অর্থনীতি
৭২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইন যেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প

রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ ও পুরোনো লাইন সংস্কারে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করার সময় বলা হয়েছিল, এই রেললাইন দিয়ে দিনে ১৪টি ট্রেন চলাচল করবে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এই রেলপথ উদ্বোধন করেন। এখন এই পথে ট্রেন চলছে মাত্র দুটি।
রাজবাড়ী-গোপালগঞ্জের মতো ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মিত আটটি রেললাইন সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাকি সাতটি রেললাইন হলো পাবনা–ঢালারচর, কুমিল্লার লাকসাম–চিনকি আস্তানা (চট্টগ্রামের কাছে), চট্টগ্রামের দোহাজারী–কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া–কুমিল্লার লাকসাম, খুলনা–মোংলা, আখাউড়া–আগরতলা (ভারত) এবং পদ্মা রেলসংযোগ (ঢাকা থেকে যশোর)। এগুলো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল কম। ফলে রেললাইনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘সাদা হাতি’।
‘সাদা হাতি’ বাগ্ধারাটি দিয়ে বোঝানো হয়, যার পেছনে প্রচুর ব্যয় হয়, কিন্তু সুফল পাওয়া যায় না। থাইল্যান্ডে রাজারা সাদা হাতি পুষতেন। প্রাণীটিকে ধরা হতো পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে। সাদা হাতি দিয়ে কোনো কাজ করানো নিষিদ্ধ ছিল। রাজারা কারও ওপর নাখোশ হলে তাঁকে বিপাকে ফেলতে সাদা হাতি উপহার দিতেন। উপহার পাওয়া ব্যক্তি সাদা হাতি পুষতে গিয়ে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়তেন।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই সব প্রকল্পের কোনোটি নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী কোনো দেশের পরামর্শে, কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায়। এখন প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার যে ১৮ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ রেখে গেছে, তার একটি অংশ দিয়ে এমন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।
রেললাইন প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় ও মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই আট প্রকল্পের ছয়টি বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল চীনের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পাঁচটিতে তাদের অংশীদার ছিল বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। দুটিতে কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদার।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ ও তমা কনস্ট্রাকশন।
সূত্র বলছে, মূলত বাংলাদেশি প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা কাজ পাওয়ার যোগ্যতা বাড়াতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রাখেন। কাজ পাওয়া এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় ঠিকাদারেরাই মূল ভূমিকা পালন করেন। একমাত্র পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার মূল ভূমিকায় ছিল।
প্রতিযোগিতা করে বেশি কাজ পাওয়া দোষের কিছু নয় বলে দাবি করেন তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান। মুঠোফোনে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, মির্জা আজম তাঁর প্রতিষ্ঠানের অংশীদার নন। তবে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। ঘনিষ্ঠতার কারণে মানুষ অপপ্রচার করে।
অবশ্য রেল, সড়ক, নৌসহ বিভিন্ন খাতে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তমা কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা বেশি কাজ পেত।
রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া
রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া রুটে ৭৮ কিলোমিটার পুরোনো রেললাইন সংস্কার এবং ৪৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ মেইন ও ৮ কিলোমিটার শাখা লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০১০ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। কাজ শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর পর, ২০১৮ সালে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শেখ হাসিনার ইচ্ছায় কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এই পথে নতুন রেলপথ, সেতু ও স্টেশন ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণের মূল কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার আগ্রহে ফরিদপুরের মধুখালী থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এটিও নেওয়া হয়েছে সমীক্ষা ছাড়া। ব্যয় ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ ও বাংলাদেশের ক্যাসল কনস্ট্রাকশন।
ক্যাসল কনস্ট্রাকশন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ২০১০ সালে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। যদিও ২০১৮ সালে রেললাইনটির কাজ শেষ হয়। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৮৩ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকায়। এ পথে রেললাইন নির্মাণে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয়নি। উদ্বোধনের পর দুই বছর রেললাইনটি দিয়ে কোনো ট্রেনই চলেনি। ২০২০ সালে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ নামে এক জোড়া ট্রেন চালু করা হয়। ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত চলে। যদিও চলার কথা ছিল ১০টি ট্রেন।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত এ কে খোন্দকারের আগ্রহে। তাঁর বাড়ি পাবনায়। এই প্রকল্পে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা অংশের কাজ করে ম্যাক্স গ্রুপ। পাবনা থেকে ঢালারচর অংশের ঠিকাদার ছিল মীর আক্তার ও ভারতের র্যানকেন (যৌথ)।
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছর রেলপথটির একাংশ চালু হয়েছে। আগামী নভেম্বরে পুরোটাই চালু হওয়ার কথা।
প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নতুন এই রেলপথ চালু হলে প্রতিদিন ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। গত নভেম্বর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এখন এই পথে ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। আগামী নভেম্বরে যশোর পর্যন্ত চালু হলে কিছু যাত্রীবাহী ও দু-একটি মালবাহী ট্রেন চালুর পরিকল্পনা আছে রেলের। তবে জনবলের অভাব, ইঞ্জিনের সংকটসহ নানা কারণে তা কতটা সম্ভব—এ বিষয়ে নিশ্চিত নন রেলের কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা (৪৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার)। চীনের সঙ্গে জিটুজি (দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে) পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। চীনা সরকার দিচ্ছে ২৬৭ কোটি ডলার (মোট ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ)।
পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। চায়না রেলওয়ে গ্রুপকে ঠিক করে দেয় সে দেশের সরকার। ঠিকাদারের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ব্যয় নির্ধারণ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এই প্রকল্প নিয়ে বড় অভিযোগ, প্রতিযোগিতা না থাকায় নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি পড়েছে।
যোগাযোগ-পরিবহন খাতে নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা তথ্যভান্ডার এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুক (এটিও) অনুযায়ী, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৬৪ লাখ পিপিপি (ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ডলার। ভারত, মালয়েশিয়া ও চীনের কয়েকটি রেলপথের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি। ২০১৬ সালে পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত একটি রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু করে ভারত। ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডর নামের এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫৩৪ কিলোমিটার। এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুকের হিসাব অনুসারে, রেলপথটির কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় মাত্র প্রায় ৯৩ লাখ ডলার। পদ্মা সেতুর রেলসংযোগে কিলোমিটারপ্রতি এর আট গুণ ব্যয় পড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি লাভজনক হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এটির চেয়েও বেশি ব্যয় করে নেওয়া পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পটি সাদা হাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে।
রেলপথ নির্মাণে বেশি ব্যয় ও বিপুল বিনিয়োগ করার পরও সুফল না পাওয়ার বিষয়টি জেনেছেন বলে উল্লেখ করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, ভবিষ্যতে যেনতেনভাবে কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট হয়েছে। এর প্রতিটি প্রকল্পের তদন্ত করা হবে।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বরে নতুন এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারে দুটি ট্রেন চারবার আসা-যাওয়া করে। এর বাইরে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রেন দুবার আসা-যাওয়া করে। তবে সেটি নিয়মিত নয়।
অথচ প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সারা দেশ থেকে কক্সবাজারে যত পর্যটক যান, এর অন্তত ৫০ শতাংশ পাবে রেল। চালুর প্রথম বছরই যাত্রী পরিবহন করে ৩৯২ কোটি টাকা ও পণ্য পরিবহন করে ৫০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুমধুম গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লক্ষ্য ছিল চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হওয়া। কিন্তু মিয়ানমারের অনাগ্রহে কক্সবাজার থেকে বাকি ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন করে আয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
এই রেলপথের কাজ দুই ভাগে বিভক্ত করে ঠিকদার নিয়োগ দেওয়া হয়। দোহাজারী-চকরিয়া অংশের কাজ করে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ও বাংলাদেশের তমা গ্রুপ। চকরিয়া-রামু-কক্সবাজার অংশের কাজ করেছে চায়না সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
খুলনা–মোংলা ও আখাউড়া–আগরতলা
ভারতীয় ঋণে খুলনা থেকে মোংলা এবং আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত দুটি নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। গত বছর ১ নভেম্বর দুটি রেলপথ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বোধনের ছয় মাস পর গত মে মাসে খুলনা-মোংলা পথে একটি ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আখাউড়া-আগরতলা ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
অথচ ২০১০ সালে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা–মোংলা রেললাইন প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, মোংলা বন্দরকে রেলসংযোগের আওতায় আনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে ‘নীরব বিপ্লব সাধিত হবে’। তিন বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। লেগেছে ১৩ বছর। পাঁচবার প্রকল্প প্রস্তাবে সংশোধন আনার পর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, খুলনা-মোংলা ও আখাউড়া-আগরতলা রুটে রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প দুটি নেওয়া হয়েছে ভারতের আগ্রহে। প্রকল্পে তাদের পরামর্শক ও ঠিকাদারেরা কাজ করেছে। মালামালও বেশির ভাগ ভারত থেকে এসেছে।
‘মানুষের লাভ হয়নি’
রেলের এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত সৈয়দ আবুল হোসেন, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজন। তাঁরা রেলকে লাভে আনতে পারেননি, সেবার মানেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেল লোকসান দিয়েছে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। ওবায়দুল কাদের, মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজন এখন আত্মগোপনে। মুঠোফোনে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, রেলের অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ঠিকাদারতাড়িত (ড্রিভেন)। ফলে এখানে লাভ–লোকসান কিংবা জনগণের জন্য কতটা উপযোগী, সেই প্রশ্ন শুরুতেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এতে রাজনীতিক ও ঠিকাদারদের দুষ্টচক্র লাভবান হয়েছে। মানুষের লাভ হয়নি।

অর্থনীতি
স্বল্প-কার্বন চাল উৎপাদনে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এডিবি

গেটস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং সিজিআইএআর আজ (সোমবার) একটি নতুন উদ্যোগ চালু করেছে। যা স্থায়ী এবং স্বল্প-কার্বন নির্গমনভিত্তিক চাল উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চিন, পাকিস্তান এবং ফিলিপাইনে এ চালের উৎপাদন বাড়াতে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এশিয়া এবং প্যাসিফিকের লাখ লাখ দুর্বল ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের জীবন উন্নত করতেও এটি সহায়তা করবে।
সোমবার (৯ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় এডিবি।
ভাত এই অঞ্চলের জীবনরেখা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এটি প্রতিদিন এই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষের খাবারের চাহিদা মেটায় এবং মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জীবিকার ভিত্তি। তবে ধান চাষ বাড়তি চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়া এবং জল সম্পদের সংস্থাপন থেকে শুরু করে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান করা না হলে, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সবচেয়ে দরিদ্র এবং ঝুঁকিতে থাকা সম্প্রদায়গুলোর উন্নয়নকে বিপদে ফেলবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ধান এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। এটি এই অঞ্চলের ক্যালরির এক চতুর্থাংশেরও বেশি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রয়োজনীয় ক্যালরির অর্ধেকের চাহিদা মেটায়। শত শত মিলিয়ন ছোট কৃষকের জন্য, ধান শুধুমাত্র খাদ্য নয়, এটি তাদের জীবিকা নির্বাহের উৎস।
এডিবির সহ সভাপতি ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, আজ সেই জীবিকা ক্রমবর্ধমানভাবে চরম আবহাওয়া এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে হুমকির মুখে। গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে অর্থায়িত নবনির্মিত এডিবি–সিজিআইএআর ক্লিয়ারিং হাউজ ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে এই উদ্যোগটি অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র জনগণের জন্য টেকসই পানি ব্যবহার, অন্তর্বর্তী মূল্য শৃঙ্খল এবং উন্নত পুষ্টির সঙ্গে স্থিতিস্থাপক, উচ্চ ফলনশীল এবং নিম্ন-নিষ্ক্রিয় কৃষি অনুশীলনকে উৎসাহিত করবে।
এডিবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এডিবি ২০২৫-২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে যা টেকসই উপায়ে উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন করতে, কঠোর জলবায়ু পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং পানি ও কার্বনের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরের জন্য এডিবির ৪০ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তর প্রতিশ্রুতির একটি অংশ, যা মে মাসে ঘোষণা করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক চাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইআরআরআই) এর ডিরেক্টর জেনারেল ইয়ভন পিন্টো বলেন, এই যৌথ উদ্যোগটি এডিবির সঙ্গে সিজিআইএআর এর কৌশলগত সহযোগিতাকে আরও জোরদার করবে।
তিনি বলেন, এডিবি এবং গেটস ফাউন্ডেশনসহ অংশীদারদের সঙ্গে আমরা এশিয়ার চাল খাতের টেকসই এবং স্থিতিস্থাপক রূপান্তর করতে পারি এবং বর্তমানে ও ভবিষ্যতে লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষকের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারি।
অর্থনীতি
দেরিতে লবণ দেওয়ায় চামড়ার কাঙ্ক্ষিত দাম মেলেনি: শিল্প উপদেষ্টা

চলতি বছরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে দেরিতে লবণ সরবরাহকেই দায়ী করছেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
সোমবার (৯ জুন) ঈদের দুই দিন পর সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শনে যান শিল্প উপদেষ্টা। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
আদিলুর রহমান খান বলেন, চামড়ায় দেরিতে লবণ দেওয়ার কারণে চলতি বছর কোরবানির পশুর চামড়ায় অনেকে কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি। তবে লবণজাত চামড়ার দর ঠিকই আছে। সরকার তৎপর ছিল বলেই এ বছর খুব কম সংখ্যক চামড়া নষ্ট হয়েছে।
চামড়ার দাম কমার বিষয়ে আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও সিন্ডিকেটের অভিযোগ উঠার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি জানান, চামড়া শিল্পের সুরক্ষায় সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। চলতি বছর ৩০ হাজার টন লবণ বিতরণ করা হয়েছে।
ল্যাম্পি স্কিন রোগের কারণে চলতি বছর ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে বলেও উল্লেখ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
এদিকে গত বছরের তুলনায় এবার কাঁচা চামড়ার দাম বেশি বলে দাবি করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। রোববার (০৮ জুন) রাজধানীতে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছিলাম লবণসহ। ৭০০-৮০০ টাকায় চামড়া বিক্রি হচ্ছে। কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া নিয়ে আধা পচা করে ফেলছে। এই আধা পচা চামড়া এই দামে বিক্রি হওয়া অনেক বেশি। যেটা ভালো চামড়া সেটা এক হাজার দুশ থেকে এক হাজার তিনশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লবণ দেওয়া চামড়া সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সোশ্যাল ও মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় চামড়ার দাম নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে চামড়ার বাজারে ধস নামানোর পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। সেখানে গরু-ছাগলসহ কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার পশু। চলতি বছর কোরবানির ঈদের মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ট্যানারি মালিকরা।
অর্থনীতি
ব্যাংক খাতে কমেছে কোটিপতি গ্রাহকের সংখ্যা

দেশের ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা গ্রাহকের সংখ্যা কমে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা গ্রাহকের সংখ্যা ছিল এক লাখ ২২ হাজার ৮১টি। চলতি বছরের মার্চ শেষে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৩৬২টিতে। অর্থাৎ, তিন মাসে ৭১৯টি হিসাব কমেছে।
কোটি টাকার গ্রাহকের সংখ্যা কমার কারণ হিসেবে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ ধরনের পরিবর্তনের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। বিশেষ করে, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে কিছু বিত্তশালী ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব তলব ও জব্দ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সাবেক এমপি, মন্ত্রী এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবও অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে অনেক বড় আমানতকারী গ্রাহক তাদের অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন।
এ ছাড়া বেশ কিছু বড় প্রতিষ্ঠানও তাদের ব্যাংক হিসাব কমিয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে প্রতিষ্ঠানের হিসাব সংখ্যা বেড়ে গেলেও এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকার কারণে একক হিসাবের সংখ্যা কমতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাব আছে। পাশাপাশি অনেক সরকারি সংস্থারও কোটি টাকার হিসাব রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কোটি টাকার হিসাবধারী গ্রাহকের সংখ্যা কমলেও এসব অ্যাকাউন্টে জমা টাকার পরিমাণ বেড়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব অ্যাকাউন্টে জমা ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মার্চ শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা।
এ ছাড়া আলোচিত সময় ব্যাংক খাতে মোট হিসাবের সংখ্যা ও জমার পরিমাণ দুটোই বেড়েছে।
ব্যাংক খাতে মোট অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সংখ্যা ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩২টি। এসব হিসাবে মোট আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬ হাজার ৮২১টি। এসব হিসাবে মোট আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট হিসাব ছিল ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩২টি। এসব হিসাবে মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটি টাকা আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর বেড়ে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯৭৬টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় এক লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টিতে। গত বছরের জুনে এমন হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টিতে, সেপ্টেম্বরে এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭টিতে এবং ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ২২ হাজার ৮১টিতে।
অর্থনীতি
প্রবাসী আয়ের শীর্ষে ঢাকা, পিছিয়ে লালমনিরহাট

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে দুই হাজার ৭৫০ কোটি ৬৩ লাখ ডলার প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ঢাকা জেলায়, ৯২৬ কোটি ১৩ লাখ ডলার। আর সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে লালমনিরহাটে, মাত্র ২ কোটি ৪১ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জেলাভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্য থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে বরাবরের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোয় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি। আর রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে সবচেয়ে কম।
বিভাগভিত্তিক তথ্যে দেখা যায়, গত জুলাই-মে সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ঢাকা বিভাগে, যা মোট রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ। এরপর রয়েছে চট্টগ্রামে ২৭ শতাংশ, সিলেটে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ, খুলনায় ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ ও বরিশালে প্রায় ৩ শতাংশ। আর মোট রেমিট্যান্সের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে দুই বিভাগে– রংপুরে ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ঢাকা জেলায়। এরপর রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও নোয়াখালী জেলার অবস্থান। জুলাই-মে সময়ে ঢাকা জেলায় ২১৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, চট্টগ্রাম জেলায় ২২৫ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এ ছাড়া কুমিল্লায় ১৪৪ কোটি, সিলেটে ১২৫ কোটি ও নোয়াখালী জেলায় ৮৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে।
কম রেমিট্যান্সের আসছে যেসব জেলায়
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে প্রবাসী আয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে লালমনিরহাট জেলা। এই জেলায় আলোচিত সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে মাত্র দুই কোটি ৪১ লাখ ডলার। প্রবাসী আয় কম আসার তালিকায় অপর চারটি জেলা হলো– রাঙামাটি, বান্দরবান, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও। রাঙামাটিতে দুই কোটি ৪৬ লাখ, বান্দরবানে দুই কোটি ৪৮ লাখ ডলার, পঞ্চগড়ে ৩ কোটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে এবং আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নভেম্বরে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ ডলার, মার্চে ৩২৯ কোটি ডলার, এপ্রিলে ২৭৫ কোটি ডলার এবং মে মাসে ২৯৭ কোটি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অর্থাৎ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা ৮ মাসে দুই বিলিয়ন এবং মার্চে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে।
অর্থনীতি
সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না চামড়া, হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

রাজধানীতে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না কাঁচা চামড়া। প্রতিবারের মতো এবারও ঢাকায় কোরবানির গরুর কাঁচা চামড়া মানভেদে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এ ছাড়া বরাবরের মতো ছাগলের চামড়ায় আগ্রহ নেই ব্যাপারিদের।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সায়েন্সল্যাব ও পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায় ঘুরে ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এ বছর বেশির ভাগ গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ছোট চামড়ার দাম ৬০০ টাকা পর্যন্ত উঠছে। গত বছরও গরুর কাঁচা চামড়ার এ রকম দাম ছিল। এ ছাড়া এবার ছাগলের চামড়া প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ১০ টাকা, যা গতবারও একই রকম ছিল।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। সেখানে গরু-ছাগলসহ কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার পশু। চলতি বছর কোরবানির ঈদের মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ট্যানারিমালিকেরা।
গত ২৬ মে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০-৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। এ ছাড়া ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। আজ বিকেল চারটার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রিকশা, ভ্যান ও ট্রাকে করে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মাদ্রাসার কর্মকর্তারা চামড়া নিয়ে আসছেন। আড়তদারেরা দরদাম করে চামড়া কিনছেন। এ ছাড়া পাইকারি ব্যবসায়ীরা সড়কের ওপর চেয়ার নিয়ে বসে চামড়া কিনছেন।
একাধিক আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, একেকটি গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনছেন। মাঝারি আকারের গরু কোরবানি হয় বেশি। সেই চামড়া তাঁরা কিনছেন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে।
পোস্তায় শহীদুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে চামড়া কিনছিলেন। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত শতাধিক চামড়া কিনেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা না বুঝে বেশি দামে চামড়া কিনে নিয়ে আসেন। তবে বাজার ভালো নয়। তিনি জানান, ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় চামড়া কিনছেন তাঁরা।
চামড়া কেনায় তদারকি করছিলেন সুমন অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মো. শরীফ। তিনি জানান, প্রতিটি গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনছেন। তাঁর ভাষ্য, একেকটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ পড়ে যাবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। বাজার মন্দা, সে জন্য গতবারের চেয়ে কিছুটা কমে কিনছেন।
বিকেলে রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে গরুর ১৩টি কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় নিয়ে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী কাউছার আহমেদ। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে এসব চামড়া তিনি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে কিনে আনেন এবং বিক্রির জন্য দাম হাঁকেন ১ হাজার ২০০ টাকা করে। কিন্তু কোনো আড়তদার বা ট্যানারি প্রতিষ্ঠান ৭৫০ টাকার ওপরে দাম দিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত ৭৫০ টাকা দরেই সবগুলো চামড়া বিক্রি করেন তিনি।
কাউছার আহমেদ বলেন, যে আকারের চামড়া বিক্রির জন্য তিনি নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। কিন্তু একপ্রকার লোকসান করেই চামড়া বিক্রি করতে হলো। সারা দিনের ভ্যান ভাড়া ও একজন সহকারীর মজুরি দিয়ে তাঁর কাছে আর কিছু থাকবে না।
সায়েন্স ল্যাব এলাকাতেই মৌসুমি বিক্রেতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে রাখছিলেন কালাম ব্রাদার্স ট্যানারির পরিচালক সাজেদুল খায়ের। চলতি বছর এই ট্যানারিটির এক দেড় লাখ লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য আছে। পাশাপাশি কোরবানি ঈদের দুই দিনে তারা অন্তত ১০ হাজারের মতো কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করবে।
সাজেদুল খায়ের বলেন, আজকে মৌসুমি বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে বেশির ভাগ গরুর চামড়া কিনেছেন। তাঁদের হিসাবে, গত বছরের তুলনায় প্রতিটি গরুর চামড়ায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা বাড়তি দাম পাওয়া যাচ্ছে।
খুব বড় আকারের চামড়া দেড় হাজার টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে। যেমন রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় আজ দুপুরে চামড়া কিনছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সকাল থেকে তিনি ৬০টির বেশি চামড়া কিনেছেন। ৩২ লাখ টাকায় কেনা দুটি গরুর চামড়া তিনি মোট তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন। অর্থাৎ প্রতিটির দাম পড়েছে দেড় হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এ বছর ছোট গরুর চামড়া বেশি। তবে সার্বিকভাবে চামড়ার সরবরাহ ভালো। তাঁদের হিসাবে, গত বছরের তুলনায় প্রতিটি চামড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দাম রয়েছে। তিনি জানান, চলতি বছর ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো পাঁচ থেকে ছয় লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে। মূলত কাঁচা চামড়ার দাম তথা বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কাঁচা চামড়া কিনে থাকে।