর্থায়ন সংসদীয় অনুমোদনের মাধ্যমে, যাতে সরকার সরাসরি প্রভাব ফেলতে না পারে
৪. প্রশাসন ও পুলিশ নির্বাচনকালীন সময়ে ইসির অধীনে রাখা
৫. সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ও লাইভ স্ট্রিমিং ব্যবস্থা চালু করা
৬. ভোটার তালিকা ও ফলাফল অনলাইনে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা
৭. ভোট জালিয়াতি বা অনিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তি—দল ও প্রার্থীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য
শেষ কথা
যদি এই কাঠামো গ্রহণ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন শুধু একটি প্রশাসনিক সংস্থা নয়, বরং গণতন্ত্রের রক্ষক হয়ে উঠবে। সরকার তখন বলতে পারবে না—“আমরা জানতাম না”; বরং জনগণ নিশ্চিত হবে যে তাদের ভোট শুধু গণনা হয় না, গণ্যও হয়। কারণ, গণতন্ত্র তখনই সত্যিকারের বেঁচে থাকে—যখন মানুষের কণ্ঠস্বর ব্যালটের কাগজে প্রতিফলিত হয়।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনুশোচনার অভাব ও নতুন জাগরণের ডাক

আমরা কম বেশি ভুল করি, করি না? কিন্তু আমাদের অনুসচনা হয় না কেন? বাংলাদেশ এবং বাঙালি সহ আরো কিছু মানুষের বসবাস এই দেশটিতে। যেভাবেই হোক দেশটা দীর্ঘ ৯ মাসেই সেই ৭১-এ স্বাধীন হয়ে গেলো। শেখ মুজিব দেশে ফিরলেন, নিজ দায়িত্বে প্রেসিডেন্ট হলেন যদিও চারদিকের চামচারা নানা ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা নিতে নির্লজ্জের মতো কেউ কিছু বলেনি। সম্ভবত বিনা সফতেই নিজ দায়িত্বে প্রেসিডেন্ট হলেন এবং পরে আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে নিজে প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপর কোন ফাঁকে জাতির পিতায় ভূষিত হলেন এবং বঙ্গবন্ধু হলেন। শেষ পর্যায়ে একদলীয় শাসন চালু করে রাষ্ট্রকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পথে নিয়ে গেলেন।
এরপর এলো জিয়াউর রহমানের উত্থান। মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হিসেবে ক্ষমতায় এসে তিনি রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়তে চাইলেন। তাঁর উদ্যোগে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়, বহুদলীয় রাজনীতি ফিরে আসে। কিন্তু ক্ষমতার খেলায় তাঁর শাসনও স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বিতর্কিত রয়ে যায়।
তারপর এলো হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দীর্ঘদিন শাসন করেন। তাঁর সময়ে প্রশাসনিক অবকাঠামোর কিছু সংস্কার হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতি ঘটে। দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা সেই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এরশাদের শাসন আমাদের শেখায়—সামরিক শাসন কখনোই জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র গড়তে পারে না।
পরে এলো খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পালাবদলের দীর্ঘ ইতিহাস। দুই দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে দেশ বারবার আঘাত পেয়েছে। এক সময় গণতন্ত্র কেবল ভোটের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার ও সমতার প্রশ্ন পিছিয়ে গেছে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? ইতিহাসে আমরা দেখেছি সেনাবাহিনী বারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেছে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাদের মূল দায়িত্ব হলো জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য ভাঙা নয়। ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হলো—সশস্ত্র বাহিনীকে নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে রাখতে হবে, যাতে তারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করে, হুমকি না হয়।
এরপর এলো ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার। তাঁদের দুটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো—প্রথমত, দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা থাকলেও সেটি ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, লুটপাট সত্ত্বেও দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়নি। তবে প্রশাসনিক সংস্কার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তরে তারা কার্যকর হতে পারেনি। এখন দেখার পালা তারা একটি সত্যিকারের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হন কিনা।
সবশেষে নতুন প্রজন্মের কথা আসছে। ২০২৪ সালে তারা দেশের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—তারা কি সেই অধিকার ধরে রাখতে পারবে? তাদের নৈতিক মূল্যবোধ কি অতীতের নেতাদের থেকে ভিন্ন কিছু হবে? যদি না হয়, তবে আমরা আবারও একই অনুশোচনার চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে নেতৃত্ব সংকট, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পুনরাবৃত্তি আমাদের জাতীয় জীবনে আজ গভীর অনুশোচনার জন্ম দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সময়কাল পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি—রাষ্ট্রের কাঠামো সংস্কারের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার চর্চা। যার ফলে প্রশাসন দুর্বল হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীকে কখনো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, আবার কখনো তারা পর্দার আড়ালে নীতিনির্ধারণী প্রভাব বিস্তার করেছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। প্রশাসন রাজনৈতিক আনুগত্যের বন্দী হয়ে পড়েছে, যেখানে দক্ষতা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা অবহেলিত। একইভাবে, সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের প্রভাব কোথায় সীমিত থাকবে—সেই প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট উত্তর আমরা পাইনি। ফলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বারবার জাতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে।
অতএব, এখন দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন সহজ নয়। কারণ বাস্তবতা হলো—আজকের তরুণদের একটি বড় অংশ বেকার। তাদের হাতে নেই পর্যাপ্ত ক্ষমতা, নেই দক্ষতা, নেই কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। ফলে তারা সারাদিন রাজনৈতিক নেতাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, কখনো ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি ও লুটপাটে অংশ নেয়, আবার কখনো রাজনৈতিক হানাহানির বলি হয়। তাদের বেকারত্ব দূরীকরণে কোনো কার্যকর পরিকল্পনা নেই, কারণ দুর্নীতিবাজ সরকার টিকে থাকার স্বার্থে এই তরুণ সমাজকে ব্যবহার করছে নিজেদের ক্ষমতার খেলায়—ফলে দেশের বারোটা বাজছে।
আমি ভেবেছিলাম, অন্তবর্তী সরকারের নেতৃত্বে ড. ইউনূস অন্তত একটি জাতীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা তৈরি করবেন, একটি সঠিক রোডম্যাপ দেখাবেন-যাতে তরুণ প্রজন্ম দক্ষতায়, সততায় এবং সৃজনশীলতায় জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তিনি সেই কাজটিও করতে পারেননি।
বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের এখন একটাই শিক্ষা দেয়—অনুশোচনা ছাড়া আমাদের পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিব থেকে জিয়া, এরশাদ থেকে খালেদা-হাসিনা পর্যন্ত প্রতিটি যুগে ভুল ছিল, অন্যায় ছিল। কিন্তু কোথাও প্রকৃত অনুশোচনা দেখা যায়নি। সেই কারণেই একই ভুল বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
আমাদের সামনে একমাত্র করণীয় হলো-একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, যেখানে শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করা হবে, তরুণদের জন্য প্রযুক্তি ও শিল্পভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা হবে, এবং নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হবে।
নতুন প্রজন্ম যদি সেই সঠিক দিকনির্দেশনা পায়, তবে তারা শুধু নিজেদের নয়, জাতির ভবিষ্যৎও আলোকিত করতে পারবে। অন্যথায়, আমরা বারবার একই প্রশ্নেই ফিরে যাব—এতো কিছুর পরেও আমরা আমাদের অনুশোচনা করি না কেন?
অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, অনুশোচনার সংস্কৃতি গড়ে তুলে, আমরা যদি একটি নৈতিক ও সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে পারি, তবে জাতির ভবিষ্যৎ আলোকিত হবে। কিন্তু যদি তা না হয়, তবে আমরা শুধু প্রশ্ন করেই যাব—এতো কিছুর পরেও দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বারবার দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, কিন্তু কই—তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন তো হয়নি, হচ্ছে না! তারপরও আমাদের কোনো অনুশোচনা নেই, কিন্তু কেন?
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
স্বাধীনতার হুমকির মুখে গণমাধ্যম

বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম স্বাধীনতার ওপর যখন প্রবল চাপ, তখন বাংলাদেশে পরিস্থিতি প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীন সাংবাদিকতার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক আনুগত্য, ভীতি ও তোষামোদে। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আজ সত্য প্রকাশ করতে ভুলে গেছেন—বরং সরকারের প্রশংসা করাই হয়ে গেছে প্রধান কাজ। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন, সাংবাদিকদের একটি অংশ প্রকাশ্যে বলতেন—‘সমালোচনা নয়, প্রশংসা করতেই এসেছি।’ এই মানসিকতা গণতন্ত্রের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয়, এটি রাষ্ট্রের মৌলিক স্বচ্ছতাকেও ধ্বংস করেছে।
আজও সেই একই চক্র সাংবাদিকতা করছে—যারা সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পায়, কারণ তারা জানে, টেন্ডার, বিজ্ঞাপন কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যাবে যদি চাটুকারিতার বাইরে পা বাড়ানো হয়। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশে যদি কেউ ‘সুইডেনের আদর্শ’ বলে একটি মডেল প্রস্তাব করে, সেটি কি এই মানসিকতার মধ্যে কার্যকর হতে পারবে?
বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো—
সংবাদমাধ্যমের মালিকানা: অধিকাংশ বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক স্বার্থে জড়িত।
সম্পাদকীয় স্বাধীনতার অভাব: সম্পাদকরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা সেন্সরশিপ প্রয়োগ করেন, যাতে ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন না হতে হয়।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও আইনি অস্ত্র: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ধারা সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
পাঠকের আস্থা কমে যাওয়া: মানুষ জানে, সংবাদপত্র অনেক সময়ই ক্ষমতাবানদের হাতের কণ্ঠস্বর, জনগণের নয়।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র কাঠামো যদি সত্যিই পুনর্গঠিত করতে হয়, তাহলে শুধু আইন নয়—মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। আর এজন্য প্রয়োজন সুইডেনের মতো শক্তিশালী ও স্বাধীন পাবলিক সার্ভিস মিডিয়া মডেল।
সুইডেনের উদাহরণ: গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ
সুইডেনে পাবলিক সার্ভিস সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান—সুইডিশ টেলিভিশন (SVT), সুইডিশ রেডিও (SR) এবং শিক্ষামূলক রেডিও (UR)—আইন দ্বারা সুরক্ষিত, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত এবং সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক। এ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় Radio and Television Act (2010:696) অনুযায়ী।
মূল বৈশিষ্ট্য:
আইনের সুরক্ষা: কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ সম্প্রচারের কনটেন্টে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না—এটি আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে।
আর্থিক স্বাধীনতা: ২০১৯ সাল থেকে কর-ভিত্তিক পাবলিক সার্ভিস ফি চালু হয়েছে, যা Förvaltningsstiftelsen för SR, SVT och UR নামের একটি স্বাধীন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
নিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্য: সংখ্যালঘু ভাষা, প্রতিবন্ধীদের জন্য কনটেন্ট, শিশু-কিশোরদের জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাদের কাজের অংশ।
জনগণের জবাবদিহি ব্যবস্থা:
১. অভিযোগ দাখিল: যে কেউ সুইডিশ প্রেস ও ব্রডকাস্টিং অথরিটি (MPRT)-তে অভিযোগ করতে পারে।
২. সরাসরি মতামত প্রদান: SVT, SR, UR-এর ওয়েবসাইটে অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ রয়েছে।
৩. বার্ষিক প্রতিবেদন: কর্মদক্ষতা ও দায়িত্বপালনের অগ্রগতি সংসদে প্রকাশ ও জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
৪. সংসদীয় শুনানি: খোলামেলা আলোচনায় জনগণের মতামত গুরুত্ব পায়, কিন্তু কনটেন্টে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয় না।
বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
যদি বাংলাদেশে সুইডেনের মতো একটি মডেল গড়ে তোলা যায়, তবে—
•সাংবাদিকরা সরকারের ভয় ছাড়াই কাজ করতে পারবেন।
•জনগণের আস্থা ফিরবে।
•গুজব, প্রোপাগান্ডা ও বাণিজ্যিক চাপ কমে যাবে।
•সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শোনা যাবে।
কিন্তু এই মডেল কার্যকর করতে হলে শুধু আইন নকল করলেই চলবে না—প্রথমে সাংবাদিকতা থেকে চামচামি ও আত্মসমর্পণ দূর করতে হবে। গণমাধ্যমকে জনগণের জন্য, জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
বাস্তবতার কঠিন মুখোমুখি
একটি সুন্দর উদাহরণ দেখানো সহজ, কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়োগের জন্য দরকার একটি শক্ত ভিত্তি। সুইডেনের বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছে—
•মজবুত অর্থনীতি
•উচ্চমানের শিক্ষা ব্যবস্থা
•সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক
•সীমিত জনসংখ্যা ও কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো
•উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ (Moral Values)
এবং—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—রাজকীয় প্রথা ভেঙে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর মানে দাঁড়ায়—দুর্নীতি, অনিয়ম, পারিবারিক একচ্ছত্র শাসন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া সুইডেনের মডেল শুধু কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়। তাই গণমাধ্যম সংস্কারের পাশাপাশি গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং—অর্থাৎ জনগণের মধ্যে নৈতিকতা, জবাবদিহি ও সচেতনতার সংস্কার—শুরু করতে হবে।
স্বচ্ছ গণতন্ত্র কেবল আইনের মাধ্যমে নয়, বরং জনগণের মানসিকতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়-এই সাহসী কথাটি আমি বলতে পারলাম শুধু এই জন্যই, আমি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে সুইডেনে বেস্ট প্র্যাকটিস করছি এসবের ওপরে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
চরকায় তেল ঢালুন, ভণ্ডদের বাজার শূন্য করুন

সবাই আমরা সোনার বাংলাকে ভালোবাসি—এই কথা শুনলে গর্ব হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি সত্যিই সেই ভালোবাসার মর্ম বুঝি? ভালোবাসা তো শুধু মুখের বুলি নয়; সেটি অনুভব করতে হয়, কাজে প্রকাশ করতে হয়। ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ হলো দেশের উন্নতি, মানুষের কল্যাণ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় আমরা কি এসবের জন্য কিছু করছি? নাকি ভালোবাসার নাম করে দেশকে ভাগাভাগি করছি, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছি, আর ব্যক্তিগত স্বার্থের পেছনে ছুটছি?
আমরা দেশকে ভালোবাসি বলি, কিন্তু নিজের জীবনযাপন, আচরণ, সিদ্ধান্ত—সবকিছু দিয়ে কি সেই ভালোবাসাকে সম্মান দিচ্ছি? নাকি দেশকে শুধু একটা ভৌগোলিক ঠিকানা ভাবছি, যেখানে টাকা রোজগার হয়, সুবিধা পাওয়া যায়, আর অন্যায়ের প্রতি চুপ থাকা যায়?
ভালোবাসা মানে শুধু আবেগ নয়—এটি দায়িত্ব। দায়িত্ব নিজের দেশকে ভালোবাসতে, তার উন্নয়নে কাজ করতে, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। আজ আমাদের অভাব নেই ভালোবাসার; আমাদের অভাব ভালোবাসার প্রমাণের।
তাহলে দেখা যাক, কোন কোন কুকর্ম সোনার বাংলাকে ভালোবাসার সাথে কোনোভাবেই মিলতে পারে না—
দুর্নীতি: জনগণের ঘামঝরা টাকায় হাত চালানো, দায়িত্বের দরজা বন্ধ করে ব্যক্তিগত ভান্ডার ভরাট করা।
সন্ত্রাসবাদ: ভয় আর আতঙ্কের ছায়া ফেলে জনজীবনকে জিম্মি করা।
চাঁদাবাজি: শ্রমজীবী মানুষের রক্ত চুষে নেওয়া।
কাজে ফাঁকি: কর্তব্য ফেলে দায়িত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া।
গুজব ছড়ানো: মিথ্যার আগুন জ্বালিয়ে ঘৃণার বাতাস বইয়ে দেওয়া।
মিথ্যাচার: সত্যকে হত্যা করে অবিশ্বাসের রাজত্ব কায়েম করা।
গরিবের হক চুরি: অভাবীর অন্ন কেড়ে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসা।
স্বার্থপরতা: দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত এজেন্ডার পূজা করা।
বিভাজন সৃষ্টিকারী রাজনীতি: মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভ্রাতৃত্বকে বিষিয়ে দেওয়া।
অযোগ্য নেতৃত্ব: উন্নয়নকে অবরুদ্ধ করে দেশের স্বপ্নকে শ্বাসরুদ্ধ করা।
এখন প্রশ্ন—যে রাজনীতিবিদ বুকে হাত দিয়ে গর্জে বলে “আমি সোনার বাংলাদেশকে ভালোবাসি”, অথচ তার কর্মকাণ্ড এই কুকর্মের তালিকায় পাওয়া যায়—তার ভালোবাসা কি সত্যি? নাকি সুপরিকল্পিত প্রতারণা?
দেশপ্রেম কোনো অনুষ্ঠানমুখী প্রদর্শনী নয়—না জাতীয় সঙ্গীতের সুরে দাঁড়িয়ে থাকা, না শহীদ মিনারে খালি পায়ে যাওয়া, না স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে ছবি তোলা। আসল দেশপ্রেম শুরু হয় পরিবার থেকে, দায়িত্ব থেকে, বিবেক থেকে। আপনি যদি ঘরের মানুষকে মর্যাদা দেন, অন্যের অধিকারকে শ্রদ্ধা করেন, সততা দিয়ে জীবিকা অর্জন করেন—তাহলেই দেশের হৃদস্পন্দনে ভালোবাসা ঢেলে দিচ্ছেন। নিজের চর্কায় তেল দিলে গোটা দেশের চাকা সচল থাকে—আর তাতেই বেঁচে ওঠে সোনার বাংলার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন জাগাতে হলে প্রথমে আমাদের মুক্ত করতে হবে দেশকে সেই সুবর্ণ ডাকাতদের হাত থেকে—যারা ক্ষমতায় উঠে জনগণের কাঁধে পা দিয়েছে, কিন্তু সেই কাঁধের হাড় ভেঙে দিয়েছে। আজ যারা দেশকে “মা” বলে ডাকে, তারাই মায়ের গলার হার, কানের দুল, এমনকি খোঁপার ফুলও চুরি করে নেয়।
তাদের দেশপ্রেমের মাপ হয় বিদেশি ব্যাংকে ডলারের অঙ্ক দিয়ে, আর জনগণের ভালোবাসা মাপে আগেই ভরা ভোটের বাক্স দিয়ে। তারা ভাবে দলীয় পতাকা উঁচিয়ে রাখলেই দায়িত্ব শেষ—কিন্তু দেশপ্রেম মানে নীরব আত্মত্যাগ, সততা ও দায়বদ্ধতা।
যেদিন আমরা সবাই মিলে নিজেদের চর্কায় তেল ঢালতে শুরু করব, সেদিন “দেশপ্রেমের ব্যবসায়ীরা” বুঝতে পারবে—বাজারে তাদের কোনো ক্রেতাই নেই। আর সেদিন সোনার বাংলার স্বপ্ন শুধু বাঁচবেই না—সে স্বপ্ন দাঁড়াবে এই ভণ্ড দেশপ্রেমিকদের কবরের উপর, হেসে বলবে—এবার তোমাদের বিদায়।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com