মত দ্বিমত
বিবেকহীনতার বাজারে সৎ থাকা মানেই ব্যর্থতা

বাংলাদেশের সমাজে যখন অনৈতিকতা ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতায় পরিণত হচ্ছে, তখন একজন বিবেকবান মানুষের জীবন হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ প্রতিরোধের গল্প। চারপাশের মানুষ যখন “স্মার্টনেস” আর “চালাকির” আড়ালে প্রতারণাকে সাজিয়ে তুলে, তখন সত্যকে ধারণ করা এক ধরনের সামাজিক আত্মদহন। এই দেশে আজ পিতা সন্তানের পরীক্ষার ফল নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, সন্তানের সততা নিয়ে ততটা নন। শিক্ষক হয়েও অনেকে নীতিকথার চেয়ে নোটবিক্রিকে গুরুত্ব দেন। ব্যবসায়ীরা ভেজালকে ‘কৌশল’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। রাজনীতি হয়ে উঠেছে জনসেবার নয়, লোভ ও প্রভাব বিস্তারের খেলা। আর এইসব ভিড়ের ভেতরে যে ক’জন মানুষ এখনো সত্য বলার সাহস রাখেন, ন্যায় পথে চলার চেষ্টা করেন—তাঁদের সমাজ ‘বোকার রাজ্যে রাজা’ বলেই গণ্য করে।
কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষের যন্ত্রণা শুরু হয় অন্য জায়গা থেকে। তিনি ভুল করলে, সেটা মেনে নিতে পারেন না—নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেন, “আমি তখন একটু সাহস দেখালে কী হতো?” অন্যরা ভুল ভুলে যায়, কিন্তু বিবেক তাকে ভুলতে দেয় না। প্রিয় মানুষদের ভুল দেখেও চুপ থাকতে হয় তাঁকে—কারণ যাকে ভালোবাসেন, তার পথভ্রষ্টতা দেখেও কিছু করতে না পারার অসহায়তা জ্বালায় হৃদয়কে। আবার যখন তিনি সত্য বলেন, সতর্ক করেন, তখন তাঁর কথাগুলো বাতাসে মিলিয়ে যায়—উল্টো মানুষ হাসে, বলে, “এই আদর্শ দিয়ে পেট চলে?” ফলে সমাজের অস্বীকৃতি আর কটাক্ষ তাকে ধীরে ধীরে নিঃশব্দ করে দেয়।
সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা আসে তখন, যখন ভুলের ফলস্বরূপ তার প্রিয়জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়—কারো চাকরি চলে যায়, কারো সম্মান ধুলায় মিশে যায়, কেউ হয়তো অপরাধের দায়ে আইনের মুখোমুখি হয়। অথচ তিনি নিজে সেই ভুলের অংশ ছিলেন না—তবুও ভালোবাসার টানে, মানবিকতার দায়ে তাঁর কষ্টও কম হয় না। এই সহভোগিতা হয়তো কারও চোখে পড়বে না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তা ক্ষয় করে তাঁর মনকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই লড়াই চলে—অবশেষে এক ক্লান্তি এসে চেপে বসে তাঁর হৃদয়ের উপর। কেউ খোঁজ নেয় না, “তুমি কেমন আছো?” সমাজ ধরে নেয়, তিনি তো ঠিকই আছেন—কারণ তিনি চিৎকার করেন না। কিন্তু ভেতরে চলে এক নীরব অবসাদ, যে বিষণ্ণতায় কথা বলে না, শুধু হ্রাস করে মানুষের আলো।
এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা বিদেশে পরিশ্রম করে উপার্জন করতে পারেন, কিন্তু দেশে ফিরে সৎ পথে আয় করতে গেলে লজ্জায় পড়েন। কারণ আমাদের সমাজ পদবি দেখে, পেশা নয়। প্রবাসে ক্লিনারের কাজও সম্মানের, দেশে চায়ের দোকান দিলে উপহাস। অথচ মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল—“এই আয় কি সৎভাবে হয়েছে?” তা না হয়ে আমরা জিজ্ঞেস করি—“এই আয় কি অনেক হয়েছে?” আমরা ভদ্রতার মুখোশে লুকিয়ে দুর্নীতিকে মর্যাদা দিই, আর সততাকে দারিদ্র্যের প্রতীক বানিয়ে ফেলি।
এই মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ নয়। কারণ সমাজ প্রতিনিয়ত বলে, “সবাই করে, তুমিই বা বাদ যাবে কেন?” কিন্তু এখানে ভুলটা স্পষ্ট—যদি সবাই ভুল করে, তাতে কি ভুলটা সঠিক হয়ে যায়? যদি সবাই ঘুষ নেয়, তবুও একজন যখন না বলেন, তখনই সমাজে পরিবর্তনের প্রথম স্পন্দন শুরু হয়। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা যদি প্রতিদিনের ‘স্পিড মানি’র লোভে না পড়ে, তিনিই তো নীতির পক্ষে দাঁড়ালেন।
সমাজের সম্মান এখন আর নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না, বরং কার গাড়ি কত দামি, কে কত বড় অফিসে কাজ করে—তা দিয়েই সম্মান মাপা হয়। একজন সৎ মুদি দোকানদারকে দেখা হয় তাচ্ছিল্যের চোখে, অথচ এক দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারকে আমরা নিমন্ত্রণ করি, হাসিমুখে গ্রহণ করি। শিক্ষা আমাদের ডিগ্রি দেয়, কিন্তু শ্রমের মর্যাদা শেখায় না—ফলে একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সারও আত্মীয়স্বজনের চোখে “বেকার” হয়ে যায়, যদিও সে কারও ঘুষ খায় না, নিজের পরিশ্রমেই বাঁচে।
যদি সত্যিই চাই, সমাজ বদলাতে, তাহলে নতুন প্রজন্মকে চোখে দেখাতে হবে মূল্যবোধ। বাবারা যদি ঘরে ঘুষ দিয়ে, মিথ্যা বলে সন্তানদের ‘সৎ হও’ বলেন, তবে তা কার্যকর হবে না। একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, একজন কৃষক, একজন সৎ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—তাঁরাই যেন হোন শিশুদের রোল মডেল। বইয়ে নয়, জীবনের গল্পে শেখাতে হবে, সততা মানে দুর্বলতা নয়—সততা মানে সাহস।
এবং সেই সাহসী মানুষদের সামনে আনতে হবে—যাঁরা আড়ালে থেকে বাঁচেন সত্যের শক্তিতে। মিডিয়া ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে তাঁদের গল্প ভাইরাল করতে হবে, যেন তরুণরা বুঝতে পারে—এই পথও সম্ভব। একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি ঘুষের সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, তাঁকেই বানাতে হবে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। একজন শিক্ষক যদি নিয়মমাফিক সময়মতো ক্লাস নেন, তিনিই হোন রোল মডেল।
কারণ যদি সৎ মানুষরা লজ্জা পায়, মুখ লুকিয়ে থাকে, তবে দুর্নীতির জয় অনিবার্য। সমাজের ভিত রক্ষা করতে হলে, সৎ মানুষদের আত্মমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মাথা উঁচু করে বলতে হবে—“আমি ছোট আয় করি, কিন্তু কারও টাকা খাই না।” সেটাই বড় গৌরব, সেটাই আসল স্বাধীনতা।
এমন কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই আছেন আমাদের চারপাশে। যেমন, ঢাকার মিরপুরে আলতাফ হোসেন—একজন চা-ওয়ালা, যিনি অতিরিক্ত এক পয়সাও নেন না। একদিন তার দোকানের সামনে এক মানিব্যাগ পড়ে থাকে—ভিতরে চল্লিশ হাজার টাকা। সবাই বলেছিল, রেখে দাও। কিন্তু তিনি তা ফেরত দেন, খুঁজে বের করে। তাঁর দোকানে এখন দ্বিগুণ কাস্টমার—কারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায়, সৎ মানুষ আজও আছে। আলতাফ বলেন, “টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনা যায় না, কিন্তু ইজ্জত থাকলে টাকা আসবেই।”
আছে রুনা আক্তার—একজন গ্রামের তরুণী, যিনি ইউটিউব দেখে ফ্রিল্যান্সিং শিখে এখন ১৫ নারীর কর্মসংস্থান করেছেন। প্রথমে কাঁথা সেলাই করে ডেটার টাকা জোগাড় করতে হতো, কিন্তু কখনো অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি বলেন, “আমি শুধু টাকা নয়, মানসিক শান্তিও চাই। সৎভাবে উপার্জনই আমাকে রাতে নিশ্চিন্ত ঘুম দেয়।”
আছে রফিকুল ইসলাম—পাবলিক সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়েও ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফিরে গেছেন নিজের গ্রামে। এখন তিনি অর্গানিক কৃষিকাজ করেন, অন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘সততা কৃষি’ শুধু ব্যবসা নয়, এক আন্দোলনের নাম। তিনি বলেন, “আমি রাষ্ট্রের চাকরি করিনি, কিন্তু সমাজের জন্য কিছু করছি—সেটা আমার কাছে অনেক বড়।”
এইসব গল্প তাঁদের জন্য, যারা মনে করেন, “সবাই চুরি করলে আমিও করব কেন?” কিংবা যারা এখনো দ্বিধায় আছেন, সত্যের পথ ধরবেন কি না। এইসব মানুষদের দেখে মনে হয়—সৎ থেকেও সম্ভব, মাথা উঁচু করে বাঁচা যায়।
কারণ সৎ উপার্জন কখনো ছোট নয়। তা ছোট আয় হতে পারে, কিন্তু তাতে থাকে ঘুম, থাকে গর্ব, থাকে আত্মমর্যাদা। আমরা যদি সম্মান দিই ছোট কাজকে, সাহস দিই সৎ মানুষদের, শ্রদ্ধা করি নিজের বিবেককে—তবে সমাজও আমাদের প্রতিদান দেবে।
বিবেক হারালে শুধু একজন ব্যক্তি নয়, একটি সমাজ হারিয়ে যায়। আর যখন একজন সৎ মানুষ নিজের দুর্বলতা ভুলে মাথা তুলে দাঁড়ান, তখন সমাজের ভিত নড়ে না—তা আরও শক্ত হয়।
কিন্তু এই সত্য-নিষ্ঠ জীবন সবসময় বাহবা পায় না। সমাজ প্রায়শই এই মানুষদের উদাহরণ বানিয়ে রাখে, অনুসরণ করার জন্য নয়—দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে “ভালো থাকলেও ভালো থাকা যায় না।” যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে চাকরি হারায়, যারা ঘুষ নেয় না বলে বদলি হয়, যারা সৎ পথে থাকায় উন্নতির পথ আটকে যায়—তাদের আমরা কেবল করুণার চোখে দেখি। অথচ করুণা নয়, তাঁদের প্রাপ্য ছিল শ্রদ্ধা। কারণ তাঁরা হেরে গেলেও তাঁদের অবস্থান ভুল ছিল না। তাঁরাই বলেন, “আমি আপস করিনি,” আর এই কথাটিই একদিন আমাদের সন্তানদের গর্বের উপাখ্যান হয়ে উঠতে পারে।
একটা শিশু যখন দেখে, তার বাবা সৎ থেকেও পিছিয়ে পড়ে, তার শিক্ষক ঘুষ না নিয়ে গরিব থাকে, তখন সে প্রশ্ন করে, “বাবা, সৎ হলে যদি এমন হয়, তবে আমি হব কেন?” তখন আমরা যদি শুধু বলি, “তুই শুধু নিজের বিবেকটা ঠিক রাখ”—তা যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে সমাজের কাঠামোকেই এমনভাবে গড়তে হবে, যাতে সৎ থাকাটাও সফলতার উপায় হিসেবে প্রতিভাত হয়। নচেত আগামী প্রজন্ম আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী হয়ে উঠবে, যারা ভাববে—“আমার লাভই চূড়ান্ত সত্য।”
তাই এখন সময় সৎ মানুষের নীরবতা ভাঙার। তাঁদের গল্প শুধু পরিবারে নয়, জাতির সামনে তুলে ধরার। সাংবাদিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা—সবার দায়িত্ব একটাই হওয়া উচিত: নায়ক বানাতে হবে সত্যবাদীদের। সিনেমার পর্দায় চোর যদি স্টাইলিশ হয়, বাস্তব জীবনের সৎ মানুষকে আমরা যদি উপহাস করি, তাহলে তরুণেরা কার পথ অনুসরণ করবে? পরিবর্তন আনতে হলে আমাদেরকে নতুন কল্পনা তৈরি করতে হবে—যেখানে নৈতিকতা দুর্বলতা নয়, বীরত্ব। যেখানে অর্থ নয়, শ্রদ্ধাই চূড়ান্ত মাপকাঠি।
অনেকে বলেন, এই দেশে কিছুই হবে না। অনেকে বলেন, “ব্যবস্থা’টাই এমন।” কিন্তু এই ব্যবস্থাটা গঠিত হয় আমাদের চুপচাপ মেনে নেওয়া থেকে। আমরা যদি একবার নির্ভয়ে বলি, “না”—তবে সেই ব্যবস্থাও বদলায়। একজন বাসচালক যদি বাড়তি ভাড়া না নেন, একজন ছাত্র যদি প্রশ্ন ফাঁস হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষা না দেয়, একজন সাংবাদিক যদি গোপন ডিল প্রত্যাখ্যান করেন—তবে আমাদের সন্তানরা জানবে, বিকল্প পথও আছে।
সেই বিকল্প পথ সহজ নয়—এটা জানি। তবে এই পথেই শান্তি আছে। কারণ রাত শেষে একজন মানুষ যখন আয়নায় তাকান, আর নিজের চোখে নিজের ভয়ের চিহ্ন না খুঁজে পান, তখন তিনি জানেন—তাঁর জীবন ছোট হতে পারে, কিন্তু তা সঠিক। যেখানে টাকা, পদবি, খ্যাতি—সবই একদিন ফুরিয়ে যাবে, সেখানে একমাত্র অবিনাশী জিনিসটি হলো আত্মমর্যাদা।
তাই এই লেখাটি শুধু কষ্টের নয়, এক অনুরোধেরও। যদি আপনি এখনো সততার পথ বেছে নিচ্ছেন, কিংবা নিতে চান, তবে জানবেন—আপনি একা নন। সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে আছেন আরও অনেকে, যারা চুপচাপ, দৃঢ়ভবে সত্যকে ধারণ করে আছেন। আপনাকে কেবল তাঁদের খুঁজে নিতে হবে। এই নীরব সেনানিরা মুখর হয়ে উঠলেই সমাজ বদলায়।
আমরা চাই এমন একটি সমাজ, যেখানে একজন কর্মচারি ঘুষ না নিয়ে বাড়ি ফিরলে স্ত্রী বলেন, “তোমার সততাই আমার গর্ব।” যেখানে একটি শিশুকে প্রশ্ন করা হয় না, “তোমার বাবা কী করেন?” বরং বলা হয়, “তোমার বাবা কেমন মানুষ?” যেখানে আয় নয়, আয়বিধি বড় কথা। আর যেখানে একজন মানুষের বিবেক, তাঁর পেশা নয়, মানুষ হওয়াটাকেই সংজ্ঞায়িত করে।
একটি সমাজে যেখানে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া যেন সাফল্যের সবচেয়ে সহজ রাস্তা, সেখানে বিবেক নিয়ে বেঁচে থাকা মানে এক ধরণের নিঃশব্দ, অদৃশ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো। এ এক পাঁচ স্তরের গভীর অনুভূতির গল্প, একজন বিবেকবান মানুষের যাত্রা কেবল নৈতিক সিদ্ধান্তের নয় — এটি এক অন্তর্গত যন্ত্রণারও। এই যাত্রা সাধারণত পাঁচটি স্তরে গঠিত হয়। প্রথমত, অনুশোচনা—নিজের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বা ভুল আচরণের জন্য অন্তরদহন। দ্বিতীয়ত, অসহায়ত্ব—প্রিয়জনের ভুল দেখেও কার্যত কিছু করতে না পারার বেদনা। তৃতীয়ত, হতাশা—নিরন্তর সতর্কতা সত্ত্বেও সমাজের শ্রবণহীনতা ও উপহাস। চতুর্থত, সহভোগিতা—ভুল না করেও ভালোবাসার মানুষদের কষ্টে মানসিক যন্ত্রণাভোগ। আর পঞ্চম স্তরে আসে বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি—ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এক অভ্যন্তরীণ মৃত্যু, যা সমাজ কখনো দেখে না, জানতেও চায় না, যা বাংলাদেশের বহু মানুষ নীরবে বহন করে যাচ্ছেন।
এই লেখাটি শেষ হচ্ছে, কিন্তু যে প্রশ্নটি শুরুতে ছিল, তা থেকে যাচ্ছে—আপনি কি সত্যিই ভাবেন, সততা দিয়ে বাঁচা যায় না? নাকি আপনি এখন একটু হলেও অনুভব করছেন, যে বাঁচা মানে কেবল আয় নয়—বাঁচা মানে হৃদয় নিয়ে বাঁচা?
যদি উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে আপনি নিজেই এক সম্ভাবনার নাম।
লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

মত দ্বিমত
রিজার্ভ বাড়ছে অথচ রেমিট্যান্স যোদ্ধারা উপেক্ষিত: কৃতজ্ঞতার মুখোশে জাতীয় বিস্মরণ?

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অর্থনৈতিক মাইলফলক। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে যারা দিনরাত ঘাম ঝরিয়ে, প্রবাসের মাটিতে কষ্ট সয়ে একেকটি ডলার পাঠাচ্ছেন, সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যথার্থ স্বীকৃতি কোথায়? কে তাদের নাম উচ্চারণ করছে? কে তাদের জন্য দাঁড়াচ্ছে?
রাজনীতিবিদরা যখন এ অর্জনের কৃতিত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে ব্যস্ত, তখন প্রকৃত নায়করা থেকে যাচ্ছেন অগোচরে, অবহেলিত এক শ্রেণি হিসেবে। রাষ্ট্র যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে যাচ্ছে, এই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি আসলে কারা।
প্রবাসজীবনের প্রতিটি দিনই যুদ্ধ—অচেনা সমাজে টিকে থাকার যুদ্ধ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট, বৈষম্য ও দুর্ব্যবহার সহ্য করার লড়াই। এই যোদ্ধারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান, তাতেই সচল থাকে আমাদের বাজেট, উন্নয়নের রাস্তাঘাট, প্রকল্প আর জনকল্যাণ। অথচ, এর বিনিময়ে তারা পান না রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, সামাজিক সম্মান কিংবা ভবিষ্যতের কোনও নিরাপত্তা।
আজও তারা ভোট দিতে পারেন না—যেন দেশের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের কোন অধিকার নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল এই অধিকার নিশ্চিত করা, কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ন্যূনতম মানবাধিকারটুকু তারা পাচ্ছেন না। এটি কি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নাকি পরিকল্পিত উপেক্ষা?
তাদের পরিবারগুলোর দিকেও রাষ্ট্রের নজর খুবই কম। দেশে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পরিবারের আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসা, শিক্ষা, কিংবা জীবননিরাপত্তা — এসব নিয়ে কোনো সুসংহত পরিকল্পনা কি সরকারের আছে? যদি থাকে, তবে তা কি আমরা জানি? আর যদি না থাকে, তাহলে কেন নেই?
সরকার কি কখনও পেনশন পরিকল্পনার কথা ভাবছে এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য? তাদের সন্তানদের জন্য কি কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা বৃত্তি, কোটা বা রাষ্ট্রীয় সহায়তা রয়েছে? যদি থাকে, তাহলে তা জনসম্মুখে প্রকাশ হোক। আর না থাকলে, এখনই সময় তাদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করার।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে—বাংলাদেশ কি সত্যিই কৃতজ্ঞ? নাকি কেবল সেই কৃতজ্ঞতার মুখোশ পরে বসে আছে, যেটার নিচে লুকিয়ে আছে চরম স্বার্থপরতা?
রিজার্ভের সংখ্যা বাড়া বড় কথা নয়—কৃতজ্ঞতা, সম্মান আর ন্যায়ের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ করাই বড় কথা। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যদি আজ না থাকতেন, তবে আমাদের বাজেটের অঙ্কগুলো কেমন হতো, সে প্রশ্ন আমাদের প্রতিটি নীতিনির্ধারক ও নাগরিকের নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিত।
আমরা কি শুধু সুযোগসন্ধানী এক জাতি? নাকি সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধাশীল, কৃতজ্ঞ ও ন্যায়বোধসম্পন্ন জাতি হয়ে উঠতে চাই?
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ঢাকাতেই বসবাস করতে হবে

এখন যদি নিরাপত্তাহীনতা, অব্যবস্থা বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাবি—তবে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে। কারণ গোটা বিশ্বেই আজ স্থিতি ও শান্তির অভাব। ইউক্রেন, গাজা, আফগানিস্তান, সুদান—প্রত্যেকটি অঞ্চল আমাদের শেখাচ্ছে: আজ কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই। তবুও, যখন গাজার বুলেটবৃষ্টি দেখি, মনে হয় আমরা যারা ঢাকায় বা অন্য কোথাও থাকি, তারা তুলনায় অনেক ভালো আছি। কিন্তু কতদিন?
কয়েক দিন আগেই ঢাকার বিমান দুর্ঘটনায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের করুণ মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—আমরা যেন এক ঘুণে ধরা রাষ্ট্রে বসবাস করছি, যেখানে দুর্নীতি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এটি রক্তের মধ্যেও মিশে গেছে। এই দুর্ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না—এটি ছিল একটি অপরাধ, একটি মৃত্যুর পূর্বঘোষণা, যা রক্ষণাবেক্ষণের নামে লুটপাট, নিরাপত্তার নামে অবহেলা, আর দায়িত্বের নামে দুর্নীতির হাত ধরে আসছিল বহুদিন ধরে।
দুর্নীতি কীভাবে প্রতিরক্ষা বাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সেটাই এখন আরেকটি বড় প্রশ্ন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর ভেতরের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায়ও আজ প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। দুর্নীতি, গাফিলতি ও অপেশাদারিত্ব মিলিয়ে আজ পুরো নিরাপত্তা খাতটাই নৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
তাহলে কে রক্ষা করবে বাংলাদেশকে? সরকার? বিরোধী দল? সামরিক বাহিনী? বুদ্ধিজীবী সমাজ? নাকি সেই সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াই লড়ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এখনো মেলেনি। কিন্তু আরেকটি প্রশ্ন আজকের বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে তুলছে—
কী পরিমাণ দুর্নীতি হলে একটি দেশের হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনী পর্যন্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণে ধরে?
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
যখন—
• হাসপাতাল রোগী মারে,
• চিকিৎসক হয়ে ওঠে দালাল,
• শিক্ষক হয়ে ওঠে সেশন ফি ব্যবসায়ী,
• প্রশাসন হয়ে ওঠে চাঁদাবাজ,
• মসজিদে উঠে আসে রাজনীতির চোরাগলি,
• মন্দিরে বাজে তদবিরের সুর,
• ঘরে নেই শান্তি,
• বাইরে নেই নিরাপত্তা,
• আর কবর পর্যন্ত নিতে হয় ঘুষ—
তখন বলুন, কোথায় যাবেন আপনি? আর কোথায় আপনি নিরাপদ? এই দেশ, এই রাষ্ট্র, এই ঢাকা—সবই কি কিছু সুবিধাভোগী আর দুর্নীতিবাজদের জন্যই? নাকি এখনো কিছু মানুষ বাকি আছে, যারা বলবে—না, আর না। এবার সত্যকে ঢেকে রাখব না। এবার জেগে উঠতেই হবে। এতকিছুর পরেও কি সবকিছু ঢাকতেই থাকবে, হতে থাকবে? নাকি এবার ঢাকায় থেকেই আমরা বলব—এখান থেকেই শুরু হবে পরিবর্তনের ঝড়?
বিশ্বের কোথাও এখন আর শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ বা ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার নিশ্চয়তা নেই। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, গাজা-ইসরায়েল সংঘাত, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিভাজন, ফ্রান্সের দাঙ্গা, আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর অভ্যুত্থান—সবকিছু বলে দিচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতা এখন কেবল কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়—এটি এক বৈশ্বিক ব্যাধি। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলাদা, কারণ এখানে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও নৈতিক দেউলিয়াপনা রাষ্ট্রকে ভিতর থেকে গিলে খাচ্ছে।
এবং এই গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়া এখন আর রাজনৈতিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ঢুকে পড়েছে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, পরিবহন, চিকিৎসা, শিক্ষা—সব খাতে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও জাতীয় আত্মার ভেতরেও।
সুতরাং, যদি আমরা কিছু না করি, তাহলে কী দাঁড়াবে শেষটায়?
• দুর্নীতি অব্যাহত থাকবে
• অব্যবস্থাপনার কারণেই মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে ধামাচাপা পড়বে
• গাজা আমাদের জন্য এক রূপক হয়ে উঠবে — “আমরাও এক অন্তর্জাত যুদ্ধক্ষেত্র”
• রাষ্ট্র ক্রমশ তার আত্মাকে হারাবে, নাগরিক হারাবে বিশ্বাস, আশা, এবং সর্বোপরি—জীবনের অর্থ
আপনি যদি প্রশ্ন করেন—কে রক্ষা করবে বাংলাদেশকে? উত্তর একটাই—আপনি। আপনার বিবেক, আপনার কণ্ঠস্বর, আপনার প্রতিবাদই পারে এই দেশকে রক্ষা করতে। বাকি কেউ আসবে না।
এতকিছুর পরেও সব কিছু কী ঢাকতেই থাকতে হবে, হতে হবে? একটি দেশের আকাশে আগুন জ্বলে—আর আমরা তার ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। একটি পাইলট মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন শহর বাঁচাতে—কিন্তু তার আত্মত্যাগ ধামাচাপা পড়ে যায় দায়সারা তদন্ত আর অপ্রকাশিত রিপোর্টের আড়ালে। আমাদের চারপাশে প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছিল ছোট ছোট বিপর্যয়—আর আমরা বলছিলাম, “এটাই তো বাংলাদেশ!”
কিন্তু আজ যখন এই মৃত্যুর কণ্ঠস্বর আমাদের ঘুম ভাঙায়, তখন অন্তত প্রশ্নটা তোলা জরুরি হয়ে পড়ে:
এতকিছুর পরেও কি সবকিছু ঢাকতেই থাকবে? সরকারি বিবৃতি দিয়ে? সামরিক গোপনীয়তার নামে? জাতীয় ভাবমূর্তির কথা বলে? না কি জনতার নিরবতা দিয়ে? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি শুধুই ঢাকার উপর নির্ভর করবে—অর্থাৎ, রাজধানী ঢাকার, কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তির, কিছু নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের দয়া বা দৌরাত্ম্যের ওপর? না কি সেই ঢাকা একদিন সত্যিই হবে বিবেকের রাজধানী—যেখানে প্রতিটি মৃত্যু প্রশ্ন তোলে, প্রতিটি অন্যায় প্রতিরোধ পায়, প্রতিটি নাগরিক জবাবদিহি দাবি করে?
আমরা কী শুধুই একটি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার ভেতরে বেঁচে থাকবো? নাকি বেছে নেবো বেঁচে ওঠার সাহস? এই লেখার শেষ পঙক্তি যদি আপনি মন দিয়ে পড়েন—তবে এটিই আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আমার আহ্বান:
তথ্য ঢেকে রাখার সংস্কৃতি শেষ হোক। সত্য কথা বলার সাহস শুরু হোক। বাংলাদেশের প্রাণটুকু যেন শুধু ঢাকায় আটকে না থাকে-সে ছড়িয়ে পড়ুক জনগণের চেতনায়, হৃদয়ে, এবং শেষমেশ—প্রতিবাদে।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী আমাদের করণীয় কী?

যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে রাজধানী ঢাকার মাইলস্টোন নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ওপর আছড়ে পড়ার ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমরা শুধু হতবাকই নই, বরং গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় শঙ্কিত। এ ঘটনা আমাদের শুধু হতবিহ্বলই করেনি, বরং দুর্ঘটনা-উত্তর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের দক্ষতা, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা, পেশাগত নীতি-নৈতিকতা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের জাতীয় প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মনে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা নিছক কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি কিংবা বিভ্রান্তি নয়; এটি রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের সামগ্রিক অদক্ষতা, পূর্বপ্রস্তুতির অভাব এবং দায়িত্বশীলতার সংকটকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে। এতে করে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো: সরকারের, প্রশাসনের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে নাগরিক নিরাপত্তা আদৌ কতটা সুরক্ষিত? জনস্বার্থের প্রশ্নে যখন নিরাপত্তা, প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়ার দায় আসে, তখন দায়িত্বশীলতার মানদণ্ডে কে কোথায় দাঁড়ায় এখনই সময় সেই কঠিন প্রশ্নের জবাব খোঁজার। এই নিবন্ধ সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার এক আন্তরিক প্রয়াস।
এই দুর্ঘটনার পর আমরা যেভাবে সরকারের কর্তাব্যক্তি (শাসকশ্রেণি), পেশাজীবী এবং রাজনীতিবিদদের একাংশের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে একটি বৃহৎ দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা কতটা কার্যকর সে বিষয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই হাসপাতাল ও দুর্ঘটনাস্থলে যেভাবে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও দায়িত্ববহির্ভূত পেশাজীবীরা অবিবেচকের মতো ভিড় জমিয়েছেন, তা শুধু উদ্ধার ও চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত করেনি, বরং জননিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মৌলিক নীতিমালাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে আগুনে ঝলসে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসায় যে সংবেদনশীলতা ও শৃঙ্খলা জরুরি, সেই প্রেক্ষাপটে এমন হঠকারী আচরণ চরম অজ্ঞতা, আত্মপ্রচারপ্রবণতা এবং রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির ভয়ানক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। এখানে ‘সহযোগিতা’ বা ‘সহমর্মিতা’র নাম করে দুর্ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে ঊদেশ্যপ্রণোদিত ‘উপস্থিতি’ নিশ্চিত করাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ সেখানে প্রয়োজন ছিল প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের নির্বিঘ্ন কাজ করার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা। দুর্যোগকালীন সময়ের এই অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপ শুধু দৃষ্টিকটু নয়, বরং তা এক ধরনের ‘নৈতিক সহিংসতা’ বলেও চিহ্নিত করা যায়।
ফলে দেশের অধিকার সচেতন নাগরিকেরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, আমরা কি সত্যিই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত? এই প্রশ্নটি শুধু প্রতীকী নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে একেবারে বাস্তব ও নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দরকার। দুর্যোগ মোকাবিলাকে আমরা এখনো অনেকাংশে একটি কারিগরি, সামরিক কিংবা বিশেষ বাহিনিনির্ভর কার্যক্রম হিসেবে ভাবি যেন এটি শুধু শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী পাঠিয়ে সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করার বিষয়। অথচ বাস্তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি সর্বাঙ্গীন ও সমন্বিত জাতীয় প্রস্তুতির বিষয় যেখানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সামর্থ নিয়োগের প্রতিফলন থাকা চাই। এটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও মনো-সামাজিক সহায়তা, প্রশাসনিক সমন্বয়, নাগরিক শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার এক সম্মিলিত ফসল। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্ঘটনা ঘটলে, আমাদের হাতে কি আছে সুনির্দিষ্ট ও দ্রুত গতিসম্পন্ন উদ্ধার উপকরণ ও সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা? কোথায় ছিল দুর্ঘটনার পর পরই জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দল? কোথায় ছিল পুড়ে যাওয়া কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য মনো-সামাজিক পরামর্শ (কাউন্সেলিং)-এর ব্যবস্থা? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোথায় ছিল দুর্যোগকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, নির্দেশনা ও সমন্বয় যা একটি দুর্যোগ মুহূর্তে দেশের নাগরিকদের আস্থা ও কার্যকর সাড়া দেওয়ার প্রধান শর্ত? ঘটনার দিন বাস্তবে এই শূন্যতাগুলো দেখিয়ে দেয়, দুর্যোগ আমাদের কাছে এখনো পরিকল্পনা নয়, কেবল প্রতিক্রিয়ার বিষয় হয়ে রয়ে গেছে।
এই দুর্ঘটনা আমাদের সামনে যেটি অনিবার্যভাবে তুলে ধরেছে, তা হলো এখনই সময় আত্মসমালোচনার এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের জন্য সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত ও নৈতিকভাবে সুসংহত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি নেওয়ার। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিচে কিছু জরুরি করণীয় তুলে ধরা হলো:
১. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্যোগ মুকাবিলার নীতিমালা প্রণয়ন ও দুর্যোগকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল গঠন জরুরি। দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে বারবার সমন্বিত ব্যবস্থাপনার দুরাবস্থা ও মানুষের হাহাকার দেখে হাত তুলে শোক প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নীতিগত স্পষ্টতা এবং সংবেদনশীল প্রশাসনিক কাঠামো। এ লক্ষ্যে কিছু জরুরি করণীয় এখনই নির্ধারণ করতে হবে, যার প্রথম ধাপ হলো দুর্যোগ মুকাবিলার জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন। এই নীতিমালায় স্পষ্টভাবে নির্দেশ থাকতে হবে দুর্যোগের মুহূর্তে কোন সংস্থা কী দায়িত্ব পালন করবে, কে কোথায় থাকবে, কে কোথায় যাবে, কার ঘটনাস্থলে যাওয়ার অধিকার আছে আর কার নেই এবং কোন কর্তৃপক্ষের অধীনে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এটি কেবল প্রশাসনিক বা সামরিক মহড়ার অনুশীলন বা সক্ষমতার প্রদর্শনী নয়, বরং এটা হবে এক ধরনের ‘নাগরিক নিরাপত্তা কাঠামো’ যা দুর্যোগে দায়িত্ব ও সীমারেখা নির্ধারণ করে সমাজের সর্বস্তরের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়টি আর শান্তি-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনির দক্ষতার উপর ছেড়ে দিলে চলবে না। এটি একটি যৌথ, নীতিনির্ভর এবং মূল্যবোধভিত্তিক কাঠামোর দাবি রাখে যা সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে, যার মূল লক্ষ্য হবে মানুষের জীবন রক্ষা, রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে শৃঙ্খলা বিধান এবং নাগরিক আস্থা পুনর্গঠন।
২. রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের জন্য আচরণবিধি ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ চালু করা এখন সময়ের দাবি। দুর্যোগকালীন সময়ে শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক ও পেশাগত পরিসরে আচরণগত নীতিনৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের জন্য বিশেষ ‘আচরণবিধি’ প্রণয়ন করতে হবে, যাতে দুর্যোগকালে কী করতে হবে এবং কী করা যাবে না তা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকে। এই আচরণবিধির বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাদেরকে আইনের আওতায় শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনীতি কেবল বক্তৃতা, উপস্থিতি আর ব্যানার টানানোর কাজ নয়; এটি এক ধরনের সামাজিক দায়দায়িত্ব ও জননিরাপত্তা সংরক্ষণের অঙ্গীকার। একইভাবে চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব পেশাজীবীদের জন্যও এমন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি চালু করা দরকার, যেখানে তারা শিখবেন সংকটকালে কীভাবে দায়িত্বশীল, মানবিক এবং পেশাগত আচরণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। এটি শুধু উদ্ধার কাজের কার্যকারিতার জন্য নয়, বরং নৈতিকতার প্রশ্ন যেখানে জনস্বার্থই হবে সর্বোচ্চ বিবেচ্য। দুর্যোগকালীন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ কোনো ব্যক্তিগত ভুল নয়; এটি একটি কাঠামোগত ব্যর্থতা, যার প্রতিকারে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দুর্যোগ মোকাবিলার গাইডলাইন প্রণয়ন এবং বাধ্যতামূলক প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ চালু করা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু পাঠদানের স্থান নয়। এগুলোর সাথে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের শিশু, কিশোর ও তরুণদের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক নিরাপত্তা জড়িত। ফলে দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এজন্য প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার একটি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবমুখী গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তারা জানে দুর্ঘটনার সময় কীভাবে দ্রুত এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এই গাইডলাইনে থাকবে জরুরি নির্গমনপথ, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, দিকনির্দেশনামূলক সংকেতচিহ্ন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের তালিকা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ পদ্ধতি। শুধু গাইডলাইন থাকা যথেষ্ট নয়, এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়াও বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্যোগ প্রতিক্রিয়াকে যদি আমরা সামাজিক শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে এর চর্চা শুরু হওয়া উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কারণ ভবিষ্যতের সচেতন নাগরিক তৈরি হয় এখানেই।
৪. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গণশিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা অত্যাবশ্যক। আগেই বলা হয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেবল পেশাদার বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। এটি একটি সামাজিক চর্চা, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তাই দুর্যোগ বিষয়ে গণশিক্ষার মাধ্যমে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা সঠিক সময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং উদ্ধার ও চিকিৎসা কাজে অনভিপ্রেত বাধা সৃষ্টি না করেন। দুর্যোগকালে বহু মানুষ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে, আবেগতাড়িত হয়ে বা ভিড়ের চাপে দিশেহারা হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করেন। ফলে উদ্ধার ও প্রাণরক্ষাকারী প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ে। গুজব, আতঙ্ক ও দায়িত্বহীন প্রচারপ্রপাগান্ডা যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ডিজিটাল মিডিয়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে গণসংযোগের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ধরনের কর্মকান্ড প্রতিরোধে গণশিক্ষাকে শুধু সামাজিক অভিযান হিসেবে না দেখে, এটি নাগরিকত্ব শিক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে মানুষ জানেন, কীভাবে দায়িত্ব নিয়ে দুর্যোগের মুহূর্তে নিজের এবং অন্যের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। যেমনভাবে প্রাচীন গ্রিসে ‘সক্রিয় নাগরিকত্ব’ (একটিভ সিটিজেনশিপ) মানে ছিল ‘অবস্থা অনুধাবন ও প্রতিক্রিয়া জানার সক্ষমতা’, তেমনি আজকের নাগরিককেও গড়ে তুলতে হবে এমনভাবে যাতে সে দুর্যোগের সময় আতঙ্কে ভেঙে না পড়ে, বরং সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতিতে নিজের ও অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেন।
৫. গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্য নৈতিক আচরণবিধি তৈরি এবং পেশাগত বিধিনিষেধের বাধ্যতামূলক প্রয়োগ ব্যবস্থা চালু করা। দুর্যোগকালীন সময়ে তথ্যের গতিপ্রবাহ শুধু জনগণের আচরণ নয়, উদ্ধার ও চিকিৎসা কার্যক্রমের সফলতাকেও সরাসরি প্রভাবিত করে। এই বাস্তবতায় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল এবং নীতিনির্ভর হওয়া উচিত। এজন্য একটি সুনির্দিষ্ট নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি, যাতে সংবাদকর্মী, ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা, ব্লগার কিংবা সাধারণ ব্যবহারকারীরা জানেন দুর্যোগকালীন সময়ে কী তথ্য প্রকাশ করা উচিত, কীভাবে সেটি প্রকাশ করতে হবে এবং কোন তথ্য প্রচার বিভ্রান্তিকর কিংবা একেবারেই বর্জনীয়। কারণ ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য সেটা চিকিৎসা, উদ্ধার তৎপরতা কিংবা জননিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট হোক তা জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক ও আবেগোন্মত্ততা (হিস্টেরিয়া) তৈরি করতে পারে, যা কখনো কখনো সংঘবদ্ধ সহিংসতায়ও রূপ নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে একটি অসতর্ক পোস্ট, একটি বিভ্রান্তিকর শিরোনাম বা একটি গুজব গোটা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই এ খাতে শুধু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সততা নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে দিকনির্দেশনা, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে যাতে বাকস্বাধীনতা ও জনস্বার্থের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করে সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহ মানবিক, কল্যাণমুখী ও গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দুর্যোগ-পরবর্তী মুহূর্তে মিডিয়ার নৈতিকতা কেবল সাংবাদিকতার প্রশ্ন নয়, এটি এখন নাগরিক দায়িত্বেরও অন্তর্গত।
৬. ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উন্নত চিকিৎসা ও মনো-সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা। দুর্ঘটনায় আহতদের উন্নত ও টেকসই চিকিৎসার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশেষ করে অভিজ্ঞতাজনিত আতঙ্ক (ট্রমা) নিরসনে অব্যাহত পরামর্শ দেওয়া অত্যাবশ্যক। দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি যে অনির্দেশ্য ও গভীর ক্ষত মানুষের মনোজগতে সৃষ্টি হয়, তা আরও দীর্ঘমেয়াদি ও মারাত্মক হতে পারে। তাই কেবল আহতদের শারীরিক চিকিৎসা নয়, দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের জন্য মনো-সামাজিক পরামর্শ সহায়তা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব। আধুনিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ‘মনো-সামাজিক প্রাথমিক চিকিৎসা’ (সাইকো-সোসাল ফাস্ট এইড) একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও তরুণদের জন্য যারা এমন দুর্ঘটনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু উন্নত হাসপাতাল নয়, প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলর, কমিউনিটি সাপোর্ট সেন্টার, এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা। রাষ্ট্রের উচিত ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে কেবল দাতা বা করুণাদৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে সহানুভূতিশীল ও ন্যায়ভিত্তিক অবস্থান নেওয়া যেখানে প্রত্যেক মানুষ তাঁর পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে পুনরায় সমাজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। এই দায় শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি একটি সভ্য রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানগত কর্তব্য।
রাষ্ট্রীয় পরিসরে নাগরিকের জান, মাল ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব কোনো গৌণ বা আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক শপথ। এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই; বরং রাষ্ট্র এবং তার বিভিন্ন অঙ্গের উচিত নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার স্বরূপ শনাক্ত করে এখনই কার্যকর ও মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। প্রতিটি দুর্ঘটনা আমাদের সামনে সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরে একটি আয়নার মত যেখানে প্রতিফলিত হয় দুর্যোগ মুকাবিলার প্রস্তুতির ঘাটতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের শূন্যতা, এবং দুর্যোগকালীন সংকট অনুধাবনের ব্যর্থতা। বিশেষ করে যুদ্ধবিমানের মতো উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্র কীভাবে একটি স্কুল ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে সেই প্রশ্নটিকে শুধুই যান্ত্রিক বিভ্রাট হিসেবে দেখা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও নৈতিক ব্যর্থতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পূর্বপ্রস্তুতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জবাবদিহিতার প্রতিটি স্তরে ঘাটতি বিদ্যমান। যদি আমরা এসব থেকে শিক্ষা না নিই, যদি প্রতিটি বিপর্যয়কে কেবল কিছুদিনের ক্ষোভ আর শোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে ভবিষ্যতের আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় গোটা জাতিকে বহন করতে হবে।
রাষ্ট্র যদি আত্মসমালোচনার সাহস না দেখায়, যদি নেতৃত্ব নিজেকে দায়মুক্ত রাখে, তাহলে আমাদের নাগরিক অধিকারের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই সময় এসেছে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভাষা পরিহার করে আত্মশুদ্ধির পথে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করার যাতে প্রত্যেক দুর্ঘটনার পেছনে থাকা কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত ও সংস্কার করা যায়।
আমরা কি সত্যিই পরিবর্তন চাই? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের ভাষায় নয়, কর্মে স্পষ্ট হতে হবে। যদি সত্যিই আমরা পরিবর্তন চাই তবে প্রয়োজন নেতৃত্বে নৈতিক শুদ্ধতা, পেশাগত জীবনে দায়বদ্ধতা, এবং নাগরিক চেতনায় সক্রিয় সচেতনতা। দুর্যোগ-পরবর্তী আবেগ দিয়ে নয়, বরং দুর্যোগ-প্রতিরোধে রূপরেখা তৈরি করেই আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা এগিয়ে নিতে হবে। এখনই সময় চোখ মেলে দেখার, সাহস করে প্রশ্ন তোলার, এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিপর্যয় রোধের। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া আমাদেরকে আরেকটি দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দেয়। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিলে তা শুধু ভুল হয়ে থাকবে না, অপরাধে পরিণত হবে যার দায় এড়াতে পারবে না কেউই। রাষ্ট্র যদি না জাগে, নাগরিক যদি না জাগে, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আজকে শিক্ষা না নিলে, কাল আর বাঁচার সুযোগ থাকবে না।
ড. মাহরুফ চৌধুরী
ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য
Email: mahruf@ymail.com
মত দ্বিমত
দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যে প্রাণসংহারী দুর্ঘটনা ঘটে, তা শুধু হতাহতের দিক থেকেই নয়, বরং একটি জাতির চেতনায়ও গভীর দাগ কেটে দিয়েছে। বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সামনে ঘটে যাওয়া এই বিভীষিকাময় দৃশ্য শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা বা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। বরং এটি আমাদের দুর্যোগ-প্রস্তুতির সীমাবদ্ধতা, অব্যবস্থা ও অবিবেচনার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ যারা প্রাণ হারিয়েছেন বা দগ্ধ হয়েছেন, তাদের শারীরিক যন্ত্রণা যেমন বাস্তব, তেমনি গোটা জাতি মানসিকভাবে গভীরভাবে আহত হয়েছে। দুর্যোগ বলে কয়ে আসে না। তবে কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে, সেই বিবেচনা ও প্রস্তুতির দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সমাজের এবং প্রতিটি পেশাজীবি ও সাধারণ নাগরিকের। এই প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন উঠছে: এমন দুর্যোগকালে যারা দায়িত্বের চেয়ে উৎসুকতা, দায়িত্বশীলতার বদলে স্বেচ্ছাচার কিংবা সাহায্যের নামে অদক্ষতা প্রদর্শন করেন তাদের আমরা কি আদৌ দায়িত্বশীল ভাবতে পারি?
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জরুরি উদ্ধার ও চিকিৎসা প্রস্তুতি, এমনকি নাগরিক ও পেশাজীবিদের আচরণগত দায়িত্ববোধ সবই নড়বড়ে, ভঙ্গুর কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ। একটি সামরিক বিমান শহরের আকাশে ভেসে বেড়ানো মানেই কেবল ‘মহড়া’ নয়; তা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতির অদূরদর্শিতা ও নাগরিক নিরাপত্তা ভাবনার সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ করে। প্রশ্ন জাগে: কেন ঘনবসতিপূর্ণ এবং শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঘেরা এলাকায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ মহড়া চলতে পারে? কতটা কার্যকর ছিল নিরাপত্তা প্রটোকল? দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিতে বা প্রাণ বাঁচাতে আমরা কতটা প্রস্তুত ছিলাম? আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এমন সংকট মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও পেশাগত নেতৃত্বের আচরণ কেমন ছিল। এ প্রশ্নগুলো শুধু এই দুর্ঘটনার জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে থাকা সামাজিক চুক্তি, দায়বদ্ধতা ও নেতৃত্বের নৈতিকতা সম্পর্কেও পুনর্বিচার দাবি করে।
এই আলোচনার উদ্দেশ্য কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব উত্থাপন করা নয়, কিংবা অন্ধ তর্কের আবর্তে জনমতকে বিভ্রান্ত করা নয়। বরং আমাদের লক্ষ্য হলো এই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার একটি গঠনমূলক পরিসর সৃষ্টি করা যেখানে দায় এড়িয়ে নয়, বরং দায়িত্ব নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রস্তুতির পথ খুঁজে নিতে পারি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখানে দুটি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাই। প্রথমত, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের বাস্তব প্রস্তুতির যে ঘাটতি তা নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা ও সমাধানমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার (বিস্তারিত থাকবে পরবর্তী লেখায়)। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার আচরণ যেন দায়িত্বশীলতা, বিবেকবোধ ও পেশাগত নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করা যা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
প্রথম ও প্রধান বিষয় হলো দুর্যোগ মুহূর্তে ঘটনাস্থলে সর্বাগ্রে উপস্থিত হওয়ার অধিকার একমাত্র সেইসব বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর, যারা উদ্ধার ও সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম। যেমন ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। অথচ বাস্তবতায় আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখেছি। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মিডিয়া কর্মী এবং উৎসুক সাধারণ মানুষের ভিড়ে দুর্ঘটনাস্থল পরিণত হয়েছে বিশৃঙ্খল প্রদর্শনমঞ্চে। কেউ ফেসবুক লাইভ করছেন, কেউ বেদনাদায়ক দৃশ্যের ছবি তুলছেন, কেউবা বিভৎসতার সরাসরি সম্প্রচার করছেন যা উদ্ধারকাজকে শুধু ব্যাহতই করেনি, বরং তা দুর্গতদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই ‘উপস্থিতির প্রতিযোগিতা’ আমাদের এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করেছে যে, আমরা এখনো নাগরিক ও পেশাগত দায়িত্ববোধের মৌলিক শিক্ষায় নিজেদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে পারিনি। দুর্যোগে কেবল উপস্থিত থাকা নয়, সময়মতো সরে দাঁড়ানোর সংবেদনশীলতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গুণ। উদ্ধার অভিযানের শুরুতেই প্রয়োজন ছিল প্রশিক্ষিত বাহিনীগুলোর সুসমন্বিত পদক্ষেপ। কিন্তু তারা যে বিশৃঙ্খল দৃশ্যের ভিড়ে কার্যত পিছিয়ে পড়ল, সেটিই প্রমাণ করে যে আমাদের নাগরিক শিষ্টাচার ও দুর্যোগ-সচেতনতা এখনো শূন্যের কোঠায় রয়ে গেছে। এ যেন আলবেয়ার কামুর ভাষায় ‘চেতনার সংকট’ (ক্রাইসিস অব কনসাসনেস) যেখানে মানুষের উপস্থিতি হয়ে ওঠে প্রতিকারের নয়, বরং প্রতিকূলতার অংশ।
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা যেকোনো গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি। সংবাদ পরিবেশন শুধু তথ্য দেওয়ার বিষয় নয়। এটি নৈতিকতা, সহানুভূতি ও মানবিক বোধের পরীক্ষাক্ষেত্র। কিন্তু মাইলস্টোন কলেজের দুর্ঘটনার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা প্রতিফলিত হয়েছে, তা এক কথায় নির্মমতার প্রদর্শনী। নিহত ও দগ্ধ শিশুদের অনাবৃত ছবি, অগ্নিদগ্ধ শ্রেণিকক্ষের বিভৎস ভিডিও, কান্নারত শিক্ষার্থীদের লাইভ সাক্ষাৎকার এবং হাসপাতালের বেডে কাতরানো শিশুর মুখের ক্লোজ-আপ এসব কিছুই শুধু নৈতিক সীমানা লঙ্ঘন করেনি, বরং একটি জাতির মানসিক স্বাস্থ্যকেই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাংবাদিকতার মূলনীতি ‘ক্ষতি না করা’ (ডু নো হারম) এখানে যেন পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছে।
জনসচেতনতা তৈরির নামে যেসব চিত্র বারবার প্রচার করা হয়েছে, তা সাংবাদিকতার আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং সংবাদকর্মীদের পেশাগত শপথের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। এর ফলে আমরা যা পেয়েছি, তা তথ্য নয়, একটি জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া সামষ্টিক আতঙ্ক (ট্রমা)। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ নয়, বরং সংবেদনবর্জিত বাণিজ্যিকতা ও ‘রেটিং’র নির্মম প্রতিযোগিতাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। মিশেল ফুকোর ভাষায়, এটি একটি ‘দৃশ্যমান শক্তি’ (ভিজিবল পাওয়ার) যা মানুষের দুর্বলতা ও দুর্দশাকে পণ্য করে তোলে। আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি তবে দায়িত্বশীলতার বদলে নিষ্ঠুর কৌতূহলের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে?
সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও গভীরভাবে চিন্তার বিষয় হলো যাঁদের সেখানে সরাসরি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না, সেইসব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিরা দলে দলে দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন। এটি নিছক সহানুভূতির প্রকাশ নয়; বরং আত্মপ্রচারের দায়ত্বজ্ঞানহীন ও আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা, যা দুর্যোগকালীন মানবিকতা ও পেশাগত শালীনতাকে চরমভাবে আঘাত করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে জানা কথা, দগ্ধ রোগীরা সংক্রমণের চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অথচ বার্ন ইউনিটে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জনারণ্যে চিকিৎসা পরিবেশ হয়ে উঠেছিল বিশৃঙ্খল ও হুমকিপূর্ণ। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা দেখেছি কেউ কেউ ছিলেন চিকিৎসক পরিচয়ের অধিকারী যাঁরা চিকিৎসা শাস্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো যেমন ‘ক্ষতি না করা’ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে সুপরিচিত। তবুও তাঁরা রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে পেশাগত জ্ঞান ও নৈতিকতা উভয়কেই উপেক্ষা করেছেন। এখানে একটি গভীর রাজনৈতিক প্রশ্ন সামনে আসে, যখন পেশাগত দায়িত্ববোধকে ছাড়িয়ে রাজনৈতিক আত্মপ্রচার প্রাধান্য পায়, তখন রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও নাগরিক সুরক্ষা কতটা নিরাপদ থাকে? মাকিয়াভেলি রাজনীতিকে বাস্তববুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, যখন সেই বুদ্ধিমত্তা জনকল্যাণ নয়, বরং ক্ষমতার ক্ষণস্থায়ী প্রদর্শন হয়ে ওঠে, তখন তা বিপজ্জনক। এই লেখার মূল অনুসন্ধান তাই এখানেই যে সময় মানুষ বাঁচানোর লড়াইয়ে অন্যরা ব্যস্ত, সেই সময় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিদের সদলবলে উপস্থিতি যদি হয়ে ওঠে এক প্রকার জনদর্শন, তাহলে সেই রাষ্ট্রিক নৈতিকতার ভবিষ্যৎ কতটা ভঙ্গুর?
একটি রাষ্ট্র হিসেবে, একটি জাতি হিসেবে, এমনকি একটি সমাজ হিসেবে আমাদের এখনই সময় আত্মসমালোচনার। আমরা জানি, অতীতের দুর্ঘটনা ফিরিয়ে আনা যায় না; কিন্তু ভবিষ্যৎকে প্রস্তুত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় কেবল সামরিক কৌশল কিংবা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথেষ্ট নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে মানবিকতা, নৈতিকতা ও কাঠামোগত প্রস্তুতির দৃঢ় ভিত্তি। নাগরিকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কি কোনো সুনির্দিষ্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আছে? দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং কি প্রস্তুত ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের নিরাপত্তা কাঠামো নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, পেশাগত সংগঠন, প্রশাসনিক মহল এবং নাগরিক সমাজের সামনে এখন আত্মসমালোচনার একটি কঠিন আয়না তুলে ধরা। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘অপরীক্ষিত জীবন মূল্যহীন’ (এ লাইফ আনএক্সামিন্ড ইজ নট অরথ লিভিং)। একইভাবে, একটি দুর্যোগ-অভ্যস্ত সমাজও যদি আত্মসমীক্ষা না করে, তবে তার ভবিষ্যৎ কেবল পুনরাবৃত্ত দুর্ভোগই ডেকে আনবে। যদি এখনই আমরা নিজেকে প্রশ্ন না করি, নিজের দায় স্বীকার না করি এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি না নিই তবে বড় কোনো দুর্যোগ সামনে এলে জাতির প্রতিক্রিয়া কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের দুর্ঘটনা যেন আমাদের সামনে একটি নির্মম আয়না যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সামষ্টিক অপ্রস্তুতি, দায়িত্বহীনতা এবং সহানুভূতির সংকট। এ আয়নায় আমরা দেখতে পাচ্ছি এক গভীর কাঠামোগত ত্রুটি, যা শুধু দুর্ঘটনা-প্রস্তুতির ঘাটতিই নয়, বরং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংবাদিকতার নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক দায়িত্ববোধ এবং সাধারণ নাগরিক আচরণ সবকিছুর মধ্যেই একধরনের মানবিক, পেশাগত ও নৈতিক রূপান্তরের জরুরি প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে এসেছে। দুর্যোগের মুহূর্তে কেবল প্রযুক্তি নয়, মানবিকতাও যদি ভেঙে পড়ে, তবে সে সমাজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। এখনই সময় আমাদের গভীরভাবে ভাবার জাতীয় দুর্যোগের মুহূর্তে আমরা আসলে কাদের হাতে নিজেদের নিরাপত্তা তুলে দিচ্ছি? যাঁরা দায়িত্ব পালনের নামে দায়িত্ব এড়িয়ে যান, মানবিকতার নামে আত্মপ্রচার করেন, কিংবা পেশাগত শপথের বদলে রাজনীতির রঙে নিজেদের মুখ রাঙান তাঁদের হাতে কি একটি জাতি নিরাপদ থাকতে পারে? এই প্রশ্ন শুধু এই লেখার নয়, বরং একটি সময়ের প্রতি জাতির দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
দুর্যোগ কখনো শুধু একটি মুহূর্তের বিপর্যয় নয়, বরং তা একটি জাতির চেতনা, কাঠামো এবং দায়িত্ববোধের পরীক্ষাক্ষেত্র। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের দুর্ঘটনা সেই পরীক্ষায় আমাদের কতটা অকূলে ভেসে গেছে, তা আমরা নিজেদের চোখেই প্রত্যক্ষ করেছি। এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের মধ্যে প্রস্তুতির অভাব আছে, আছে সহানুভূতির সংকট এবং রয়েছে নৈতিক দায়িত্ববোধের দুর্বলতা।
আমরা যদি সত্যিই একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও সচেতন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের দেশটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তবে দুর্যোগকে কেবল সহানুভূতির ভাষণে না রেখে, তা থেকে নৈতিক ও কাঠামোগত শিক্ষা নিতে হবে। এ শিক্ষা শুরু করতে হবে শাসকের আত্মসমালোচনা থেকে, রাজনৈতিক নেতাদের কান্ডজ্ঞান অর্জন থেকে, পেশাজীবির দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি থেকে এবং নাগরিকের আচার-আচরণ সংস্কারের মাধ্যমে। দুর্যোগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগ্রহ নয়; বরং প্রয়োজন কাজের যোগ্যতা, সংবেদনশীলতা এবং সময়জ্ঞান। আর সাংবাদিকতার নামে বিভৎসতা নয়, প্রয়োজন দায়িত্বশীল তথ্য পরিবেশন ও মানুষের হৃদয় বোঝার ক্ষমতা। রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসক ও প্রশাসকেরা যদি সত্যিই মানুষকে ভালোবাসে, তবে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে হবে দুর্যোগকালে, কেবল বক্তব্যের ফুলঝুড়িতে নয়, সঠিক কর্মের মাধ্যমে। সচেতনতা, শৃঙ্খলা ও সহানুভূতির একত্র প্রয়োগেই সম্ভব ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবিলা করা। তা নাহলে, আমরা শুধু ভবিষ্যৎ ভয়াবহ ঘটনার অপেক্ষায় থাকব আর প্রতিবারই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কিছু মানুষের অবিবেচনার ফল ভোগ করবে জাতি।
ড. মাহরুফ চৌধুরী
ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য
Email: mahruf@ymail.com
মত দ্বিমত
পাইলটের জন্য পতাকা, কান্তির জন্য নীরবতা: এই রাষ্ট্র কার?

একটা দেশ স্বাধীন করে তাকে জিম্মি করা হবে—এটা আমি কেনো, কেউ-ই ১৯৭১-এ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ পুরো দেশের সাধারণ মানুষ অসাধারণ মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। এই অসাধারণ মানুষগুলো কারা? তাদের চেহারা কেমন? তাদের সীমাহীন ভালোবাসা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি! তাদের জন্মই হয়েছে সাধারণ মানুষের সেবা করার জন্য! কী আশ্চর্য বিষয়! পাশ্চাত্যে মানুষ সমাজকল্যাণের মাধ্যমে সেবা দেয়—শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিঃস্বার্থভাবে যুক্ত থেকে। তারা মানুষের পাশে থাকে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলে।
কিন্তু বাংলাদেশে সবার একটাই অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষা—রাজনীতি করতে হবে। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে, ভাগ্য বদলাতে, গণতন্ত্র আনতে, জনগণের জন্য কাজ করতে হবে—এমন সব মহৎ উদ্দেশ্যের মুখোশ পরে এক অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলছে রাজনৈতিক অভিনয়। ভন্ডামির এই নাটক আজও থামেনি। সব বুঝেও সাধারণ মানুষ সেই অসাধারণ মানুষের পেছনে ছুটে চলে—কেন?
একটা দেশের মূল ফোকাস যদি কেবল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে প্রতিটি দুর্ঘটনা হয়ে ওঠে রাজনীতির নাট্যমঞ্চ। একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটলে কী দেখতে পাবেন? সকল দলের নেতা-কর্মীরা হুড়োহুড়ি করে ঘটনাস্থলে হাজির হন। রোগী মৃত্যুর মুখে—তাতে কিছু যায় আসে না। আগে রাজনীতিকদের সামনে জবাবদিহি করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আর মিডিয়ার কাজ? কেবল এটুকু জানানো—কোন নেতা কখন এলেন, কী বললেন, কোথায় দাঁড়ালেন, কীভাবে গেলেন।
এই বাস্তবতার নির্মম সত্যতা আবারও সামনে এল ২০২৫ সালের ২১ জুলাই। দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান (F-7 BGI) ঢাকার বীর উত্তম এ. কে. খন্দকার বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই এটি কারিগরি ত্রুটির সম্মুখীন হয়।
দক্ষ বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম জনবহুল এলাকা এড়িয়ে বিমানটি সরিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন—গণমাধ্যমে এমনই দাবি এসেছে। কিন্তু আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে এই বিবরণের সঙ্গে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। ঘটনাস্থলের আকাশে আমি প্যারাস্যুটে বৈমানিককে অবতরণ করতে দেখেছি। সে প্রেক্ষাপটে “প্রাণপণ চেষ্টা করে শেষরক্ষা হয়নি” বলাটা যুক্তিগতভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ে। বরং এটি বিভ্রান্তিকর এক বার্তা দেয়, যা বাস্তব ঘটনার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খায় না।
এ ধরনের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করার আগে অন্তত দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে বিবেচনা করা জরুরি:
১. পাইলট আদৌ শেষ পর্যন্ত বিমানটি নিয়ন্ত্রণে রেখে জনবহুল এলাকা এড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিনা—তা নির্ভর করে নির্ভরযোগ্য তথ্য ও তদন্তের ওপর।
২. যদি তিনি ইজেক্ট করে প্যারাস্যুটে অবতরণ করে থাকেন, তবে এটি স্পষ্ট হয় যে, তিনি নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন; এবং সেই মুহূর্তে বিমানটির আর কোনো নিয়ন্ত্রণ হয়তো তার হাতে ছিল না।
যাইহোক শেষ মুহূর্তে বিমানটি আছড়ে পড়ে উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি বহুতল ভবনে। দৃশ্যপট ছিল বিভীষিকাময়—বিমানটি ভবনের এক পাশে আঘাত করে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং অপর পাশে বেরিয়ে যায়। আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। ঘটনাস্থলেই ১৯ থেকে ২০ জন নিহত—অধিকাংশই শিশু শিক্ষার্থী। গুরুতর আহত হয় শতাধিক, অনেকেই এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর জাতি শোকে মুহ্যমান। কিন্তু এই শোকের পেছনে লুকিয়ে আছে অনেকগুলো জলজ্যান্ত প্রশ্ন—যেগুলোর উত্তর আমরা দিনের পর দিন এড়িয়ে চলেছি। মঘনবসতিপূর্ণ মহানগরের বুকে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি ও যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ—এটা কি কেবল অযৌক্তিই, না কি সরাসরি রাষ্ট্রের অমানবিকতা?
ঢাকা শুধু একটি শহর নয়—এটি একটি জীবন্ত নগর। মএখানে প্রতিদিন কোটি মানুষের চলাচল, স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, ঘরবাড়ি—সব একে অন্যের গা ঘেঁষে। মএই শহরে সামরিক বিমানঘাঁটি ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তর রাখা মানে প্রতিদিন লাখো মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা। মএটা শুধু দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নয়—এটা রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার নগ্ন প্রকাশ।
তাই এখনই সময়—এই সামরিক স্থাপনাগুলোকে ঢাকার বাইরে তুলনামূলক কম জনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার।
এই সিদ্ধান্ত শুধু দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাবে না—শহরের বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ট্রাফিক জটও কমাবে। মসবচেয়ে বড় কথা, এটি হবে একটি নৈতিক ও সভ্য সিদ্ধান্ত—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এক অনিবার্য পদক্ষেপ।
আমার প্রশ্ন আবারও সেই অসাধারণ মানুষদের উদ্দেশ্যে— আপনারা আর কতদিন সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন?
এখনও রাজধানীর আকাশে যুদ্ধবিমান উড়ছে! এটা কেমন রাষ্ট্রযন্ত্র, যেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ চলে মানুষের মাথার ওপর দিয়ে? মকবরস্থান থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়, সেনানিবাস, সদর দপ্তর—সবকিছুই রাজধানীতে? মতবু মানুষ নিশ্চুপ। মকারণ আজ সাধারণ মানুষ অসাধারণ মানুষদের কাছে জিম্মি। জিম্মি কেন?
রাজধানীর আকাশে যুদ্ধবিমান থাকলেও—দেশ কখনও উন্নত হবে না যদি শিল্পের চাকা না ঘোরে, যদি শিক্ষার মান না বাড়ে, যদি কৃষকের মুখে হাসি না ফোটে, যদি সারা দেশে পরিকাঠামো না গড়ে ওঠে। উন্নয়ন মানে শুধু ফ্লাইওভার নয়—উন্নয়ন মানে প্রতিটি ঘরে আলো, প্রতিটি পরিবারে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া।
ঢাকা নয়—বাংলাদেশই উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রনীতি যেন সব উল্টো পথে হাঁটে: গ্রামের স্কুল বন্ধ হয়, কৃষকের ধান পচে যায়, যুবক চাকরি না পেয়ে দালালের হাতে প্রবাসে জীবন সঁপে দেয়—আর এই সংকটের মাঝেই একদল অসাধারণ মানুষ আয়েশ করে দেশ চালান।
দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে রক্তের মতো প্রবাহিত— স্বাস্থ্যখাত, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রকৌশল, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ—সবখানেই ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, দায়িত্বহীনতা। আর এই নীতিহীন ব্যবস্থার কারিগর কারা? সেই অসাধারণ মানুষরাই, যারা মুখে দেশপ্রেমের বুলি আওড়ে, অথচ কাজে চরম অবক্ষয় ঘটায়।
মানুষ এখন উন্নয়ন চায় না—চায় নিরাপদ বাঁচার অধিকার। কিন্তু রাষ্ট্র তা দিতেও ব্যর্থ। কারণ রাষ্ট্র এখন রাজনীতিকদের পকেটে, আর সেই পকেট থেকে চলে পৃষ্ঠপোষকদের ব্যাংকে।
আমরা আর কত সহ্য করব? রাষ্ট্র কি শুধু কাগজে স্বাধীন থাকবে, বাস্তবে থাকবে অসাধারণদের হাতে বন্দি? আমরা কি এমন একটি দেশ রেখে যেতে চাই আমাদের সন্তানদের জন্য, যেখানে প্রতিটি সত্য চাপা পড়ে থাকবে? যেখানে প্রশ্ন তুললেই রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা? যেখানে দুর্নীতিই নিয়ম, আর সততা ব্যতিক্রম?
এখনো সময় আছে। আমাদের দরকার—
• নৈতিক পুনর্জাগরণ,
• বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ,
• সাধারণ মানুষের ঐক্য।
এই দেশ অসাধারণদের নয়—এই দেশ ১৮ কোটি সাধারণ মানুষের। মতারা যদি চায়, তাহলে এই রাষ্ট্র আবার সেই ১৯৭১-এর পথে হাঁটতে পারবে—স্বাধীনতা রক্ষার, নতুন করে অর্জনের পথে। একটা দেশ স্বাধীন করে তাকে জিম্মি করা হবে—এটা আমি তো নয়ই, ১৯৭১-এ কেউই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ, দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে গেছে অসাধারণ মানুষের কাছে—যারা মুখে সেবা, অথচ কাজে সর্বনাশ করে।
আমার প্রশ্ন—আর কতদিন? আর কতদিন এই অসাধারণ নামধারী মানুষদের হাতে এই জাতি অপমানিত, শোষিত, নিঃস্ব থাকবে? এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নামক রাষ্ট্রটি অসাধারণ মানুষের নামে অপহৃত। পেছনে পড়ে থাকে কান্তির মতো হাজারো সাধারণ মানুষ, যারা কেবল বেঁচে থাকার ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও পায় না।
পাইলটের মৃত্যু রাষ্ট্রের ট্র্যাজেডি হতে পারে, কিন্তু কান্তির মৃত্যু জাতির অপমান। পাইলট মরেছেন—সেটি দুঃখজনক, সম্মানজনকও বটে। কারণ তিনি জানতেন, তার পেশা একরকম চুক্তি—যেখানে জীবনের বিনিময়ে দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যুতে কফিনে রাষ্ট্রীয় পতাকা পড়ে, বীরের মর্যাদা মেলে।
কিন্তু কান্তি? তার কফিনে কোনো পতাকা নেই, কোনো মন্ত্রী নেই, টিভি ক্যামেরাও নেই। সে তো যুদ্ধ করেনি, অস্ত্র ধরেনি, রাষ্ট্রের শত্রুও ছিল না। মসে ছিল ভবিষ্যৎ—বই হাতে একটা স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়েছিল। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে—অবহেলায়, অবজ্ঞায়, অনৈতিক রাষ্ট্রচর্চার নির্মম পরিণতিতে।
পাইলটের মৃত্যু যদি কর্তব্যের পরিণতি হয়, কান্তির মৃত্যু তা নয়। একজন জীবনের ঝুঁকি জেনে পেশায় এসেছেন—অন্যজন স্কুলে গিয়েছিল জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে। একজনের মৃত্যু হয়তো অনিবার্য ছিল, অন্যজনের মৃত্যু ছিল অপরাধ।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com