অর্থনীতি
ওয়ারেন বাফেটের বেড়ে ওঠা-জীবন-বিয়ে ও বিনিয়োগের যত কাহিনি

আগামী ৩০ আগস্ট তাঁর বয়স হবে ৯৪ বছর। এখনো খেতে পছন্দ করেন চিজ বার্গার আর চেরি কোকাকোলা। চুটিয়ে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলেন। ‘ব্রেকিং ব্যাড’ ওয়েব সিরিজের দারুণ ভক্ত। ৬৫ বছর ধরে একটি বাসাতেই থাকেন। লেনদেন করেন নগদ অর্থে। আর যা আয় করেন, বিলিয়ে দেন তার প্রায় সবটাই।
বলছি ওয়ারেন বাফেটের কথা, বিশ্বের সেরা বিনিয়োগকারী। তিনি এমন এক মানুষ, যাঁর কোনো শত্রু নেই বললেই চলে। নামটা যেন কেবলই ভালো লাগা আর শ্রদ্ধার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১১ সালে তাঁর গলায় প্রেসিডেনশিয়াল গোল্ড মেডেল পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওয়ারেন বাফেট কেবল একজন শীর্ষ ধনীই নন, একই সঙ্গে অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও ভালোবাসার মানুষ।’ ভালোবেসে তাঁকে ডাকা হয় ‘ওমাহার জাদুকর’।
ওয়ারেন বাফেট এখন বিশ্বের ষষ্ঠ শীর্ষ ধনী, বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আবার কেউ কেউ বলেন, বাফেট যত ভালো বিনিয়োগকারী, তার চেয়েও ভালো ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক। বাফেট যেখানে বিনিয়োগ করেন আর যেভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালান, সেটাকেই আদর্শ মানা হয়। আসলে বিনিয়োগকারী হিসেবে তিনি কিংবদন্তিতুল্য আর ব্যবস্থাপক হিসেবে প্রথম শ্রেণির। ফোর্বস পত্রিকার ২০২৪ তালিকা অনুযায়ী বাফেটের সম্পদের পরিমাণ এখন ১৩৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট কত জানেন তো? ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
ওয়ারেন বাফেটের আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনহিতৈষীদের একজন। ২০০৬ সালে তিনি তাঁর সম্পদের ৯৯ শতাংশই দানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর এখন পর্যন্ত দান করেছেন প্রায় ৫৬ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
যেভাবে বেড়ে ওঠা
ওয়ারেন বাফেটের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যের ওমাহায়, ১৯৩০ সালের ৩০ আগস্ট। হাওয়ার্ড ও লেইলা বাফেট দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। হাওয়ার্ড দম্পতি বিয়ে করেছিলেন ১৯২৫ সালে। বড় বোন ডরিসের জন্ম ১৯২৮ সালে আর ছোট বোন বার্টি ওয়ারেন বাফেটের চেয়ে তিন বছরের ছোট।
বাবা হাওয়ার্ড বাফেট ছিলেন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারী। তাঁর শেয়ার কেনাবেচার একটি ব্রোকারেজ ছিল। ছোটবেলায় দেখতেন, বাবা একগাদা কাগজ নিয়ে রাতে বাসায় ফিরছেন। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর বাবা আসলে কী করেন? মা বলেছিলেন, ইনভেস্টর। তখনই তিনি ঠিক করে ফেললেন, তাঁকেও ইনভেস্টর হতে হবে। ছয়-সাত বছর বয়সেই স্কুলের খাতায় নিজের নাম লিখে রেখেছিলেন ‘ওয়ারেন বাফেট: ফিউচার ইনভেস্টর’। বাফেট সেটাই হয়েছেন।
বিনিয়োগকারী হতে ছেলের অদম্য আগ্রহ দেখে বাবা হাওয়ার্ড বাফেট পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘বড় বিনিয়োগকারী হতে চাইলে নিজের একটি ব্যবসা ভাবতে শেখো, নিজের সম্পদমূল্য বাড়িয়ে তোলো।’ এ কথা বাফেট বড় হয়েও মনে রেখেছেন। মূলত, বিনিয়োগকারী হওয়ার বীজ ওয়ারেনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবাই।
একদম ছেলেবেলাতেই ওয়ারেন তাঁর বাল্যবন্ধুকে বলে রেখেছিলেন, ৩৫ বছর বয়সে তিনি লাখপতি বা মিলিয়নিয়ার হবেন। আর এ লক্ষ্যেই মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম শেয়ারটি কিনেছিলেন। পরে সিএনবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমি শুরুই করেছি দেরিতে। জানি না এতটা সময় কেন নষ্ট করেছিলাম।’
দাদার ছিল মুদির দোকান। ওয়ারেন বাফেট সেই বয়সেই নিজের সম্পদমূল্য বাড়াতে সপ্তাহে ৫ ডলার বেতনে দাদার দোকানে কাজ নেন। মাত্র ছয় বছর বয়সেই দাদার দোকান থেকে ২৪ সেন্টে ৬ প্যাকেট কোকাকোলা কিনে একটু দূরে গিয়ে বিক্রি করে ৫ সেন্ট মুনাফা করেছিলেন। এরপর কিছু অর্থ জমিয়ে ১১ বছর বয়সে ৩৮ ডলার করে সিটিজ সার্ভিসের ৬টি শেয়ার কেনেন। এর তিনটি শেয়ার দিয়ে দেন বোনকে। তবে জীবনের প্রথম শেয়ার ব্যবসা শুরুতে হতাশ করেছিল তাঁকে। কিছুদিনের মধ্যেই শেয়ারের দাম কমে ২৭ ডলার হয়ে যায়। কিন্তু তিনি অপেক্ষা করেছেন। দর বেড়ে ৪০ ডলার হতেই বিক্রি করে দেন। তিনি এখনো মানেন, সেটি ছিল তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই ওই শেয়ারের দাম আরও বেড়ে ২০০ ডলার হয়ে যায়। সেই ঘটনা থেকে তিনি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছিলেন। আর তা হলো অধ্যবসায়, যার প্রতিফলন পুরো জীবনেই ছিল।
ছোটবেলায় সম্পদ বাড়াতে ওয়ারেন বাফেট বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুইংগাম, পত্রিকা, কোকাকোলাও বিক্রি করেছেন। পাড়ার সেলুনের সামনে বন্ধুরা মিলে একটা পোকার খেলার মেশিনও বসিয়েছিলেন। এ সময় বাবা ওয়ারেনের নামে একটি ব্যাংক হিসাবও খুলে দিয়েছিলেন। একসময় ব্যাংক থেকে নোটিশ এল যে ওয়ারেন বাফেটের নামে কিছু ডলার জমা পড়েছে। ফলে এখন আয়কর দিতে হবে। ছেলেকে বললেন আয়কর দিতে। কারণ, তখন থেকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখতে হবে। বাফেটের বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। বয়স কম হওয়ায় স্থানীয় আয়কর বিভাগ ৩৫ ডলার ফেরত দিলে বাফেট তা দিয়ে একটি বাইসাইকেল কিনেছিলেন। সেই বাইসাইকেল তিনি চালাতেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও।
ওয়াশিংটন–যাত্রা
ওয়ারেন বাফেটের জন্ম ১৯৩০ সালে। ১৯৩০-এর পুরো দশকই ছিল গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার কাল। লাখ লাখ মানুষ তখন বেকার। বিনিয়োগেও চরম মন্দা। বিনিয়োগকারী হিসেবে সিনিয়র বাফেট সিদ্ধান্তে এলেন যে গন্ডগোলটা আসলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের। তখন ঠিক করলেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়েই সরকারকে প্রভাবিত করতে হবে। নির্বাচনে দাঁড়ালেন। ১৯৪৩ সালে তিনি নেব্রাস্কা সেকেন্ড ডিস্ট্রিক্ট থেকে ইউএস হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের সদস্য নির্বাচিত হলেন। মাঝখানে একবার বাদ দিয়ে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কংগ্রেসে। ফলে ১৯৪৩ সালেই বাবার সঙ্গে ওমাহা ছেড়ে ওয়াশিংটনে চলে যান তিনি। ওয়ারেন বাবার সঙ্গে ওয়াশিংটন এসেছিলেন ১২০ ডলার হাতে নিয়ে। কিন্তু যখন ওয়াশিংটন ছেড়ে চলে যান, তখন তাঁর সেই বিনিয়োগ বেড়ে হয়েছিল ১০ হাজার ডলার।
বাফেটের স্কুলজীবন শেষ হয় ১৭ বছর বয়সে, ১৯৪৭ সালে। কলেজে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ওয়ারটন বিজনেস স্কুলে পড়বেন বাফেট। সেখানে ছিলেনও দুই বছর। একসময় ফিরে আসেন ওমাহায়। বাফেট পড়তে চেয়েছিলেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে। কিন্তু তাঁকে নেওয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত হার্ভার্ডের ভর্তির নিকৃষ্টতম প্রত্যাখ্যানের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয় এটাকেই।
প্রত্যাখ্যানের গল্প
নেব্রাস্কা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরে ওয়ারেন বাফেট হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে পড়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। ভর্তির জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল শিকাগোতে। ১০ মিনিট সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর তাঁকে বাতিল করে দেওয়া হয়। এক অনুষ্ঠানে বাফেট এ নিয়ে বলেছেন, ‘আমার প্রতিক্রিয়া ছিল বাবাকে কীভাবে এটা বলব। তবে সেই প্রত্যাখ্যানই ছিল জীবনে অন্যতম সেরা ঘটনা।’ কেননা, এর ফলে তাঁর সামনে কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলে যাওয়ার দরজা খুলে গিয়েছিল।
অনেক ছেলেবেলা থেকে বিনিয়োগ নিয়ে পড়াশোনা করতেন বলে দুই নামী অধ্যাপকের নাম জানতেন। তাঁরা হলেন বেনজামিন গ্রাহাম বা বেন গ্রাহাম এবং ডেভিড ডড। ওয়ারেন বাফেট এ নিয়ে বলেছেন, ‘আমি তাদের দুজনের বই পড়েছি। সে কারণে আমি তাদের চিঠি লিখলাম। লিখলাম, “প্রিয় অধ্যাপক ডড, আমি ভেবেছিলাম তোমরা দুজন বেঁচে নেই। কিন্তু এখন দেখছি তোমরা বেঁচে আছ এবং কলাম্বিয়ায় পড়াচ্ছ। আমি আসলেই এখানে আসতে চাই।” তাঁরা আমাকে সেখানে নিলেন। তাঁরা দুজনেই অত্যন্ত ভালো শিক্ষক। বিশেষ করে বেন গ্রাহাম আমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা দিয়েছিলেন, যা আজীবন কাজে লেগেছে। বলেছিলেন, “বিনিয়োগ করার দুটি নিয়ম আছে। এক হচ্ছে কখনো অর্থ লোকসান দেবে না, আর দ্বিতীয় নিয়ম হচ্ছে, প্রথম নিয়মটা কখনো ভুলবে না।”’
১৯৪৯ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে চলে যান কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলে। বেনজামিন গ্রাহামের দ্য ইন্টেলিজেন্ট ইনভেস্টর এখনো ওয়ারেন বাফেটের অন্যতম প্রিয় বই। গ্রাহামকে আকৃষ্ট করার জন্য বইটি সম্পূর্ণ মুখস্থ করেছিলেন তিনি। বাফেটই ছিলেন বেন গ্রাহামের একমাত্র ছাত্র, যিনি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়েছিলেন। লেখাপড়া শেষ করার পর বাফেট চেয়েছিলেন গ্রাহামের সঙ্গে কাজ করবেন। কিন্তু ইহুদি না হওয়ায় প্রথমে তিনি তাঁকে নিতে চাননি। পরে অবশ্য সুযোগ পান বাফেট। আর এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ওপরে ওঠার।
বেনজামিন গ্রাহামকে নিয়ে আরেকটি মজার গল্প আছে। একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ওয়াশিংটনের ট্রেনে উঠে পড়েছিলেন বাফেট। হুজ হুর পুরোনো একটি সংস্করণ পড়ে জেনেছিলেন, বেন গ্রাহাম গেইকো নামে একটি ছোট বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান। ওয়াশিংটনে নেমে তিনি হাজির হন গেইকোর অফিসে। সেদিন ছিল শনিবার। গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। দমলেন না। বেল বাজিয়েই চললেন। একসময় কেউ একজন দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে তখনো একজন কাজ করছিলেন। বাফেট প্রথমেই তাঁর কাছে জানতে চাইলেন বিমা কোম্পানিটির কাজের ধরন নিয়ে। সেই কথাবার্তা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ চার ঘণ্টা। লোকটি ছিল গেইকোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লরিমার ডেভি ডেভিডসন। চার ঘণ্টার সেই আলাপও বাফেটের জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। সেই যে বিমা ব্যবসা পছন্দ করা শুরু করেন, তা আজও আছে।
বাফেট এখন গেইকোর মালিক। আর প্রতিষ্ঠানটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় একটি বিমাপ্রতিষ্ঠান। পরে এক সাক্ষাৎকারে ওয়ারেন বলেছিলেন, সেই চার ঘণ্টার আলাপে যা শিখেছিলেন, তা ছিল কলেজজীবনের শিক্ষার চেয়েও বেশি।
বিয়ে এবং আলাদা থাকা
কলাম্বিয়া থেকে ফিরে এসে ওয়ারেন বাফেট বিয়ে করেন ১৯৫২ সালে, ওমাহায়। সুজান টমসন ছিলেন ছোট বোন বার্টির কলেজের বন্ধু। তবে এই দম্পতি আলাদা বসবাস শুরু করেছিলেন ১৯৭৭ সালে। সুজান সে সময় সান ফ্রান্সিসকো চলে যান তাঁর নিজের সংগীত পেশাকে এগিয়ে নিতে। ২০০৪ সালে সুজান মারা যান, তখনো তাঁরা বিবাহিতই ছিলেন।
২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট ওয়ারেন বাফেট দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন অ্যাস্ট্রিড মেংক্সকে। এখানেও একটা গল্প আছে। সুজান ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাওয়ার আগে প্রিয় বান্ধবী অ্যাস্ট্রিডকে স্বামীর তদারকির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই অ্যাস্ট্রিড ছিলেন ওয়ারেনের সঙ্গী। বাফেটের ৭৬তম জন্মদিনের দিন তাঁরা বিয়ে করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে অ্যাস্ট্রিডের প্রশংসা করে সুজান বলেছিলেন, ‘সে বাফেটের খুব যত্ন করে। যার প্রশংসা সে করে, আমিও করি।’
প্রথম কোম্পানি আর একমাত্র বাড়ি
গুরু বা মেন্টর বেন গ্রাহামের সঙ্গে ওয়ারেন কাজ করেন দুবছর। ১৯৫৬ সালে ফিরে আসেন ওমাহায়। বয়স তখন তাঁর ২৫। ফিরে এসে প্রথম অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ ব্যবসা শুরু করেন। সেই কোম্পানির নাম ছিল বাফেট পার্টনারশিপ লিমিটেড। অংশীদারদের মধ্যে ছিলেন নিজের শ্বশুর, বোন ডরিস, খালা অ্যালিস এবং একজন কলেজের বন্ধু। শুরুতে মোট বিনিয়োগ ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ডলার, এর মধ্যে মাত্র ১০০ ডলার ছিল ওয়ারেনের। কোম্পানিতে ওয়ারেনের ফি ছিল ৪ শতাংশের বেশি লাভ হলে তার ৫০ শতাংশ। আর ক্ষতি হলে তার ২৫ শতাংশ বহন করবেন ওয়ারেন।
বিনিয়োগ ব্যবসায় ভালোই লাভ করেছিলেন তাঁরা। দুই বছর পরই ওমাহায় ৩১ হাজার ৫০০ ডলার দিয়ে একটি বাড়ি কেনেন তিনি। বিশ্বের একজন শীর্ষ ধনী হওয়া সত্ত্বেও পরের ৬৫ বছর ধরে সেই বাড়িতেই তিনি জীবন কাটাচ্ছেন। ৬ হাজার ৫৭০ বর্গফুটের সেই বাড়িতে কক্ষ পাঁচটি। বার্কশায়ার অফিসের খুব কাছেই এই বাড়ি। ১৯৭১ সালে অবশ্য ক্যালিফোর্নিয়ার লেগুনা বিচে একটি অবসরযাপন কেন্দ্র কিনেছিলেন বাফেট, পরে সেটি বিক্রি করে দেন।
২০১৪ সালে বার্কশায়ারের বার্ষিক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যা চাই, তার সবই আমার জীবনে আছে। তবে আমার জীবন এত সুখের থাকত না, বরং আরও খারাপ হতো, যদি আমার ছয় বা আটটা বাড়ি থাকত।’
বন্ধুত্ব–১: বাফেট ও চার্লি মাঙ্গার
দুজন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব না হলে ওয়ারেন বাফেটের জীবনও হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তাঁদের একজন হচ্ছে চার্লি মাঙ্গার। চার্লি মাঙ্গার না থাকলে বাফেট হয়তো এত দূর আসতে পারতেন না। চার্লির সঙ্গে দেখা হওয়া ও বন্ধুত্ব ওয়ারেনের জীবনের অন্যতম বড় ঘটনা। নিজেদের নিয়ে তাঁরা কৌতুক করে বলেন, ‘দুজনে দুজনার’। ৬০ বছরের বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের, একটি দিনের জন্যও মন-কষাকষি হয়নি।
চার্লি মাঙ্গারের সঙ্গে বাফেটের প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে এক নৈশভোজে। অবশ্য আগে থেকেই তিনি চার্লিকে জানতেন। বাফেট অ্যান্ড সন্স নামে বাফেটের দাদার মুদির দোকানে কিছুদিন কাজ করেছিলেন চার্লি। তবে বন্ধুত্বের শুরু সেই নৈশভোজের টেবিল থেকেই।
কেন চার্লি মাঙ্গারকে ভালো লেগেছিল? বাফেট এক বক্তৃতায় বলেছেন, মাঙ্গার নিজে কৌতুক বলে নিজেই হাসিতে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন দেখে মনে হয়েছিল, এই লোকটি ঠিক তাঁর মতোই। সুতরাং অন্য কোনো বন্ধু খোঁজার আর দরকার নেই। সেই থেকে পরের বছরগুলোয় তাঁরা একসঙ্গে সবকিছু করেছেন। অনেক কিছু শিখেছেনও।
মাঙ্গার ছিলেন মূলত আইনবিদ। হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে পাস করে পরিবারসহ ক্যালিফোর্নিয়া চলে গিয়েছিলেন। অপারেশন করাতে গিয়ে একটা চোখ হারান। অন্য পেশায় থাকলেও দুজনের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। পরে বাফেট রাজি করিয়েছিলেন আইন পেশা ছেড়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৭৮ সালে বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন মাঙ্গার।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাফেটের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ছিল মাঙ্গারের। যেমন একটা সময় প্রযুক্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল বাফেটের। কারণ, প্রযুক্তি কোন দিকে যাবে, তিনি তার পূর্বাভাস দিতে পারতেন না। মাঙ্গার তাঁকে রাজি করান প্রযুক্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগে। এরপরই অ্যাপল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বার্কশায়ার। আজকে বার্কশায়ারের এত অগ্রগতির বড় কারণ অ্যাপলের মুনাফা। ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর ৯৯ বছর বয়সে মারা যান চার্লি মাঙ্গার।
বার্কশায়ার গঠনের নেপথ্যে
ওয়ারেন বাফেট এখন বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের হ্যাঙ্গারের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ডুবতে থাকা এ প্রতিষ্ঠান তিনি কিনেছিলেন ১৯৬৫ সালের ১০ মে। কেনার গল্পটিও অনেক মজার। শুরুতে এটি ছিল বস্ত্র কারখানা। ১৮৩৯ সালে এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অলিভার চেস। তখন এর নাম ছিল ভ্যালি ফলস কোম্পানি। ১৯২৯ সালে বার্কশায়ার কটন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হয় ভ্যালি ফলস কোম্পানি। এর নাম হয় বার্কশায়ার ফাইন স্পিনিং অ্যাসোসিয়েটস। ১৯৫৫ সালে এই কোম্পানি আবারও একীভূত হয় হ্যাথঅ্যাওয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সঙ্গে। শুরুতে ভালো করলেও পরে ব্যবসা খারাপ হতে থাকে। তখন এটি চালাতেন সিব্যারি স্ট্যানটন নামের আরেক মার্কিন ব্যবসায়ী।
১৯৬২ সালে ওয়ারেন বাফেট প্রথম বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের শেয়ার কেনা শুরু করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে এর শেয়ারদর বাজার পরিস্থিতির তুলনায় কম। তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে ওয়ারেন শেয়ার কিনেছিলেন, তা পূরণ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ১৯৬৪ সালে সিবারি স্ট্যানটন মৌখিকভাবে ওয়ারেনকে প্রস্তাব দেন যে তিনি সাড়ে ১১ ডলারে শেয়ারগুলো কিনে নেবেন, অর্থাৎ বাইব্যাক করবেন। ওয়ারেন সম্মত হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ট্যানটন বাইব্যাকের যে নথি পাঠান, সেখানে শেয়ারের দর লেখা ছিল ১১ দশমিক ৩৭৫ ডলার। এতে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হন। ফলে শেয়ার বিক্রি না করে বার্কশায়ারের আরও শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্ট্যানটনকে শাস্তি দেওয়া। শেষ পর্যন্ত তা-ই করেছিলেন। মালিকানার কর্তৃত্ব নিয়েই স্ট্যানটনকে বরখাস্ত করেন বাফেট।
ওয়ারেন বাফেটও এটা বস্ত্রকল হিসেবেই চালিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে এসে এর সম্প্রসারণ ঘটান। আস্তে আস্তে একটিকে একটি হোল্ডিং কোম্পানিতে পরিণত করেন। সবার আগে বিমাশিল্পে প্রবেশ করেন তিনি। প্রথমে ন্যাশনাল ইনডেমনিটি কোম্পানি নামে একটা বিমা প্রতিষ্ঠান কিনে নেন। পরে কেনেন গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি (জিইআইসিও বা গেইকো)। মূলত, বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের উত্থান এই বিমা কোম্পানির মাধ্যমেই। ১৯৮৫ সালে ওয়ারেন বস্ত্রকলের কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ করে দেন।
এখনো ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের মতো বস্ত্রকলে বিনিয়োগ হচ্ছে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল; যদিও এখানে বিনিয়োগ করে এখন পর্যন্ত তিনি মুনাফা পেয়েছেন ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই বিনিয়োগ অন্য কোথাও করলে মুনাফা আরও বেশি হতো।
ওয়ারেন বাফেট ১৯৭২ সালে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ছোট্ট একটা চকলেট কোম্পানি কিনে নিয়েছিলেন মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলারে। সি’জ ক্যান্ডি নামের সেই কোম্পানি কেনা ছিল ওয়ারেনের অত্যন্ত প্রিয় বিনিয়োগ, যাকে তিনি বলেন স্বপ্নের ব্যবসা।
ওয়ারেন বাফেটের আরেকটি মাইলস্টোন ছিল ১৯৮৩ সাল। সে বছর বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের শেয়ারের দর প্রথমবারের মতো ১ হাজার ডলার হয়। বাফেটের প্রিয় পানীয় চেরি কোকাকোলা। ১৯৮৮ সালে তিনি কোকাকোলা কোম্পানির শেয়ার কেনেন। এর পর থেকে তো বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ে একের পর এক মাইলস্টোন অর্জন করে বিশ্বের অন্যতম সেরা কোম্পানিতে পরিণত হয়।
বন্ধুত্ব–২: বাফেট ও বিল গেটস
এবার আরেক বন্ধুত্বের গল্প।
দিনটি ছিল ১৯৯১ সালের ৫ জুলাই। এই দিন ওয়ারেন বাফেটের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় বিশ্বের আরেক শীর্ষ ধনী বিল গেটসের। অথচ বিল গেটস সেদিন ওয়াশিংটনের সেই নৈশভোজে যেতেই চাননি। মায়ের অনুরোধে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওয়ারেন বাফেটকে নিয়ে বিল গেটসের বহু লেখার একটি হচ্ছে ‘হোয়াট আই লার্নড ফ্রম ওয়ারেন বাফেট’। লেখাটি ১৯৯৬ সালে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে সেই রাতের বর্ণনা দিয়েছেন বিল গেটস।
বিল গেটস সেখানে লিখেছেন, এমন একজন লোকের সঙ্গে দেখা হবে, যিনি শুধু শেয়ার নিয়েই কথা বলবেন—বিষয়টা মোটেই ভালো লাগছিল না তাঁর। শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হয়েছিলেন, কারণ পারিবারিক সেই অনুষ্ঠানে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মালিক-প্রকাশক ক্যাথরিন গ্রাহামও থাকবেন—এই কথা শুনে। ক্যাথরিনের সঙ্গে এর আগে কখনো আলাপ হয়নি। ক্যাথরিন ছিলেন ওয়ারেনের ভালো বন্ধু।
সেখানেই ওয়ারেনের সঙ্গে বিল গেটসের আলাপ শুরু। বিল গেটস লিখেছেন, কথা ছিল সৌজন্যের খাতিরে মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকবেন। কিন্তু দুজনে এমনই জমে গেলেন যে পুরোটা দিন গল্প করে কাটিয়ে দিলেন। কেবল তা-ই নয়, বিল গেটস কথা দিলেন, শিগগিরই তাঁরা ফুটবল খেলা দেখতে নেব্রাস্কায় যাবেন।
সেই যে বন্ধুত্বের শুরু, আজও তা অমলিন। ওয়ারেন বাফেটের সেরা অনুরাগীর নাম আসলে বিল গেটস।
জীবনের নতুন অধ্যায়
২০০৯ সালের মার্চ মাসের শুরুর একদিন বিল গেটস আসেন ওমাহায়। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটি রেস্তোরাঁয় ওয়ারেন বাফেট আর গেটস একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। সেটা ছিল নতুন এক আলোচনার সূত্রপাত। এরপর বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেট ২০০৯ সালের ৪ মার্চ যৌথভাবে একটি চিঠি লেখেন আরেক শীর্ষ ধনী ডেভিড রকফেলারকে। চিঠিতে তাঁকে একটি নৈশভোজে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় ডেভিড, জনকল্যাণকর কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা দুজন অনেক আলাপ-আলোচনা করেছি। আমরা ভাবছিলাম, আমাদের সমমনা বারোজনের মতো মানুষের সবাই একসঙ্গে একই আলোচনার টেবিলে বসতে পারলে খুব ভালো হয়। আমাদের লক্ষ্য হবে নিজেদের বিভিন্ন দিক শেয়ার করা। সেই সঙ্গে এটাও আলাপ করে দেখা যে যাঁরা এখনো একই পর্যায়ে আসেননি, তাঁদের সমর্থন জোগাতে ও উৎসাহিত করতে আরও বেশি কিছু করা যায় কি না। আমরা দুজনই আপনি এবং আপনার পরিবার দাতব্যকাজে যে সম্মিলিত স্পৃহার জন্ম দিয়েছেন, তার প্রশংসা করি। সে কারণেই আমরা শুরুতেই আপনার কাছে যেতে চাই আমাদের এই আলোচনা আয়োজনে আপনি আগ্রহী হবেন কি না, তা বুঝতে।’
চিঠি পেয়েই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ডেভিড রকফেলার। এরপর ২৪ মার্চ এই তিনজনের স্বাক্ষরে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের আরও কয়েকজনের কাছে। এরপর বহুল আকাঙ্ক্ষিত নৈশভোজটি অনুষ্ঠিত হয় সে বছরের ৫ মে, রকফেলার ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হাউসে। এই উদ্যোগে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন বিল গেটসের তৎকালীন স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ওই সব সেরা ধনী, যাঁরা সম্পদের একটি বড় অংশ যেকোনো ধরনের ভালো কাজে দান করতে আগ্রহী, তাঁদের একত্র করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া।
ওই নৈশভোজের পরই জনসেবা বা জনহিতকর কাজে দানের বিষয়টি নতুন এক ইতিহাস তৈরি করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তহবিল সংগ্রহের কাজটি শুরু হয় এর পর থেকেই। তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ফোর্বস-এর তালিকার চার শ মার্কিন ধনীকে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তাঁরা অন্তত অর্জিত সম্পদের অর্ধেক দান করেন। এরপরই ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় একটি নতুন উদ্যোগের, নতুন কর্মসূচির। তার আনুষ্ঠানিক নাম ‘দ্য গিভিং প্লেজ’ বা ‘দানের অঙ্গীকার’।
এমন নয় যে এর আগে কোটিপতিরা দান করতেন না। যেমন ২০০৬ সাল থেকেই ওয়ারেন বাফেট তাঁর সম্পদ নানা ধরনের জনহিতকর কাজে বিলিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে বাফেট সহায়তা দিচ্ছেন আগে থেকেই। কিন্তু একটি সম্মিলিত উদ্যোগের ভাবনা থেকেই সৃষ্টি হলো দ্য গিভিং প্লেজের। শর্ত এখানে দুটি। সম্পদের পরিমাণ হতে হবে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি, আর দান করতে হবে সে সম্পদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। অবশ্য বিল গেটস তাঁর সম্পদের ৯৫ শতাংশ আর ওয়ারেন বাফেট তাঁর সম্পদের ৯৯ শতাংশ দান করার ঘোষণা দিয়েছিলেন আরও আগেই।
এখন কেমন আছেন
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ওয়ারেন বাফেট প্রকাশ করেন যে তিনি প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে সেটি ছিল প্রথম পর্যায়ের, ফলে কোনো বিপদ ঘটেনি। ২০১৮ সালে এসে ওয়ারেন বাফেট উত্তরাধিকার বাছাইয়ের কাজটি শুরু করেন। ওই বছরের ১০ জানুয়ারি গ্রেগরি অ্যাবেল এবং অজিত জৈন বার্কশায়ারের ভাইস চেয়ার হিসেবে যোগ দেন। বাফেট এ নিয়ে সে সময় বলেছিলেন, উত্তরাধিকার বাছাই করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এই উদ্যোগ। স্বাস্থ্যগতভাবে তিনি খুব ভালো আছেন। দ্রুতই প্রধান নির্বাহীর পদ ছেড়ে তিনি দিচ্ছেন না। দুজনের মধ্যে অ্যাবেল তদারক করছেন বার্কশায়ারের বিমা ব্যবসার বাইরের অন্য সবকিছু, আর বিমা ব্যবসা দেখছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অজিত জৈন।
ওয়ারেন বাফেটের তিন সন্তান। আয়ের ৯৯ শতাংশ দান করার অঙ্গীকারের কারণে সন্তানেরা উত্তরাধিকারসূত্রে পাবেন কমই। বাফেট সব সময়ই বলেন, কিছু একটা করার জন্য তিনি সন্তানদের পর্যাপ্ত অর্থ দিয়ে যাবেন। কিন্তু এত অর্থ দিয়ে যাবেন না, যাতে সন্তানদের কিছুই না করতে হয়।
বাফেট চেয়েছেন তাঁর সন্তানেরা জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুক। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তাঁর সন্তানেরা। প্রথম সন্তান সুজান এলিস বাফেট নিজেই একজন বড় জনহিতৈষী, নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন আছে। জনশিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে এই ফাউন্ডেশন। দ্বিতীয় সন্তান হাওয়ার্ড গ্রাহাম বাফেট একজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং লেখক। ছোট ছেলে পিটার অ্যান্ড্রু বাফেট একজন সংগীতশিল্পী, সুরকার ও লেখক। সংগীতে তিনি আঞ্চলিক অ্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। লেখক হিসেবেও নিউইয়র্ক টাইমস–এর বেস্ট সেলিং তালিকায় তিনি আছেন।
ওয়ারেন বাফেট প্রত্যেক সন্তানের ফাউন্ডেশনে বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের ২১০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ শেয়ার দিয়ে রেখেছেন।
সাধারণ জীবনযাপন
ওয়ারেন বাফেটকে বলা হয় সর্বকালের সেরা বিনিয়োগকারী। আবার একজন ভালো মানুষ হিসেবেও তাঁর সুনাম সর্বত্র। খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন। দিন শুরু করেন ভোরবেলা। আট ঘণ্টা ঘুমিয়ে ওঠেন সকাল পৌনে সাতটায়। পড়তে ভালোবাসেন। দিনের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা কেবল পড়েন। পড়ার তালিকায় থাকে মূলত অর্থনীতির নানা জার্নাল, বিভিন্ন কোম্পানি রিপোর্ট, আর্থিক বিবরণী এবং দৈনিক পত্রিকা। তিনি নিয়মিতভাবে পাঁচটি পত্রিকা পড়েন—ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও ওমাহা ওয়ার্ল্ড-হেরাল্ড। নিজেই বলেছেন, দিনে তিনি অন্তত ৫০০ পৃষ্ঠা পড়তে চেষ্টা করেন।
বাফেটের কাজের পদ্ধতিও আলাদা। বার্কশায়ার হ্যাথঅ্যাওয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫টির বেশি। সব কটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা প্রধান নির্বাহী বা সিইও নিয়োগ দেওয়া আছে। তাঁরাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। বাফেট বলেন, প্রতিষ্ঠানকে সিইও বা ব্যবস্থাপকের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। আর তাঁর কাজ হচ্ছে যোগ্য সিইও বা ম্যানেজার খুঁজে বের করা। তিনি মনে করেন, বিশেষ মানবিক গুণ থাকলেও বুদ্ধিহীন লোকের পক্ষে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আর আরামপ্রিয় লোকদের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কারণ, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁরা ভেঙে পড়েন। একধরনের মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে পেশা শুধু উপার্জনের মাধ্যম নয়, ব্যক্তিগত গর্বও বটে। নিতে হবে তাঁদেরই।
নিয়ম মেনে বছরে একবার বার্কশায়ার হ্যাঙ্গারের বার্ষিক সভা হয়। সেই সভার প্রতি দৃষ্টি থাকে সবার। প্রতিবছর এই সভা উপলক্ষে ওয়ারেন বাফেট একটি চিঠি লেখেন। ১৯৬৫ সাল থেকে তিনি প্রতিবছর চিঠি লিখে আসছেন। বলা হয়, সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ-পরামর্শ লুকিয়ে থাকে ওয়ারেন বাফেটের ওই বার্ষিক চিঠিতেই। এই চিঠিকে বলা হয় সেরা বিনিয়োগ-সাহিত্য।
ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগ-পরামর্শের জন্য এখনো সবাই উন্মুখ হয়ে থাকেন। তাঁর বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে আছে অসংখ্য বই। বিনিয়োগ নিয়ে তাঁর কয়েক হাজার উক্তি পাওয়া যায়। এর মধ্যে উত্তরসূরিদের জন্য তাঁর সবচেয়ে ভালো পরামর্শের একটি হচ্ছে—তাঁদের অবশ্যই তিনটি খারাপ দিক থেকে দূরে থাকতে হবে। যাকে তিনি বলেছেন, ‘এবিসি অব বিজনেস ডিকেই’। যেমন অ্যারোগেন্স বা ঔদ্ধত্য, ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র এবং কমপ্লাসেন্সি বা আত্মতুষ্টি।
বাফেট বলেন, একজন ভালো ম্যানেজার বড় ফুটবল কোচের মতো। তাঁরা নিজে মাঠে না নেমেও দলকে খেলান ও জিতিয়ে আনেন। আবার জয়ী হওয়ার উপাদান রেখে যান টিমের মধ্যে, যাতে তিনি না থাকলেও জিততে পারে দলটি। বিনিয়োগ করার জন্য তাঁর সেরা পরামর্শ হচ্ছে, যে জিনিস আমি নিজের জন্য কিনব না, তা অন্যকে কেনার উপদেশ দেব না।
চার্লি মাঙ্গারের মৃত্যুর পর বার্কশায়ারে একা হয়ে গেছেন ওয়ারেন বাফেট। তাই এ বছর তিনি চিঠিতে কী লিখবেন, সবার নজর থাকবে সেদিকেই।

অর্থনীতি
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ জুলাইয়ের চেতনার পরিপন্থি: সিপিডি

রাজনৈতিক সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটেও অপ্রদর্শিত আয় (কালোটাকা) বৈধ করার সুযোগ রাখায় কড়া সমালোচনা করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ ধরনের পদক্ষেপ জুলাই আন্দোলনের বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি।
মঙ্গলবার (৩ জুন) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর একটি হোটেলে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
ফাহমিদা বলেন, বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে। তাতে যারা নিয়মিত নৈতিকভাবে কর দেন তাদের নৈতিকতাতে আঘাত করা হয়েছে। এতে বৈধপথে উপার্জনকারীদের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি হবে। তাছাড়া এই পদক্ষেপে সরকারের খুব বেশি রাজস্ব আয় হবে বলেও মনে হয় না।
তিনি বলেন, আয়কর আইন-২০২৩ এর প্রথম তফসিলের আওতায় যেকোনো ব্যক্তি আবাসন বা অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগ করে নির্ধারিত বিশেষ কর দিয়ে অঘোষিত তহবিলকে বৈধতা দিতে পারেন। এই সুবিধা গ্রহণের জন্য করের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। কিন্তু সিপিডি সবসময়অঘোষিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগের বিরুদ্ধে। এই সুবিধা সৎ করদাতাদের জন্য নিরুৎসাহিত করে। কর কর্তৃপক্ষের কর আইন ও বিধি প্রয়োগের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
ফাহমিদা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ আয় ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, এই ধরনের পদক্ষেপ সাধারণ জনগণের কাছে কেবল ভুল সংকেত পাঠাতে পারে। এটি জুলাইয়ের চেতনার পরিপন্থি।
তিনি বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বৈষম্যের হাতিয়ার। এ ধরনের সু্বিধা বৈধভাবে আয় করা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। এটা বৈষম্য। যা জুলাই আন্দোলনের যে বৈষম্যবিরোধী চেতনা,তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করি।
এর আগে সোমবার (২ জুন) অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন। বাজেটে বলা হয়েছে, কেউ চাইলে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে নিজের অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতে পারবেন। তবে এবারের বাজেটে আগের তুলনায় বেশি হারে কর দিতে হবে।
বাজেটের সামগ্রিক কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক। তার মতে, কিছু কিছু পদক্ষেপ ভালো নেওয়া হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু সামগ্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যে একই কাঠামোর মধ্যে এখানে একটু বেশি, ওখানে একটু কম—এ রকম করে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাজেটের যে দর্শন, সেখানে বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সব ক্ষেত্রে সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অর্থনীতি
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা নেই

প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। এতদিন ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা ছিল।
সোমবার (২ জুন) বিকেলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেট ঘোষণায় বলা হয়, ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না। ট্রেড লাইসেন্স নিতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। বর্তমানে ৪৬টি সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব ৪৬ সেবার মধ্যে এখন ১১ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র দাখিল করলেই সেবা মিলবে।
বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে চায় সরকার। এ খাত থেকে এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
এদিকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মোট ৮৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার মধ্যে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের পরিশোধ বাদ দিয়ে সরকারের নিট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মোট ৪৮ হাজার ৬১৫ কোটি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার। একই সময়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের নগদায়ন বাবদ ৪৩ হাজার ৪৭৬ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। সে হিসাবে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা।
তবে স্বস্তির বিষয় হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনার নিয়ম আরও সহজ করেছে সরকার। এতে স্বস্তি পাবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও কৃষিপণ্যের আমদানিতে স্থানীয় ঋণপত্রের (এলসি) কমিশনের ওপর উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর আওতায় পড়বে চাল, ডাল, ধান, গম, পেঁয়াজ, আলু, চিনি, ভোজ্যতেলসহ ২৫টির বেশি খাদ্যপণ্য। এছাড়া কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ফলমূল আমদানির ওপর কর হ্রাসের মাধ্যমে ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের (৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার হ্রাস পাওয়ার ঘটনা।
অর্থনীতি
বছরে একবারের বেশি স্বর্ণ আনলে মিলবে না ব্যাগেজ রুলসের ছাড়

শুল্ক পরিশোধ করে বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনার সুবিধা আরও সংকুচিত করলো অন্তর্বর্তী সরকার। শুল্ক পরিশোধ সুবিধার আওতায় ঘন ঘন দেশে স্বর্ণ আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনা হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে।
এখন থেকে কোনো যাত্রী বছরে একবারের বেশি ব্যাগেজ রুলসের সুবিধায় স্বর্ণ আনতে পারবেন না।
সোমবার (২ জুন) অর্থমন্ত্রী ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের রেকর্ডকৃত বক্তব্যের মাধ্যমে এই সংশোধনের ঘোষণা দেন।
বর্তমানে ঘোষণা দিয়ে একজন যাত্রী বছরে যতবার ইচ্ছা ১১৭ গ্রাম বা ১০ ভরি স্বর্ণ আনতে পারেন এবং এতে ৪০ হাজার টাকা কর দিতে হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে কোনো যাত্রী বছরে একবারের বেশি ব্যাগেজ রুলসের সুবিধায় স্বর্ণ আনতে পারবেন না।
বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি থাকলেও বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) নেতারা বলছেন, আমদানির তুলনায় ব্যাগেজ রুলসের আওতায় স্বর্ণ আনা তুলনামূলক সস্তা। তাই অনেকে আমদানির বদলে যাত্রীদের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলস ব্যবহারে বেশি আগ্রহী।
এমনকি অনেক চোরাচালানকারীও এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকার ২০১৮ সালে দেশে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দিলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই বছর থেকে চার বছরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে এসেছে মাত্র ১৪৫ কেজি স্বর্ণ, যা দেশে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদার এক শতাংশেরও কম।
তবে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রতিদিন শত কেজির বেশি স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে, যা আইনি হলেও আমদানির হিসাব ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকছে।
আগের ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, একজন নারী যাত্রী ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার বিনা শুল্কে আনতে পারতেন।
অর্থনীতি
বাড়ছে না বিদ্যুতের দাম

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক ব্যয় ১০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হলেও আপাতত দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণায় তিনি এ তথ্য জানান।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আপাতত বিদ্যুতের মূল্য না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে চলতি বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তিনি বলেন, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে নীতিগতভাবে আমরা বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ খাতে প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক ব্যয় ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলোও পর্যালোচনা করছি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে এনার্জি অডিট করার উদ্যোগ নিয়েছি।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার এবং ২০২৮ সালের মধ্যে স্থানীয় কূপ থেকে অতিরিক্ত ১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
অর্থনীতি
চলতি জুনেই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে: অর্থ উপদেষ্টা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলেন। তার এ বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।
মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
কাফি