অর্থনীতি
৭২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইন যেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প
রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ ও পুরোনো লাইন সংস্কারে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করার সময় বলা হয়েছিল, এই রেললাইন দিয়ে দিনে ১৪টি ট্রেন চলাচল করবে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এই রেলপথ উদ্বোধন করেন। এখন এই পথে ট্রেন চলছে মাত্র দুটি।
রাজবাড়ী-গোপালগঞ্জের মতো ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মিত আটটি রেললাইন সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাকি সাতটি রেললাইন হলো পাবনা–ঢালারচর, কুমিল্লার লাকসাম–চিনকি আস্তানা (চট্টগ্রামের কাছে), চট্টগ্রামের দোহাজারী–কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া–কুমিল্লার লাকসাম, খুলনা–মোংলা, আখাউড়া–আগরতলা (ভারত) এবং পদ্মা রেলসংযোগ (ঢাকা থেকে যশোর)। এগুলো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল কম। ফলে রেললাইনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘সাদা হাতি’।
‘সাদা হাতি’ বাগ্ধারাটি দিয়ে বোঝানো হয়, যার পেছনে প্রচুর ব্যয় হয়, কিন্তু সুফল পাওয়া যায় না। থাইল্যান্ডে রাজারা সাদা হাতি পুষতেন। প্রাণীটিকে ধরা হতো পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে। সাদা হাতি দিয়ে কোনো কাজ করানো নিষিদ্ধ ছিল। রাজারা কারও ওপর নাখোশ হলে তাঁকে বিপাকে ফেলতে সাদা হাতি উপহার দিতেন। উপহার পাওয়া ব্যক্তি সাদা হাতি পুষতে গিয়ে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়তেন।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই সব প্রকল্পের কোনোটি নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী কোনো দেশের পরামর্শে, কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায়। এখন প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার যে ১৮ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ রেখে গেছে, তার একটি অংশ দিয়ে এমন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।
রেললাইন প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় ও মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই আট প্রকল্পের ছয়টি বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল চীনের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পাঁচটিতে তাদের অংশীদার ছিল বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। দুটিতে কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদার।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ ও তমা কনস্ট্রাকশন।
সূত্র বলছে, মূলত বাংলাদেশি প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা কাজ পাওয়ার যোগ্যতা বাড়াতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রাখেন। কাজ পাওয়া এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় ঠিকাদারেরাই মূল ভূমিকা পালন করেন। একমাত্র পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার মূল ভূমিকায় ছিল।
প্রতিযোগিতা করে বেশি কাজ পাওয়া দোষের কিছু নয় বলে দাবি করেন তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান। মুঠোফোনে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, মির্জা আজম তাঁর প্রতিষ্ঠানের অংশীদার নন। তবে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। ঘনিষ্ঠতার কারণে মানুষ অপপ্রচার করে।
অবশ্য রেল, সড়ক, নৌসহ বিভিন্ন খাতে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তমা কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা বেশি কাজ পেত।
রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া
রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া রুটে ৭৮ কিলোমিটার পুরোনো রেললাইন সংস্কার এবং ৪৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ মেইন ও ৮ কিলোমিটার শাখা লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০১০ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। কাজ শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর পর, ২০১৮ সালে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শেখ হাসিনার ইচ্ছায় কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এই পথে নতুন রেলপথ, সেতু ও স্টেশন ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণের মূল কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার আগ্রহে ফরিদপুরের মধুখালী থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এটিও নেওয়া হয়েছে সমীক্ষা ছাড়া। ব্যয় ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ ও বাংলাদেশের ক্যাসল কনস্ট্রাকশন।
ক্যাসল কনস্ট্রাকশন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ২০১০ সালে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। যদিও ২০১৮ সালে রেললাইনটির কাজ শেষ হয়। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৮৩ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকায়। এ পথে রেললাইন নির্মাণে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয়নি। উদ্বোধনের পর দুই বছর রেললাইনটি দিয়ে কোনো ট্রেনই চলেনি। ২০২০ সালে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ নামে এক জোড়া ট্রেন চালু করা হয়। ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত চলে। যদিও চলার কথা ছিল ১০টি ট্রেন।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত এ কে খোন্দকারের আগ্রহে। তাঁর বাড়ি পাবনায়। এই প্রকল্পে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা অংশের কাজ করে ম্যাক্স গ্রুপ। পাবনা থেকে ঢালারচর অংশের ঠিকাদার ছিল মীর আক্তার ও ভারতের র্যানকেন (যৌথ)।
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছর রেলপথটির একাংশ চালু হয়েছে। আগামী নভেম্বরে পুরোটাই চালু হওয়ার কথা।
প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নতুন এই রেলপথ চালু হলে প্রতিদিন ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। গত নভেম্বর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এখন এই পথে ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। আগামী নভেম্বরে যশোর পর্যন্ত চালু হলে কিছু যাত্রীবাহী ও দু-একটি মালবাহী ট্রেন চালুর পরিকল্পনা আছে রেলের। তবে জনবলের অভাব, ইঞ্জিনের সংকটসহ নানা কারণে তা কতটা সম্ভব—এ বিষয়ে নিশ্চিত নন রেলের কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা (৪৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার)। চীনের সঙ্গে জিটুজি (দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে) পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। চীনা সরকার দিচ্ছে ২৬৭ কোটি ডলার (মোট ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ)।
পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। চায়না রেলওয়ে গ্রুপকে ঠিক করে দেয় সে দেশের সরকার। ঠিকাদারের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ব্যয় নির্ধারণ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এই প্রকল্প নিয়ে বড় অভিযোগ, প্রতিযোগিতা না থাকায় নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি পড়েছে।
যোগাযোগ-পরিবহন খাতে নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা তথ্যভান্ডার এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুক (এটিও) অনুযায়ী, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৬৪ লাখ পিপিপি (ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ডলার। ভারত, মালয়েশিয়া ও চীনের কয়েকটি রেলপথের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি। ২০১৬ সালে পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত একটি রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু করে ভারত। ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডর নামের এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫৩৪ কিলোমিটার। এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুকের হিসাব অনুসারে, রেলপথটির কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় মাত্র প্রায় ৯৩ লাখ ডলার। পদ্মা সেতুর রেলসংযোগে কিলোমিটারপ্রতি এর আট গুণ ব্যয় পড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি লাভজনক হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এটির চেয়েও বেশি ব্যয় করে নেওয়া পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পটি সাদা হাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে।
রেলপথ নির্মাণে বেশি ব্যয় ও বিপুল বিনিয়োগ করার পরও সুফল না পাওয়ার বিষয়টি জেনেছেন বলে উল্লেখ করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, ভবিষ্যতে যেনতেনভাবে কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট হয়েছে। এর প্রতিটি প্রকল্পের তদন্ত করা হবে।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বরে নতুন এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারে দুটি ট্রেন চারবার আসা-যাওয়া করে। এর বাইরে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রেন দুবার আসা-যাওয়া করে। তবে সেটি নিয়মিত নয়।
অথচ প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সারা দেশ থেকে কক্সবাজারে যত পর্যটক যান, এর অন্তত ৫০ শতাংশ পাবে রেল। চালুর প্রথম বছরই যাত্রী পরিবহন করে ৩৯২ কোটি টাকা ও পণ্য পরিবহন করে ৫০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুমধুম গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লক্ষ্য ছিল চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হওয়া। কিন্তু মিয়ানমারের অনাগ্রহে কক্সবাজার থেকে বাকি ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন করে আয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
এই রেলপথের কাজ দুই ভাগে বিভক্ত করে ঠিকদার নিয়োগ দেওয়া হয়। দোহাজারী-চকরিয়া অংশের কাজ করে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ও বাংলাদেশের তমা গ্রুপ। চকরিয়া-রামু-কক্সবাজার অংশের কাজ করেছে চায়না সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
খুলনা–মোংলা ও আখাউড়া–আগরতলা
ভারতীয় ঋণে খুলনা থেকে মোংলা এবং আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত দুটি নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। গত বছর ১ নভেম্বর দুটি রেলপথ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বোধনের ছয় মাস পর গত মে মাসে খুলনা-মোংলা পথে একটি ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আখাউড়া-আগরতলা ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
অথচ ২০১০ সালে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা–মোংলা রেললাইন প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, মোংলা বন্দরকে রেলসংযোগের আওতায় আনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে ‘নীরব বিপ্লব সাধিত হবে’। তিন বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। লেগেছে ১৩ বছর। পাঁচবার প্রকল্প প্রস্তাবে সংশোধন আনার পর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, খুলনা-মোংলা ও আখাউড়া-আগরতলা রুটে রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প দুটি নেওয়া হয়েছে ভারতের আগ্রহে। প্রকল্পে তাদের পরামর্শক ও ঠিকাদারেরা কাজ করেছে। মালামালও বেশির ভাগ ভারত থেকে এসেছে।
‘মানুষের লাভ হয়নি’
রেলের এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত সৈয়দ আবুল হোসেন, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজন। তাঁরা রেলকে লাভে আনতে পারেননি, সেবার মানেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেল লোকসান দিয়েছে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। ওবায়দুল কাদের, মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজন এখন আত্মগোপনে। মুঠোফোনে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, রেলের অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ঠিকাদারতাড়িত (ড্রিভেন)। ফলে এখানে লাভ–লোকসান কিংবা জনগণের জন্য কতটা উপযোগী, সেই প্রশ্ন শুরুতেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এতে রাজনীতিক ও ঠিকাদারদের দুষ্টচক্র লাভবান হয়েছে। মানুষের লাভ হয়নি।
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
অর্থনীতি
সবজির দামে সুখবর নেই, স্থিতিশীল মাংস
প্রকৃতিতে ইতোমধ্যে শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে, আর মৌসুমের সবজিতেও ভরে উঠেছে বাজার। এর পরও গত সপ্তাহের মতো এ সপ্তাতেও সবজির দামে খুব একটা হেরফের ঘটেনি, আগের মতোই রয়েছে অধিকাংশ সবজির দাম। মাংসের দামেও দর বৃদ্ধি-পতন দেখা যায়নি।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সরেজমিনে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহের মতো এ সপ্তাহেও প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। পেঁয়াজ কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ফুলকপি ও পাতাকপি পিস ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ কেজি ১২০ টাকা, লাউ পিস ৮০ টাকা, কাঁচা পেঁপে কেজি ৫০ টাকা, শিম ১২০ টাকা, করলা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, পটল ৬০ টাকা ও টমেটো ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এর মধ্যে কিছু সবজির দাম বেড়েছে ও কমেছে। গত সপ্তাহে কুমড়ো বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা কেজি, যা এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। বেগুনের দাম ছিল ৭০ টাকা, যা এ সপ্তাহে ৬০ টাকা। আবার গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে বেড়েছে বরবটির দাম। ৬০ টাকা কেজির বরবটি এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। বেড়েছে শসার দামও। গতসপ্তাহে শসা ৬০ টাকা, এ সপ্তাহে যার দাম ১০০ টাকা।
আগ্রহ নিয়েই শীতের সবজি কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা। বাজারে আসা ক্রেতা নাইমুর বলেন, আগে শীতের সবজি আরো কম দামে কিনেছি। আশা করছি শীত আসলে দাম আরেকটু কমে যাবে, তখন আমরা একটু স্বস্তিতে কেনাকাটা করতে পারবো।
এদিকে বাজারে গরু, খাসির মাংস ও মুরগির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়, সোনালির কেজি ২৮০ টাকা, লেয়ার মুরগি ৩০০, কক ৩০০ টাকা কেজি। পাশাপাশি দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বাজার ভেদে ৭৫০ টাকা থেকে ৭৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং খাসির মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়।
তবে বাজারে সব ধরনের মাছ বাড়তি দামেই আটকে আছে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি চাষের কই বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়, পাঙাশ মাছ প্রতি কেজি ২০০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, কাঁতল ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকা, গলসা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, ট্যাংরা প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া রুই প্রতি কেজি ৩৬০ টাকা, রুপচাঁদা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, চিংড়ি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এমআই
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
অর্থনীতি
ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে এস আলমের ১৮ কোম্পানি!
কর স্বর্গ ও গোপন (শেল) কোম্পানি খোলার অন্যতম কেন্দ্র বলে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে বাংলাদেশের বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস. আলমের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সন্ধান মিলেছে। এই গ্রুপের অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তকারীদের মতে, ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে – ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে – মূলত অর্থপাচারের উদ্দেশ্যে ১৮টি গোপন কোম্পানি খুলেছেন এস আলমের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদ। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতিও নেননি তিনি।
২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতন হয়। এরপর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা এস আলমসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত দুর্নীতি ও আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যা আরও জোরদার করার মধ্যে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। গত ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের সাথে জড়িত সন্দেহে ১৫০ ব্যক্তির একটি তালিকা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৯ জনের বিষয়ে এরমধ্যেই তদন্ত করা হচ্ছে।
এর কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরানোর প্রাথমিক কাজ এরমধ্যে শুরু হয়েছে। ‘তবে জাল ফেলা হয়েছে, এখন গোটানো বাকি।’
এই প্রচেষ্টার সাথে জড়িত টাস্কফোর্সের একজন সদস্য জানান, পাচার হওয়া সম্পদ শনাক্ত ও উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ়সংকল্প, যেকারণে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে এস আলমের বিনিয়োগের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এর আগে গত অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকখাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এরমধ্যে কেবল এস আলম-ই অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন।
সম্পদ উদ্ধারে দরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকখাতকে ধবংস করার জন্য দায়ী দুজন ব্যবসায়ী – এস আলম ও সালমান এফ রহমান। বিগত সরকারও যেখানে মূল ভূমিকা রেখেছে।
“গভর্নর বলেছেন, কেবল এস আলমই ১০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। এসব অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকারকে সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে। সিঙ্গাপুর-সহ যেসব দেশে অর্থপাচার হয়েছে, ফিরিয়ে আনতে সহায়তা চেয়ে— সেসব দেশের সরকারের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে” – বলেন তিনি।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস ও ইউরোপে এস আলম গ্রুপের বিপুল বিনিয়োগের কথা জানা যাচ্ছে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন যে, “এই প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ, এবং তাতে অনেক বছর লাগতে পারে। এরমধ্যে আগামী নির্বাচনে হওয়া যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনও বিষয়টিকে জটিল করে তুলতে পারে। বিশেষত অর্থপাচারের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচিত সরকারের সাথে আঁতাত করে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টাও হয়তো করবে।”
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ পুনরুদ্ধারে গত ১৯ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স। বৈঠকে এস আলম-সহ অন্যান্য শিল্পগোষ্ঠীর বৈদেশিক সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হয়। টাস্কফোর্সের সঙ্গে কাজ করা দেশি-বিদেশি কর্মকর্তাদের সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ভার্জিন আইল্যান্ডসে এস আলমের যেসব কোম্পানি
টাস্কফোর্সের সূত্রমতে, ২০১১ সালে প্রথম এস আলমের নামে ক্যানালি লজিস্টিকস পিটিই লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গঠন করা হয় ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে। এরপর এস আলমের মালিকানায় ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আরও ১০টি কোম্পানি খোলা হয়। এগুলো হলো – হানিওয়েল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, গোল্ডেন ট্রেইলস ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, হ্যামিলটন ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, হ্যাজেল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, লিভোনিয়া পিটিই লিমিটেড, লু শুই ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, পিটসডেল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, স্পিংফিল্ড ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, চিং শুই ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড এবং ট্রিভোলি ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড।
এছাড়া, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত আরও ছয়টি কোম্পানি গঠন করা হয়। এগুলো হলো – আদাইর ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, গ্রিনিচ ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, লিনিয়ার ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, ম্যারিকো ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, ওয়েভপ্যাক ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড এবং জেনিতা ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড।
এছাড়া, ২০১৯ সালের ২২ মে তারিখে এস আলমের মালিকানায় পিকক প্রোপার্টি হোল্ডিংস লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি গঠিত হয়।
হ্যাজেল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেডে ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাইফুল আলমের নামে, বাকি ৩০ শতাংশের মালিক তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন।
বিদেশে বিনিয়োগ করতে হলে, যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি বা সংস্থাকে আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। এস আলম গ্রুপকে এধরনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।
২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া প্যারাডাইস পেপারে বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিদেশে সম্পদ পাচারের তথ্য উঠে আসে, যেখানে কর স্বর্গ হিসেবে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের দিকেও আলোকপাত করা হয়।
সিঙ্গাপুর থেকে ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি সেখানে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক কর সুবিধা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে কোনোপ্রকার আয়কর, বাণিজ্যিক কর, বা মূলধনী আয়ের ওপর কর না থাকা। এছাড়া, বিনিয়োগকারীর গোপনীয়তার অধিকারও দেয় সেখানকার কর্তৃপক্ষ, যার ফলে প্রকাশ্যে তাদের শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালকদের নাম আনুষ্ঠানিক নথিতে প্রকাশ না করেও সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে বিভিন্ন কোম্পানি।
কর স্বর্গের ব্যবহার হয় কেন?
অর্থপাচার ও নানান ধরনের দুর্নীতির জন্য খোলা হয় শেল বা গোপন কোম্পানি। করফাঁকি এবং আয়ের উৎস গোপন করতে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা কর স্বর্গ বা ট্যাক্স হ্যাভেন বলে পরিচিত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এসব প্রতিষ্ঠান খুলে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সম্পদ ধারণ বা তা লেনদেনের মাধ্যমে অন্যত্র স্থানান্তর করতে শেল কোম্পানি খোলা হয়, যাদের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে কর স্বর্গগুলো। কারণ সেখানে কর যেমন স্বল্প, তেমনি আইন ও বিধিমালাও শিথিল। পায় গোপনীয়তা রক্ষার সুবিধাও। কর সুবিধা লাভ এবং গোপন কার্যক্রম পরিচালনায় আগ্রহী ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জনপ্রিয় কয়েকটি কর স্বর্গের মধ্যে নাম করা যায় – কেম্যান আইল্যান্ডস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বারমুডা ও চ্যানেল আইনল্যান্ডস এর।
ইন্টারন্যাশল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) এর এক অনুসন্ধানে এসব কর স্বর্গের ব্যাপক সুবিধা গ্রহণের চিত্র উঠে এসেছে। বিভিন্ন শেল কোম্পানি ব্যবহার করে কীভাবে কর ফাঁকি দেওয়া, অর্থ পাচার ও প্রকৃত মালিকানা গোপন রাখা হচ্ছে তা-ও উঠে আসে এতে।
সম্পদ ফিরিয়ে আনা কঠিন, তবে সম্ভব
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)- এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তাঁদের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ– বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে নিশ্চয় প্রমাণ আছে যে অর্থপাচার হয়েছে, কারণ তারাও জড়িত ছিল। “পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব না, তবে এটি জটিল ও দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া।”
তিনি বলেন, প্রথমে এটা আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে এস আলমের কোম্পানিগুলোর অর্থায়ন করা হয়েছে। “এটাকে পাচার হওয়া টাকা বললেও– আইনিভাবে প্রমাণ না করতে পারলে, কোনো দেশই তা ফেরত দেবে না। তবে একবার আইনিভাবে প্রমাণ করা গেলে– সম্পদ ফিরিয়ে আনতে তখন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা যাবে।”
এই লক্ষ্য অর্জনে বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় – গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচটি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিদেশে এস আলমের যেসব সম্পদ
২০০৯ সাল থেকে গত এক দশকে এস আলম নিজের এবং তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন কোম্পানি স্থাপন করে সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেন।
সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, এস আলম একটি শপিং মলে ৩টি হোটেল ও রিটেইল স্পেস কেনার জন্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার (বর্তমান ডলারমূল্যে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সমান) বিনিয়োগ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন গোপনীয় নথি অনুযায়ী দেখা যায়, ভুয়া কগজে প্রতিষ্ঠান খুলে নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে দেশের প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা লুট করেছেন এই এস. আলম।
এসব ঋণের অর্থ শত শত আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মোড়কে এলসির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রেগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
এমআই
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
অর্থনীতি
সাবেক মন্ত্রী কামরুলের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য কামরুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
বুধবার (২০ নভেম্বর) দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ।
চিঠিতে তার ও তার ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব থাকলে আগামী ৩০ দিনের জন্য তা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, রাজধানীর নিউমার্কেট থানা এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় বুধবার কামরুল ইসলামের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমানের আদালত শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
এদিন তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিপ তার ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।
এসময় আসামিপক্ষে তার আইনজীবী রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এমআই
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
অর্থনীতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ কর্মকর্তাকে দুদকে তলব
ঋণের নামে ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) দুদকের উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাতের সই করা এক চিঠিতে এ তলব করেন।
চট্টগ্রামের মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. গোলাম সরওয়ার চৌধুরী ও অন্য ব্যবসায়ী গ্রুপ জাল-জালিয়াতি করে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়। দুদক সূত্রে এই খবর জানা গেছে।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ইয়াছির আরাফাতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। ১৭ কর্মকর্তার বিষয়ে ও অভিযোগ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাত স্বাক্ষরিত চিঠি এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে ওইসব কর্মকর্তার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি পাঠাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের চাকতাই শাখার গ্রাহক মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, জুবিলী রোড শাখার গ্রাহক ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স, খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের ঋণ পরিদর্শন বা মনিটরিং নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভূমিকার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, গত ১১ নভেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওইসব কর্মকর্তাদেরকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিলো। তারা ওইদিন হাজির না হওয়ায় তাদেরেক দুদকে হাজির হয়ে ঋণ-সংক্রান্ত পরিদর্শন রেকর্ডপত্র ও লিখিত বক্তব্য জমা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ওই ১৭ কর্মকর্তা হলেন- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের উপপরিচালক মে. জুবাইর যেসেন, উপপরিচালক খোরশেদুল আলম, রুবেল চৌধুরী, দেবাশীষ বিশ্বাস, মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বাবলু, যুগ্ম পরিচালক সুনির্বাণ বড়ুয়া, অনিক তালুকদার, কোল হোসেন, সৈয়দ মু আরিফ-উন-নবী, অতিরিক্ত পরিচালক ছলিমা বেগম, শংকর কান্তি ঘোষ, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও মো. সোয়াইব চৌধুরী।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঢাকা অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আব্দুর রউফ, উপপরিচালক লেনিন আজাদ পলাশ, পরিদর্শন দলের নেতা ও অতিরিক্ত পরিচালক মো. মঞ্জুর হোসেন খান।
এমআই
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
অর্থনীতি
খেজুরের আমদানিতে কমলো শুল্ক, থাকছে না অগ্রিম কর
রমজানে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে খেজুর আমদানিতে আমদানি শুল্ক ও সমুদয় অগ্রিম কর কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সই করা প্রজ্ঞাপন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। নতুন ওই সুবিধা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পবিত্র রমজান মাসে খেজুরকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য খেজুর আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ হতে হ্রাস করে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে অর্থাৎ মোট করভার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ হতে হ্রাস করে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়েছে।
এর আগে ১৭ নভেম্বর খেজুর আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) কমানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। খেজুর আমদানিতে আগাম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ, আগাম কর ৫ শতাংশ পুরোপুরি বাতিল এবং আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার সুপারিশ করে ট্যারিফ কমিশন।
এনবিআর মনে করে, খেজুর আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক-কর হ্রাস করার ফলে মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরের আমদানি ব্যয় প্রায় ৬০ টাকা হতে ১০০ টাকা হ্রাস পেতে পারে। আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর হ্রাসের ফলে খেজুরের আমদানি বৃদ্ধি পাবে, বাজারে খেজুরের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং খেজুরের বিক্রয় মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
এমআই