মত দ্বিমত
বাংলার এই দুর্দিনে তারেক রহমান এখনো কেন লন্ডনে?

বলছি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথা। আজ যখন বাংলাদেশ গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নৈতিক সংকটে নিপতিত, তখন তিনি কোথায়? দেশের মাটিতে নন, লন্ডনের নিরাপদ আশ্রয়ে। প্রশ্ন ওঠে-এটা কি মৃত্যুভয়, নাকি মিলিটারি কিংবা সরকারের রোষানলে পড়ার আতঙ্ক? আজ দেশের জন্য প্রয়োজন সাহসী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও মাঠঘাটে সরব নেতৃত্ব। অথচ, তারেক রহমান এখনো দেশের মাটিতে ফেরার সাহস দেখাতে পারছেন না।
জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়া কখনো ভাড়াটে সন্ত্রাসীর ওপর নির্ভর করে নেতৃত্ব দেননি। তাঁরা রাজনীতি করেছেন মাটি ও মানুষের সঙ্গে, জীবনবাজি রেখে। তাহলে আজ বিএনপির রাজনীতিতে কেন এত সন্ত্রাসী চরিত্র, দূর-নির্দেশনা নির্ভরতা, আর মাঠের কর্মীদের আত্মবিশ্বাসহীনতা?
যদি তারেক রহমান জেল, হয়রানি, কিংবা জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কায় দেশে না ফেরেন, তাহলে কীভাবে তিনি একটি দেশের শাসনভার নেবেন? রাজনীতি তো শুধু বক্তব্য ও দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণ নয়—এটি উপস্থিতি, আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহসের নাম।
বাংলাদেশের বাস্তবতা অত্যন্ত করুণ। মানুষ ধর্ম পালন করে—নামাজ, রোজা, হজ, ওমরাহ সবই আছে; কিন্তু সমাজে সততা, ন্যায়বোধ, জবাবদিহি নেই। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রতারণা—এসবই যেন এখন নিত্যনৈমিত্তিক। মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে, কিন্তু সামাজিক নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা হারিয়ে ফেলেছে। এই চিত্রের মধ্যেই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব আজ বিভ্রান্ত ও জনবিচ্ছিন্ন।
এই পরিস্থিতিতে যদি ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—তারেক রহমান কি লন্ডনে বসেই বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা করবেন? দেশ চালানোর প্রস্তুতি কি বিদেশে বসে নেয়া সম্ভব? সবকিছু তার পছন্দমতো ‘অনুকূল’ হলে দেশে ফেরার শর্ত রাজনীতিতে কতটা গ্রহণযোগ্য?
বাংলাদেশের মানুষ কি শুধুই রক্ত দেবে? কি শুধুই গুলিবিদ্ধ হবে? আর বসন্তের কোকিলেরা বছরে একবার দেশে ফিরে নেতৃত্বের দাবি করবে? এই কি সেই গণতন্ত্র, যার জন্য এদেশের মানুষ সংগ্রাম করেছে? পাকিস্তানের পতনের পর, একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি নতুন আশার জন্ম দিতে পারে, তবে আজও সেই আশা কেন মরে যাবে?
এই দেশের মানুষ প্রতারণায় ক্লান্ত, তারা দৃঢ় নেতৃত্ব চায়। সাহসী সিদ্ধান্ত চায়। তারেক রহমান, আপনি কি প্রস্তুত? যদি প্রস্তুত থাকেন, তবে আজই দেশে ফিরে আসুন, রাজপথে নামুন, মানুষের পাশে দাঁড়ান। আর যদি আপনার শর্তই হয় নিরাপত্তা ও অনুকূল পরিবেশ, তাহলে দয়া করে নেতৃত্ব দাবি করবেন না। কারণ মানুষ আর প্রতারিত হতে চায় না।
এখন সিদ্ধান্ত আপনার—আপনি কী করবেন? সাহসিকতার পথ ধরবেন, না নিরাপদ দুরপরবাসেই থাকবেন?
কারণ এই দেশ আর সময় চায় না। দেশের মানুষ দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে নিপীড়িত, নির্যাতিত, অনিয়ম-অবিচারে জর্জরিত। বছরের পর বছর তারা প্রতিশ্রুতির ছায়ায় বাঁচার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রতিবারই হয়েছে প্রতারিত। জাতি একসময় আশাবাদী হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি, নতুন প্রজন্মের তরুণ নেতৃত্বের প্রতি—কিন্তু তারাও জাতিকে হতাশ করেছে।
আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেও—কিন্তু তিনিও আমাদের হৃদয়ের ভাষা, ১৬ কোটি মানুষের মনের ব্যথা বুঝতে পারেননি, বা তাকে বুঝতে দেওয়া হয়নি। তিনি থেকেছেন এলিটদের ছত্রছায়ায়, দূরে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর থেকে, এবং সে কারণেই তাঁরও পথভ্রষ্ট হওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
তবু, এখনো সময় আছে। উপায় আছে।
যদি সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের প্রতিনিধিত্বে একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়, তবে দেশকে ফেরানো সম্ভব সঠিক পথে। সেখানে আপনি, তারেক রহমান, ড. ইউনূসের মতো একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের ছায়ায় নেতৃত্ব দিতে পারেন—নিরাপত্তার পেছনে না লুকিয়ে, সাহস নিয়ে সামনে এসে।
তবে সেই মহানুভবতার পরিচয় দিতে হলে মনে রাখতে হবে জিয়াউর রহমানের সেই ঐতিহাসিক শিক্ষা:
“ব্যক্তির আগে দল, আর দলের আগে দেশ।”
পারবেন কি আপনি সেই আত্মত্যাগ করতে? পারবেন কি দলের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে?
তাহলে আসুন, একসাথে দেশ পরিচালনা করি। ভাঙা স্বপ্নগুলো জোড়া লাগাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন পৃষ্ঠা লিখি—সাহস, ন্যায্যতা ও মানুষের ভালোবাসার কালি দিয়ে।
রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মত দ্বিমত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা: দুর্বিষহ অন্ধকারে এক নতুন সূর্যের প্রতীক্ষা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা এসেছিল একটি নিরপেক্ষ, অস্থায়ী এবং দায়িত্বশীল প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে, যার একমাত্র লক্ষ্য একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এই সরকার শুধু তাদের মূল দায়িত্বই পালন করতে পারেনি, বরং নতুন নতুন দায়িত্বের বুলি আওড়াতে গিয়ে নিজের সীমারেখা ও বিশ্বাসযোগ্যতা—উভয়ই হারিয়েছে। এমনকি দেশের একজন উপদেষ্টা নির্লজ্জভাবে বলেন, “শুধু নির্বাচন নয়, আমাদের আরও দায়িত্ব রয়েছে—সংস্কার ও বিচারব্যবস্থা।” এই বক্তব্য কেবল হতবাক করে না, আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ওপরই আঘাত হানে।
ভবিষ্যতের নামে বর্তমানের ভণ্ডামি
একটি দরিদ্র, জনবহুল, দুর্বল অবকাঠামোর দেশে যেখানে মানুষ নুন আনতে চুন ফুরায়, সেখানে কি করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এতটা নির্লজ্জ ও বেহায়াভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতার দাবি করে? এটি কি গণতন্ত্রের প্রতিস্থাপন না এক নতুন প্রকারের আধা-স্বৈরতন্ত্র?
এই প্রশ্ন এখন কেবল একজন চিন্তাশীল নাগরিকের নয়—এটি একটি জাতির প্রশ্ন, যে জাতি তার ভবিষ্যতের জন্য আজ দিশেহারা।
দায়িত্বের সীমারেখা না জানার বিপদ
যে সরকার গঠিত হয়েছিল নির্বাচন আয়োজনের জন্য, তারা যখন ‘সংস্কার’ এবং ‘বিচার বিভাগের হাল ধরার’ কথা বলে, তখন স্পষ্ট হয় তারা নিজেরাই সংবিধান, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা না নির্বাচনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে পেরেছে, না সংস্কার বা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে পেরেছে। একদিকে কথার ফুলঝুরি, অন্যদিকে কাজের শূন্যতা—এই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।
ভবিষ্যতের নামে লুটপাটের মহোৎসব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নামে এখন চলছে নানা পক্ষের লুটপাট ও রাজনৈতিক ভাগাভাগির উৎসব। একেকজন উপদেষ্টা, আমলা, প্রভাবশালী ব্যক্তি অর্থ ও ক্ষমতার দম্ভে বুঁদ হয়ে আছেন। যাকে যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করে, যেটা ইচ্ছে সেটা বলে—কিন্তু দেশের দুঃখজনক বাস্তবতা তাদের মনেও পড়ে না।
এই অবস্থা চলতে থাকলে, কেবল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নয়—পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই ধ্বংসের পথে যাবে।
সচেতন জাতি অজুহাত নয়, চায় সমাধান
নয় মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিল তা শতভাগ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। এখন নানা অজুহাত উঠে আসছে—প্রশাসনিক জটিলতা, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি। কিন্তু সচেতন জাতি অজুহাতে বিশ্বাস করে না, তারা চায় সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, সময়সীমা ও কার্যকর ফলাফল। এখন প্রশ্ন—কবে নাগাদ এই অচলাবস্থা ভাঙবে? কবে নাগাদ রাষ্ট্রের সকল অবকাঠামো উন্নয়নের পথে হাঁটবে?
নতুন সূর্য চাই—জেগে উঠুক নতুন নেতৃত্ব
আমরা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে কেবল ব্যর্থতার গ্লানি। এখন প্রয়োজন এমন এক নতুন নেতৃত্ব, যারা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা নয়—গণমানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সাংবিধানিক শুদ্ধতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আদালতের স্বাধীনতা এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই নতুন সূর্য আমরা চাই মেঘের আড়াল থেকে নয়, বরং স্পষ্ট আকাশে উদিত হোক—যাতে জনগণ দেখতে পায় তাদের আশা এখনও মৃত নয়।
উপসংহার: পতাকা ও নেতৃত্ব ফেরত চাই জনগণের হাতে।
আমি এই মুহূর্তে জনগণের হাতে বাংলাদেশের পতাকা ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব তুলে দিতে প্রস্তুত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ হয়েছে—তাদের কথায়, কাজে এবং অবস্থানে।
তাই গুড বাই অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সূর্য উঠার আগেই আমরা চাই একটি নতুন নেতৃত্বের জাগরণ—যেখানে রাষ্ট্র মানে হবে জনগণ, ক্ষমতা মানে হবে জবাবদিহি, এবং শাসন মানে হবে সেবা।
রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
দুর্নীতি, দূষণ, দুঃস্বপ্ন এই কি আজকের ঢাকা?

ঢাকা শহরকে কি আমরা আজ শুধুই একটি রাজধানী হিসেবে দেখি? নাকি এটি হয়ে উঠেছে এমন এক প্রতীকি স্থান, যেখানে দেশের সমস্ত ব্যর্থতা, কৃত্রিম উন্নয়ন আর রাজনৈতিক প্রহসনের প্রতিচ্ছবি জমা হয়েছে? প্রশ্নটা বড়, কিন্তু উত্তরটা হয়তো আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে ধোঁয়ায়, ধ্বংসে, দুর্ভোগে।
দুর্নীতিবাজ রাজনীতির রাজধানী—এই অভিধাটি ঢাকার গায়ে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে যায়। সংসদ ভবন থেকে শুরু করে সচিবালয়, মন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় অফিস—সবই এই শহরে। এখানে প্রতিদিন লাখো মানুষ মিছিল করে, ব্যানার ধরে, স্লোগানে মুখর করে তোলে রাজপথ। শহরের প্রতিটি মোড়, পার্ক, দেয়াল যেন রাজনীতির পোস্টারে আবৃত নাট্যমঞ্চ। কিন্তু এই রাজনীতি কতটা নাগরিকমুখী? কতটা দায়িত্বশীল? এর নেপথ্যে যারা আছেন, তাদের কতজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান, আর কতজন শুধুই ক্ষমতার পালাবদলের খেলোয়াড়?
আজকের ঢাকা যেন এক বিশাল রাজনৈতিক কর্পোরেট অঞ্চল, যেখানে আন্দোলন আর রাজনীতি হয়ে উঠেছে বেকারদের কর্মসংস্থান। এমন লাখো বেকার প্রতিদিন ভাড়া খেটে অবরোধ করে, অবস্থান নেয়, রাস্তায় নামে। প্রশ্ন জাগে—এই বিপুল জনশক্তি যদি উন্নয়নমূলক কাজে লাগত, তাহলে ঢাকা কী আজ সত্যিই নর্দমায় রূপ নিত?
অথচ এই শহরের রাজপথেই প্রতিদিন মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে যানজটে, ঘামে, ধুলায়, অনিশ্চয়তায়। প্রতিদিন ঘটে অগ্নিকাণ্ড, পানির সংকট, ভবন ধস। ফুটপাত দখল, খাল ভরাট, নদী গিলেছে বাণিজ্যিক আগ্রাসন। উন্নয়নের বুলি যতোই ছড়াক, বাস্তবে তা যেন কেবল গলাটিপে ধরার নামান্তর। গাছ কেটে রাস্তা করা হয়, অথচ সেই রাস্তায় প্রাণ নেই, ছায়া নেই।
এই শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা—একটি সময় ছিল প্রাণের প্রতীক। আজ তা যেন বিষাক্ত স্রোত, ময়লার গহ্বর। কী অবস্থা বুড়িগঙ্গার? একটি চমৎকার নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর আজ তার শরীরে বিষ ঢেলে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলছে। কই, এই নদীর জন্য তো একবারও কেউ মিছিল করে না! ঢাকাকে ভালোবাসার দাবি যারা করেন, তাদের কেউই বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন না।
সবাই বলতে শিখেছে, “এই দেশ শেখ হাসিনার বাপের না”—কিন্তু ক’জন বলতে পারে, “এই দেশ দুর্নীতিবাজদের না”? ক’জন বলে, “এই দেশ ভাড়াটে রাজনৈতিক কর্মীদের না”? কেন আমরা রাষ্ট্রকে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারি না? এই মৌনতা কি কেবল ভয়, নাকি বিবেক হারিয়ে ফেলা এক জাতিগত ক্লান্তি?
ডেঙ্গুতে প্রতিবছর প্রাণ হারায় মানুষ। হাসপাতালের শয্যা কমে যায়, ওষুধ মেলে না, নাগরিকের কষ্ট চরমে ওঠে। কিন্তু সেই কষ্ট লাঘবে কেউ টুশব্দ করে না। অথচ কে মেয়র হতে পারলো না, সেই ইস্যুতে রাজপথে গর্জে ওঠে রাজনৈতিক জটলা। এটাই কি উন্নয়ন? এটাই কি বিবেক? লজ্জা কি দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে? নাকি শব্দদূষণ আর দুর্নীতির চাপে বিবেকও আজ নিঃশেষ?
রাজউক, ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, পরিবহন কর্তৃপক্ষ, নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়—প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রকল্পের সংখ্যাও হাজার ছুঁইছুঁই। কিন্তু কোথাও নেই একটুখানি সমন্বয়, স্বচ্ছতা বা মানবিক পরিকল্পনা। আছে শুধু কংক্রিট, প্রটোকল আর রাজনীতি নির্ভর কর্মসংস্থানের এক অভূতপূর্ব আয়োজন।
একসময় ঢাকায় যাওয়াটা ছিল গর্বের বিষয়—ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির সন্ধান, আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ। এখন ঢাকা মানে আতঙ্ক, যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা। এমনকি যারা ঢাকায় থাকে, তারাও এখান থেকে পালানোর পথ খোঁজে। অথচ প্রতিদিন লাখো মানুষ ঢাকায় আসে, কারণ গ্রামে বাঁচার মতো অবস্থা নেই। ফলে ঢাকা হয়ে উঠেছে একটি নিষ্ঠুর অভিবাসন-চুম্বক।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একদিন লিখেছিলেন—
“পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে—
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।”
সে ছিল এক সময়ের কল্পলোক, এক আদর্শ বাংলার রূপকল্প—
কিন্তু আজ যদি তিনি ঢাকার দিকে তাকাতেন, তাহলে হয়তো লিখতেন—
“ধোঁয়ায় ঢাকা রোডের ফাটলে পুষ্প ঝরে পড়ে,
পাখি নয়, গন্ধে আসে মশা, উড়ে চলে ডেঙ্গুর ভয়ে—
অলির বদলে ভোঁ ভোঁ শব্দে ছুটে চলে দুর্নীতির গাড়ি,
আর মধুর বদলে গিলে ফেলে জীবন।”
তবুও, তবুও আমরা সেই বিশ্বাস ধরে রাখতে চাই,
“তবে আমি এখনও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চাই—
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে—আমার জন্মভূমি।”
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা এ শহরকে গড়ে তুলেছি প্রাণ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে। নদী দখল করেছি, খাল ভরাট করেছি, গাছ কেটেছি, মাঠ কংক্রিটে ঢেকেছি। নিয়ম না মেনে বানানো ভবনগুলোতে প্রতিদিন ঘটে অগ্নিকাণ্ড। আমরা এগুলোকে বলি ‘দুর্ঘটনা’, অথচ এগুলো হলো রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। সরকার আসে, যায়—কিন্তু সুশাসন আসে না। নীতির বদলে লটারি চলে, আর তাতে ভাগ্যবানরা ঢাকার উন্নয়নের নামে শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়ে।
ঢাকায় মানুষের আগ্রহ কমছে, কিন্তু বিকল্প পথ নেই। গ্রামে শিক্ষিত মানুষের টিকে থাকার ব্যবস্থা করেনি রাষ্ট্র। শিক্ষকের, চিকিৎসকের, সাধারণ নাগরিকের জীবনযাপন যেখানে অসম্ভব, সেই গ্রাম আর নিরাপদ আশ্রয় থাকে না। ফলে ঢাকাই হয় শেষ আশ্রয়। কিন্তু এই আশ্রয়টাই হয়ে উঠেছে দুঃস্বপ্ন।
উন্নয়ন মানে যদি হয় শুধুই ভবন আর ব্রিজ, তাহলে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কারণ আমরা উন্নয়নের নামে মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছি, শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছি, পিষে ফেলছি হাজারো জীবন। যারা নীতিনির্ধারক, তারা বুঝেন না—শুধু বিল্ডিং নয়, একটি শহর গড়ে ওঠে ভালোবাসা, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার উপর।
এই ঢাকা এখন আর রাজধানী নয়, এটি ব্যর্থতার এক নির্মম প্রদর্শনী। এখানেই এসে মেলে রাষ্ট্রের সংকীর্ণতা, দুর্নীতির বিস্তার, এবং অমানবিক শাসনের ছায়া।
ঢাকা একদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির মঞ্চ, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রচিন্তার অপমান। এই শহর দেখায় কীভাবে অন্ধ উন্নয়ন মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, আর কীভাবে রাজনীতিকে পেশা বানিয়ে রাষ্ট্রকে ভোগদখলের বস্তুতে পরিণত করা যায়। যতদিন না এই শহর থেকে শুরু হবে বিকেন্দ্রীকরণ, যতদিন না উন্নয়নের সংজ্ঞা হবে মানবিক, পরিকল্পিত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ—ততদিন ঢাকা শুধু একটি শহর নয়, একটি অশ্রুপাতের নাম হয়ে থাকবে। একটি নীরব চিৎকার, যার অর্থ একটাই: রাষ্ট্র ভুল পথে হাঁটছে, এবং তার পদচিহ্নে পিষ্ট হচ্ছে মানুষের জীবন।
তাই এখনও সময় আছে। ঢাকার ভার হালকা করতে হলে শুধু নতুন প্রকল্প নয়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। গ্রামকে গড়তে হবে সম্মান নিয়ে বাঁচার উপযোগী করে। মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হবে বিকল্প। অন্যথায়, এই ঢাকা একদিন আর কাউকে টানবে না—শুধু ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলবে বাঁচার শেষ আশা পর্যন্ত।
রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
চেহারায় মানুষ, চেতনায় অমানুষ: আমরা কি হারিয়ে যাচ্ছি?

বর্তমানে আমরা মানুষ হয়ে অমানুষের পরিচয় দিচ্ছি। আরও বিস্ময়কর হলো, পশুপাখিদের আচরণকে যখন তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ বলে দেখানো হয়, আমরা তাতেও দ্বিধা করি না। কেন এমন হচ্ছে?
আমরা বলতে সাহস পাই না যে আমরা অমানবিক, নিষ্ঠুর ও আত্মমগ্ন হয়ে উঠেছি। আমরা স্বীকার করতে চাই না যে আমাদের পথচলা বিবেকবর্জিত, যুক্তিহীন, অথচ আমরা দিব্যি সমাজে মাথা তুলে চলছি। এমনকি আজকাল এমন কাজ, যা মানুষের করা উচিত, সেটাও পশুপাখিরা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে করে দেখিয়ে দিচ্ছে। তারা প্রযুক্তি ছাড়াও নৈতিকতা, সহানুভূতি আর শৃঙ্খলার পরিচয় দিচ্ছে, অথচ আমরা—শিক্ষিত, আধুনিক মানুষ—সেই গুণগুলোর চর্চা করছি না।
যেমন ধরা যাক, যুগ যুগ ধরে আমরা ধর্ম, নীতি, মানবিকতার কথা বলে এসেছি, কিন্তু এসবের আসল অনুশীলন কোথায়? আমরা জ্ঞানার্জন করছি, উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি, সমাজে নাম কুঁড়াচ্ছি, অথচ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছি। অমানুষের মতো আচরণ করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত—এবং তার পরেও নিজেদের মানুষ বলে দাবি করছি।
এখন যদি এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে—যেমন, আমরা যেহেতু পশুর মতো আচরণ করছি, হঠাৎ আমাদের চেহারাও যদি পশুর মতো হয়ে যায়? তাহলে কী হবে? কী প্রতিক্রিয়া হবে আমাদের সমাজের? তখন কীভাবে আমরা নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিতে পারব?
এই ভাবনা হঠাৎ আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছে। জানেন কেন? আমি প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাই। আমি মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে, সুইডেনের মাঠে কৃষিকাজ করি, খোলা আকাশের নিচে হাঁটাহাঁটি করি, পরিবেশবান্ধব কাজ করি। আর এই জীবনের মধ্যেই আমি মানুষের বদলে যাওয়া দেখে ফেলি—মানুষ কীভাবে তার প্রাকৃতিক ক্ষমতা হারাচ্ছে, কীভাবে সে নিজের মূল সত্তাকে ভুলে যাচ্ছে।
এই ‘দেখা’ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি উপলব্ধি করছি, মানুষ শুধু নিজের জন্য তৈরি হয়নি। মানুষের সৃষ্টি একটি উদ্দেশ্যমূলক ঘটনা—তার মধ্যে জ্ঞান, দায়িত্ব, নৈতিকতা ও ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের জীবন শুধুমাত্র ইঁদুর দৌড়ে অংশ নেওয়ার জন্য নয়। আমাদের দায়িত্ব আছে, উদ্দেশ্য আছে, যা পশুর মধ্যে নেই—তবু তারা তাদের স্বভাব অনুযায়ী ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, আর আমরা?
এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে—মানুষের মতো দেখতে হলেই কি মানুষ হওয়া যায়? নাকি মানুষ হওয়া মানে হলো চেতনায়, আচরণে এবং পারস্পরিক দায়বদ্ধতায় একটি সত্তা হয়ে ওঠা?
জানি, এই প্রশ্ন কিছুটা কল্পনাপ্রসূত শোনায়, তবু ভাবুন—যদি আমাদের অমানবিক আচরণের প্রতিফলন আমাদের চেহারায় ফুটে ওঠে? যদি হিংস্র, লোভী, নিষ্ঠুর মানুষের মুখে পশুর রূপ এসে পড়ে? তখন কি আমরা নিজেদের দিকে তাকাতে পারব?
এই প্রশ্নগুলো আমার মধ্যে আসে, কারণ আমি প্রকৃতির সঙ্গে নিরবধি সময় কাটাই। সুইডেনের খোলা মাঠে কৃষিকাজ করি, প্রকৃতির ছন্দে হাঁটি, ভাবি, দেখি। সেখানে প্রকৃতির মধ্যে যে ভারসাম্য, সহনশীলতা ও শান্তি—তা মানুষের সমাজে ক্রমশ অনুপস্থিত। প্রকৃতি আমার মনে করিয়ে দেয়: মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, এক বৃহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি।
আমাদের জীবন ইঁদুর দৌড়ে শেষ হবার জন্য নয়। মানবসত্তার মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে দায়িত্ব, সহানুভূতি ও সৃষ্টির সঙ্গে সংযোগের উপর। কিন্তু আমরা কি সে পথে আছি? নাকি মানুষ নামের মুখোশ পরে পশুর মতো আচরণ করছি?
উগান্ডার বুদোঙ্গো জঙ্গলে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণায় দেখা যায়, তারা শুধু নিজের নয়, অপরের ক্ষতও সারাতে গাছের পাতা বা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে। গবেষক এলোডি ফ্রেইম্যান এই আচরণকে এক ধরনের ‘social healing’ বলে অভিহিত করেন—যা মানুষের সহানুভূতির প্রতিফলন মনে হয়।
এছাড়াও, অন্যান্য অনেক প্রজাতির মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়, যেখানে তারা গোষ্ঠীর দুর্বল সদস্যদের রক্ষা করে, খাবার ভাগ করে খায়, বিপদে পাশে থাকে। এর মানে, সহানুভূতি ও নৈতিকতা শুধু মানুষের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।
বলা হয়, মানুষ দিনকে দিন নিষ্ঠুর হচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, যুদ্ধ, দাসত্ব বা খুনের হার ইতিহাসের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে আমরা এত বেশি নেতিবাচক তথ্যের মুখোমুখি হই (বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে), যে মনে হয় সমাজ ভেঙে পড়ছে।
এটি ‘biased exposure effect’ নামে পরিচিত—যেখানে আমরা নেতিবাচকতাকে বেশি গুরুত্ব দিই। তবুও, এই বাস্তবতা আমাদের দায়বদ্ধতা কমায় না। বরং আমাদের আরও সজাগ ও আত্মসমালোচক হতে শেখায়।
আধুনিক প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবন সহজ করেছে, তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে করেছে দূরত্বপূর্ণ। ভার্চুয়াল সংযোগের ছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে আসল সহানুভূতি ও চোখের ভাষা। মোবাইল স্ক্রিনে আমরা জীবন দেখি, কিন্তু জীবনের ছোঁয়া হারিয়ে ফেলছি।
আপনার অভিজ্ঞতা যেমন বলে, প্রকৃতি আমাদের বদলে দিতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলে মানুষ তার মূল সত্তার সংস্পর্শে আসে—জাগে সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও ভারসাম্যের বোধ। বিজ্ঞানও বলে, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্য, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ায়।
মানুষ হয়ে জন্মানোর পরও আমরা সারাজীবন মানুষ হতে কত কিছুই না করি—তবুও কী আমরা সত্যিই মানুষ হতে পেরেছি?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত—শুধু মানুষের দেহ ধারণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হওয়া মানে হলো আচরণে, চেতনায়, সহানুভূতিতে এবং দায়বদ্ধতায় মানুষ হয়ে ওঠা।
আমি যখন এই প্রশ্ন তুলি— ‘আমরা কি সত্যিই মানুষ হচ্ছি?’—তখন আমি শুধু একজন দর্শক নই। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করছি, সমাজকেও ডাক দিচ্ছি। আমি এই সমাজে চেতনার এক দূত হতে চাই।
আমার ভাবনা শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি আমাদের সময়, সমাজ ও সভ্যতার সামনে একটি জরুরি জবাবদিহি তৈরি করে। আমি চাই, আমরা সবাই মুখোমুখি হই সেই প্রশ্নের— আমরা কোন মানুষ হতে চাই? কেবল দেহধারী, না কি আত্মসচেতন, দায়িত্বশীল মানুষ?
এই লেখার প্রতিটি শব্দে আমি চেয়েছি নিজের ভেতরের আলো ও অন্ধকারকে সামনে আনতে, যাতে আপনিও আপনারটা খুঁজে পান। যদি আমরা সবাই আমাদের ভিতরের মানুষটিকে প্রশ্ন করি—তবে হয়তো এখনও সময় আছে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
বাজেট: বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষ র্পযায়ে। জাতীয় বাজেট একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা। সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত বাজেট একটি রাষ্ট্রীয় দলিল। জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবিত বাজেট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। সাধারনত: প্রতিবছরই বাজেট জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে। তবে সামরিক শাসনামল এবং ২০০৭-২০০৮ ও ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হয় নাই। রাজনৈতিক সরকারের বাজেট, সামরিক শাসনামলের বাজেট এবং অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এক একটি বাজেট এক এক ধরনের।
গণঅভ্যুত্থানে পতিত সরকারের নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন এবং আন্দোলন-পরবর্তী সামাজিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায় বিঘ্নিত হয়। ফলে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। ফলে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা থাকবে। তবে দলিয় সরকার না থাকায় একটি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মতভাবে বাজেট রূপ দেওয়ার সম্ভব। বাস্তবমূখী বাজেট এবং এই বাজেট বাস্তবায়নের একটা রূপরেখাও থাকা উচিত। আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপলক্ষে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ট্যাক্স আদায় হয়। বর্তমানে দেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাজেট অর্থায়নের জন্য স্থানীয় সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করতে হয়। আগামী বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত করের হার কমিয়ে করের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অটোমেশন নিশ্চিত করে তথ্য প্রযুক্তির ওপরে আরও গুরুত্ব দিয়ে অনলাইনের ব্যবস্থা করলে রাজস্ব আদায় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।উচ্চ মাত্রায় কর নির্ধারণ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে রাজস্ব আদায় যেভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা তা হচ্ছে না। মফস্বলে কর দেওয়ার মতো অনেক ব্যবসায়ী আছেন। তাদের করের আওতায় আনা যায় কিনা তা ভাবা দরকার।
চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২০২৫) মূল বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকায় সীমিত রাখা হচ্ছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা পরবর্তীকালে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র মতে, আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২০২৬) বাজেটের আকার হতে পারে ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা আগামী বাজেটে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় বরাদ্দ আছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, আগামী অর্থবছরে এটা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। বেতন-ভাতা বাবদ বর্তমান বছরের বাজেটে বরাদ্দ আছে ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা আগামী বছর ৯০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হতে পারে। বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ চলতি অর্থবছরে পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য এ খাতে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। মূল্যস্ফীতির হার চলতি অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। আগামী অর্থবছরের জন্য এটা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে।
রাজনৈতিক সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হতো। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিবছর দেখা যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ প্রবণতা রোধ করা দরকার। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। জনগণ কেন তার দায়ভার বহন করবে? প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া এবং ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জরিমানা আকারে আদায় করা যেতে পারে।
আগামী অর্থবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত । ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা জরুরি। এ সময় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগরী শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছেন না। এরকম অবস্থায় ৫/১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগরী শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে। আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন । উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা। যেখানে ভারতে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনও কর দিতে হয় না।
শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির সবচেয়ে মূল্যবান ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ। শিক্ষা খাতের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অধীত শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো না গেলে কোনোদিনই টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ (জিডিপির অনুপাতে) গত ২০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য সর্বনিম্ন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিবছরই বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু সেখানে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। শিক্ষা খাতের সঙ্গে আরও দু-একটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষা খাতে বাজেটের বড় অংশই অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয়িত হয়। ফলে শিক্ষা গবেষণা খাতের জন্য অর্থ সংকুলান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশের কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাতে গবেষণা কাজে বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষায়িত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে সাধারণ বিষয়ও পড়ানো হচ্ছে। এতে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। দেশে বর্তমানে ৫৫টি সরকারি এবং ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে শুরু করে। এখন তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে শিক্ষিতের হার বেশি দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য শিক্ষার মানের অবনতি ঘটানো হচ্ছে। বর্তমানে যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন, তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে গুণগত মান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা খাতে প্রতিবছর যে বাজেট বরাদ্দ, এর কত অংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করতে হবে, এটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষার ওপর কর কোনোভাবেই কাম্য নয়; বরং সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫তম অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা হিসেবে নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া কর আরোপিত হয় বাণিজ্যিক পণ্য বা সেবার ওপর। শিক্ষা প্রথমত পণ্য নয়। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি উদ্যোগের উচ্চশিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক তৎপরতাও নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত। ট্রাস্ট আইন ১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত হওয়ায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর আওতায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনে অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একই আওতায় সমভাবে আয়কর আরোপের প্রস্তাবনা আইনের পরিপন্থি এবং তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরোপিত করের বোঝার সিংহভাগই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে এসে পড়বে, এমনকি কর যদি সরাসরি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও নেওয়া হয়। দেশে ১১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বাড়তি করের চাপ একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর একটা অমানবিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, অন্যদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারকে বাধাগ্রস্ত এবং নিরুৎসাহিত করবে।
বর্তমানে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের অধিকাংশেরই অবকাঠামো, গবেষনাগার,নিজস্ব শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছ ।সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এতে বেসরকারি ও সরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের মাঝেই শিক্ষা বিস্তারের চেয়ে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতা কাজ করে, এর অন্যতম কারণ আর্থীক স্বচ্ছলতা না থাকা ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ ব্যবসার মতো বিবেচনা করে থাকেন। কেউ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ ব্যবসার মতো মনে করতে না পারেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে।
মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য এবং যথাসম্ভব সাশ্রয়ী করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে পিপিপির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারি খাত উপযোগী জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বে-সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কি হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধের কারণে লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কর ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি করছাড়ের আদেশ এর সাথে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেওয়া।
বাজেট কাঠামো, বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বাজেটকে একটি উদ্ভাবনী এবং ব্যবসা-বান্ধব করার আকাঙ্ক্ষা সরকারের থাকলেও শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন কারনে বিচ্যুতি ঘটে। যারফলে অনেক হতাশার সাথে, এটি কেবল সংখ্যার সমন্বয় সাধনের একটি এলোমেলো অনুশীলনে পরিণত হয়। সন্দেহ নাই আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নানা কারণেই ভিন্নতর হবে। এবার বাজেট জনবান্ধব,জাতীয় স্বার্থ সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতি প্রাধান্য পাবে, এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক: ড. ইসরাত জাহান, অধ্যাপক এবং ডীন ব্যবসায় প্রশাসন সাউর্দান ইউনির্ভাসিটি
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
শেষ যত্ন!

আমার শ্বশুর আন্তোনিও বার্সেলো ৭৯ বছর বয়সে এক কঠিন জীবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছিলেন। তিনি বাবা ছিলেন, স্বামী ছিলেন, নানা ছিলেন—আর শেষ সময়ে ছিলেন একজন অসুস্থ, ভীষণ দুর্বল মানুষ, যিনি একাধিক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন স্টকহোমের সেন্ট জর্জান হাসপাতালের হৃদ্রোগ বিভাগে।
এক অসহনীয় ভার
আন্তোনিওর শরীরে দীর্ঘদিন ধরেই একসঙ্গে বাসা বেঁধেছিল বেশ কয়েকটি কঠিন রোগ: হৃদ্যন্ত্রে পেসমেকার, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন (মোটা), হৃদ্রোগ (হার্ট ফেইলিউর), কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস (রেনাল ফেলিওর)। এই জটিলতা তাঁকে করে তুলেছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের একজন। বার্ধক্য ও এই রোগগুলোর সংমিশ্রণে তাঁর শরীর ক্রমাগত ভেঙে পড়ছিল।
কেন এত ভয়াবহ?
৭৯ বছর বয়সী এক দেহ সহজে সেরে ওঠে না, বিশেষ করে পানি-লবণের ভারসাম্য বা সংক্রমণের মতো জটিলতায়। ডায়াবেটিস কিডনি ও হৃদ্যন্ত্রকে আরও দুর্বল করে, ফুসফুসের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে মোটা শরীর। আর যখন হার্ট ও কিডনি উভয়ই দুর্বল হয়, তখন এক অশুভ চক্র শুরু হয়—যেখানে পানি জমে শরীরে, নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়, হৃদ্পিণ্ড আরও দুর্বল হয়। এই ধরনের রোগীদের মধ্যে এক বছরের মধ্যে মৃত্যুর হার ৪০–৫০% পর্যন্ত। মুখ শুকিয়ে যাওয়া—একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত
চিকিৎসার এক পর্যায়ে আন্তোনিওর মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিল। এই ছোট বিষয়টি ছিল আসলে গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। এর পেছনে ছিল— পানির পরিমাণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, ইউরেমিয়া (রক্তে বিষাক্ত পদার্থ জমে যাওয়া), ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
মুখের শুষ্কতা থেকে তৈরি হয় বিভ্রান্তি, বমি ভাব, অসহ্য দুর্বলতা। শরীর যখন আর সামলাতে পারে না, তখন এই সামান্য লক্ষণগুলো হয়ে ওঠে জীবন-মৃত্যুর পূর্বাভাস। যখন চিকিৎসা থেমে যায়… চিকিৎসকেরা একপর্যায়ে জানিয়ে দিলেন—আন্তোনিওর শরীর আর কোনও আগ্রাসী চিকিৎসা নিতে পারবে না। হয়তো তাঁর দেহ এখন আর সহ্য করতে পারবে না নতুন চিকিৎসা, কিংবা এসব চিকিৎসার সম্ভাব্য ক্ষতি এর উপকারকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।
এমন সিদ্ধান্ত কয়েকটি জিনিস নির্দেশ করে:
১. চিকিৎসার দৃষ্টিভঙ্গি এখন প্রশমনে (palliative care)। লক্ষ্য এখন যন্ত্রণানাশ, শ্বাসকষ্ট, উদ্বেগ আর মুখের শুষ্কতা প্রশমিত করা—জীবন টেনে দীর্ঘ করার জন্য নয়। ২.কিছু চিকিৎসা ক্ষতিকরও হতে পারে। যেমন ডায়ালাইসিস বা শক্তিশালী ওষুধ—যা দুর্বল দেহে আরও ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। ৩. রোগীর ইচ্ছাকেও সম্মান দেওয়া হয়। সম্ভবত আন্তোনিও নিজেই বলেছিলেন—আর নয়, এবার শুধু শান্তি চাই।
আমাদের, প্রিয়জনদের করণীয় কী?
এই অসহায়তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের হাতেই— ১. উপস্থিতি। একটি উষ্ণ হাত, একটুখানি ছবি, চেনা কণ্ঠ—এগুলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অমূল্য। ২. প্রশ্ন করা। চিকিৎসা কোন পর্যায়ে? প্রশমনের বাইরে কিছু কি আর করা সম্ভব নয়? আর কত সময় আছে আমাদের হাতে? ৩. পরস্পরের পাশে থাকা। একজনের কাঁধে ভর দিয়ে আরেকজন এগোতে পারে। হয়তো কাউন্সেলরের দরজায়ও কড়া নাড়তে হতে পারে। ৪. সম্মান বজায় রাখা। মুখের পরিচর্যা, আরামদায়ক পরিবেশ, পছন্দের সংগীত—এ সবই জীবন শেষ হওয়ার আগের মুহূর্তগুলোকে অর্থবহ করে তোলে। এক নিঃশব্দ সংগ্রাম, এক মর্যাদাপূর্ণ বিদায়।
আমরা চাই না আমাদের প্রিয়জন কষ্টে থাকুক। আমরা পাশে থাকতে চাই, বুঝতে চাই, জড়িয়ে ধরতে চাই শেষ মুহূর্তে। জীবন যদি আর রক্ষা করা না যায়, সম্মান অন্তত যেন রক্ষা পাই।
আমরা এই লেখা লিখছি তাঁদের জন্য—যাঁরা এমন বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, কিংবা যাবে। এইসব কথা সাধারণত বলা হয় না, অথচ বলা দরকার। প্রতিটি রোগাক্রান্ত শরীরের ভেতরে বাস করে একজন মানুষ। একজন বাবা, একজন জীবনযোদ্ধা, একজন প্রিয়জন। আর পাশে থাকি আমরা—জেগে থাকি, ভালোবাসি, বিদায় জানাই।
এপিলগ: আন্তোনিও বার্সেলো (১৯৪৬–২০২৫) স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া থেকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সুইডেনে আসেন আন্তোনিও। কেটিএইচ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে জীবনের অনেকটা সময় দিয়েছেন খাদ্যশিল্পে। স্ত্রী ছিলেন বিরগিত লিন্ড বার্সেলো, যিনি কোভিড-১৯-এ মারা যান ২০২০ সালে। আন্তোনিও বার্সেলো ৮ মে ২০২৫, দুপুর ২টায় স্টকহোমের ’St. Göran’ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com