মত দ্বিমত
বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়: সময়ের দাবি ও জাতির ভবিষ্যতের প্রয়োজন

শিক্ষা শুধু তথ্য গ্রহণের প্রক্রিয়া নয়, বরং মানুষ গড়ার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়। একটি জাতি তার ভবিষ্যৎ যেমন নির্ধারণ করে তার অর্থনীতি ও রাজনীতির মাধ্যমে, ঠিক তেমনি — এমনকি তারও আগে — শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু এই ব্যবস্থার সফলতা নির্ভর করে যাঁদের হাতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেই শিক্ষকদের ওপর। আর সুশিক্ষার কারিগর হতে হলে শিক্ষককে শুধু পাঠদানে দক্ষ হলেই চলে না, তাঁর দরকার গভীর মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৈতিকতা ও নেতৃত্বের জ্ঞান। এই দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় – একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান, যেখানে শিক্ষক গঠনের সব স্তর কাঠামোবদ্ধ ও গবেষণাভিত্তিক হবে।
কেন বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় দরকার?
আজকের বিশ্ব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মুখোমুখি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে সমাজ ও শিক্ষার ধরন। শিক্ষার্থীরা এখন কেবল পাঠ্যবই নয়, বরং ইউটিউব, গুগল, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রতিনিয়ত তথ্য নিচ্ছে। এই বাস্তবতায় একজন শিক্ষককে হতে হয় শুধু বই পড়ানো ব্যক্তি নয়, বরং একজন নেতা, কোচ, গাইড এবং জীবনদর্শনের নির্মাতা। এই রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন এমন একটি প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম, যা শিক্ষককে পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করবে।
একটি কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা প্রক্রিয়ার চার স্তর: একটি রূপক ধারণা
আমরা যদি শিক্ষাকে একটি গাছ রোপণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বুঝতে পারি:
১. বীজ বপন (প্রাথমিক শিক্ষা)
২. চারা রোপণ (মাধ্যমিক শিক্ষা)
৩. গাছ লাগানো (কলেজ পর্যায়)
৪. ফল ফলানো (বিশ্ববিদ্যালয় স্তর)
এই পুরো প্রক্রিয়া সফলভাবে পরিচালনার জন্য দরকার একজন “প্রক্রিয়ার পরিচালক” বা “শিক্ষা নীতিনির্ধারক”, যিনি জানবেন কী ধরনের শিক্ষক কোথায় প্রয়োজন, কীভাবে নিয়োগ ও মূল্যায়ন করতে হবে, এবং কীভাবে মাইন্ডসেট গঠন করতে হবে।
স্তরভিত্তিক বিশ্লেষণ: শিক্ষক গঠনের ঘাটতি ও করণীয়
১. প্রাথমিক স্তর: মূল চরিত্র গঠনের সময়
এই স্তরে শিশুরা অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে শেখে। এখানকার শিক্ষকের প্রধান কাজ শিশুর আচরণ পর্যবেক্ষণ, উৎসাহ দেওয়া এবং তাদের ক্রিয়েটিভিটি গড়ে তোলা। এজন্য শিক্ষককে জানতে হবে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তি, এমনকি পরিবেশ ও নৈতিকতা।
বাস্তবতা:
• অধিকাংশ শিক্ষক এই স্তরের উপযোগী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন।
• শিক্ষক নিয়োগে গুণগত যাচাই অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
• মনিটরিং ও ফিডব্যাক ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে।
প্রস্তাব:
• বাধ্যতামূলক মানসিক স্বাস্থ্য ও শিশু বিকাশ বিষয়ক প্রশিক্ষণ
• গেম-ভিত্তিক ও লার্নিং-বাই-ডুইং মডেল ব্যবহার
• নির্ধারিত মূল্যায়ন চক্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণ আপডেট
২. মাধ্যমিক স্তর: পরিচয় ও পথ নির্ধারণের সময়
কৈশোরে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন হয় নাটকীয়ভাবে। এই সময়ে শিক্ষককে হতে হয় গাইড, অভিভাবক ও বন্ধু। শুধু পাঠ্যবিষয়ের শিক্ষকতা নয়, বরং জীবনের নীতিনির্ধারক হয়ে উঠেন শিক্ষক।
বাস্তবতা:
• অধিকাংশ শিক্ষক এই মানসিক স্তরের প্রয়োজনীয়তা বোঝেন না।
• শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তি, অবসাদ ও মনোযোগহীনতা বেড়েছে।
• প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকগণ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারছেন না।
প্রস্তাব:
• ডিজিটাল লিটারেসি ও কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক
• ভার্চুয়াল ম্যানেজমেন্ট এবং ক্লাসরুম সাইকোলজি অন্তর্ভুক্তি
• শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণে সিস্টেম তৈরি
৩. কলেজ স্তর: জীবনের গতি নির্ধারণের সময়
এই সময় একজন শিক্ষার্থী নিজের ভবিষ্যৎ পেশা, আদর্শ ও জীবনদর্শন নির্ধারণ করে। ভালো গাইডেন্সের অভাবে শিক্ষার্থী হারিয়ে যেতে পারে।
বাস্তবতা:
• শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর বোঝাপড়া অনেক সময় দূরত্বপূর্ণ।
• পারিবারিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক চাপ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে।
• রেগুলার ফিডব্যাক এবং সহানুভূতিশীল যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে।
প্রস্তাব:
• রিলেশনশিপ ব্যাসেড লার্নিং মডেল চালু করা।
• শিক্ষক-শিক্ষার্থী বোঝাপড়ার জন্য মাসিক কাউন্সেলিং সেশন।
• দায়িত্ব-কেন্দ্রিক শিক্ষা কৌশল বাস্তবায়ন।
৪. বিশ্ববিদ্যালয় স্তর: জীবনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি
এটাই হলো শিক্ষার প্যাকেজিং পর্ব। এখান থেকে শিক্ষার্থী পেশাগত জগতে প্রবেশ করে। তারা শুধু একজন কর্মচারী নয়, বরং একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠবে কিনা, তা নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উপর।
বাস্তবতা:
• অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকের ভূমিকা সীমাবদ্ধ সিলেবাসে।
• শিক্ষার্থীরা ‘পারফর্মেন্স’ শেখে না, শেখে শুধু ‘পরীক্ষা পাশ’।
• সিভিক দায়িত্ববোধ, ক্রিটিক্যাল থিংকিং বা আত্মউন্নয়ন শেখানো হয় না।
প্রস্তাব:
• শিক্ষকের জন্য লাইফ স্কিল ও লিডারশিপ প্রশিক্ষণ
• ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া পার্টনারশিপ
• শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ কোর্স
বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য
১. জাতীয় পর্যায়ের মানদণ্ডে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাঠামো
২. প্রত্যেক স্তরের জন্য আলাদা ট্র্যাক ও স্পেশালাইজেশন
৩. শিক্ষাদান ছাড়াও রিসার্চ, ডেভেলপমেন্ট ও মনিটরিং সেল
৪. ই-লার্নিং এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুম পরিচালনায় দক্ষতা
৫. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম
৬. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা
দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি
শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো প্রকার দুর্নীতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রতিটি স্তরে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে কোনো শিক্ষাব্যবস্থাই সফল হতে পারে না। দুর্নীতিগ্রস্ত একজন শিক্ষক মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক অধঃপতনের দায়। কাজেই এই প্রস্তাবিত বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ এবং নৈতিকতা-ভিত্তিক একটি মডেল প্রতিষ্ঠান—যেখানে মূল্যায়ন হবে দক্ষতার ভিত্তিতে, নিয়োগ হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, এবং পরিচালনা হবে সততার ভিত্তিতে। এটাই হতে হবে শিক্ষার প্রথম শর্ত।
অব্যবহৃত জনসম্পদের ব্যর্থতা
আজ যখন গোটা বিশ্ব দক্ষ জনশক্তির খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছে, তখন বাংলাদেশ, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ যুব জনগোষ্ঠীর দেশ, তার বিশাল ম্যানপাওয়ারকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে — শুধু সুপরিকল্পিত শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন অবকাঠামোর অভাবে। এই ব্যর্থতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি কৌশলগত ও জাতীয় ব্যর্থতা। সুশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও নেতৃত্ব-সক্ষম নাগরিক তৈরি না করতে পারলে, এই জনশক্তি একসময় বোঝায় পরিণত হতে পারে। কাজেই এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো—একটি শক্তিশালী, দক্ষতানির্ভর ও দৃষ্টিভঙ্গিমূলক শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা, যার কেন্দ্রে থাকবে বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ।
শিক্ষকের অভিজ্ঞতা: প্রশিক্ষণ ছাড়া পাঠদানের বাস্তব সংকট
মফস্বলের এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন মাজেদা বেগম। বিষয় ইংরেজি, কিন্তু কোনো ধরনের প্রফেশনাল শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তাঁর কোনো শিক্ষাই নেই। তিনি নিজেই বলেন, “আমার বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থাকলেও কীভাবে পড়াতে হবে, ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখতে হবে, কীভাবে ক্লাসে জটিল বিষয় সহজভাবে উপস্থাপন করতে হবে—এসব শেখার কোনো সুযোগ পাইনি।” ফলাফল দাঁড়িয়েছে, ক্লাসে গণ্ডগোল বাড়ছে, ছাত্ররা বিষয় বুঝছে না, আগ্রহ হারাচ্ছে। এটা কেবল মাজেদা বেগমের গল্প নয়, দেশের হাজারো শিক্ষকের গল্প। শিক্ষার শিকড় যখন দুর্বল থাকে, তখন ফল আসলেও তা হয় অপুষ্ট। বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ না থাকলে আমরা এমন অপুষ্ট ফলেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হব।
ঠিক এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশের একটি গ্রামের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পাঠদান করছেন সুইডেনপ্রবাসী অধ্যাপক ড. মান্নান মৃধা (KTH, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)। তাঁর নিজ জেলা মাগুরার নহাটা গ্রামে তিনি নিয়মিত ফিরে আসেন, ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন—“কী শিক্ষা, কেন শিক্ষা, কীভাবে শিক্ষা”—এই তিনটি প্রশ্নের জীবনঘনিষ্ঠ উত্তর খোঁজার জন্য। কীভাবে শিক্ষায় ‘মজা’ ঢুকিয়ে শেখাকে আনন্দময় করা যায়—তা তিনি নিজ হাতে দেখিয়ে দেন। মান্নান মৃধার এই কাজ নিছক প্রবাসী উদ্যোগ নয়; বরং এটি সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগ, যেখানে শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, সমাজ গঠনের দায়িত্ব।
ফিনল্যান্ডে শিক্ষক হতে হলে মাস্টার্স ডিগ্রির পাশাপাশি কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। শেখাতে জানার পাশাপাশি জানতে হয় ছাত্রদের মনস্তত্ত্ব, শেখানোর কৌশল, এবং শিক্ষাকে জীবনঘনিষ্ঠ করে তোলার উপায়। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে শিক্ষকরা কেবল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন না, তাঁরা গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের অংশীদার। সমাজে তাঁদের সম্মান রাষ্ট্রদূতের সমান। পরীক্ষার সংখ্যা সেখানে কম, কিন্তু শেখা গভীর। এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল দর্শন হলো—“শিক্ষক গড়াই শিক্ষার প্রথম কাজ।” একজন শিক্ষককে হতে হয় নেতৃত্বদানে সক্ষম, মূল্যবোধসম্পন্ন এবং চিন্তার দিশারি। এই নীতিগত বিনির্মাণেই দেশগুলো এমন একটি মানবিক ও দক্ষ নাগরিক তৈরির প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে পেরেছে—যেখানে পরীক্ষায় নয়, মানুষ তৈরিতে জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি শিক্ষার মানে মৌলিক পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে এই মডেল শুধু অনুকরণ নয়, বরং উদ্দীপনা হয়ে উঠতে পারে।
জাতি গঠনের কারিগর যদি হয় শিক্ষক, তবে শিক্ষকের গড়ন হবে জাতিগঠনের প্রথম কাজ। আজ প্রয়োজন সেই প্রতিষ্ঠান, যা শিক্ষককে গড়ে তুলবে নতুন যুগের উপযোগী করে — চিন্তা, দক্ষতা এবং মূল্যবোধের সমন্বয়ে। এ জন্য বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু প্রয়োজন নয়, বরং এখন এটি জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত। কারণ, সুশিক্ষা ছাড়া মনুষ্যত্ব গড়ে ওঠে না — আর সুশিক্ষার কারিগর তৈরি না হলে উন্নয়নের ভিত্তিই দুর্বল থেকে যাবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মত দ্বিমত
পহেলা মে ও রেমিট্যান্স যোদ্ধার চোখে বাংলাদেশ: একটি নৈতিক আত্মমুক্তির দাবি

যে মানুষটি একদিন দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁর চোখে ছিল একটি স্বপ্ন—পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা। আজ সেই স্বপ্ন বহন করে দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তাঁদের রক্তঘামে আসে বছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যুরো অফ ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (BMET)-এর তথ্য বলছে, এই অর্থে গড়ে উঠেছে গ্রামের অবকাঠামো, শিক্ষিত হয়েছে সন্তান, বদলে গেছে পরিবারের ভাগ্য। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—দেশে ফিরে আসার পরে কি এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা পান?
অস্বীকৃত কিন্তু অবিচ্ছেদ্য অবদান
প্রবাসীরা দিনের পর দিন মরুভূমির উত্তাপে, ঠান্ডায় জমে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে অর্থ পাঠান, তা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাঁদের জীবনের বিসর্জনে তৈরি হয় গ্রামে নতুন ঘর, সন্তানরা পায় উচ্চশিক্ষা, শহরে গড়ে ওঠে ব্যবসা। কিন্তু এই শ্রমিকরা যে অবদানের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সেটি প্রায়শই রাজনৈতিক কৃতিত্বের মোড়কে হারিয়ে যায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাঁদের জন্য কোনো স্পষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা চোখে পড়ে না।
রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা: একটি নৈতিক ব্যর্থতা
বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক ২০-৩০ বছর কাজ করে দেশে ফেরেন। কিন্তু দেশে ফিরে পান না কোনো স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো—না পেনশন, না সামাজিক বীমা, না মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা। বরং ফিরে পান অচেনা বাস্তবতা, অবহেলা ও একাকীত্ব। বিশ্বের বহু দেশে যেমন ফিলিপিন্সে ‘Overseas Workers Welfare Administration (OWWA)’-এর মতো প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা রয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সেখানে নীরব দর্শক। আমাদের দেশেও একটি কার্যকরী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা কি অসম্ভব?
ভবিষ্যতের দিকে অন্ধ রাষ্ট্রযন্ত্র
বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। তাঁরা দেশে ফিরে পড়েন প্রান্তিকতার ফাঁদে। ফলে, এই আত্মত্যাগী মানুষগুলো সমাজে হয়ে ওঠেন ‘অপ্রয়োজনীয়’ এক শ্রেণি, যাদের সম্মান নেই, পরিচর্যা নেই, গর্ব নেই। এই রাষ্ট্রীয় অন্ধত্ব একদিন আমাদের সমগ্র অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
নীতিগত পরিবর্তন: সময়ের দাবি
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এই যোদ্ধাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা। এজন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা বিবেচনায় নেয়া উচিত:
১. জাতীয় রেমিট্যান্স পেনশন স্কিম: প্রবাসীদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক পেনশন স্কিম চালু করতে হবে।
২. পুনঃবাসন ও রি-স্কিলিং প্রোগ্রাম: দেশে ফেরা প্রবাসীদের জন্য কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. উদ্যোক্তা তহবিল ও বিনিয়োগ সহায়তা: রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য সহজশর্তে ঋণ ও তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট: অভিবাসন-পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় বিশেষায়িত সেবা গড়ে তুলতে হবে।
৫. জাতীয় স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা প্রথা: তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার জন্য একটি বার্ষিক জাতীয় সম্মাননা চালু করা যেতে পারে।
নৈতিক অধঃপতন থেকে আত্মমুক্তির সময় এখন
আজকের বাংলাদেশে, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মসম্মান এবং মর্যাদার জন্য লড়াই করছি, সেখানে দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, এবং ভণ্ডামি আমাদের সর্বশ্রেণীর জনগণের ভবিষ্যৎকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী আজ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ আমরা জানি—দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অদূরদর্শী প্রতিরোধ আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতির পথকে অস্বাভাবিকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের অবস্থা এখন এমন, যে কেউ আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, বরং বরাবরই আমাদের দুর্নীতির কারণে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে।
আমরা জানি, উন্নত রাষ্ট্রসমূহ থেকে যে ধরনের বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা আসার কথা, তা নির্ভরশীল দেশীয় নীতির ওপর। আর সেই নীতি যখন দুর্নীতিগ্রস্ত, অসৎ ও অদূরদর্শী, তখন আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে আমাদের দেশের মূল্যায়ন আশানুরূপ থাকে না। আমাদের দরকার একটি নৈতিক, যোগ্য, এবং দক্ষ নেতৃত্ব, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী, জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। আমরা এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, যারা দুর্নীতির পথ পরিহার করবে এবং জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি পালন করবে।
এখানে স্পষ্টভাবে বলতে চাই—রাজনীতির নামে দুর্নীতি আর বাংলার মাটিতে চলবে না। মালিকদের অধিকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের অধিকার পর্যন্ত সুষ্ঠু এবং ন্যায়সংগত পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যেখানে কোনো ধরনের অপব্যবহার ও অশান্তি সহ্য করা হবে না। রাজনৈতিক তৎপরতা যদি জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে থাকে, তবে সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে এমন পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি হতে আমরা আর কোনোভাবেই অনুমতি দেব না।
রাষ্ট্রযন্ত্র যদি আজও অবহেলার কূপে বন্দী থাকে, তবে ইতিহাস একদিন এই ব্যর্থ রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য ন্যায়, রাষ্ট্রের জন্য আত্মশুদ্ধির ঘন্টাধ্বনি
পহেলা মে—এটি কেবল শ্রমিক দিবস নয়, এটি রাষ্ট্রের আত্মা জাগানোর দিন। আজকের এই দিনে আমরা যদি সেই পরিশ্রমী হাতগুলোর দিকে না তাকাই, যারা প্রিয়জন ছেড়ে মরুপ্রান্তরে ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে, তাহলে আমাদের বিবেক মৃত।
অন্তত পহেলা মে—শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার যেমন দিন, তেমনি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা পূর্ণ করার দিন। তাঁদের অবদানকে জাতির উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে না রাখলে উন্নয়ন শুধু ঢাকের বাদ্য হবে—গভীরতা থাকবে না। রাষ্ট্রের উচিত, নিজের দায়িত্ববোধ থেকে এই প্রবাসী জনগণের পাশে দাঁড়ানো।
আমরা চাই না করুণা, চাই ন্যায্যতা।
আমরা চাই না সংবর্ধনার ফুল, চাই সামাজিক নিরাপত্তার শিকড়।
রাষ্ট্র যদি আজও এই শ্রেণীকে অবহেলা করে, তবে একদিন ইতিহাস তাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
এই লেখা একটি আবেগ নয়—এটি সময়ের গলায় চেপে বসা এক নৈতিক হুঁশিয়ারি।
আজ না হলে কাল, কাল না হলে ইতিহাস—এই রাষ্ট্রকে উত্তর দিতেই হবে।
তাই, পহেলা মে শুধুই শ্লোগান বা ফুল দেয়ার দিন নয়—
এটি হোক আত্মসমালোচনার, আত্মউন্নয়নের ও দায়িত্বশীলতার প্রতীক।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অবসরকালীন জীবন যেন হয় নিরাপদ, সম্মানজনক ও মানবিক—
এটাই হওয়া উচিত আমাদের রাষ্ট্রনীতির পরবর্তী ধাপ।
যে রাষ্ট্র তার ঘামের শ্রদ্ধা দিতে জানে না,
সে উন্নয়নের মুখোশ পরে নিজের মাটিকেই অস্বীকার করে।
আমরা একটি রাষ্ট্র চাই—ক্ষমতার নয়, মর্যাদার নামেই যার পরিচয় হবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
rahman.mridha@gmail.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
আসুন দেশ গড়ার আগে নিজেকে গড়ি

যদি একটি জাতির খারাপ হতে ৫৪ বছর লাগে, তাহলে এক বছরে কীভাবে ভালো হওয়া সম্ভব? যদি বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিমুক্ত, সৎ, সুশিক্ষিত, ন্যায়পরায়ণ এবং সৃজনশীল হতে চায়, তবে সেটা কি মাত্র এক বছরের মধ্যে সম্ভব? প্রকৃত সত্য হলো—৫৪ বছরের দুর্নীতির আগুন এক বছরে নিভিয়ে ভালো কিছু করা যায় না।
বর্তমান বাস্তবতা হলো, গত ৯ মাসে একজন নেতাকর্মীও বুকে হাত রেখে বলতে পারবে না যে, তারা কোনো ভালো কাজ করেছে। যেখানে ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি তার পুরো সময় (৯ মাস) এক উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রেখেছেন, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নেতাকে দেখি না, যিনি মন থেকে তার প্রচেষ্টাকে সমর্থন কিংবা সহায়তা করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে ভালো কিছু করার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপও চোখে পড়েনি।
আমি মনে করি, যতদিন ড. ইউনূস সুস্থ আছেন, আমাদের তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত এবং তার ন্যায়পরায়ণতা, ম্যানেজমেন্ট কৌশল ও গ্রহণযোগ্যতা থেকে শেখা উচিত। একই সঙ্গে, দেশের সমস্ত দুর্নীতিবাজ ও অপকর্মীদের চিহ্নিত করা জরুরি। শুধু আওয়ামী লীগের পেছনে সময় নষ্ট না করে, বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দলের সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদেরও বিচারের আওতায় আনুন। তারপর নিরপেক্ষ নির্বাচন করুন—তখন সফলতা আসবে। না হলে, ‘যে লাউ, সে কদু’—আজ এই মুহূর্তে লিখে রাখুন, আমি বলছি।
বিএনপি নানা কৌশলে নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এর পেছনে কী কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র বা গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে—কেউ কি তা খুঁজে দেখেছে? নাকি সবাই চোখ বন্ধ করে নাটক দেখে চলেছে? আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের দুর্নীতি, লুটপাট ও দুঃশাসনের ফলেই ৫ই আগস্টে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে।
নেতাকর্মীরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, অথচ রাষ্ট্রের মূল চাবিকাঠি এখনো তাদের হাতে। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে আজও আওয়ামী লীগের বিষাক্ত শেকড় ছড়িয়ে আছে। তাহলে প্রশ্ন আসে—যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল, তাদের রাজনীতি করতে বাধা দেওয়া কেন? কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিচ্ছে না? আজ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেই, তবুও দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আগের চেয়েও বেড়েছে। যদি এই লুটেরা কর্মকাণ্ড বন্ধ না হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়—স্বৈরাচারের পতনের নামে এই নাটক কেন মঞ্চস্থ হলো?
কে কার সঙ্গে প্রহসন করছে?
আজকের বাস্তবতায় চোখ মেললেই দেখা যায়—লুটপাট বেড়েছে, অনিয়ম চরমে উঠেছে, দুর্নীতি দানবের মতো মাথা তুলেছে। রাস্তা দখল করা সেই ছাত্ররা আজ দেশের ক্ষতিগ্রস্ত সন্ত্রাসী খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। তাহলে কোথায় গেল দেশপ্রেম? কোথায় সেই ত্যাগের চেতনা? সত্যি কথা হলো—এত রক্ত, এত বিসর্জন—সবকিছু কি ছিল শুধু দুর্নীতির পালাবদলের জন্য? পৃথিবী তো ভুলে যায়নি—জনগণ কি আবারও প্রতারিত হলো? আওয়ামী লীগ অতীতে ভারতের দালালি করে ক্ষমতায় টিকে ছিল। আজ বিএনপি-জামাতও ভারতের তল্পিবাহক হতে মরিয়া।
ঘটনা কী? উদ্দেশ্য কী? নাকি দেশ বিক্রির হাট বসেছে?
ড. ইউনূসের মতো একজন স্বাধীন মেরুদণ্ডসম্পন্ন নেতা থাকার কারণেই তারা পুরোপুরি ভারতের গোলামী করতে পারছে না—এটাই তাদের আসল ব্যথা। তাই তারা হাওয়া গরম করে দ্রুত নির্বাচন চাইছে। আমি শেখ হাসিনার আমলেও প্রবাস থেকে লিখতাম। তখনও সব লেখা ছাপা হতো না, তবে অন্তত ৬০% অপ্রিয় সত্য আলো দেখতে পেত। আর এখন? ৩০% লেখাও প্রকাশ পায় না, আর যদি প্রকাশিত হয়, সেটিও উঠিয়ে নেওয়া হয়।
বিশ্বাস না হলে, কালবেলা পত্রিকা দেখুন। তাই, কেউ এসে আমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই— আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশ স্বর্গ হয়ে গেছে—না, হয়নি। আর এভাবে হবে না। ড. ইউনূসের মতো ন্যায়বান নেতার নেতৃত্বে যদি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক শক্তি একত্রিত হতো, তবে পরিবর্তন সম্ভব ছিল।কিন্তু আজ বাংলাদেশের মাটি সেই মনমানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে।
আজ রাজনীতি মানে দুর্নীতির নতুন মোড়ক, দেশপ্রেম মানে লুটপাটের নতুন লাইসেন্স। এখনো সময় আছে—যারা সত্যিকারে বাংলাদেশকে ভালোবাসো, তারা জেগে ওঠো। নইলে, এই মাতৃভূমি দুর্বৃত্তদের হাতে বিক্রি হয়ে যাবে—চিরতরে। যদি আমার কথা মনে ধরে, তবে আসুন, সবাই মিলে একবার হলেও মন থেকে শতভাগ চেষ্টা করি। দেখবেন—সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা এই বাংলাদেশে প্রকৃতির অফুরন্ত সম্পদ আমাদের জীবনকে কীভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে, তা উপলব্ধি করতে পারবেন।
দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো খনিজ সম্পদ না থাকলেও আছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার প্রবাহিত জীবনরক্ত। নদীর পানি আমাদের মাটি উর্বর করে তুলেছে, যার ফলশ্রুতিতে ধান, পাট, শাক-সবজি, ফলমূলসহ শতধরনের ফসল জন্মায়। ইলিশ, সুপারি, নারিকেল, ধান, বিভিন্ন রবিশস্য—এসবই আমাদের প্রধান সম্পদ। এগুলোর দিকেই নজর দিন।
আমরা বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ। এই জনগণকে চোর বানাবেন না, মানুষ বানান। তখনই গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। গরুর মতো ‘নির্বাচন, নির্বাচন’ বলে অকারণে জাগর কেটে সময় নষ্ট না করে, বাস্তবভিত্তিক কাজ করুন। পারস্পরিক সহায়তায় এগিয়ে চলুন। দেখবেন, আমরা সকলেই ভালো থাকবো।
সর্বোপরি, নতুন প্রজন্মের কাছে বলি:
আমি চল্লিশ বছর দেশের বাইরে থেকেও দেশের অন্নের অপচয় করিনি। সর্বদা চেষ্টা করেছি একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, সৃজনশীল মানুষ হিসেবে দেশের জন্য কিছু ভালো করতে। কখনো কোনো রিটার্ন আশা করিনি, এমনকি দেশে ফিরি না। আমি যখন পারি, তোমরাও পারবে। কারণ, তোমরাই তো দেশের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছো—তোমাদের তো আমার চেয়ে বেশি দরদ থাকা উচিত, তাই না? আমি দেশের মালিক। আমার অধিকার তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছি। বিনিময়ে শুধু একটাই আশা—তোমরা ভালো হয়ে যাও। এবার, নিজেদের সংশোধন করে দেশটাকে গড়তে হবে—কারণ দেশটা আমাদের সকলের।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
এতো দেখছি নতুন বোতলে পুরনো মাদক!

‘ভারত থাকলে আমি থাকব, যা খুশি তাই করব’—এই মানসিকতা নতুন নয়। ‘দেশ পরে, আমি আগে’—এমন আত্মকেন্দ্রিকতা আমরা ইতিহাসে বহুবার দেখেছি। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধেই তো আমরা দেখেছি—কারা জীবন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, আর কারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আজ যখন দেখি শেখ পরিবারের নাম করে দেশপ্রেমের নাটক চলছে, তখন প্রশ্ন জাগে—সত্যিই কারা এই দেশের হয়ে লড়েছিল?
একদা পাকিস্তানি সরকার আমাদের সম্পদ লুটে নিয়ে যেত—এটা ছিল ভয়াবহ। আজ শেখ হাসিনার সরকার একই কায়দায় দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে বানিয়েছে ‘বেগমপাড়া’। তফাৎ কোথায়? তখন নাম ছিল পাকিস্তান, আজ নাম ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’। আর যখন এই চক্রের সদস্যরা পালিয়ে যায়, তখন বারবার প্রশ্ন জাগে—আসল রাজাকার কারা? যারা যুদ্ধ করেনি? নাকি যারা নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে পরে দেশটাকে পণ্য বানিয়ে বিদেশে চলে গেছে?
একটি সত্য চাপা পড়লে ইতিহাস বিকৃত হয়। ‘আওয়ামী লীগ’ নামে যে দলটি একদিন গণমানুষের শক্তি ছিল, আজ কি সেটিই এই লুটেরা চক্র? না, একেবারেই নয়। আমরা যারা ছিলাম—যুদ্ধ করেছি, মিছিল করেছি, রাস্তায় ছিলাম—আমরাও তো আওয়ামী লীগেরই অংশ ছিলাম। কিন্তু সেই দল আর এই দল এক নয়। সবার পলায়ন ঘটেনি। আমরা রয়ে গিয়েছিলাম, লড়াই করেছি, আজও দেশেই আছি—কাজ করে যাচ্ছি।
আমরা রাজনীতি করি না, গুণ্ডামি করি না, চাঁদাবাজিও না। আমরা দেশ গড়ি, মানুষের জন্য কাজ করি। আমরা Good for Nothing নই—আমরা দেশের ভিতরে Good for Everything।
তাই আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার:
অপরাধী অপরাধীই—সে যেই দলের হোক না কেন। সে আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি, জামাত, শিবির বা অন্য যেকোনো দল—আইনের শাসনের আওতায় তার বিচার হতেই হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নামের ট্যাগ থাকলেই সাধারণ মানুষকে দমন করা, নির্যাতন চালানো—এটা চলতে পারে না।
৭০ শতাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল—তারা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা যুদ্ধে ছিল না—তারাই এখন রাষ্ট্রের মালিক হয়ে বসে আছে। আর যারা ছিল, যারা লড়েছিল, রক্ত দিয়েছিল—তারা এখনো উপেক্ষিত।
দেখা যাচ্ছে, যারা দেশেই থেকে গিয়েছে, তারা হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত—তবুও তারা দেশের উন্নয়নে কিছু না কিছু করছে। অন্যদিকে, যারা কৌশলে ক্ষমতা নিয়ে দেশ লুটেছে, নিজেরা বিদেশে বসে দেশ চালিয়েছে—তারা এখনো বিচারহীন। এই বিভাজন আমাদের বুঝতে হবে।
সত্য চেপে রাখলে প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, জনগণকে বিভ্রান্ত করে। তাদের চিহ্নিত করুন। বিচারের আওতায় আনুন। কিন্তু যারা একসময় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে বিশ্বাস করেছিল, সাধারণ মানুষ হিসেবে আশাবাদী ছিল—তাদের দোষ দিয়ে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করবেন না।
জিয়াউর রহমান নিজেও আওয়ামী লীগের অংশ ছিলেন, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু যখন দেখেছেন শেখ পরিবার দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তখন সরে দাঁড়িয়েছেন। আমরাও তাই করেছিলাম—বিশ্বাস করেছিলাম, পরে প্রতারণা দেখেছি।
আজ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আমাদের বিনীত আহ্বান: আপনার দায়িত্ব সংস্কার করা, বিশৃঙ্খলা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে যেন নতুন করে হতাশা না আসে—এই দায়িত্ব আপনাকে নিতেই হবে।
আমরা কেউ ভারতের গোলাম না, না শেখ পরিবারের, না কোনো দলের। আমরা দেশের, মানুষের। সেই দায়িত্ব থেকেই বলছি: এই দেশ কারো বাপের সম্পত্তি নয়। এটা সৎ, মহৎ, কর্মঠ মানুষের দেশ। যারা দুর্নীতির সংস্কৃতিতে জড়িত, তারা সবাই অপরাধী—দলের নামে হোক, বা ব্যক্তিগত সুবিধার নামে।
শুধু একটি দলের দুর্নীতিকে টার্গেট করলে হবে না। বিএনপির নামেও আজ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হচ্ছে। তারা বলে বেড়ায়—“আমরা পেছনে থাকি, তোরা ওপরে থাক”—এই অপসংস্কৃতিও এখন বিএনপির নামেই প্রতিষ্ঠিত।
প্রশ্ন হচ্ছে: তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ আর বিএনপির চাঁদাবাজের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? অথবা অন্য দলের গডফাদারদের সঙ্গে?
স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হয়ে যদি আমরা নতুন এক স্বরাচারের শৃঙ্খলে বন্দি হই—তাহলে কেন ঝরেছিল এত রক্ত? কেন মায়েরা সন্তান হারিয়েছিলেন, তরুণেরা জীবন দিয়েছিল?
২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি পরিবর্তনের জন্য ছিল না— তা ছিল রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক রূপান্তরের জন্য। যদি সেই কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে, পুরনো শোষণ শুধু নতুন মুখে ফিরে আসে— তাহলে আমাদের সংগ্রাম ব্যর্থই থেকে যাবে।
এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান দায়িত্ব: আর কোনো ফ্যাসিবাদ যেন এই দেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এই লড়াই কোনো গদির জন্য নয়, কোনো গোষ্ঠীর জয়গান নয়— এটি ন্যায়ের, মানবিকতা আর অন্তর্ভুক্তির রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের লড়াই।
যে-ই করুক, দলের নাম যেটাই হোক- অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে সমান ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে আমরা শুধু এক শোষকের জায়গায় আরেক শোষক বসাচ্ছি।
দলের নাম দিয়ে কারো গায়ে ‘অভিজাতত্বের চাদর’ জড়িয়ে দিলে এই সমাজ কখনো বদলাবে না। আমরা দেখেছি—জামায়াত, বিএনপি, আওয়ামী লীগ এমনকি তথাকথিত স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম—সবখানেই একই অপরাধ, শুধু রং বদলেছে।
এই সুবিধাবাদী কালচার, বংশানুক্রমিক দুর্নীতির নেটওয়ার্ক—যদি ভেঙে না ফেলা যায়, তাহলে সরকার বদলালেও থাকবে ‘যে লাউ, সেই কদু’। সুতরাং, আজ সময় সত্য বলার।
সংস্কারের নামে ভণ্ডামি নয়।
দেশটা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়—এটি সেইসব মানুষের, যারা ন্যায়ের পক্ষে, মানুষের পক্ষে। দল নয়, ব্যক্তি নয়—নীতি হোক নেতৃত্বের ভিত্তি। মুখ নয়—মনোভাব বদলাক।
যারা এখনো বলে, ‘আমরা ঐ দলের লোক, ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক করে ফেলব’—তাদের জিজ্ঞেস করি: তোমরা নিজে কি বদলেছো? যদি বদল না আসেই, তাহলে আগামীকালও পুরনো লোক, পুরনো পদ্ধতি, পুরনো মিথ্যাচারই চলবে!
আমরা চাই—একটি নতুন বাংলাদেশ, যেখানে বিচার হবে কর্ম ও সততার ভিত্তিতে—না কারো রক্তের সম্পর্ক দেখে, না দলের ট্যাগ দেখে। সৎ মানুষই হোক এই দেশের কান্ডারি। আর তা কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করেই দেখাতে হবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
যোগ্যতা বনাম ক্ষমতা: তন্ত্রের আয়নায় মানুষের মুক্তি-সংকট

ভূমিকা: প্রশ্নের শিকড়ে ফিরে যাওয়া যোগ্য ব্যক্তি কখন অযোগ্য হয়ে পড়ে?
এই প্রশ্নে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের রাজনীতি, রাষ্ট্রচিন্তা এবং সমাজব্যবস্থার মূল সংকট। কেউ জন্মসূত্রে রাজা, কেউ নির্বাচনে বিজয়ী, কেউ ধর্মীয় নেতারূপে, কেউ সৈনিক থেকে শাসক। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়—ক্ষমতা তাদের পরিবর্তন করে, কিংবা সিস্টেমই তাদের বিকৃত করে দেয়।
যোগ্যতা তখন শুধু একটি শুরুর দাবি হয়ে থাকে—বাস্তব শাসনে তা হয় বিকৃত, পরিত্যক্ত কিংবা বিক্রিত। এই বিশ্লেষণে আমরা ফিরে যাব রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ধর্মতন্ত্রের ইতিহাসে। দেখব—কে কিভাবে ‘যোগ্য’ হয়েছিলেন, এবং কেন কালের প্রবাহে ‘অযোগ্য’ হয়ে উঠলেন।
শেষত, আমরা দাঁড়াব বর্তমান বাস্তবতায়—যেখানে একমাত্র প্রশ্ন হবে, মানুষের মুক্তির জন্য কোন তন্ত্র সবচেয়ে প্রয়োজনীয়?
তন্ত্র মানে কী?
তন্ত্র মানে শাসনের কাঠামো। এই কাঠামোই ঠিক করে, কে শাসক হবে, কীভাবে ক্ষমতা অর্জন হবে, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, আর দায়বদ্ধতার ধরণ কেমন হবে।
সাধারণভাবে পাঁচটি তন্ত্র চিহ্নিত করা যায়:
১. রাজতন্ত্র (Monarchy)
২. পরিবারতন্ত্র / বংশতন্ত্র (Dynastic politics)
৩. প্রজাতন্ত্র / গণতন্ত্র (Republic/Democracy)
৪. একনায়কতন্ত্র / সামরিক শাসন (Autocracy/Military rule)
৫. ধর্মতন্ত্র (Theocracy)
আমরা দেখব—এই পাঁচটি তন্ত্রেই ‘যোগ্য’ মানুষ শাসনে আসেন, কিন্তু সময়ের সাথে কেউ অযোগ্য হয়ে পড়েন। প্রশ্ন হলো—কেন?
যোগ্যতার সংজ্ঞা: আমাদের অবস্থান
আমরা যেই যোগ্যতার কথা বলছি, তা চার স্তরের উপর প্রতিষ্ঠিত:
১. নৈতিকতা: ব্যক্তির নীতিবোধ, মানবিকতা, স্বচ্ছতা
২. দক্ষতা ও শিক্ষা: রাষ্ট্রচিন্তা, অর্থনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক জ্ঞান
৩. কর্মদক্ষতা: বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা, প্রশাসনিক সক্ষমতা
৪. জনসম্পৃক্ততা: মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা, বেকারত্ব দূরীকরণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, সামাজিক দায়বদ্ধতা।
এই চারটি উপাদান মিলেই গঠিত হয় প্রকৃত যোগ্যতা। এই যোগ্যতা ছাড়া কেউ নেতা হতে পারেন না—আর যদি হনও, তারা ক্ষমতার ভার বহন করতে পারেন না।
রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের আয়নায় যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিবর্তন
রাজতন্ত্র— জন্মগত শ্রেষ্ঠত্ব না ঐতিহাসিক জড়তা?
রাজতন্ত্রের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত দাবির ওপর—“একজন মানুষ, কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট বংশে জন্মেছে বলেই, সে অন্য সবার চেয়ে অধিক যোগ্য।” এটি আদিতে ঈশ্বরদত্ত বা ঐশ্বরিক অনুমতির দাবির সঙ্গে যুক্ত ছিল।
ইতিহাসের কয়েকটি দৃষ্টান্ত:
• ফারাও (মিশর): নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবি করতেন।
• চীনের রাজবংশ: “Mandate of Heaven”-এর ধারক ছিলেন।
• ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র: রাজা/রানী ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং চার্চের প্রধান।
• ভারতীয় উপমহাদেশে: মুঘল ও অন্যান্য রাজাদের শাসন ছিল জন্মভিত্তিক উত্তরাধিকার নির্ভর।
কেন তারা যোগ্য ছিলেন (বা মনে করা হতো):
•উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, কূটনৈতিক, সংস্কৃতিতে পারদর্শী
•সেনাপতি ও প্রশাসক হিসেবে প্রস্তুত করা হতো ছোটবেলা থেকে
কেন তারা অযোগ্য হয়ে উঠতেন:
• জন্ম-যোগ্যতা কোনও বাস্তব দক্ষতা বা মূল্যবোধ নিশ্চিত করে না
• অধিকাংশ উত্তরসূরি শাসকেরা অহংকারী, অলস বা নির্মম হয়ে ওঠেন
• জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে
• নেতৃত্ব হয় এক বদ্ধবৃত্ত—কোনো বিকল্প বা সংশোধন নেই
রাজতন্ত্র একসময় শৃঙ্খলা এনেছিল, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এটি মানুষের মধ্যে বৈষম্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অযোগ্যতার চক্র তৈরি করে। জন্মই নেতৃত্বের মাপকাঠি হতে পারে না—এটি চরম অন্যায় এবং অমানবিক।
পরিবারতন্ত্র — গণতন্ত্রের মুখোশে বংশানুক্রমিক আধিপত্য
পরিবারতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের বিকৃত রূপ—যেখানে শাসক নির্বাচিত হলেও, ক্ষমতা এক পরিবারের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। এটি আধুনিক কালে রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলংকা—সবখানেই এই প্রবণতা লক্ষণীয়:
• শেখ পরিবার বনাম জিয়া পরিবার (বাংলাদেশ)
• গান্ধী পরিবার (ভারত)
• ভুট্টো পরিবার (পাকিস্তান)
• কিম বংশ (উ. কোরিয়া)
যোগ্যতা বলে দাবি করা হয়:
• ‘ঐতিহ্য’, ‘অভিজ্ঞতা’, ‘পরিচিতি’, এবং ‘জনসম্পৃক্ততা’
আসলে ঘটে যা:
• পরিবারতন্ত্র রাজনীতিকে একটি ব্যক্তিগত ব্যবসায় পরিণত করে
• দুর্নীতি, আত্মীয়করণ (nepotism), এবং লুটপাট বেড়ে যায়
• যুবসমাজ বা নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার সুযোগ পায় না
• দলগত শৃঙ্খলার চেয়ে পারিবারিক আনুগত্য বড় হয়ে দাঁড়ায়
জনগণের ক্ষতি কোথায়:
• একই চক্রের মধ্যে সমস্যার সমাধান অসম্ভব
• উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণ হয় ক্ষমতা রক্ষার কৌশলে, জনগণের কল্যাণে নয়
পরিবারতন্ত্রের মধ্যে জন্ম ও সম্পর্কের যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একে গণতন্ত্রের নামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা চলে।
সংক্ষিপ্ত অন্তর্বর্তী সংলাপ:
রাজতন্ত্র একসময় শৃঙ্খলা এনেছিল
পরিবারতন্ত্র আধুনিক রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে
কিন্তু উভয় তন্ত্রেই
যোগ্যতা = বংশ,
যোগ্যতা ≠ শিক্ষা, দক্ষতা, মূল্যবোধ, জনসম্পৃক্ততা।
আধুনিক তন্ত্রে যোগ্যতার মৃত্যুকাহিনি
গণতন্ত্র—সংখ্যার রাজনীতিতে গুণমানের পতন
গণতন্ত্র একসময় মানুষের স্বপ্ন ছিল। স্বাধীন মত প্রকাশ, জন-ইচ্ছার প্রতিফলন, এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের সুযোগ—এসব ছিল এই ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ধীরে ধীরে গণতন্ত্র সংখ্যার খেলায় পরিণত হয়, যেখানে “কতজন বলছে” সেটাই ঠিক, “কে কী বলছে” তা নয়।
এই ব্যবস্থায় যোগ্যতা মূল্য পায় তখনই, যখন তা জনপ্রিয় হয়। একসময় নেতৃত্ব পেতে হলে লাগত দূরদর্শিতা, নৈতিকতা ও সেবার ইতিহাস, আজ তা মুছে গেছে নির্বাচনী কৌশল, গণমাধ্যমের প্রভাব এবং অর্থবলের ছায়ায়। আর এই ছায়ার মধ্যেই হারিয়ে যায় প্রকৃত যোগ্যরা—যারা কথা বলেন মানুষের অধিকারের পক্ষে, উন্নয়নের স্থায়ী রূপরেখা নিয়ে।
এইভাবে গণতন্ত্র পরিণত হয় ‘ভোট-সর্বস্ব ব্যবস্থায়’, যেখানে সত্য নয়, আবেগ বিক্রি হয়—যেখানে যোগ্যতা নয়, পরিচিতি আর প্রতিশ্রুতি জিতে যায়। জনগণ বিভ্রান্ত হয় মিডিয়ার নাটকে, রাজনৈতিক ধর্মীয় উস্কানিতে, আর সেখানে দাঁড়িয়ে এক সময়কার যোগ্য ব্যক্তিটিও জনসমর্থনহীন হয়ে পড়ে, হয়ে যায় ‘অযোগ্য’।
একনায়কতন্ত্র—শৃঙ্খলার নামে চিন্তার হত্যাকাণ্ড
একনায়কতন্ত্র আসে সংকটকে পুঁজি করে—“দেশে বিশৃঙ্খলা চলছে”, “বিচারব্যবস্থা দুর্বল”, “রাজনীতি দুষ্টু খেলোয়াড়ে ভরা”—এইসব যুক্তি দিয়ে যখন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় একজন বা এক গোষ্ঠীর হাতে, তখনই শুরু হয় এক ভিন্ন খেলাধুলা।
প্রথমে মনে হয়, কেউ একজন দৃঢ় হাতে হাল ধরেছে। উন্নয়ন হয়, শৃঙ্খলা ফিরে আসে, ঘুষ-দুর্নীতি কমে যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা যায়—যে কথা বলছে না, সে-ই টিকে আছে। আর যে প্রশ্ন তোলে, সে ‘অবিশ্বস্ত’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘বিদেশি এজেন্ট’। এইখানেই যোগ্য ব্যক্তি পরিণত হয় অযোগ্যতে। কারণ একনায়কের প্রয়োজন চাটুকার, চিন্তাশীল নয়। রাষ্ট্র তখন চালায় ‘একজনের অভিমত’, দেশের কণ্ঠ হয়ে ওঠে ‘একটা মঞ্চ’—আর সেখানে হাজার চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে একজনও টিকে না।
বহু যোগ্য শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী বা কর্মী—যারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করে—তারা এই ব্যবস্থায় হয় নির্বাসিত, নয় নিঃশব্দ।
ধর্মতন্ত্র—নৈতিকতার নামে জ্ঞানের নিধন
ধর্ম, মূলত মানুষের ভিতরকার মূল্যবোধ গঠনের জন্য। কিন্তু রাষ্ট্র যখন ধর্ম দিয়ে পরিচালিত হয়, তখন ধর্ম হয় শাসনের হাতিয়ার। নৈতিকতার জায়গায় আসে ভয়, আত্মোপলব্ধির জায়গায় আসে বিধান। ধর্মতন্ত্রে যোগ্যতা নির্ধারিত হয় ঈশ্বরের নামে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কয়েকজন মানুষের ব্যাখ্যার মাধ্যমে। তারা ধর্মের যে অংশকে চায়, সেটুকু তুলে ধরে; বাকি ইতিহাস, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, সমাজতত্ত্ব—সব হয় ‘নিষিদ্ধ’ জ্ঞান। এখানে যোগ্যতা মানে হয় ‘ধর্মীয় ব্যাখ্যা জানা’, কিন্তু তার সঙ্গে বাস্তব রাষ্ট্র পরিচালনার জ্ঞান, অর্থনীতি বা প্রযুক্তির জ্ঞান—তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তাই একজন ধর্মীয় নেতা রাষ্ট্রনায়ক হতে পারেন, অথচ তিনি সমাজের জটিল বাস্তবতা বুঝেন না। যারা বোঝেন, তারা ‘অবিশ্বাসী’ বা ‘ভ্রান্ত’। এই অবস্থায় একসময় যোগ্য ব্যক্তি—যিনি মানুষের মুক্তি, শিক্ষা, সমতা ও আধুনিকতা নিয়ে কাজ করেন—তাকে রাষ্ট্রশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সম্মিলিত উপলব্ধি:
তিনটি আধুনিক তন্ত্র—গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র—প্রথমদিকে মানুষকে আশ্বাস দিয়েছিল পরিবর্তনের, মুক্তির, ন্যায়ের। কিন্তু সময়ের সাথে তারা সকলেই যোগ্যতার পরিবর্তে বেছে নিয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষাকারীদের।
• গণতন্ত্রে যোগ্যতা হারায় সংখ্যার ভারে,
• একনায়কতন্ত্রে হারায় মতপ্রকাশের বন্ধনে,
• ধর্মতন্ত্রে হারায় জ্ঞান ও মানবিকতার অবদমনে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠে—তাহলে আমরা কোন পথে যাব? আমরা কোন যোগ্যতা চাই? এবং সে উত্তর খুঁজতেই প্রয়োজন পরবর্তী পদক্ষেপ, যেখানে প্রস্তাব করা হবে এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা—যেখানে মানুষ, নীতি ও দক্ষতা হবে কেন্দ্রবিন্দু।
তাহলে কেমন তন্ত্র চাই মানুষকে মানুষের মতো বাঁচাতে?
মানুষমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা — এক ‘নৈতিক দক্ষগণতন্ত্র’-এর নকশা
কেন সব তন্ত্র ব্যর্থ হলো মানুষের কাছে?
রাজতন্ত্র বলল, “আমার জন্মই আমার যোগ্যতা”—মানুষ হারালো মর্যাদা
পরিবারতন্ত্র বলল, “আমার বংশই আমার অধিকার”—মানুষ হারালো সম্ভাবনা
গণতন্ত্র বলল, “সংখ্যাই সত্য”—মানুষ হারালো বিচার
*একনায়ক বলল, “আমি আইন”—মানুষ হারালো কণ্ঠ
*ধর্মতন্ত্র বলল, “ভয়েই শান্তি”—মানুষ হারালো স্বাধীনতা
এতগুলো তন্ত্র থাকতেও যদি মানুষ হয় গৃহহীন, বেকার, অপমানিত, নিপীড়িত—তবে প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র কার জন্য? তন্ত্র কার জন্য?
বিকল্প কী? — এক নতুন প্রস্তাবনা: নৈতিক দক্ষগণতন্ত্র (Moral Meritocracy-based Democracy)
আমরা একটি এমন তন্ত্র কল্পনা করি— যেখানে নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে নৈতিকতা, দক্ষতা, জনদায়িত্ব, এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাস্তব সংযোগ-এর ভিত্তিতে। এই তন্ত্রের চারটি স্তম্ভ হবে:
১. নৈতিকতা:
• রাষ্ট্রনায়ক হতে হলে তার জীবনচরিত, সম্পদের উৎস, ও নীতিনৈতিকতা জনসমক্ষে স্বচ্ছভাবে উন্মুক্ত হতে হবে
• দুর্নীতিমুক্ত ও জনহিতকর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে
২. দক্ষতা:
• রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা আবশ্যক
• নেতৃত্বে আসার আগে পাবলিক সার্ভিস, নীতিনির্ধারণ, বা সমন্বয় কাজে অভিজ্ঞতা থাকা চাই
৩. গণপ্রতিনিধিত্ব:
• নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম ও নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই
• স্থানীয় জনগণকে নেতৃত্ব নির্ধারণে সক্রিয় ও শিক্ষিত ভূমিকা নিতে সক্ষম করে তোলা
৪. মানবিকতা:
• রাষ্ট্র হবে লাভের জন্য নয়, মানুষের জন্য
• সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক, সংখ্যালঘুদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
বাস্তবায়নের রূপরেখা (Action Framework)
১. শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার:
নৈতিকতা, গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনমুখী পাঠ্যক্রম চালু
২. রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কার:
নেতৃত্বের যোগ্যতা নির্ধারণে নির্বাচন কমিশনের পাশে একটি Merit Assessment Council গঠন
৩. মিডিয়া ও তথ্যপুঞ্জের ভূমিকা:
স্বচ্ছতা ও সচেতনতার জন্য তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা
জনগণকে ভুল তথ্য থেকে রক্ষা করে বাস্তব তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করা
৪. প্রবাসী ও তরুণদের অংশগ্রহণ:
বিশ্বব্যাপী দক্ষ জনশক্তিকে রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্ভুক্ত করা
নতুন প্রজন্মকে প্রযুক্তি ও মানবিক চিন্তায় শক্তিশালী করা
চূড়ান্ত উপলব্ধি: মানুষই রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু
মানুষ শুধুই ভোটার নয়, মানুষ হলো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কারণ।
অতএব, যে রাষ্ট্র বা তন্ত্র মানুষের যোগ্যতা, মর্যাদা ও জীবনের গুণগত মান উন্নয়নে প্রতিশ্রুত নয়—তা অযোগ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা।
উপসংহার:
যেখানে মানুষ বড়, তন্ত্র নয়—সেই রাষ্ট্রই সত্যিকারের মানবিক রাষ্ট্র। রাজা, পিতা, একনায়ক কিংবা ইমাম নয়—আমাদের প্রয়োজন এমন এক রাষ্ট্রনায়ক, যিনি শিক্ষা, মানবতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার আলোয় পরিচালিত। এবং সে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আমরা নাম দেব —নৈতিক দক্ষগণতন্ত্র। কে সেই সুন্দর কে!
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
মত দ্বিমত
লুণ্ঠন আর লাশের ভাণ্ডারে পরিণত বাংলাদেশ: রাজনীতি নয়, মাফিয়া সিন্ডিকেটের দখলদারি

দেশটা আজ আর রাষ্ট্র নয়-এটা এখন ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ করা এক কর্পোরেট পাঁয়তারা, যেখানে নামমাত্র ভিন্ন দুই দল আসলে এক লুণ্ঠনবাজ চক্রের দুই শাখা মাত্র।
বিএনপি এখন মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, আর হাতে নেয় আওয়ামী দস্যুদের ফেলে যাওয়া সম্পদের দখল। পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী নেতারা কাঁধে চোরাই সম্পত্তির ব্যাগ আর পেছনে সেনা প্রটোকল নিয়ে দেশ ছাড়ছে, আর বিএনপি সেই দখলদারির লেজ লুটিয়ে দেশটাকে নিজের করে নিচ্ছে—এই নোংরা নাটক আর কতকাল চলবে?
সেনাবাহিনীর এক নির্লজ্জ অংশ এখন এই লুণ্ঠনের সহযাত্রী। তারা অস্ত্র দিয়ে নয়, নীরব সহযোগিতায় দিচ্ছে ‘সেফ একজিট’, যেন জাতিকে বিক্রি করে দেওয়া একটি লুকানো প্যাকেজ ডিল। যেই আওয়ামী লীগ এক দশক ধরে জনগণকে গিলে খেয়েছে, সেই দলের দালালরা আজ বিদেশে ঘর তোলে—আর বিএনপি দেশীয় লুটপাটে নেমে পড়ে। এ যেন ‘চোর বদল, চুরি নয়’!
এদিকে, ড. ইউনূস হয়ে উঠেছেন সেই অদ্ভুত প্রতীক, যিনি পর্দার আড়ালে থেকে আন্তর্জাতিক মহলকে সান্ত্বনা দেন—“বাংলাদেশে সংস্কার চলছে!”
সংস্কার? নাকি ব্যর্থতার মেকআপ? তিনি কি বুঝেন না, এই সংস্কারের নামেই হচ্ছে আরেক দফা জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার আয়োজন?
এই মুহূর্তে দেশটা কোথায় দাঁড়িয়ে?
• প্রশাসন বিক্রি হয়ে গেছে দলীয় কর্মীদের কাছে।
• বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়, ভয়পেয়ে চুপ।
• নিরাপত্তা বাহিনী দুইদলের পালাক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে সন্ত্রাসীদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে।
• সাংবাদিকতা হয় দালালি, না হয় নিপীড়নের শিকার।
• বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানের চর্চা নয়—দলের দালাল তৈরির কারখানা।
• আর রেমিট্যান্স যোদ্ধারা? তারা এখনো ডলার পাঠাচ্ছে সেই দেশকে, যাকে শাসন করছে চোর আর মাফিয়ারা।
এইবার আমাদের সহ্য করার সীমা পেরিয়ে গেছে।
করোনার মতো বিশ্বব্যাপী মহামারির সময় যেভাবে সবাই এক হয়েছিল, এখন সময় এসেছে সেই ঐক্যের থেকেও বড় এক যুদ্ধে নামার—এইবার লক্ষ্য দুর্নীতির মূলোৎপাটন।
দুর্নীতি আর দলবাজি এখন ভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর।
এটা শুধুমাত্র অর্থ চুরি করে না—এটা ভবিষ্যৎ খায়, স্বপ্ন নষ্ট করে, আত্মসম্মান ছিঁড়ে ফেলে।
একটি প্রস্তাবিত সংগ্রামী চেতনা: “রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যুদ্ধ”
১. এই আন্দোলনের কোনো দল থাকবে না—থাকবে কেবল জনগণ বনাম চোর।
২. নেতৃত্ব আসবে প্রবাসীদের কাছ থেকে—যারা দলবাজির ঊর্ধ্বে, এবং এই দেশটাকে ভালোবেসেই বাঁচিয়ে রেখেছে।
3. সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, কৃষক, শ্রমিক—সবাইকে একাট্টা হতে হবে এক কণ্ঠে: “চোরের দেশ চাই না, আমাদের দেশ ফেরত চাই!”
4. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে হবে—এবার আর নির্বাচন নয়, নির্মূল চাই!
এইবার, কোনো নরম কথা নয়। এইবার, ঘৃণার ঘৃণিত রাজনীতিকে শেষ করে দিতে হবে।
এই যুদ্ধ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার নয়—এটা গণতন্ত্রকে নতুন করে গড়ার যুদ্ধ।
যারা এই রাষ্ট্রকে পঁচিয়ে তুলেছে, তাদের আর শুধরে দেওয়ার সুযোগ নেই।
তাদের বিচার করতে হবে—জনগণের কাঠগড়ায়, ইতিহাসের আদালতে।
এইবার—জাগতে হবে, দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে।
না হলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
আমাদের বিপ্লবের নীলনকশা (Manifesto of National Moral Uprising)।
• অপ্রিয় সত্য থাকে
• করণীয় এবং বর্জনীয় স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়
• একটি ধারাবাহিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কর্মপন্থা উপস্থাপিত হয়
• প্রবাসীদের, তরুণদের, এবং সচেতন নাগরিকদের জাগ্রত করে তোলা যায়
জাতীয় নৈতিক জাগরণের রোডম্যাপ
(Remittance Fighters’ Manifesto for Moral Revolution)
প্রথম অধ্যায়: বাস্তবতা ও বোধোদয়
• দেশ এখন লুণ্ঠনের রাষ্ট্রে পরিণত: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়—দুই পক্ষই এখন মাফিয়া সিন্ডিকেট
• সেনাবাহিনীর এক অংশ, প্রশাসন, আদালত, পুলিশ—সবই দখল ও দুর্নীতির অংশীদার
• রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের অর্থনীতি বাঁচালেও, তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই
• আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন প্রশ্নবিদ্ধ ও ভণ্ডামীতে পূর্ণ
দ্বিতীয় অধ্যায়: লক্ষ্যে অবিচলতা
আমাদের চূড়ান্ত দাবি:
১. দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক প্রশাসন পুনর্গঠন
২. রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দখলদারিত্বের অবসান
৩. প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও নেতৃত্বে বাস্তব ক্ষমতায়ন
৪. একটি সত্যিকারের জনগণের সংবিধান পুনর্গঠন প্রক্রিয়া
৫. আন্তর্জাতিক স্বচ্ছ তদন্ত—দুই দল, সেনাবাহিনী, এবং সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে
তৃতীয় অধ্যায়: করণীয় ও সংগ্রামের রূপরেখা
১. দেশে ও বিদেশে সমান্তরাল সচেতনতামূলক আন্দোলন:
• সোশ্যাল মিডিয়ায় সংঘবদ্ধ ক্যাম্পেইন (truth bombs, exposé series)
• প্রবাসী সম্মেলন ও রেমিট্যান্স প্ল্যাটফর্ম গঠন
• স্বাধীন সাংবাদিক ও লেখকদের মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ
২. জাতীয়ভাবে নিরপেক্ষ সংগঠন গঠন:
• “জাতীয় নৈতিক আন্দোলন পরিষদ”—দলনিরপেক্ষ, প্রবাসীবান্ধব সংগঠন
• স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী গণজাগরণ কমিটি
৩. আন্তর্জাতিক লবিং ও চিঠি প্রেরণ:
• UN, EU, Human Rights Watch, Transparency International-এর কাছে গণচিঠি
• বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যদের কাছে প্রবাসীদের সরাসরি চিঠি
• মিডিয়াতে লেটার-টু-এডিটর প্রচার
চতুর্থ অধ্যায়: বর্জনীয় বিষয়সমূহ
• ভোট ছাড়া নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেওয়া
• রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র বা দালালদের বিশ্বাস করা
• নিরবতা—কারণ, নিরবতা মানে অপরাধে অংশগ্রহণ
পঞ্চম অধ্যায়: আত্মপ্রতিরোধ ও আত্মমর্যাদার বিপ্লব
• কোনো রাজনৈতিক চক্রের অধীনে নয়—নিজেদের নেতৃত্বে নিজেদের দেশ গড়ার সময় এখন
• এই আন্দোলন হবে যুদ্ধ নয়, বিবেকের সংঘাত
• এই যুদ্ধ হবে অস্ত্র নয়, তথ্য, নৈতিকতা, জনসমর্থনের বিপ্লব
শেষ ঘোষণা:
“এইবার থামাতে হবে। এইবার নামতে হবে।
এইবার, বিপ্লব না হলে দেশ থাকবে না।”
রেমিট্যান্স যোদ্ধার রায়:
দুর্নীতিমুক্ত গণতন্ত্র আগে, তারপরই নির্বাচন।”
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com