মত দ্বিমত
আমাদেরও একজন রানী এলিজাবেথ ছিলেন
হ্যাঁ বলছি বেগম খালেদা জিয়ার কথা। তিনি যতটুকু কথা বলার দরকার ততটুকুই বলতেন, যতটুকু করার দরকার ততটুকুই করতেন এবং সেটা নিয়ে কখনো কোনো দ্বিমত পোষণ করতে দেখিনি কাউকে। তিনি গত ১৫ মাসে অনেকের চোখে জাতির এক মাতৃসম প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিপ্লবী নেতা কর্মীদের মধ্যে আমি একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি। তা ছিল গত বছরের সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের সময়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির চোখে মুখে এক ধরনের আবেগের ঢেউ কাজ করছিল। তাদের মনের ভাষা যেন ছিল জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, তোমাকে এই সমাবেশে আনতে পেরে, তোমাকে দেখাতে তোমার সন্তানেরা পেরেছে তোমার জন্মভূমিকে তোমার কাছে ফিরিয়ে নিতে।
দীর্ঘ ১৬ বছর গৃহবন্দিনী থাকা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর জীবনের এই সময়টি ছিল বাংলার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া এক বিশেষ সম্মানের সময়। সম্ভবত সেই স্মৃতিই তাঁকে এবারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসেও উপস্থিত থাকতে অনুপ্রাণিত করেছিল, শারীরিকভাবে নানা ধরনের জটিলতা থাকা সত্ত্বেও। বিনিময়ে তিনি নিজ কানে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে শুনতে পান যে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক।
একজন সহধর্মিণীর জন্য তাঁর স্বামীর এমন গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, তা আবার লাখো মানুষের উপস্থিতিতে, নিঃসন্দেহে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ ১৬ বছরের বেশি সময় নির্বাসিত একমাত্র সন্তানের দেশে প্রত্যাবর্তন এবং সেই সন্তানের উপস্থিতিতেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, ঠিক একই দিনে যেদিন তাঁর সহধর্মী প্রেসিডেন্ট জিয়া পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।
দীর্ঘ ৫৫ বছরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অনেক রাজনৈতিক নেতার বিদায় হয়েছে। আমার কাছে নিঃসন্দেহে শহীদ ওসমান হাদি, প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং গণতন্ত্রের পক্ষে আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় জাগরণের চেতনায় বেগম খালেদা জিয়া একজন রানী এলিজাবেথের মতো স্থির, নীরব এবং মর্যাদাসম্পন্ন প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন।
রহমান মৃধা, গবেষক-লেখক এবং সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
শুধু বেসরকারি ব্যাংকাররাই বঞ্চিত হবেন কেন?
চলতি বছরের গত ৯ ডিসেম্বর ব্যাংক কোম্পানীর কর্মকর্তা কর্মচারীগণের উৎসাহ বোনাস প্রদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি একটি সার্কুলার জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে “ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আর্থিক সক্ষমতা পর্যালোচনায় অ্যাক্রুড বা আনরিয়ালাইজড আয়ের ভিত্তিতে প্রণোদনা প্রদান করা ব্যাংকের আর্থিক সুশাসন এবং সুদক্ষ ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক্ষণে তফসিলী ব্যাংকসমূহকে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুকূলে উৎসাহ প্রদানের পূর্বে নিম্নোক্ত সকল বিষয়ে নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
কোনো আর্থিক বছরে শুধুমাত্র প্রকৃত আয়-ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ণীত মুনাফা অর্জিত হলে উৎসাহ বোনাস দেয়া যাবে পুঞ্জিভূত মুনাফা হতে উৎসাহ প্রদান করা যাবে না। রেগুলেটরি মূলধন সংরক্ষণে কোন ঘাটতি বা কোনরূপ সঞ্চিতি ঘাটতি থাকতে পারবে না এবং এ ক্ষেত্রে কোনরূপ বিলম্ব করার সুবিধা প্রদান প্রদত্ত হলে তা মুনাফা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া যাবেনা। বিভিন্ন সূচকে উন্নতির শ্রেণিকৃত পাবলিক অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি এই বোনাস প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও তফশিলী বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মরত কর্মচারীদের উৎসাহ প্রদান নির্দেশিকা ২০২৫ অনুসরণীয় হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করা হলো।”
ব্যাংক মুনাফা না করলেও সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের অনুমিতি নিয়ে প্রণোদনা বোনাস গ্রহণ করতে পারবেন কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেটা পারবেন না এটা কি একটা বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নয়? যেসকল বেসরকারি ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে এবং বছরের আয়-ব্যয় হিসাবে মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু অতীতের মন্দ ঋণের কারণে প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে সেসব ব্যাংকের কর্মীরা প্রণোদনা বোনাস পেলে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কি ক্ষতি হবে?
সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এমন বিশেষ কী সৎকাজ করেছেন এবং বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা কী এমন তিরস্কারযোগ্য কাজ করলেন সেটা কোন প্যারামিটারে যাচাই করা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক সেটার কোন ব্যাখা দেয় নাই। সরকারি ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ প্রদান করা বা রিকভারির কাজে কর্মকর্তা কর্মচারিদের যে তৎপরতা রয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ করেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। সম্প্রতি পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণে প্রভিশন ঘাটতি। শুধুমাত্র জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা। একই ভাবে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, কৃষি এবং রাকাবেরও।
যেসব ব্যাংক বড় ধরণের প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে তাদের এ সমস্যার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমানভাবে দায়ী। খেলাপী গ্রাহকদের সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেছে। এখন তাদের সমস্যা থেকে উত্তরণের সহজ ব্যবস্থা না করে ব্যাংকারদের উপর আরো নিপীড়ণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো থেকে বড় বড় লুটেরা ব্যবসায়ী যেসব টাকা লুট করেছে সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য নিয়েই করেছে। এসব অপরাধে ব্যাংকাররা শাস্তি ভোগ করছেন কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তাকে এখনো পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা এসব অপকর্মে জড়িত ছিলেন তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা না হলে আগামীতে এ ধরণের অপরাধ আরো মহামারি আকার ধারণ করবে।
একাত্তর টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে “সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালি, কৃষি ও রাকাব- এই ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০১৯ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল মাত্র ৩১ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে জনতা ব্যাংক, যাদের মূলধন ঘাটতি একাই ৬৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এই বিপুল অঙ্কের বড়ো অংশই আটকে আছে বেক্সিমকো, এস আলম, অ্যাননটেক্সসহ শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে।” খবরে আরো বলা হয়েছে, ছয় ব্যাংক মিলিয়ে ৩২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি ডেফারেল সুবিধা নিয়ে সাময়িকভাবে আড়াল করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খানের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছে অল্প কিছু ব্যবসায়ী। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। এর জন্য সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোপূর্বেও এসব ব্যাংকে মূলধন যোগান দিয়েছিল সরকার। কিন্তু ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত যে নেতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে এই মুহূর্তে সরকারের মূলধন প্রদান করার সক্ষমতা নেই। এছাড়া এসব ব্যাংকে নতুন করে মূলধন দেয়ার নীতি থেকেও বেরিয়ে এসেছে সরকার। তাই ব্যাংক কর্মকর্তারাই এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, ঋণ বিতরণের পর যত ভালো গ্রাহকই হোক ঐ ঋণ তদারকি করা ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু ব্যাংকগুলো সে কাজ যথাযথভাবে পালন করেনি।
জুন পর্যন্ত ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট খেলাপির প্রায় এক-চতুর্থাংশ। শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক, যেখানে প্রতি ১০০ টাকার ঋণের ৭১ টাকা ঝুঁকিপূর্ণ। ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি হার প্রায় ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি ব্যাংকের খেলাপীর হার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় সবসময় বেশি।
প্রভিশন ঘাটতির সংকট নিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো মুনাফা না করে লস করলেও কর্মকর্তাদের জন্য প্রণোদনা বোনাস প্রদান করা হবে আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো মুনাফা করেও কর্মকর্তারা বোনাস পাবেন না। এ কেমন নীতি! ব্যাংকগুলোর যদি পর্যাপ্ত তারল্য থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ হবে এ ধরণের নিষেধজ্ঞা তুলে দিয়ে বোনাস প্রদানের বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উপর ছেড়ে দেয়া। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকারদের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করাই হবে সুবিচার।
তাছাড়া ব্যাংকগুলোর এই বিপুল খেলাপীর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় কোন অংশে কম নয়। ব্যাংকগুলোর রেগুলেটর হিসেবে এস আলম, বেক্সিমকো এবং অ্যাননটেক্সের মত বড় বড় খেলাপীরা যেন বেশি বেশি টাকা পাচার এবং অবৈধ বিনিয়োগ সুবিধা নিতে পারে সেজন্য সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট পরিবর্তন সহ নানাবিধ অবৈধ সুযোগ তৈরি করে দিতে বার বার নতুন নতুন আইন তৈরি করেছে এবং সার্কুলার দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেসরকারি ব্যাংকারদের উপর ছড়ি ঘুরানোর কোন সীমা পরিসীমা নাই। দেশের ব্যাংকখাতের এতবড় ঋণ খেলাপী ও প্রভিশন ঘাটতির সমান দায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রতি বছর ৫ থেকে ৮টি বোনাস ভোগ করেন কোন নৈতিক শক্তির বলে? বেসরকারি ব্যাংকারদের সুযোগ সুবিধা বন্ধ করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সুযোগ সুবিধা বন্ধ করতে হবে। অভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোনাস সবার শেষে নেয়া উচিত।
সুসাশন প্রতিষ্ঠার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার দিয়ে থাকে। কিন্তু এই বিভাজনমূলক সার্কুলারের ফলে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা আগামীতেও খেলাপী ঋণের বিষয়ে উদাসীন থাকবে। বাড়তে থাকবে খেলাপী ঋণ। ব্যংকারদের থাকবেনা কোন মাথা ব্যাথা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংক খাতের সুসাশন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়া অমূলক নয়। তাই এই সার্কুলার বাতিল করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রণোদনামূলক বোনাস ব্যাংকগুলোর উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম। আর একই সমস্যার দুই ধরণের সমাধান দিয়ে জটিলতা বৃদ্ধি না করে বেসরকারি ব্যাংকারদেরও বিশেষ উপায়ে প্রণোদনা বোনাসের আওতায় আনা হোক।
লেখক: জাওয়াদ কারীম, গবেষক
ইমেইল: karimjawad1979@gmail.com
এমকে
মত দ্বিমত
সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুতে বাংলা হারিয়েছিলাম, হাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফিরে পেতে চাই বাংলাদেশ
আমি হয় জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করব, নয় শহীদ হব। এটাই কি একজন নেতার পরিচয়? নবাব সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুর পর অসম্পূর্ণ বাংলা কি সত্যিই এমন একজন নেতার সন্ধান করছে? যদি করে থাকে, তাহলে আমরা হাদিকে পেয়েও কেন তাকে ধরে রাখতে পারলাম না? হাদি কি ভুল জগতে এসেছিল, নাকি অন্ধদের জগতে আয়না নিয়ে এসেছিল? আজ বাংলার আংশিক ভূখণ্ড বাংলাদেশ কি তার জবাব দিতে পারবে?
বাংলাদেশ কি মনে করছে হাদি হেরেছে? বাংলাদেশ কি একটুও হারেনি? আঠারো কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন কত মানুষের জীবন শেষ হয়। পরিবার ভেঙে পড়ে, কান্নায় চোখ ভিজে যায়। কিন্তু এবার একজন হাদির মৃত্যুতে খোদার আরশ কেঁদেছে। কারণ এ মৃত্যু সাধারণ নয়। এটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজীবন মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
হাদি আজ সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। পুরো বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমি নিজেও সেই সকাল থেকে নীরবতা পালন করছি। কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ হৃদয়ের গভীরে এক তীব্র উপলব্ধি নেমে এলো। ঠিক তখনই লিখতে বসেছি, হাদির স্মরণে।
নবাব সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে এক গভীর অন্ধকার নেমে আসে। তাঁর পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার রাজনৈতিক আত্মমর্যাদা ভেঙে পড়ে এবং স্বাধীন শাসনের শেষ স্তম্ভটি ধসে যায়। এই মৃত্যু ছিল কেবল একজন শাসকের অবসান নয়, বরং তৎকালীন বাংলার সার্বভৌমত্ব হারানোর সূচনাক্ষণ। এখানে বাংলা বলতে বোঝানো হয় সেই সময়ের সুবা বাংলা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উড়িষ্যার বিস্তৃত অঞ্চল। ক্ষমতার শূন্যতায় বিশ্বাসঘাতকতা ও লোভের দরজা খুলে যায়, আর সেই ফাঁক দিয়েই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে এই সমগ্র ভূঅঞ্চলের কর্তৃত্ব দখল করে নেয়। ফলশ্রুতিতে বাংলা হাতছাড়া হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনের অধীন এক পরাধীন ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
আমি সাত সাগর দেখেছি, আমি সাত আশ্চর্য দেখেছি, আমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। আমি শেখ পরিবারের পতন দেখেছি। আমি ওলফ পালমের মৃত্যু দেখেছি। আমি ২০১৯ সালের করোনা মহামারিতে লাখো মানুষের মৃত্যু দেখেছি। আমি ২০২৪ সালের গণহত্যার করুণ পরিণতি দেখেছি। আমি হাদিকে শহীদ হতে দেখলাম। কিন্তু আমি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হতে দেখিনি।
কারণ জানেন, আমরা পথভ্রষ্ট একটি জাতি। দুর্নীতি আর অকৃতজ্ঞতায় ডুবে থাকা এই সমাজ কি সত্যিই স্বাধীনতার সাধ গ্রহণ করার যোগ্য? এই প্রশ্ন আজও আমার বিবেককে জাগিয়ে রাখে। সেই জাগরণের মধ্যেই জন্ম নেয় আরেকটি প্রশ্ন। নবাব সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুর পর বাংলার সেই দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে?
আমার মনে আজ আরেকটি প্রশ্ন জাগে। সেই ১৯৪৭ সালে বাংলার একটি ভূখণ্ড, পূর্ব পাকিস্তান, কি ভারতের দয়ায় ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছিল? সেইজন্যই কি আজও আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার মর্যাদা পাইনি? কারণ বাংলাদেশ কেবল একটি মানচিত্র নয়। বাংলাদেশ একটি বিস্তৃত মানবভূমি, যেখানে ভুপেন হাজারিকার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মানুষের অভিন্ন আত্মার গান।
একই আশা, একই ভালোবাসা
কান্না হাসির একই ভাষা
দুঃখ সুখের বুকের মাঝে একই যন্ত্রণা
ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা
মেঘনা, যমুনা
গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা…
এই গান শুধু সুর নয়। এটি আমাদের অস্তিত্বের আর্তনাদ। আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা সবাই একই যন্ত্রণার সন্তান। অথচ সেই সত্যকে ভুলে গিয়ে আমরা যখন বিভক্ত হই, তখনই হাদির মতো মানুষ একা হয়ে আলো জ্বালাতে আসে।
হাদি হারেনি। হেরেছি আমরা। হাদির মৃত্যু কোনো পরাজয় নয়। এটি আমাদের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইতিহাস একদিন প্রশ্ন করবে, আমরা কি এমন একজন মানুষকে চিনতে পারিনি, না কি চিনেও বাঁচাতে চাইনি।
হাদি আজ নেই, কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের সামনে আয়নার মতো ধরে রেখেছে। সেই আয়নায় যদি আমরা নিজেদের বিকৃত মুখ দেখি, দায় নয় আয়নার, দায় আমাদের। হাদির স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন একটাই। আমরা কি সত্যিকারের স্বাধীন হতে চাই, নাকি শহীদের রক্ত দেখেও চুপ করে থাকার অভ্যাসটাই আমাদের নিয়তি হয়ে গেছে? ইতিহাস আমাদের শেখায়, একটি মৃত্যুর পরই কখনো কখনো একটি জাতি তার ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলে। নবাব সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুর পর আমরা বাংলা হারিয়েছিলাম। সেই হারানোর ক্ষত আজও শুকায়নি।
হাদির মৃত্যুর পর আর হারাতে চাই না। আর কোনো ভূমি নয়, আর কোনো আত্মা নয়, আর কোনো নেমকহারামি নয়, আর কোনো প্রাণ হানি নয়। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমি বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
নৈতিক ব্যবসা থেকে মানবকল্যাণভিত্তিক অর্থনীতি: বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা
বিশ্ব অর্থনীতি আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে নৈতিকতা এবং মানব কল্যাণ কোনো নৈতিক বিলাসিতা নয় বরং টেকসই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বাস্তবতা আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশটি সাম্প্রতিক দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও সেই অগ্রগতি দুর্নীতি, বৈষম্য, প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলের কারণে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মুখে।
গ্লোবাল অর্থনীতির প্রবাহ আজ নৈতিক বিনিয়োগ, স্বচ্ছতা, ডিজিটাল জবাবদিহি এবং মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। উন্নত বিশ্বের কর্পোরেট কাঠামো ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে যে মানব কল্যাণ, ন্যায্যতা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং কর্মীর প্রতি সম্মান শুধু দায়িত্ব নয় বরং অর্থনৈতিক সাফল্যের শক্তিশালী ভিত্তি। বাংলাদেশের পথচলা তাই স্পষ্ট। নৈতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা এবং মানবকল্যাণকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিতে পারলেই দেশ একটি স্থিতিশীল, সম্মানজনক এবং সমৃদ্ধ অবস্থানে পৌঁছাতে পারে।
এই লিখাটি সেই পথনকশা তুলে ধরে। এখানে গ্লোবাল বিজনেস পাসপেক্টিভকে ভিত্তি করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা পরিবেশ, দুর্নীতি কাঠামো, সিন্ডিকেট অর্থনীতি এবং মানব উন্নয়নের সব দিক সমন্বিতভাবে আলোচিত হয়েছে। লক্ষ্য একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা যেখানে অর্থনীতি মানুষের জন্য কাজ করবে এবং ব্যবসা হবে নৈতিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
বিশ্ব অর্থনীতি দ্রুত এমন এক রূপান্তর পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যেখানে ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে প্রযুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ এবং টেকসই উন্নয়ন। ডিজিটাল অর্থনীতির দ্রুত সম্প্রসারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতার নিয়ম এখন ব্যবসার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে।
বিশ্বের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, লিঙ্গ সমতা, কর্পোরেট জবাবদিহি এবং পরিচ্ছন্ন সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। একটি কোম্পানি কোথায়, কীভাবে এবং কোন নৈতিক প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন করে তা এখন বাজার নির্ধারণের অন্যতম উপাদান। ফলে নৈতিকতার অভাব সরাসরি বিনিয়োগ, ব্র্যান্ড ইমেজ এবং বাজার প্রতিযোগিতা কমিয়ে দিচ্ছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, যারা নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তারা শুধু মানুষের আস্থা অর্জন করে না বরং বৈশ্বিক বাজারে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার শক্তি অর্জন করে। বাংলাদেশের জন্য এই শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নৈতিক ব্যবসা বলতে শুধু সৎ প্রশাসন বোঝায় না। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো যা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক স্তরে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে। বিশ্বে স্বীকৃত নৈতিক ব্যবসার মানদণ্ডগুলো হলো-
দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন
স্বচ্ছ বিনিয়োগ ব্যবস্থা
ন্যায়সংগত বাজার প্রতিযোগিতা
শ্রমিক অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ
পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উৎপাদন
সামাজিক দায়বদ্ধতার অনুভূতি
উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহির চর্চা
লাভের সুষম বন্টন এবং কর্মীদের প্রতি ন্যায্যতা
যে প্রতিষ্ঠানগুলো এ মানদণ্ড অনুসরণ করে তারা স্থানীয় বাজারে এবং বৈশ্বিক বাজারে সবচেয়ে স্থিতিশীল হয়। নৈতিকতা সেখানে শুধু শোভাকর নয় বরং ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের শক্তিশালী অস্ত্র।
বাংলাদেশে আজ অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি এক কঠিন বাস্তবতা বিদ্যমান। জনসংখ্যা কাঠামো, যুব সম্ভাবনা এবং ডিজিটাল অগ্রগতির মতো বড় সুবিধা থাকলেও দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক অনিয়ম এবং অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
দেশের বাজার ব্যবস্থা প্রায় সব খাতেই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। কৃষিপণ্য থেকে বন্দর পরিচালনা, জ্বালানি থেকে আমদানি ব্যবসা, এমনকি শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য খাতেও এই অনিয়মের প্রভাব রয়েছে। ফলে ন্যায্যমূল্য, উৎপাদন ব্যয় এবং বাজার প্রবাহ সবই বিকৃত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, দক্ষতার অভাব, নৈতিকতা শিক্ষা অনুপস্থিতি এবং প্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞান ঘাটতি আগামী প্রজন্মকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে সুযোগ এখনও বিশাল। বাংলাদেশের জনগণের শক্তি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং তরুণ উদ্যোক্তা শ্রেণি একটি বৃহৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা এবং নৈতিক অর্থনৈতিক কাঠামো।
একটি দেশের ভবিষ্যৎ তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কাঠামোতে কয়েকটি মূল সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা দেশের উন্নয়নকে ধীর করে দিচ্ছে।
পাঠ্যবই এবং জ্ঞান কাঠামো বিশ্বমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মুখস্থ নির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি সীমাবদ্ধ করে।
নৈতিকতা চরিত্র গঠন রাজনীতি অর্থনীতি এবং গ্লোবাল ব্যবসা সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দুর্বল।
শিক্ষকের মান উন্নয়ন যথেষ্ট নয়।
ডিজিটাল এবং প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা পিছিয়ে।
উচ্চশিক্ষায় গবেষণা এবং উদ্ভাবনের পরিবেশ দুর্বল।
এই কাঠামো দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে হলে তাদের নৈতিকতা, সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং মানবকেন্দ্রিক নেতৃত্বের মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি নৈতিক ব্যবসা এবং মানবকল্যাণ ভিত্তিক উন্নয়ন মডেলে রূপান্তরিত হতে চায় তবে শিক্ষাব্যবস্থা হবে সেই ভিত্তি। শিক্ষা এবং অর্থনীতি একে অপরের সম্পূরক। তাই পাঠ্যক্রমে নৈতিক ব্যবসা, গ্লোবাল অর্থনীতি, ডিজিটাল দক্ষতা এবং মানবিক মূল্যবোধের বিস্তৃত অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য।
বাংলাদেশে সিন্ডিকেট অর্থনীতি নতুন নয়। এটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, দলীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে। এর প্রভাব ভয়ংকর।
কৃষি বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় উৎপাদক ন্যায্যমূল্য পায় না।
জ্বালানি বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বাড়ানো হয়।
আমদানি খাতে গোষ্ঠীভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত।
বন্দর ব্যবস্থাপনায় গোপন সমঝোতা ব্যবসার ব্যয় বাড়ায়।
সিন্ডিকেট স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে।
এই পরিস্থিতি শুধু বাজার ব্যাহত করে না বরং নৈতিক উদ্যোক্তা সংস্কৃতি ধ্বংস করে। নতুন উদ্যোক্তা বাজারে টিকতে পারে না, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারায়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে এবং পুরো অর্থনীতি একটি অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়ে।
নৈতিক ব্যবসার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এই সিন্ডিকেট এবং দুর্নীতির কাঠামো। তাই মানবকল্যাণ ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথম কাজ হচ্ছে এই অনৈতিক শক্তির শিকড় উপড়ে ফেলা, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা এবং রাষ্ট্র, ব্যবসা এবং নাগরিক সমাজের শক্তসমন্বিত ভূমিকা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে ব্যবসা পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু নীতি থাকা যথেষ্ট নয়। কার্যকর Institutional Framework এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি সরকারি খাত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংস্থা মিলিতভাবে দায়িত্ব নিলে দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের প্রভাব হ্রাস পাবে।
ডিজিটাল অডিটিং, স্বচ্ছ তথ্যপ্রকাশ, ব্যাংকিং ও ফিনটেক প্ল্যাটফর্মে লেনদেন, এবং স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ কাঠামোর মূল ভিত্তি। এই ব্যবস্থা প্রতিটি ব্যবসা লেনদেনকে ট্র্যাকযোগ্য করে তোলে এবং জনসাধারণ, সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করে।
সাথে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নৈতিক ও সাসটেইনেবল প্র্যাকটিসে উদ্বুদ্ধ করতে কর সুবিধা, প্রশিক্ষণ এবং বিনিয়োগ সহজলভ্য করা অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল ব্যবসায়িক পরিবেশকে শক্তিশালী করবে না, বরং জাতির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও দৃঢ় করবে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি, সিন্ডিকেট এবং প্রশাসনিক অনিয়মের মূল উৎস হলো ক্যাশ ভিত্তিক লেনদেন। ক্যাশের মাধ্যমে অডিট ট্রেইল নেই, লেনদেন সহজে লুকানো যায়। তাই ক্যাশের পরিবর্তে কার্ড সিস্টেম এবং ডিজিটাল পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য।
ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে প্রতিটি অর্থপ্রদানের রেকর্ড রাখা যায়। এটি ট্যাক্স ফাঁকি, অবৈধ কমিশন এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, হাটবাজার, কৃষি এবং সরকারি প্রকল্পে ডিজিটাল পেমেন্ট প্রবর্তন করলে জবাবদিহিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ডিজিটাল অর্থনীতি কেবল দুর্নীতি কমায় না, বরং বিদেশি বিনিয়োগ, নৈতিক ব্যবসা সংস্কৃতি, স্বচ্ছ বাজার এবং সামাজিক আস্থা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। এটি একটি ন্যাশনাল ইকোনমিক সিকিউরিটি ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে AI, অটোমেশন, ডেটা গভর্ন্যান্স এবং ডিজিটাল কমপ্লায়েন্সের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রযুক্তিগত রূপান্তরকে গ্রহণ করা জরুরি।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরবরাহ চেইন স্বচ্ছ করা, প্রতিটি লেনদেন মনিটর করা, উৎপাদন ও বিতরণ দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর্মী দক্ষতা উন্নয়ন করা সম্ভব। এছাড়া, ডিজিটাল উদ্ভাবন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে, সৃজনশীল ব্যবসা প্রবাহ বাড়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করে।
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। নৈতিক ব্যবসার মধ্যে পরিবেশগত দায়িত্ব সংযুক্ত করা ছাড়া কোনো টেকসই অর্থনীতি সম্ভব নয়।
সবুজ উৎপাদন, কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার এবং পরিবেশ বান্ধব শিল্পপ্রক্রিয়া গ্রহণ করলে দেশের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ইমেজ শক্তিশালী হবে।
টেকসই কৃষি ও পুনঃনবীকরণযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং দূরবর্তী অঞ্চলের জনগণও সমৃদ্ধিতে অংশ নেবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি হলো এসএমই খাত এবং কৃষি। নৈতিক ব্যবসা ও স্বচ্ছ বাজার নিশ্চিত করলে এসএমই দ্রুত সম্প্রসারণ পাবে।
কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে, গ্রামীণ উদ্যোক্তা স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে, নারী উদ্যোক্তা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারবে।
এসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল পেমেন্ট এবং টেকসই সরবরাহ চেইন কার্যকর হলে স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
নৈতিক ব্যবসার একটি প্রধান সুফল হলো সামাজিক ন্যায়বিচার। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন এবং শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা।
সকল স্তরে নৈতিকতার প্রভাব সমাজকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক করে তোলে। রাষ্ট্র ও ব্যবসা একযোগে কাজ করলে সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশের জন্য টেকসই ও নৈতিক অর্থনীতির রোডম্যাপ:
১. শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকীকরণ: নৈতিকতা, প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন
২. ডিজিটাল পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করা
৩. Institutional Framework শক্তিশালী: অডিটিং, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি
৪. টেকসই উৎপাদন এবং সবুজ অর্থনীতি সম্প্রসারণ
৫. এসএমই ও কৃষি খাতকে শক্তিশালী করা
৬. মানবকল্যাণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা
৭. আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তি গ্রহণ
৮. সিন্ডিকেট, ভেজাল ও দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা
এই রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে না, বরং নৈতিক, মানবিক এবং টেকসই রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মানের উদাহরণ হবে।
রহমান মৃধা, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
ওসমান হাদির মাথায় গুলি: গণতন্ত্রের মর্যাদা ও নাগরিক নিরাপত্তার পরীক্ষা
১২ ডিসেম্বর ২০২৫ দুপুর আনুমানিক ২টা ২৫ মিনিটে ঢাকা শহরের পল্টন ও বিজয়নগর এলাকার বক্স কালভার্ট রোডে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তিনি ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী।
ব্যাটারিচালিত রিকশায় চলাচলের সময় মোটরসাইকেলে থাকা দুই থেকে তিনজন সশস্ত্র হামলাকারী তাকে লক্ষ্য করে বারবার গুলি ছোড়ে। একটি গুলি তার মাথায় প্রবেশ করে বের হয়ে যায়, যার ফলে মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাত লাগে। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে আছেন।
• ওসমান হাদি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং একজন স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রার্থী।
• হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে এসে পরিকল্পিত ও লক্ষ্যভিত্তিকভাবে গুলি চালায়।
• ঘটনার সময় আশপাশে সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
• ঘটনার পর পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত ইউনিট এলাকাটি ঘিরে ফেলে।
• আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে এবং হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয়েছে।
• চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে গুলিটি বাম কানের ওপর দিয়ে মাথায় প্রবেশ করে ডান পাশে বের হয়ে গেছে।
• এর ফলে মস্তিষ্কের উভয় পাশে গুরুতর ক্ষতি হয়েছে।
• তাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসে রাখা হয়েছে।
• জরুরি ব্রেইন সার্জারি সম্পন্ন করা হয়েছে।
• তার অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন।
এই হামলার ঘটনা দ্রুতই একটি জাতীয় উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
• বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আক্রমণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
• সাধারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়েছে।
• নির্বাচনের একদিন পর এমন হামলা হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
• এই ঘটনার ফলে জনগণের মধ্যে ভয়, অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা আরও বেড়েছে।
মূল প্রশ্নটি এখন অত্যন্ত স্পষ্ট
গণতন্ত্র কি সকলের জন্য সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে?
• নির্বাচনের সময় সাধারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
• বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা থেকেই এমন লক্ষ্যভিত্তিক হামলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
• এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে।
• এই ঘটনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছে।
এটি স্পষ্ট যে গণতন্ত্রের আওতায় প্রত্যেক নাগরিক, প্রতিটি প্রার্থী ও সমর্থকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। আইন কিংবা রাজনীতির ঊর্ধ্বে মানুষের জীবন। নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড।
• ওসমান হাদি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হামলার শিকার হয়েছেন।
• এটি কেবল একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়। এটি জনজীবনের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর সতর্ক সংকেত।
• সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পর্যায়েই জনগণের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই।
• নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সামান্য ত্রুটিও জনআস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের কাছে আজ জাতির প্রশ্ন একটাই, আপনি কি সত্যিই একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে এসেছেন, নাকি পুরনো বৈষম্যের ওপর কেবল নতুন মুখ বসাতে।
গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ যদি হয় সকল নাগরিকের জন্য সমান নিরাপত্তা, সমান সুযোগ এবং সমান রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, তাহলে রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নিরাপত্তা বণ্টন গণতন্ত্র নয়। এটি ক্ষমতার পক্ষপাত।
ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা যদি বারবার ঘটে, যদি হুমকির কথা জানানোর পরও রাষ্ট্র নীরব থাকে, আর একই সময়ে নির্দিষ্ট একজন নেতার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে জনগণ যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলবে- এই সরকার আর আগের সরকারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোথায়। ইতিহাস আপনাকে বিচার করবে এই প্রশ্নে নয় যে আপনি কী বলেছিলেন, বরং এই প্রশ্নে যে আপনি কার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন আর কাকে অনিশ্চয়তার মুখে ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্র যদি নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে।
আজও সময় আছে। পক্ষপাত নয়, ন্যায়। ভীতি নয়, আস্থা। বিশেষ নিরাপত্তা নয়, সমান নিরাপত্তা।
এই পথেই কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একটি নিরাপদ বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আর একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা জরুরি। বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যদি সত্যিই আপনার প্রশাসন উপহার দিতে চায়, তবে শুধু কথা বললেই হবে না। Walk as you talk। আপনি যেমন বলেন, ঠিক তেমন করেই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিন এবং প্রমাণ করে দেখান।
অন্যথায়, শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব আপনাকে ক্ষমা করবে না। এটি কোনো হুমকি বা হুঁশিয়ারি নয়। এটি গণতন্ত্রের পক্ষে সত্য ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর হৃদয়ের কথা। এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কাউকে আঘাত করা নয়। উদ্দেশ্য একটাই ভুল পথে গেলে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি করা যাতে রাষ্ট্র সঠিক পথে চলতে পারে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং সবার স্বার্থেই গণতন্ত্র টিকে থাকে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
সাসপেকশন: একটি জাতির অদৃশ্য মহামারি
সন্দেহ কী? কেন সন্দেহ জন্মায়? আর এই সন্দেহের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র থেকে ভূরাজনীতি, সন্দেহ একসময় সবার ওপর ছায়া ফেলে। রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা কর্মী এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও এই সন্দেহ এমনভাবে ঢুকে যায় যে, তা একসময় একটি অদৃশ্য অস্ত্র হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন পুরো জাতি এক অদৃশ্য মহামারির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
আজকের পৃথিবীতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল শক্তি তথ্য নয়, বরং সন্দেহের ব্যবস্থাপনা। কূটনৈতিক নীতি, বিশেষ করে ভারতের র (রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং) তাদের নীতি নির্ধারণ করে মূলত কাকে সন্দেহ করা হবে এবং কীভাবে সেই সন্দেহকে সামাজিক মননে স্থায়ী আকার দেওয়া যাবে তার উপর ভিত্তি করে। ফলে এই অঞ্চলে সন্দেহ কেবল অনুভূতি নয়, বরং এক ধরণের স্ট্র্যাটেজি।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সন্দেহ এক অদৃশ্য ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে
সামাজিক বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে
রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল হচ্ছে
রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়ছে
এবং সবচেয়ে ভয়াবহ, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরির মতো পরিবেশ তৈরি হচ্ছে
একটি জাতি যখন বিশ্বাস হারায় তখন যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তার পরিণতি কেবল রাজনৈতিক নয়, রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের সংকট তৈরিরও ঝুঁকি তৈরি করে।
সদ্য আলোচিত ঘটনার প্রেক্ষিতে সন্দেহের বিস্তার
সম্প্রতি BMA (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) ৮৯তম লং কোর্সের ২০২৫ সালের প্রেসিডেন্টস প্যারেড এবং পাশিং আউট অনুষ্ঠানে সোর্ড অফ অনার প্রাপ্ত একজন ক্যাডেটকে কেন্দ্র করে আলোচনার উত্তাপ বেড়ে গেছে। এই প্যারেড ও পাশিং আউট অনুষ্ঠান বাস্তব; ভিডিও, সামাজিক মিডিয়া পোস্ট এবং BMA সম্পর্কিত পেজগুলোর রেকর্ডে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে উল্লেখযোগ্য যে, BMA বা সংশ্লিষ্ট অফিসিয়াল খবরে (সরকারি পৃষ্ঠা বা প্রধান সংবাদমাধ্যমের বিশ্বস্ত প্রতিবেদন) এখনও ওই ক্যাডেটকে ডিজিএফআই প্রধান (হামিদ) এর সন্তান হিসেবে পরিকল্পিতভাবে সোর্ড অফ অনার দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের তথ্য সরাসরি নিশ্চিত করা যায়নি। সমাজে বিষয়টি নিয়ে যে আলোচনা ও অভিযোগ রয়েছে, তা অনিরীক্ষিত সন্দেহ বা ছড়ানো গুজব হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
যদিও তার প্রতি দেয়া এই সর্বোচ্চ সম্মানকে অনেকেই দেখছেন বাবার রাজনৈতিক শক্তি, ব্যক্তিগত প্রভাব বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পক্ষপাতের ফল হিসেবে। যে কারণে সারা দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলছে, যার বাবা অভিযুক্ত, যার পরিবারের ওপর জনমনে সন্দেহের চাপ, সে কীভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান পেল?
এই প্রশ্নগুলো একদিনে তৈরি হয়নি। গুম খুন, পালিয়ে যাওয়া, বিদেশে আশ্রয় নেওয়া এই সব ইস্যু জনগণের মনে এমনিতেই সন্দেহ তৈরি করে রেখেছে। তাই নতুন করে এমন কোনও ঘটনা ঘটলে তা সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।
অতীতে তেমনই দেখা গেছে আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়
স্বৈরাচারী শাসনামলেও দেখা গেছে, কেউ রাজাকার বংশধর, কেউ ইসলামপন্থী পরিবার থেকে এসেছে, কেউ রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসী, এই যুক্তিতে বহু তরুণকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বহু যোগ্য মানুষকে আয়নাঘরে পাঠানো হয়েছে। এতে পুরো একটি প্রজন্মের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালানো হয়েছে।
ফলে আজ যখন দেখা যাচ্ছে যে পূর্বের বিতর্কিত জেনারেলদের সন্তানরা আবারো সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসছে বা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পাচ্ছে, তখন সমাজে স্বাভাবিকভাবেই একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে, অতীতে যেমন প্রতিহিংসা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও একই প্রতিহিংসা ফিরে আসবে।
এই ভয়টাই মানুষকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে। কারণ দেশের তরুণেরা যদি একদিন নেতৃত্বের জায়গায় আসে, তারা কি এই ইতিহাস ভুলে যাবে? নাকি সেই পুরোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা আবারো রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করবে?
তাহলে করণীয় কী?
প্রথমত সন্দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন তিনটি জিনিস
১. স্বচ্ছতা
২. জবাবদিহিতা
৩. প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা
দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে
মেধা এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন যেন ব্যক্তির পরিবার, বংশ, ইতিহাস বা রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে হয়।
তৃতীয়ত প্রয়োজন জনবিশ্বাস পুনঃস্থাপন।
বিশ্বাস ভেঙে গেলে ক্ষমতা বা শক্তি দিয়ে তা পুনর্গঠন সম্ভব নয়।
শুধুমাত্র সত্য, বিচার এবং ন্যায় দিয়ে জাতিকে শান্ত করা যায়।
সারমর্ম
এক কথায় বলতে গেলে;
সন্দেহ আমাদের সময়ের নীরব মহামারি।
এটি ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব জায়গায়
ঢুকে পড়েছে।
গোয়েন্দা নীতি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং অতীতের প্রতিহিংসার কারণে এই সন্দেহ আরও তীব্র হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সোর্ড অফ অনারের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাদের সমাজ এখনও ন্যায় এবং যোগ্যতার চেয়ে সন্দেহ এবং ক্ষমতার প্রতি বেশি সংবেদনশীল।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে কেবল সেনাবাহিনী নয়, পুরো জাতি একটি অবিশ্বাসের গহ্বরে পড়ে যাবে।
তাই আজ সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো সত্য উন্মোচন করা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলোকে একেবারে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা।
সন্দেহকে থামানোর একমাত্র উপায় সত্য আর ন্যায়ের শক্তি।
অন্যথায় এই মহামারি ভেঙে দেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে, ভেঙে দেবে আমাদের রাষ্ট্রকে, ভেঙে দেবে আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com




