মত দ্বিমত
গোটা বিশ্ব কী তাহলে অর্থনীতিতেও হার মানল আমেরিকার কাছে?

বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামঞ্চে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কখনো আমেরিকা, কখনো চীন, আবার কখনো ইউরোপ-এই ত্রিমুখী টানাপোড়েনে বারবার প্রশ্ন জাগে, তাহলে কী সত্যিই আমেরিকাই বিশ্বের অর্থনীতির একচ্ছত্র অধিপতি? সাম্প্রতিক কালে চীনের উত্থান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও, আমেরিকার ডলার, প্রযুক্তি, বিনিয়োগ নীতি এবং ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবে অন্যান্য সব অর্থনীতি এখনও অনেকটাই পরাধীন। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে এক গভীর প্রশ্ন তোলে-বিশ্ব অর্থনীতিতেও কী শেষ পর্যন্ত আমেরিকাই জয়ী?
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যের উপর ১০% শুল্ক আরোপ করে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যা বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়েছে।
নতুন শুল্ক নীতির প্রধান দিকনির্দেশনা নিম্নরূপ:
• সর্বজনীন ১০% শুল্ক: অধিকাংশ দেশের আমদানি পণ্যের উপর ১০% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ৫ এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে।
• নির্দিষ্ট দেশের জন্য উচ্চতর শুল্ক: যেসব দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, তাদের ক্ষেত্রে শুল্ক হার ১১% থেকে ৫০% পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে, যা ৯ এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে।
এই শুল্ক নীতির ফলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে:
• চীনের প্রতিক্রিয়া: চীন এই শুল্ক বৃদ্ধিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে, যা বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
• বাজারে অস্থিরতা: শুল্ক ঘোষণার পর বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারে পতন ঘটে। বিশেষ করে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক প্রায় ১০% হ্রাস পায়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
• অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাবের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ২০২৫ সালে মার্কিন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট কমতে পারে।
এই শুল্ক নীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন:
• মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি: শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে, যা ভোক্তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে।
• বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা: প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
• বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা: শুল্ক নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করছেন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্ক নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এই নীতির ফলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বাজার স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ভবিষ্যতে এই শুল্ক নীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্থিতিশীল বাণিজ্য নীতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী ট্রেডমার্কেট বা পণ্যবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা ও সংকট সৃষ্টি হয়েছে:
• স্টক মার্কেট: Dow Jones, NASDAQ, FTSE, এবং Nikkei – সবকিছুর সূচকই পতনের মুখে।
• ভোক্তা পণ্য ও জ্বালানি: কাঁচামাল, জ্বালানি, খাদ্যশস্য, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি – সবকিছুর দাম দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
• ইন্ডাস্ট্রিয়াল চেইন: সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে; শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে।
এখানে কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক:
১. সাইন্স-বেজড বিজনেস বনাম ক্যাসিনো ব্যবসা
ট্রেডমার্কেটের সাইন্স-বেজড ব্যবসা হওয়ার দাবি, বাস্তবিক অর্থে, অনেকাংশেই মিথ্যা। বাজারের অধিকাংশ বাণিজ্য আসলে সঠিক অর্থনৈতিক মূল্যায়ন বা বাস্তব পণ্য-পরিসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং শেয়ারবাজারের অবস্থান নির্ধারণ হয় গুজব, মৌলিক ঝুঁকি, বড় অর্থনৈতিক সংকেত, বাজারের মনস্তত্ত্ব—এসব দ্বারা। অনেক সময় শেয়ারবাজারে স্টকের দাম ওঠানামা করে শুধুমাত্র বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বের কারণে, যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এজন্যই অনেকেই একে “ক্যাসিনো ব্যবসা” হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে গাণিতিক বা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে অনুমান এবং ভাগ্যই প্রধান ভূমিকা নেয়।
২. অর্থনীতির জন্য হাঁস্যকর বিষয়
এটি অর্থনীতির জন্য হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায় যখন একটি পণ্যের মূল্য, যা অনেক সময় কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, অস্থিরভাবে ওঠানামা করে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়, বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং কিছু কোম্পানির শেয়ার শুধুমাত্র শেয়ার বাঁচানোর জন্য ক্যাসিনো স্টাইল ব্যবসা শুরু করে। এতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর সম্ভাবনা থাকে, যা একেবারে একটি জুয়া খেলার মতো হয়ে পড়ে।
৩. ট্রেডমার্কেট কি ব্যবসা?
এটা ব্যবসা নয়, বরং এর কার্যক্রম অনেকটা একটি গেম বা জুয়া খেলার মতো। শেয়ারবাজারে যে পণ্য বা সেবা সরবরাহ হয় না, সেটি এক ধরনের “কমোডিটি” হিসেবে দেখা হয়, যেখানে মূলত মুনাফার জন্য শেয়ার কেনাবেচা করা হয়, কিন্তু কোনও প্রকৃত অর্থনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা হয় না। বাজারে এখন “স্পেকুলেশন”—অর্থাৎ ভবিষ্যতের দাম বাড়ানোর জন্য পণ্যের ভলিউম এবং গুজব নিয়েই মানুষ চলছে, আর এর ফলস্বরূপ, এটি ব্যবসার চেয়ে লটারির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অভাব
ট্রেডমার্কেটের পরিবর্তন, যা ৩০% বা তার বেশি ওঠানামা করতে পারে এক দিনের মধ্যে, সেটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বাভাবিক। এর কোনো নির্ধারিত অর্থনৈতিক যুক্তি বা ফান্ডামেন্টাল নেই। এটি শর্ট-টার্ম সাইকলিক চেঞ্জেস এবং ম্যানিপুলেটিভ ফ্যাক্টরস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যা “সাইন্স-বেজড বিজনেস” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
৫. অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রভাব
বিশ্বব্যাপী যখন ট্রেডমার্কেটের এই অস্থিরতা বাড়ে, তখন এর প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি বাজারের অংশগ্রহণকারীদের জন্য এক ধরনের ভীতি তৈরি করে, যার ফলে বহু মানুষ বিনিয়োগ থেকে পুঁজি হারায়।
ক্যাসিনো ব্যবসা আর শেয়ারবাজারে পার্থক্য
একে যদি কোনো বাজারের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা বাস্তব অর্থনৈতিক শর্তের ভিত্তিতে ব্যবসা বলা না যায়, তবে সেটি ক্যাসিনো ব্যবসা হতে বাধ্য। যদি বড় অর্থনৈতিক রাষ্ট্রগুলো বাজারে এমন ভীতি-ভিত্তিক ব্যবসা চালায়, তবে এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত নেতিবাচক হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এটি শুধু একটি শুল্কনীতি নয়, এটি একটি আর্থ-রাজনৈতিক শক্তি পুনঃবন্টনের সূচনা।”
বিশ্বের জন্য করণীয়: একটি নতুন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা জরুরি
বিশ্ব এখন একটি নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো প্রয়োজন:
১. WTO-র শক্তিশালী পুনর্গঠন: যাতে বড় রাষ্ট্রগুলোর একতরফা সিদ্ধান্ত ঠেকানো যায়।
২. আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট গঠন: BIMSTEC, BRICS+, African Union ইত্যাদি জোটগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো।
৩. বিকল্প মুদ্রা ও ট্রেড রুট: ডলার-নির্ভরতা কমানো, জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের পথ খোলা।
৪. টেকসই উৎপাদন ও বিকেন্দ্রীকরণ: Supply chain-এর বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রতিটি অঞ্চলে উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি।
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের এই মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই পদক্ষেপগুলো বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
১. বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা: বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার একক আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে একটি নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠা জরুরি, যেখানে সব দেশ অংশগ্রহণ করবে।
২. ডলার নির্ভরতা কমিয়ে আঞ্চলিক মুদ্রাবিনিময় ও লেনদেন জোরদার করা: ডলার-নির্ভরতা কমিয়ে আঞ্চলিক মুদ্রা ব্যবহার করে ব্যবসা করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ তৈরি করতে হবে।
৩. উন্নয়নশীল দেশগুলোর উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ানো: দেশগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
৪. স্থানীয় বাজার ও কৃষি অর্থনীতি শক্তিশালী করা: খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির বিকাশে স্থানীয় উৎপাদনকে উত্সাহিত করতে হবে।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ বহুপাক্ষিক বাণিজ্যনীতি গড়ে তোলা: এমন একটি বাণিজ্যনীতি গঠন করতে হবে, যেখানে মানবিক প্রয়োজন এবং ন্যায্যতা অগ্রাধিকার পাবে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ নয়।
এই সময়ে দেশগুলোর জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত করবে:
১. জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা: দেশগুলোর উচিত নিজস্ব গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা।
২. আমেরিকার উন্নত শিক্ষা ও গবেষণার মডেল থেকে শেখার মনোভাব: বিদেশী শিক্ষা ও গবেষণার সেরা উদাহরণ থেকে নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা।
৩. বৈশ্বিক বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতি: প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে, যেখানে বড় দেশগুলোর শক্তির দাপটের পরিবর্তে সব দেশের সুযোগ থাকবে।
৪. বৈশ্বিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুষম বাণিজ্য চুক্তি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ভিত্তিতে সুষম চুক্তি প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে পুনরুদ্ধার করার সুযোগ মেলে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে টেকসই এবং সমৃদ্ধির জন্য কয়েকটি ভুল পদক্ষেপ এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি:
১. মার্কিন চাপে বা স্বার্থে আত্মসমর্পণমূলক নীতি গ্রহণ: গ্লোবাল পলিটিকাল চাপের মুখে এসে আত্মসমর্পণ করা দেশগুলোর জন্য কখনই শুভকর নয়।
২. একমুখী আমদানি-নির্ভরতা: শুধু আমদানির ওপর নির্ভর করে কখনও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পাওয়া সম্ভব নয়; স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া: দীর্ঘমেয়াদী বৈদেশিক ঋণের বোঝা দেশের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
৪. নিজের উৎপাদনশীলতা উপেক্ষা করে কেবল আমদানিকৃত পণ্যে নির্ভরতা: দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পরিবর্তে শুধুমাত্র আমদানি করতে থাকলে তা অর্থনৈতিক সংকটে নিয়ে যাবে।
উন্নত বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে এবং স্বনির্ভর হতে কিছু বড় অর্জন জরুরি:
১. টেকসই অর্থনৈতিক অবকাঠামো: দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন এমন এক অর্থনৈতিক অবকাঠামো যা পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
২. নিজস্ব গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পখাত: দেশে নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পখাত গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশটি শক্তিশালী হবে।
৩. একটি স্বাধীন ও সমন্বিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট: দেশগুলো নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গড়ে তুলবে, যা আন্তর্জাতিক স্তরে তাদের অবস্থানকে মজবুত করবে।
৪. মানবকেন্দ্রিক ও পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির মডেল: একটি সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে।
৫. তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা: তরুণদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে।
বিশ্ব অর্থনীতি আজ এক বৈশ্বিক দাবার ছকে আটকে গেছে, যেখানে আমেরিকা বহু বছর ধরেই চালকের আসনে। তবে এটি চূড়ান্ত নয়, কারণ ইতিহাস বলছে—অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায় সময়ের সাথে সাথে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখনই উপযুক্ত সময় নিজেদের ভিত মজবুত করে নতুন অর্থনৈতিক পথ রচনার। আমেরিকার কাছে নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কাছে যেন জয়ী হয় বিশ্ব।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মত দ্বিমত
অন্তরের গহীনে পহেলা বৈশাখ: ছোটবেলার স্মৃতি থেকে নতুন অধ্যায়ের সূচনা

দেশ এবং ভাষা, একে অপরের সাথে গভীরভাবে গাঁথা, যেন দুই প্রাচীন রেশমি সুতো এক সুতায় বাঁধা। বাংলা ভাষা, এই মাটি, এই জনগণের অভ্যন্তরীণ আত্মা—এগুলো সবই একযোগে জড়িয়ে থাকে, যেখানে একে অপরের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এই দেশের মানুষ, যে ভাষায় কথা বলে, যে সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে, সেই ভাষা ও সংস্কৃতি তার অস্তিত্বের অঙ্গ। এবং পহেলা বৈশাখ, এই বাঙালি নববর্ষ, ঠিক তেমনই একটি দিন—যে দিনটি শুধুমাত্র একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের যাত্রা, যেখানে আমরা সবাই একযোগে একটি নতুন সূর্যের দিকে এগিয়ে যাই।
এদিনের অমলিন আনন্দে ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত, পাশে মরিচ, পেঁয়াজ আর নুনের স্বাদ—এই খাবারের মধ্যে রয়েছে এক অমোঘ সম্পর্ক। স্নিগ্ধতার এক স্বরূপ, যা কেবল বাংলার মাটিতেই সম্ভব। চিরকালীন এই ঐতিহ্য, যেখানে বছরের শুরুতে হালখাতা আর মিষ্টির আদান-প্রদান, এক নিঃশব্দ চুক্তি—একটি নতুন বছরে ব্যবসা, সম্পর্ক, জীবন—সব কিছুই নতুন করে শুরু হতে থাকে।
এবারের পহেলা বৈশাখে, পুরনো বছরের সেই সমস্ত অশুভ প্রতিচ্ছবি, ধান্দাবাজি, চাঁদাবাজি—সবকিছু দূর হয়ে যাবে। নববর্ষের এই দিনটি যেন এক নতুন দিগন্তের সূচনা, যেখানে আমরা শুধুমাত্র নতুন কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখি না, বরং সেই পুরনো দিনের অশান্তি ও কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য, একটি সুন্দর, সজীব এবং পবিত্র জীবনের দিকে অগ্রসর হতে চাই।
প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, একে অপরের পরিপূরক। বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ, এই দিনটি শুধুমাত্র আমাদের ক্যালেন্ডারের একটি নতুন পৃষ্ঠা নয়, বরং এটি আমাদের চারপাশের প্রকৃতির এক অনবদ্য রূপ। বৈশাখের প্রথম দিনে আকাশের কোণে মেঘের গম্ভীরতা, যেন সে জানাচ্ছে নতুন বছর আসছে, নতুন আশা, নতুন উল্লাস। ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে বৈশাখী বৃষ্টি এসে প্রকৃতির গা ভিজিয়ে দেয়, যেমন আমাদের হৃদয়ের গভীরে বয়ে আনে এক নতুন আনন্দের তরঙ্গ। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি গন্ধ—কলমি শাক, পাটুলি ফুল, পলাশের রঙে মোড়া নববর্ষের ফুল। এই দিনটি যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক শ্রদ্ধাঞ্জলি, যে ফুলগুলো শোভা পায় আমাদের ছোট-বড়, শহর-বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায়।
গ্রামের পলিতে কিংবা শহরের কোন পার্কে, পহেলা বৈশাখের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দেয় আনন্দের অনুভূতি। পুরনো বাংলার গ্রামের প্রান্তরে পাকা ফসলের সুবাস, সেই প্রাচীন ঝিলগুলোর শান্ত জল, খালি মাঠে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য—এগুলি শুধু চোখে নয়, আমাদের মনে প্রতিধ্বনিত হয়, যেন পহেলা বৈশাখের প্রতিটি মুহূর্ত প্রকৃতি নিজ হাতে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে।
এই দিনটি শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক উদযাপন নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কেরও একটি বিশেষ রূপ, যা আমাদের শিকড়ের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সারা দেশের মানুষের আনন্দে মেতে ওঠা, গ্রামীণ পরিবেশে গুচ্ছগুচ্ছ পটল, কাঁচা কলা, কচুরিপানা—এই সব প্রকৃতির উপাদান, একে অপরকে সহযোগিতা করে নতুন বছরের দারুণ সূচনা করতে। বৈশাখী বাতাস, মাটির গন্ধ এবং নতুন জীবনের এক সতেজ শ্বাস—এই উপাদানগুলো একত্রিত হয়ে পহেলা বৈশাখের উদযাপনকে শুধু একটি দিন নয়, বরং এটি যেন একটি নয়া দিগন্তের সূচনা, যেখানে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি হাতে হাত রেখে একত্রে উদযাপন করে।
পহেলা বৈশাখের দিনটি যেন এক সুন্দর গল্প, যার প্রতিটি দৃশ্য জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ভোর বেলা, যখন প্রথম সূর্য ওঠে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষের পদচারণা শুরু হয়। শহরের বাজারে, ফুলের দোকানে ভিড় জমে যায়—প্রতিটি দোকানে সাজানো থাকে নানা রঙের ফুল। গোলাপের লাল, গাঁদার হলুদ, শাপলার সাদা, আর পলাশের তীব্র কমলা রঙের ফুলের গুচ্ছ, যেন প্রকৃতির নিজস্ব শুভেচ্ছা। সেখানে একেকটি ছোট গল্প প্রতিধ্বনিত হয়, এক বিক্রেতা তার দোকানে সাজানো ফুলগুলো তুলে তুলে বিক্রি করছে, আর এক বৃদ্ধা আনন্দের সাথে একটি ছোট পুতুলের ফুল কেনে, যেন পুরনো দিনের রঙিন স্মৃতি ফিরে পাচ্ছে।
গ্রামের সরু পথে, হালকা রোদে, লাল-সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা চমক দিয়ে হেঁটে যায়, তাদের গায়ে ফুলের মালা, হাতে সজাগ চুড়ি, মুখে হাসি—পহেলা বৈশাখের আনন্দের প্রতীক। ছোট ছেলে-মেয়ে, তারা ঝরে পড়া পাতা ও ফুলের সঙ্গে খেলছে, মুখে মিষ্টি খাবারের খুশি হাসি, যেন পুরো গ্রামটি এক নতুন রঙে রাঙানো। পথে, গ্রামের পুকুরে নৌকায় চড়ে মাঝির গান শুনতে পাওয়া যায়, সেই গান যা বাঙালি ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, একটি দৃশ্য যা শুধু বাঙালির কাছে নয়, সারা বিশ্বে নস্টালজিয়া তৈরি করে।
আর শহরের বড় পার্ক, রমনা বটতলায়, যেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরিহিত মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সুর মেলাচ্ছে, সবাই যেন একসাথে গাইছে—“এসো হে বৈশাখ এসো এসো…”। এ যেন এক উত্সব, এক সমবেত সঙ্গীত, যেখানে সবার হৃদয় এক সঙ্গে মিলছে। বটগাছের নিচে, পুরনো দারুণ ঐতিহ্যের গুনগুন, আর চিরন্তন প্রাকৃতিক সুরের মাঝে, পহেলা বৈশাখকে অভ্যর্থনা জানাতে সবাই মিলিত।
এটি একটি মুহূর্ত, যেখানে অতীত ও বর্তমান একসাথে মিশে যায়, যেখানে প্রতিটি সুর, প্রতিটি ফুল, প্রতিটি হাসি এক নতুন কাহিনী রচনা করে—পহেলা বৈশাখের দিনটি, যা আমাদের জীবনে সেই সোনালী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন আমরা একে অপরকে আরও ভালোভাবে জানতাম, ভালোবাসতাম।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে নতুন বছর উদযাপন হয়, তবে বাংলা নববর্ষের প্রতি যে অনন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, তা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের থেকে একেবারেই আলাদা। যেমন, ইংরেজি নববর্ষ ১ জানুয়ারিতে আসে, এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে এটি এক আড়ম্বরপূর্ণ পার্টির মাধ্যমে পালিত হয়। রাতের বেলা, আতশবাজি, মিউজিক এবং জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে মানুষ। তবে বাংলা নববর্ষের উৎসবটি শুধুমাত্র একটি রাতের অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি পুরো দিনের, পুরো সমাজের একটি অনন্য ঐতিহ্য। এখানে দিন শুরু হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে, যেখানে সূর্যোদয়ের সাথে এক অনাবিল শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ভারতেও নানা অঞ্চলে নববর্ষ উদযাপন করা হয়, যেমন বাংলা নববর্ষ, পাঞ্জাবের বৈশাখি, এবং গুজরাটের উত্তরায়ণ। যদিও এগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে—ফসল কাটার সময়, কৃষকের জীবনের শুরু—তবে প্রতিটি অঞ্চলের নববর্ষের রীতি, সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠান আলাদা। বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ, বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, মিষ্টি গন্ধে ভরা গাছে গাছে রঙিন ফুল আর পরিবেশের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি তৈরি হয়, যা আর কোথাও পাওয়া যায় না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নববর্ষ উদযাপন হয় ভিন্নভাবে। যেমন চীনা নববর্ষে থাকে লাল রঙের উত্সব, যা পৃথিবীজুড়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিশেষ খাবার, সাংস্কৃতিক নৃত্য ও ড্রাগন র্যালি থাকে। আর জাপানি নববর্ষে, বরফাচ্ছন্ন পর্বতমালা এবং সাদা প্রাকৃতিক দৃশ্যে পালিত হয় উৎসব, যেখানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এসব সবার মধ্যে একটি সাধারণ মিল রয়েছে—নতুন বছরের সূচনায় পুরনো সব পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ও আশা।
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর মানুষের মাঝে একাত্মতা তৈরি করা। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে নৃত্য, সঙ্গীত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করে, যা বাংলাদেশের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই দিনটি শুধু একটি কালেন্ডারীয় পরিবর্তন নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এটা যেন মানুষের মনের মধ্যে এক নতুন প্রেরণা দেয়, যেখানে সবাই মিলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে এক হয়ে জীবন উদযাপন করে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে, যেমন সুইডেন, নেদারল্যান্ডস কিংবা স্পেনে, নববর্ষ উদযাপন হয় অঙ্গীকার, আশাবাদ এবং বন্ধুত্বের ভিত্তিতে। তবে পহেলা বৈশাখের বৈশিষ্ট্য হলো, এর মধ্যে যে উন্মুক্ততা, ঐক্য ও সামাজিক যোগাযোগ রয়েছে, তা যেন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে, যেখানে জাতিগত ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে, সবাই একসঙ্গে উদযাপন করে।
বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের উদযাপন, তাই শুধু একটি জাতির নববর্ষ উদযাপন নয়, এটি একটি বৈশ্বিক উত্সবের অংশ, যা আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্ব, শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। এটি একটি দৃঢ় আহ্বান—বিশ্বের প্রতি যে, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের শিকড়কে সম্মান জানিয়ে, আমরা যেন নিজেদের বিশ্বাসে অটুট থেকে, সবধরনের বিভেদ ও বৈষম্য ভুলে মানবতা, ভালোবাসা ও একাত্মতায় বিশ্বাস রাখি।
পহেলা বৈশাখের দিনটি যেন এক অমূল্য স্মৃতি, যা হৃদয়ে চিরকাল রয়ে যায়। ছোটবেলায়, আমার গ্রামের পথে পহেলা বৈশাখের আনন্দ ছিল এক অপূর্ব দৃশ্য। দুপুর বেলা, পান্তা-ইলিশ আর পেঁয়াজ, চিঁড়া-দইয়ের এক অপূর্ব পর্বে বসে, আমার সঙ্গীরা একে অপরকে জানাতো বছরের শুভেচ্ছা। তবে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল, পহেলা বৈশাখের দিনটিতে রমনার বটতলায় যাওয়া। একসঙ্গে গানের তালে তালে নাচ, গল্প বলা—যেখানে শুধু ঐতিহ্যই নয়, সেখানে ছিল একাত্মতা, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের শক্তি। আমি যেন তখন উপলব্ধি করতাম, পহেলা বৈশাখ শুধু একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং একটি নতুন জীবনের সূচনা, যেখানে আশা ও সম্ভাবনার আলো জ্বলতে থাকে।
তখনকার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে, মনে হয়—আজও যদি সেই ঐতিহ্যকে অটুট রাখতে পারতাম, যদি সেদিনের মতোই আমরা সবাই এক হয়ে নতুন বছরের শুরুটা উদ্যাপন করতে পারতাম, তবে হয়তো আমাদের সমাজের সবার মধ্যে সত্যিকার অর্থে ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হত। এই স্মৃতিগুলো যেন এখনো মনকে উজ্জীবিত করে—যতই সময় এগিয়ে যাক, পহেলা বৈশাখের সেই স্নিগ্ধ রোদ, সেই পান্তা-ইলিশ, সেই গানের সুর—সব কিছু মনে হয়, কখনো মুছে যাবে না, বরং প্রতিটি পহেলা বৈশাখের সঙ্গে নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠবে।
পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) সারা বিশ্বের বাঙালিদের জন্য এটি শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের জীবনের এক নতুন যাত্রা, যেখানে আশা, ভালবাসা, পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা থাকুক। এখানে ধর্ম, জাতি কিংবা বিশ্বাসের কোনো ব্যাপার নেই—এটা শুধু জাতিগত পরিচয়ের উদযাপন।
আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসকে সম্মান করতে হবে এবং কোনো কিছুই আমাদের জাতিগত পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। তাই আসুন, আমরা যেন বিশ্বে এক শক্তিশালী, উদার জাতি হয়ে উঠি। দূর হোক কুসংস্কার, জয় হোক মানবতার, গড়ে উঠুক বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।
এবারের পহেলা বৈশাখ হতে পারে ভবিষ্যৎ নির্মাণের চাবিকাঠি, যা সবার জন্য ভালোবাসা, শান্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। সবাইকে বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
নতুন ভোরের ডাক, পুরনো শকুনদের বিদায়

বাংলাদেশ আর আমি–এ যেন এক অভিন্ন সত্তা। আমি চাইলে দেশটিকে ছেড়ে থাকতে পারি না, আবার তার মিথ্যা, শোষণ আর দুর্নীতির রাজনীতির কারণে কাছে যেতেও পারি না। ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ বলে পেছন ফিরে তাকাই, কিন্তু দেশের রক্তচোষা রাজনীতিবিদদের কুকর্ম আর মিথ্যাচার আমাকে আটকে রাখে।
আমি বিশ্বাস করি- আল্লাহ্র আলোকিত পথে হাঁটাই মুক্তির একমাত্র উপায়। সেই পথেই চলি, যেখানে সত্য আছে, যেখানে প্রিয় মানুষদের আদর্শিক ছায়া পড়ে। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, যাদের হাতে দেশ ছিল- তারাই দেশকে পদদলিত করেছে, পথভ্রষ্ট করেছে, মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করেছে।
তাই আজ দূর থেকে দেশের জন্য কাজ করি। দেশের মানুষকে ভালোবেসে, তাদের চোখের জল দেখে আজ আমি কলম তুলে নিই, বুকের ভেতর জমা ক্ষোভ ছড়িয়ে দিই প্রতিটি শব্দে। কারণ দেশের জন্য কিছু করতে হলে, মুখে বুলি না ঝাড়লেও চলে, কাজে প্রমাণ দিতে হয়।
কিন্তু, হায়! যখনই দেখি কেউ সাহস করে দেশের হাল ধরতে চায়, নতুন করে গড়তে চায় স্বপ্নের বাংলাদেশ-ঠিক তখনই সেই পুরনো গলাবাজ, সেই চেনা মুখগুলো গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে: “নির্বাচন চাই! ভোট চাই!”
তাদের প্রশ্ন করি—কোথায় ছিল এই ভোটের অধিকার, যখন তোমরা ক্ষমতায় ছিলে?
১. শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনের বাইরে ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ১.৫ বছর।
২. জিয়াউর রহমান ছিলেন ৪.৫ বছর, সেনাশাসনের মুখোশে।
৩. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন পুরো ১০ বছর—সরাসরি সামরিক শাসক!
৪. ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছাড়ার সময়ও নির্বাচনের নামে নাটক চলেছে।
৫. আর শেখ হাসিনা—২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, একের পর এক পাতানো নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন আর ভুয়া উন্নয়নের গল্পে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—এই সময়গুলোতে কোথায় ছিল জনগণের প্রকৃত অধিকার? আপনারা ক্ষমতায় গিয়েছেন, বারবার গিয়েছেন—কিন্তু কী দিয়েছেন জাতিকে?
শিক্ষিত বেকারত্ব, পাটকলের গেট বন্ধ, চিকিৎসাহীন মৃত্যু, দুর্নীতির পাহাড়, আর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার হাহাকার!
নিজেরা ফকির থেকে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, আর দেশের মানুষ আজও ভাতের জন্য দাঁড়ায় রাস্তায় লাইনে!
এখন যখন বাংলাদেশ তার সত্যিকারের অভিভাবককে পেয়েছে, তখনই শুরু হয়েছে কণ্ঠরোধের ষড়যন্ত্র—“নির্বাচন চাই, নির্বাচন চাই!” এই আওয়াজ এখন যেন শুধুই বিরক্তিকর প্যাঁচপ্যাঁচানি।
ভাইরে, বিপ্লব কখনও ব্যালট চায় না। ইতিহাসের প্রতিটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে বিপ্লবী শক্তির হাত ধরে, জনগণের ভরসা আর নেতৃত্বের আস্থায়। বিপ্লব মানেই স্বতঃসিদ্ধ বৈধতা। আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন, ফরাসি বিপ্লব, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব-সবই ছিল রাজনীতির প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নতুন পথ রচনা করার গল্প।
আজ বাংলাদেশের মানুষ আর ভোটের জন্য গলা ফাটায় না—তারা চায় একজন আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ শাসক। একজন মানুষ, যে লুটপাট করবে না, ক্ষমতাকে দান হিসেবে নয়—দায়িত্ব হিসেবে নেবে। যে কৃষকের ঘাম বুঝবে, ছাত্রের চোখে স্বপ্ন দেখবে, বৃদ্ধের মুখে শান্তির হাসি আনবে।
আর যারা দিনভর রাস্তায় নেমে নির্বাচন, নির্বাচন বলে গলা ফাটায়—তাদের বলি, যে নিজের সংসার চালাতে পারে না, সে দেশ চালাবে কীভাবে? রাজনীতি আজ ব্যবসা নয়, চাকরি নয়—এটা সেবা। আর যদি সেবা না পারেন, সোজা কাজ করুন, ঘাম ঝরান, পরিবারকে খাওয়ান, দেশের জন্য সৎভাবে আয় করুন।
আমি বিদেশে থেকেও দেশের জন্য কাজ করি। আপনি দেশে থেকে পারবেন না কেন? দেশপ্রেম মানে ব্যানার নয়, ব্যালট নয়—দেশপ্রেম মানে নিজের যোগ্যতাকে দেশের কল্যাণে উৎসর্গ করা। আজ আমাদের প্রয়োজন সৎ নেতৃত্ব, আদর্শিক কাঠামো আর জাতীয় ঐক্য। ভোট নয়, দল নয়, ক্ষমতা নয়—আমরা চাই বাংলাদেশ গড়ে উঠুক নতুন ন্যায়ের ভিতের ওপর।
তাই বলছি- নোভোটিং এট দিস মোমেন্ট! বিপ্লবী সরকারের জন্য ভোট লাগে না! কারণ, সত্যিকারের বিপ্লব কখনও ব্যালটে আসে না—সে আসে মানুষের মঙ্গল আর ইতিহাসের অনিবার্যতার হাত ধরে!
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদ/কাফি
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
জোনাকি পোকাও অন্ধকারে নিজের আলোয় চলে

একটি আত্মমুক্তির ডাক তরুণদের প্রতি..
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ছুটে আসছেন বিশ্বের শীর্ষ বিনিয়োগকারীরা। কারণ তারা দেখেছেন সম্ভাবনার এক নতুন বিস্ফোরণ-এই দেশের নবীন প্রজন্ম।
তারা দেখেছেন প্রযুক্তি-দক্ষ, সৃজনশীল, পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনী এক তরুণ সমাজ, যারা কেবল স্বপ্ন দেখে না, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেও জানে।
বিশ্ব এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে- আশায়, আস্থায়, আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। তারা এগিয়ে আসছে এই প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে, তাদের মেধা ও শ্রমে ভর করে একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে পাশে দাঁড়াতে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই নবীন প্রজন্ম কী করছে?
তারা কি সেই স্বপ্নের পথে এগোচ্ছে? নাকি এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে সেইসব মুখোশধারী নেতাদের পেছনে, যাদের একমাত্র মূলধন হলো মিথ্যাচার, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার?
যারা বছরের পর বছর ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, প্রশাসনকে পচিয়ে তুলেছে, এবং জনগণের ভাগ্য নিয়ে নির্লজ্জ তামাশা করেছে, আপনি কি তাদের পেছনেই সময় নষ্ট করবেন? আপনি কি সেই ছায়ার পেছনে ছুটবেন, না কি নিজের আলো জ্বালাবেন—নিজের স্বপ্ন, নিজের ভবিষ্যৎ, নিজের দেশের জন্য?
আজ বিশ্বের নজর বাংলাদেশের দিকে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তুলনামূলকভাবে দুর্বল, তাই বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিনিয়োগকারী
এখন সরাসরি বাংলাদেশে কাজ করার সাহস দেখাচ্ছেন। যা গত ৫৪ বছরেও সম্ভব হয়নি।
এই বিরল সুযোগ আপনার- নিজেকে গড়ে তোলার, নিজের চাকা ঘোরানোর, নিজের আলোর স্পন্দনে চারপাশকে আলোকিত করার। তাই এখনই সময় ভেঙে ফেলুন দুর্নীতির দেয়াল, ছিঁড়ে ফেলুন দাসত্বের শৃঙ্খল। গড়ুন একটি নতুন বাংলাদেশ নিজের মতো করে।
একটি বাংলাদেশ যেখানে নেতৃত্ব আসবে সততা, দক্ষতা ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে। যেখানে নেতৃত্ব আর উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। বরং গড়ে উঠবে নিচ থেকে, ঘাম ও মেধা দিয়ে। একটি বাংলাদেশ যেখানে তরুণরা আর নেতৃত্বের পেছনে দৌড়াবে না বরং নিজেরাই নেতৃত্ব দেবে। সারাদিন ইঁদুরের মতো কোনো কার্লপ্রিট পলিটিশিয়ানের পেছনে না ছুটে বরং নিজের চাকা ঘুরান জ্বালান নিজের আর দেশের আলো।
আর যদি চান বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সৎ, দক্ষ, যোগ্য নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক তবে আজই নিজেকে বিনিয়োগ করুন। নিজের শিক্ষা, সময়, শ্রম, চিন্তা আর সৃষ্টিশীলতাকে দিন যথার্থ কাজে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন। দেখবেন, বিশ্ব আপনার পেছনে ঘুরছে। দেখবেন, একদিন সেই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদও আপনার দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। একটি কাজের সুযোগের জন্য।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ মূলত আমেরিকার-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ

প্রথমেই বলে রাখি, ইসরায়েল কোন রাষ্ট্র নয়, ফেডারেল রিজার্ভ এর রথচাইল্ড পরিবারের ইন্টারেস্টে এই ‘প্রক্সি রাষ্ট্র’-টির জন্ম দেয় ব্রিটেন এবং পরবর্তীতে এটি মেইনটেইন করে যুক্তরাষ্ট্র। দিনশেষে এটি আমেরিকার প্রক্সি কান্ট্রি।
তার মানে, ইসরায়েল- প্যালেস্টাইন যুদ্ধ মূলত আমেরিকার-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ। ইসরায়েল আমেরিকার প্রক্সি কেবল, এর বাইরে কিছুই না। আর আমেরিকা বলতে সেই ফেডারেল রিজার্ভ, সেই রথচাইল্ড ফ্যামিলি।
উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা বাদে পৃথিবীর সব দেশই ফেডারেল রিজার্ভ এর ক্লায়েন্ট (বাংলাদেশ তো বটেই)। এর মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সম্পদই তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, প্রভাবিত। আইকিউ ইরাক ২০০০ সালে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিল, সাদ্দামের অবস্থা আপনারা জানেন।লিবিয়া ২০০৯ সালে ফেডারেল রিজার্ভ এ তাদের মজুত সব স্বর্ণ দেশে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। গাদ্দাফি এবং লিবিয়া শেষ। সিরিয়া ২০০৬ এ ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বের হয়ে আসতে চায়। সিরিয়াকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। আসাদকে পালাতে হয় এই সময়ে এসে আমেরিকা স্পন্সর্ড জিহাদের মাধ্যমে।
ইরান এর বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক লড়াইতে না গেলেও সারা পৃথিবী থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
বাইরে বাইরে অনেক কারণ বললেও মূলত ফেডারেল রিজার্ভ থেকে যারাই বের হতে চেয়ে ছিল, তাদের সাথেই যুদ্ধ করেছে আমেরিকা। এটাই কী পয়েন্ট! এখন কথা হচ্ছে, এই ফেডারেল রিজার্ভ কে শক্তিশালী করলো কারা? নবীর দেশ মক্কা মদীনার ভুমির রাজা (যদিও ইসলামে রাজতন্ত্র হারাম) সৌদ পরিবার। তা কিভাবে? পেট্রো ডলার চুক্তি।
এটি কি? বলছি।
পেট্রো ডলার চুক্তি (Petrodollar Agreement) মূলত এমন একটি অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত, যার মাধ্যমে বিশ্বের তেলের বাজারে মার্কিন ডলারকে লেনদেনের প্রধান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সিস্টেম চালু হয়, যেখানে মার্কিন ডলার ছিল গোল্ডের সঙ্গে লিঙ্কড এবং বিশ্ব বাণিজ্যের রিজার্ভ কারেন্সি। কিন্তু ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন “Gold Standard” বাতিল করেন। ফলে ডলার আর স্বর্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকলো না। এতে ডলারের উপর আস্থা কমে যায়, এবং মার্কিন অর্থনীতি চাপে পড়ে।
১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে Yom Kippur War এবং OPEC-এর তেল নিষেধাজ্ঞা বিশ্বে তেল সংকট তৈরি করে। এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব এর মধ্যে গোপন চুক্তি হয় ১৯৭৪ সালে। চুক্তির মূল পয়েন্ট হচ্ছে সৌদি আরব ও OPEC দেশগুলো তেল শুধুমাত্র মার্কিন ডলারে বিক্রি করবে। বিনিময়ে, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি রাজপরিবারকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে নিরাপত্তা দেবে। এবং সৌদির তেল আয়ের একটি বড় অংশ আবার মার্কিন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হবে (বিশেষ করে U.S. Treasury bonds)। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে তেল কেনার জন্য মার্কিন ডলার জোগাড় করতে হতো। ফলে ডলারের উপর নির্ভরতা বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র তার মুদ্রা ছাপিয়েও বিশ্ববাজারে শক্তিশালী থাকতে পারে — একে বলা হয় “𝑫𝒐𝒍𝒍𝒂𝒓 𝑯𝒆𝒈𝒆𝒎𝒐𝒏𝒚”। এই 𝑫𝒐𝒍𝒍𝒂𝒓 𝑯𝒆𝒈𝒆𝒎𝒐𝒏𝒚 ই আমেরিকাকে সুপার পাওয়ার বানিয়েছে, যা বানিয়েছে মূলত মক্কা মদিনার দেশের রাজপরিবার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে যে “নিরাপত্তা” দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পেট্রো ডলার চুক্তির অংশ হিসেবে, তার মাধ্যমে আমেরিকা মূলত এই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি প্যানেল মুসলিম দেশগুলোর (সৌদি আরব, আরব আমিরাত, জর্ডান, বাহরাইন, কুয়েত ও ওমান) এবং তুরস্ক এলাকায় নিয়োজিত আছে কমপক্ষে ৪৫,০০০ আমেরিকান সেনা। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের সকল সেনাবাহিনী মূলত আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত। এই অঞ্ছলের এয়ার বেস, নেভাল বেস, রাডার গুলো এর পজিশন সংযুক্ত ছবিতে দেয়া আছে।
এত কিছু কেন বললাম? শত্রু দেশের সামরিক স্থাপনা নিজের ভেতর রেখে আপনারা কিভাবে প্যালেস্টাইনকে বাঁচাবেন? শত্রু দেশের মিলিটারি বেস দেশের ভেতরে রেখে কোকাকোলা বয়কটের কর্মসূচী হাস্যকর লাগে না? যুদ্ধ করতে চাইলে আগে যুদ্ধ করতে হবে এই আরবদের সাথে। এরাই ইসরায়েল এর শক্তি, এরাই আমেরিকার শক্তি। প্যালেস্টাইনীদের রক্তের দায় ইসরায়েল কিংবা আমেরিকার চেয়ে এই আরব গাদ্দার দের অনেক বেশী। এরা আবার অনেক নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, ধর্মের বাণী শোনায়। আর অপেক্ষায় আছে একটা আমেরিকান স্পন্সর্ড জেহাদ এর।
এই আরব দেশগুলোই মূল শয়তান। এতো এতো নবী এসেও এদের ঠিক করা গেলো না। আপনারা যখন এদের কাছেই সাহায্য চান, তখন আমার হাসি পায়। বোমার আঘাতে প্যালেস্টাইনী শিশুর ছিন্ন মাথা দেখে কান্নাও পায়।
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার এম এ মোহিমেন তানিম, এসএসবিবি
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
বাংলাদেশ: বিদেশি গোয়েন্দা প্রভাব, দুর্নীতি ও আসন্ন বিপর্যয়

বাংলাদেশ এক গভীর সংকটের সম্মুখীন। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং)-এর অনুপ্রবেশ এখন স্পষ্ট। শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে এই সংস্থাটি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চরম হুমকি।
শুধু প্রশাসন নয়, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, কূটনীতি, নিরাপত্তা—সব জায়গায় ভারতের প্রভাব বাড়ানোর নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বহু প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভারতীয় প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেন তারা “সঠিক” পথে চলেন। পদোন্নতির শর্ত হিসেবে এই প্রশিক্ষণকে ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল ও নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে “র”-এর প্রভাব
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি আজ এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব।
• বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন একটি নির্দিষ্ট বিদেশি শক্তির স্বার্থ রক্ষা হয়।
• উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে কারা কাজ পাবে, কোন খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে—এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের বদলে বৈদেশিক হস্তক্ষেপই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।
• প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতেও ভারতের উপস্থিতি নীতি-নির্ধারণের ওপর ছায়ার মতো পড়েছে।
এই বাস্তবতায় দেশ কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নির্বাচনী উন্মাদনা: দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র?
এমন এক সময়ে, যখন রাষ্ট্র দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দি এবং বিদেশি প্রভাবের শৃঙ্খলে আটকে গেছে, তখন হঠাৎ কিছু রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো করছে। প্রশ্ন হচ্ছে—
এরা কি ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, নাকি দুর্নীতির নতুন এক পর্ব শুরু করতে চায়?
যারা আজ জনমতের তোয়াক্কা না করে একটি তড়িঘড়ি নির্বাচন আয়োজনের জন্য লড়ছে, তারা কি সত্যিই দেশকে বাঁচাতে চায়? নাকি তারা বিদেশি শক্তির হাতের পুতুল হয়ে আরও বড় দুর্নীতির চক্র তৈরি করতে চাইছে? যদি তারা দেশপ্রেমিক হয়ে থাকে, তবে তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভুল পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। এটি হবে মায়ানমার বা থাইল্যান্ডের সম্প্রতি ধসে পড়া ভবনের মতো—একটি দুর্বল কাঠামো যা যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
ড. ইউনূস: কূটনৈতিক শক্তির সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন
এমন সংকটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
• তিনি বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানিত একজন ব্যক্তি, যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনীতির সংযোগ রয়েছে।
• তার অবস্থান ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাংলাদেশকে “র”-এর প্রভাবমুক্ত করার একটি কৌশলগত উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
• দেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক খাতকে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়।
প্রথমে মুক্তি, তারপর নির্বাচন
বাংলাদেশের সমস্যা এখন কে ক্ষমতায় আসবে, সেটি নয়। আসল সংকট হলো—রাষ্ট্র কি আদৌ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে?
নির্বাচন তখনই অর্থবহ হবে, যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকার অর্থে দেশীয় স্বার্থে কাজ করবে। তাই, প্রথমে “র”-এর প্রভাবমুক্ত হওয়া এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূল করা প্রয়োজন। এরপরই গণতন্ত্রের কথা বলা যেতে পারে।
আশার বাণী: বাংলাদেশ এখনো জাগতে পারে
এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়নি। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই দেশ বড় সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, তখন জনগণের প্রতিরোধ ও সচেতনতা সেই সংকটকে অতিক্রম করেছে।
✅ সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি।
✅ দেশপ্রেমিক ও নৈতিক নেতৃত্বকে সমর্থন দেওয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
✅ বিদেশি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া বাংলাদেশ বাঁচবে না।
এখনো সময় আছে। যদি জনগণ সচেতন হয়, যদি সঠিক নেতৃত্ব দেশকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসে, তবে বাংলাদেশ আবারো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)