মত দ্বিমত
দুর্নীতির দুষ্টচক্রে আজ সমাজ বিভক্ত

রতনে রতন চেনে-এই প্রবাদটি আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নির্মম প্রতিফলন। ক্ষমতার অধিকারীরা নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে, কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র এবং দলীয় সন্ত্রাস শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে ওঠে, সেখানে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এমন এক দানবীয় ক্ষমতার বলয়ে আবদ্ধ, যেখানে জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দলীয় স্বার্থের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। শাসকের আশীর্বাদপুষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী, দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক কর্মী ও প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশ সমাজের প্রতিটি স্তরে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ক্ষমতার লোভে অন্ধ এই স্বৈরতান্ত্রিক গোষ্ঠী দলীয় পরিচয়ে অপরাধীদের রক্ষা করছে, তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আর জনগণের রক্ত-ঘাম ঝরানো উপার্জন। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক বিপ্লবের পর দেশের অপরাধীরা আরও নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে আসছে—যারা একসময় ছায়ার আড়ালে ছিল, তারা এখন দলের আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে চাঁদাবাজি, দখলবাজি আর ভয়ংকর সন্ত্রাসের লাইসেন্স পাচ্ছে। একদিকে ক্ষমতাধরদের ভোগবিলাস বাড়ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ে হাহাকার করছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আজ দলীয় স্বার্থ রক্ষার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার একরকম বিলুপ্ত।
বিশ্বের দিকে তাকালে দেখি, ডোনাল্ড ট্রাম্প, এলন মাস্কের মতো ব্যক্তিত্বরা সম্পদের পাহাড় গড়ার পাশাপাশি নতুন নতুন চিন্তাধারা দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছেন, বিশ্বকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন। অথচ আমাদের দেশে রাজনীতি মানেই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখা, দলীয় দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং জনগণের সম্পদ লুটপাট করা। যখন আধুনিক বিশ্ব নতুন বিপ্লবের পথে হাঁটছে, তখন আমরা এক গোষ্ঠীর শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছি।
পরিবর্তনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে পুরনো চিন্তাভাবনা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা। পুরো বিশ্ব যখন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমরা দলীয় স্বার্থের বলি হয়ে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছি। শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ নয়, বরং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা আরও ভয়ংকর। এখানে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা দূরদর্শী নেতৃত্ব নেই, আছে শুধু ক্ষমতার লড়াই। শাসকেরা জনগণকে মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদে ফেলে, ঠিক যেমন হামিলনের বাঁশিওয়ালা গ্রামবাসীদের ভুল পথে চালিত করেছিল। জনগণের সামনে কোনো বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নেই, শুধু চোখ ধাঁধানো প্রতিশ্রুতি আর শাসকদের চাটুকারিতায় গড়া এক বিভ্রান্তিকর ভবিষ্যৎ। ক্ষমতার এই দানবীয় প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট হচ্ছে, দুর্নীতি আরও গভীরে প্রোথিত হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
এই বাস্তবতা কি আমাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে? নাকি আমরা সাহসী হয়ে সত্যিকারের পরিবর্তনের পথে হাঁটব?
বারবার রক্ত দিয়ে স্বৈরশাসকের পতন ঘটানোর চেয়ে, আমাদের পুরো শাসনব্যবস্থার কাঠামোই বদলাতে হবে, যেন কোনো স্বৈরাচারী বা পরিবারতান্ত্রিক সরকার আর জন্ম নিতে না পারে। আমাদের দায়িত্ব শুধু ভোট দেওয়া নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সচেতনভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সমাজের প্রতিটি মানুষকে তাদের অধিকার, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের জন্য রুখে দাঁড়াতে হবে। দুর্নীতিবাজ শাসক ও তাদের সন্ত্রাসীদের রুখতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
যদি আমরা আজও চুপ করে থাকি, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা এক নিঃস্ব, পরাধীন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্র রেখে যাব। তাই সময় এখনই—দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেগে ওঠার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার!
একটি সৃজনশীল, উন্নত এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি হলো— শিক্ষার উন্নতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই উপাদানগুলোই একটি দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এখানে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে; শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের হাতের পুতুল, যেখানে জ্ঞানার্জনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে দুর্নীতি, দলীয়করণ ও ব্যক্তিস্বার্থ।
একটি সমাজ তখনই টিকে থাকে যখন তার জনগণ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে দৌড়ায় না, বরং নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে এখন এমন একটি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যেখানে মানুষের চেতনা ভোঁতা হয়ে গেছে। তারা রাষ্ট্রীয় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দূরে থাক, বরং নিজেদের অধিকার নিয়েই বিভ্রান্ত।
বিশ্বের এক প্রান্তে যখন ধর্মীয় মূল্যবোধ, যেমন রমজান মাস, মানুষকে আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, তখন সেই একই সমাজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বোর্ড দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হলে তা নিছক ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়— বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভয়ানক দুর্বলতার প্রমাণ। এটি প্রমাণ করে যে, দুর্নীতি এখন শুধুমাত্র ব্যক্তির চরিত্র নষ্ট করছে না, বরং পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে এক সাংবিধানিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো— এভাবে আর কতদিন চলতে থাকবে? যদি সত্যিই আমাদের সমাজকে সুষ্ঠু, ন্যায্য এবং উন্নত ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করতে হয়, তাহলে এই দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামো ভেঙে ফেলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
একটি বিপরীত চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে: বাংলাদেশে দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও পারিবারিক শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। জনগণ এমন এক শাসকশ্রেণীর হাতে বন্দি, যারা কোনো পরিবর্তন চায় না— তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো নিজেদের ক্ষমতা ও পারিবারিক স্বার্থ টিকিয়ে রাখা।
এটি অনেকটা হামিলনের গ্রামবাসীদের মতো, যারা প্রথমে বুঝতেই পারেনি যে তারা ভুল পথে চলছে। বাংলাদেশের জনগণও যদি নিজেদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং ন্যায়ের ব্যাপারে সচেতন না হয়, তবে তারা চিরকাল শাসকের পথ অনুসরণ করতেই থাকবে, নিজেদের ভবিষ্যতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।
আজকের বাংলাদেশ ভয়াবহ এক রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন দেশের প্রতিটি স্তরে গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। এটি এমন একটি কাঠামো, যেখানে জনগণ নিজেদের অধিকার ভুলে গিয়ে শাসকদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করছে। কিন্তু এই আনুগত্য কোনো উন্নয়ন বা কল্যাণ বয়ে আনবে না— বরং এটি হামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পের মতো জনগণের জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
এই সন্ত্রাসী শক্তি, দুর্নীতি এবং অযোগ্য নেতৃত্ব দেশের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে। দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, যতদিন না আমরা এই কাঠামোকে ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গড়তে পারি। জনগণের উচিত অন্ধ আনুগত্যের পথ ছেড়ে সচেতন ও শিক্ষিত হয়ে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অন্যথায়, দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে।
একটি কার্যকর, ন্যায়সংগত ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার একমাত্র উপায় হলো পুরোনো, দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোর পরিবর্তে নতুন কাঠামো তৈরি করা।
এই কাঠামোর ভিত্তি হবে—
শিক্ষায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা। প্রশাসনে জবাবদিহিতা। বিচারব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা। অর্থনীতিতে সমতা ও ন্যায়বিচার।
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায়, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি খাতই দলীয়করণ ও দুর্নীতির শিকার, যার ফলে কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থা আজ দলীয়করণ, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার জালে বন্দি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষাপর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার দৃষ্টিগোচর হয়—
প্রশাসনিক পদে দলীয় নিয়োগ: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রশাসনিক পদগুলোতে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়, ফলে যোগ্যদের জায়গা সংকুচিত হয়ে যায়।
🔴 ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য: অর্থের বিনিময়ে ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, ফলে প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হয় এবং শিক্ষার মান ধ্বংস হয়ে যায়।
🔴 ক্যাম্পাসে দলীয় সন্ত্রাস: ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে— হলে সিট বাণিজ্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা, এবং ভিন্নমত দমন এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
🔴 পরীক্ষায় অনিয়ম ও সেশনজট: প্রশ্নফাঁস, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে প্রকৃত মূল্যায়ন অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
🔴 শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করা: উচ্চশিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ সংস্কৃতি এবং কোচিং বাণিজ্যের কারণে সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে।
যে শিক্ষাব্যবস্থায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, সেখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের দায়িত্বে গেলে কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত থাকবে?
আজকের শিক্ষার্থী যখন ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়, তখন সে ভবিষ্যতে সৎ থাকার কথা ভাববেই বা কেন? ফলে, এই চক্র বন্ধ না হলে দুর্নীতি কেবল আরও শক্তিশালী হয়ে টিকে থাকবে।
এই ভয়ংকর বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতিবাজ প্রশাসকদের অপসারণ করতে হবে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যোগ্যতা ও মেধা ফিরে আসে।
এখন সময় এসেছে দেশের জনগণের জেগে ওঠার। যদি আমরা পরিবর্তন না আনি, তাহলে শাসকগোষ্ঠীর লুটপাট অব্যাহত থাকবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে।
সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য— সংগ্রাম শুরু হোক আজই!
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থা চরম দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে বন্দি। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একটি নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং প্রগতিশীল সমাজের ভিত্তি স্থাপন করা হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়, বরং গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।
একটি কার্যকর রাষ্ট্রের প্রথম শর্ত হলো দক্ষ, স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন। বর্তমান প্রশাসন দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যেখানে মেধা ও দক্ষতার কোনো মূল্য নেই। এটি পরিবর্তন করতে হলে—
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপহীন প্রশাসন: প্রশাসনের সকল নিয়োগ ও পদোন্নতি শুধুমাত্র মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দিতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত দক্ষ লোক দ্বারা পরিচালিত হয়।
ডিজিটাল প্রশাসন: সরকারি কার্যক্রমে ব্লকচেইন ও এআই প্রযুক্তি সংযুক্ত করতে হবে, যাতে দুর্নীতির সুযোগ কমে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
নাগরিক সেবার সহজলভ্যতা: প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধে অনলাইন পোর্টাল, একক হেল্পডেস্ক এবং ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে জনগণ দ্রুত ও কার্যকর সেবা পায়।
বর্তমান বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির শিকার। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য—
স্বাধীন বিচার বিভাগ: বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে এবং আদালতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
দ্রুত ও ডিজিটাল বিচার: মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা দূর করতে অনলাইন কোর্ট ও ই-জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে বিচার সহজ ও দ্রুত হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার: পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে তাদেরকে জনগণের সেবায় আরও কার্যকর করতে হবে।
দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে দেশের সম্পদ কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য—
ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের জবাবদিহিতা: ব্যাংক লুট ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা: নতুন ব্যবসা ও স্টার্টআপগুলোকে স্বল্পসুদে ঋণ এবং কর সুবিধা দিতে হবে, যাতে অর্থনীতি উৎপাদনমুখী হয়।
অর্থপাচার রোধ: কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে এবং বিদেশে অর্থপাচার কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
বাংলাদেশে এখনো শ্রেণিভেদ, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকট। একটি সমান সুযোগের সমাজ গড়তে হলে—
সমান অধিকার ও সুযোগ: শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য দূর করতে হবে।
দুর্নীতিগ্রস্তদের সামাজিক বর্জন: দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা কমাতে হবে এবং তাদেরকে সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলতে হবে।
বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো দুর্নীতিগ্রস্ত ও সেকেলে প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে। এর পরিবর্তন আনতে হলে—
ডিজিটাল প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা: ব্লকচেইন ও এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম স্বচ্ছ ও দক্ষ করতে হবে।
ডিজিটাল অর্থনীতি: সকল লেনদেন স্বচ্ছ করতে হবে এবং ফিনটেক ও ক্যাশলেস অর্থনীতির সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে কালো টাকার লেনদেন কমে।
প্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক ও স্বাস্থ্যসেবা: টেলিমেডিসিন, অনলাইন শিক্ষা এবং ডিজিটাল কল্যাণমূলক কার্যক্রম সহজলভ্য করতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা হামিলনের গ্রামবাসীদের মতো—যেখানে জনগণ অন্ধভাবে নেতৃত্বের পেছনে ছুটছে, কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না যে এই পথ তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো কাঠামো ভেঙে একটি নতুন সুশাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। এজন্য—
শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে, যাতে মেধা ও নৈতিকতা অগ্রাধিকার পায়। প্রশাসনকে দুর্নীতি ও দলীয়করণমুক্ত করতে হবে, যাতে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি হয়। অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করে জনগণের জন্য সমৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে হবে।
এটি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থায়, সামাজিক মনোভাব এবং প্রশাসনিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
আমাদের অন্ধ আনুগত্য ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে হবে। কাঠামো ভেঙে নতুন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্রকে চিরতরে উৎখাত করতে হবে। সুশাসন, গণতন্ত্র ও সমাজের উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তি সম্ভব নয়।
এখনই নতুন কাঠামো গড়ার সময়! সুশাসন, ন্যায়বিচার ও জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখনই এই পরিবর্তন আনতে হবে!
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com

মত দ্বিমত
আগে ছিল ঘুষখোর, পরে দুর্নীতিবাজ, এখন হয়েছে চাঁদাবাজ: উন্নয়নের উল্টো পদচিহ্ন

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের গল্প আজকাল পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের ঘোষণায় কিংবা নেতার মুখে মুখে শোনা যায়—‘দেশ বদলে গেছে’, ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান’, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু হয়েছে’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তব’। কথাগুলো শুনতে যেমন চমকপ্রদ, বাস্তবে তেমনই একটা নির্মম প্রশ্নও উঁকি দেয়—এই উন্নয়নের সুবিধাভোগী কারা? এবং উন্নয়ন বলতে আমরা কি কেবল ভবন, সেতু, কিংবা GDP বুঝি, নাকি মানুষ ও মনুষ্যত্বেরও কোনো মানদণ্ড আছে? একসময় যাদের আমরা বলতাম ঘুষখোর, তারা ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে; একটা টেবিলের নিচে টাকার খাম গলিয়ে দিতো, লজ্জা একটু ছিল, ভয়ও ছিল আইনের। তারপর তারা হলো দুর্নীতিবাজ—পদে বসে ক্ষমতার খোলস গায়ে দিয়ে টেন্ডার ভাগাভাগি, ব্যাংক লোন লুট, প্রজেক্ট বাজেট ফাঁকি—সবই নীতির নামে বৈধ করে ফেললো। এখন তারা চাঁদাবাজ, যারা আর লুকায় না, প্রকাশ্যেই বলে—‘এক্সট্রা দিতে হবে ভাই, নাহলে কাজ হবে না।’ এটা শুধু দুর্নীতির বিবর্তন নয়, এটা একটা জাতির বিবেক হারানোর ইতিহাস।
বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে— ‘রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হবে জনগণের কল্যাণ সাধন।’ কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র যেন এক সিন্ডিকেট চালিত পণ্যবাজার—যেখানে প্রশাসন, পুলিশ, রাজনীতি, ব্যবসা এমনকি বিচারব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে একটি জালায় বাঁধা, যার মধ্যে সৎ থাকতে গেলে ডুবে যেতে হয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিল একটি মুক্তির স্বপ্ন। তখন সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ ছিল মেজর জেনারেল, সীমিত শক্তি, সীমিত সুযোগ, কিন্তু ছিল একরকম দেশপ্রেম। সময়ের সাথে সাথে যখন পদোন্নতি হলো—লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তারপর জেনারেল—তখন কি শুধু দপ্তর বড় হলো, নাকি লোভও বড় হলো? একদিকে জিপি লাইন, পাজেরো, প্রটোকল, অন্যদিকে গরিব রিকশাচালক, অসুস্থ কৃষক, চাকরির জন্য হাহাকার করা তরুণ। উন্নয়নের তুলাদণ্ড কি দু’পাশে সমান ভার বহন করেছে? রাষ্ট্র যখন নাগরিকের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন নাগরিক হয় নিঃস্ব—অথবা বিক্রি হয়ে যায়। আজকের যুবক চাকরির আশায় ঘুষ দেয়, শিক্ষকতা পেতে ঘুষ দেয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হতে ঘুষ দেয়। তারপর যখন সে চাকরিটা পায়, তখন প্রথম কাজ হয় সেই ঘুষের টাকা সুদে আসলে তুলতে হবে—ঘুষ খেতে হবে, চাঁদা তুলতে হবে, মানুষকে জিম্মি করতে হবে। এভাবে দুর্নীতি একটা চাকরির অনুষঙ্গ হয়ে যায়, আর চাঁদাবাজি হয়ে যায় নৈতিকতার পরিণতি।
যে রাষ্ট্রের হাসপাতাল অচল, শিক্ষাব্যবস্থা লুটেরাদের হাতে, বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট, গণমাধ্যম ভীত, সেই রাষ্ট্র কিসের উন্নয়ন দেখাচ্ছে? রাষ্ট্র যদি মানুষকে সুশিক্ষা, সুবিচার, এবং নিরাপদ জীবন দিতে না পারে, তাহলে সেটা কেবল একটি ক্ষমতার যন্ত্র—যা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, আর চাঁদাবাজদের জন্য অপারেশনাল। একটা সময় ছিল—স্কুলের দেওয়ালে লেখা থাকত, “জ্ঞানই শক্তি”, কিংবা “কৃষিই জাতির মেরুদণ্ড”। কিন্তু আজকে এই কথাগুলো কেবল দেয়ালে রয়ে গেছে, বাস্তবতায় তারা মুছে গেছে। বরং এখন যেন রাষ্ট্রের অদৃশ্য সংবিধান হচ্ছে—‘ঘুষ দাও, চাঁদা দাও, অন্যথায় তোমার অস্তিত্ব থাকবে না।’
আমরা যে প্রজন্ম তৈরি করছি, তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অন্যদিকে স্কুলশিক্ষকের গায়ে হাত তোলা—এই সবই একই সমাজের চিত্র। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই নৈতিকতা, নেই চিন্তার স্বাধীনতা, নেই কর্মমুখী দিকনির্দেশনা।
বিশ্ববিদ্যালয় এখন দলীয় অফিসে রূপ নিয়েছে, আর ছাত্ররাজনীতি মানে অস্ত্র, দখল আর ভয় দেখানো। শিক্ষক হয়ে উঠেছেন শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র, আর ছাত্র হয়ে উঠেছে ক্ষমতাবানের ভবিষ্যৎ বাহিনী।
জেনে হোক কিংবা না জেনে, আমরা গড়ে তুলছি এক নিষ্প্রভ, মেধাহীন ও চাটুকার প্রজন্ম—যাদের হাতে তুলে দিচ্ছি প্রশ্নফাঁস, গাইড বই, কোচিং নির্ভরতা, ঘুষ দিয়ে পাওয়া নিয়োগপত্র, আর ক্যাম্পাসজুড়ে দলীয় ক্যাডারতন্ত্র। যে শিক্ষার হাত ধরে জাতি গড়ার কথা ছিল, সেই শিক্ষাই আজ জাতি ভাঙার কারখানায় পরিণত হয়েছে।
আমরা মুখে সৃজনশীলতার কথা বলি, অথচ পাঠ্যবই মুখস্থ ছাড়া পাসের সুযোগ নেই। আমরা নৈতিকতার কথা বলি, অথচ শিক্ষকের চাকরি হয় টাকার বিনিময়ে। যেখানে শিক্ষকই ঘুষ দিয়ে আসেন শ্রেণিকক্ষে, সেখানে ছাত্র কেন শিখবে সততার পাঠ? আর যখন রাষ্ট্র নিজেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘তেল মন্ত্রণালয়’তে রূপ দেয়, তখন তরুণ প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
আমরা দেশজ উৎপাদনের চেয়ে আমদানিকে বড় করে তুলেছি। কৃষক যখন মাঠে ফসল পচিয়ে ফেলে দেয়, তখনই বাজারে ঢুকে পড়ে বিদেশি চাল, ডাল, পেঁয়াজ। কৃষকের পাশে দাঁড়ায় না কেউ—না সরকার, না মিডিয়া, না ব্যাংক। ঘুষ দিয়ে তাকে কিনতে হয় সেচের পানি, দালালের কাছ থেকে নিতে হয় সরকারি বীজ-সার। আর সে ফসল যখন ফলায়, তখন বাজারে দাম থাকে না।
শিল্পখাতের চিত্র আরও করুণ। একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দক্ষ জনশক্তি পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে—দেশে রয়ে যাচ্ছে শুধু অব্যবস্থা আর আমলাতন্ত্রের জঞ্জাল। আমরা এখন একটা “ভোগী জাতি”—নিজে কিছু উৎপাদন না করেই শুধু ভোগ করতে চাই। চীন, ভারত কিংবা তুরস্কের ওপর নির্ভর করেই চলছে আমাদের অর্থনীতি। অথচ সরকার বলে—“আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছি।” প্রশ্ন হলো—এই উন্নয়ন কার জন্য? যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিক ১২ ঘণ্টা খেটে ১২ হাজার টাকা পায়, আর এক প্রকল্প পরিচালক ১ কোটি টাকায় গাড়ি কেনে—সেটি কি উন্নয়ন, নাকি লুণ্ঠনের ছদ্মবেশ? সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র যুবসমাজে। তারা শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। মেধাবী যুবক যখন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেকার থাকে, তখন একসময় সে বাধ্য হয় বিকল্প খুঁজতে—আর সেই বিকল্পের নাম হয় ‘যুবলীগ’ বা ‘যুবদল’। সেখানে চাকরি নেই, কিন্তু পিস্তল আছে; বেতন নেই, কিন্তু চাঁদা আছে; ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু মাদক আছে। রাষ্ট্র তার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শক্তি—তরুণ সমাজকে—নিজেই অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, গডফাদারদের ছত্রছায়ায় গড়ে তুলছে একেকটি সন্ত্রাসী ইউনিট।
আজকের ছাত্র রাজনীতি মানেই চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, টিকটকে ‘লাইভ মারামারি’। একজন তরুণ যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজে পায় না, তখন তার স্বপ্ন আর কৃষি, স্টার্টআপ, প্রযুক্তি কিংবা শিল্পের দিকে যায় না—গিয়ে পড়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বন্দুকের নিচে। রাষ্ট্র যখন তার যুবসমাজকে স্বপ্ন না দিয়ে অস্ত্র দেয়, তখন সে রাষ্ট্র কেবল মেরুদণ্ডহীনই হয় না—সে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে।
গণতন্ত্রে বলা হয়, “মানুষই মালিক।” কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ যেন কেবল ভোটের দিনই মানুষ, তারপর সে হয়ে যায় এক নির্বাক, অধিকারহীন ভিখারি। রাস্তা বানানো হয় ভিআইপি’র জন্য, হাসপাতালের উন্নয়ন হয় বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য, আর নীতি নির্ধারিত হয় কর্পোরেট ক্লাবের কাচঘেরা কক্ষে বসে। কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমজীবী—তারা যেন কেবল উন্নয়নের ভাষণকে অলংকৃত করার জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু নীতির কেন্দ্রে নয়।
প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসে—এই রাষ্ট্রটা কার? যাদের ঘামে পথ তৈরি হয়, গায়ে রোদ লাগে, তারাই কি এই রাষ্ট্রের মালিক? না কি তারা, যাদের টাকা সুইস ব্যাংকে, সন্তান বিদেশে পড়ে, বছরে একবার দেশে আসে, আর টকশোতে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে? রাষ্ট্র হওয়া উচিত সেই মানুষের, যিনি অন্যের ঘর তৈরি করতে গিয়ে নিজের ঘর বানাতে পারেন না। রাষ্ট্র হওয়া উচিত সেই শিক্ষকের, যিনি ছাত্রকে স্বপ্ন দেখান অথচ বেতন পান দেরিতে। রাষ্ট্রের কাজ হলো অসম্ভবকে সম্ভব করা, প্রতিভাকে জায়গা করে দেওয়া, শ্রমিকের ঘামে মাথা উঁচু করা। কিন্তু আজ রাষ্ট্র বন্দি—ধনীদের হাতে, ক্ষমতাবানদের শিকলে। আর যারা রাষ্ট্র চালায়, তারা মানুষকে দেখে ভোটের সংখ্যা হিসেবে, হৃদয়ের সত্তা হিসেবে নয়।
এই প্রশ্ন আজ আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে—আমরা কাদের জন্য রাষ্ট্র গড়ছি? এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না, হাসপাতালে সেবা নয় বরং রাজনৈতিক সভার জন্য স্টেজ বানানো জরুরি, যেখানে মেধার চেয়ে পরিচয়, সততার চেয়ে সদস্যপদ বেশি কার্যকর। সেই রাষ্ট্রের কোনো গর্ব থাকতে পারে না। কেন এক সৎ শিক্ষক হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করেন, আর এক চাঁদাবাজ যুবক জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠে? কেন উন্নয়ন মানেই হয় ভবন, রাস্তা, ব্যানার আর বিজ্ঞাপন—কিন্তু সেই উন্নয়নে থাকে না সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, কান্না, জীবন?
আমরা চাই এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে শিক্ষক হবেন জাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যুবক হবে হিরো, কৃষক হবে গর্বের প্রতীক। যেখানে পুলিশ হবে মানুষের রক্ষক, কোনো দলের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হবে আলোর মিনার, যেখানে ছড়াবে জ্ঞানের শক্তি, মাদকের ভয় নয়। এখন সময় প্রশ্ন তোলার। এখন সময় “না” বলার। না ঘুষকে, না দুর্নীতিকে, না চাঁদাবাজিকে। রাষ্ট্র যদি মানুষের না হয়—তবে মানুষকেই রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে।
আসুন, আমরা ভণ্ড মুখোশটা সরাই। জিডিপি নয়, আমরা বিচার করি—মানুষ হাসছে কি না। যদি মানুষ না থাকে, তাহলে উন্নয়ন কিসের জন্য? আজ দুর্নীতি আর অপরাধ নয়, সামাজিক দক্ষতা হয়ে উঠেছে। সৎ মানুষকে আমরা বলি বোকা, নির্লজ্জ চাঁদাবাজকে বলি স্মার্ট। এই মানসিকতা না বদলালে ‘উন্নয়ন’ কেবল কাগজে থাকবে—মানুষের জীবনে আসবে না।
আজ প্রয়োজন একটি নৈতিক মুক্তিযুদ্ধ—একটি সাহসী, সৎ ও গণমুখী সংগ্রাম, যেখানে চাঁদাবাজিকে ঘৃণা করা হবে, ঘুষখোরদের জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, আর রাষ্ট্র একদিন সাহস করে নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে— জনগণ রাষ্ট্রের কর্মচারীদের সেবক নয়, বরং কর্মচারীরাই জনগণের সেবক; এটাই একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সত্যিকার আত্মা। যদি প্রতিজ্ঞা করি—আমি আবার জনগণের রাষ্ট্র হতে চাই। আমরা কি প্রস্তুত সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে?
রহমান মৃধা, সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার। Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
রিজার্ভ বাড়ছে অথচ রেমিট্যান্স যোদ্ধারা উপেক্ষিত: কৃতজ্ঞতার মুখোশে জাতীয় বিস্মরণ?

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অর্থনৈতিক মাইলফলক। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে যারা দিনরাত ঘাম ঝরিয়ে, প্রবাসের মাটিতে কষ্ট সয়ে একেকটি ডলার পাঠাচ্ছেন, সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যথার্থ স্বীকৃতি কোথায়? কে তাদের নাম উচ্চারণ করছে? কে তাদের জন্য দাঁড়াচ্ছে?
রাজনীতিবিদরা যখন এ অর্জনের কৃতিত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে ব্যস্ত, তখন প্রকৃত নায়করা থেকে যাচ্ছেন অগোচরে, অবহেলিত এক শ্রেণি হিসেবে। রাষ্ট্র যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে যাচ্ছে, এই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি আসলে কারা।
প্রবাসজীবনের প্রতিটি দিনই যুদ্ধ—অচেনা সমাজে টিকে থাকার যুদ্ধ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট, বৈষম্য ও দুর্ব্যবহার সহ্য করার লড়াই। এই যোদ্ধারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান, তাতেই সচল থাকে আমাদের বাজেট, উন্নয়নের রাস্তাঘাট, প্রকল্প আর জনকল্যাণ। অথচ, এর বিনিময়ে তারা পান না রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, সামাজিক সম্মান কিংবা ভবিষ্যতের কোনও নিরাপত্তা।
আজও তারা ভোট দিতে পারেন না—যেন দেশের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের কোন অধিকার নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল এই অধিকার নিশ্চিত করা, কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ন্যূনতম মানবাধিকারটুকু তারা পাচ্ছেন না। এটি কি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নাকি পরিকল্পিত উপেক্ষা?
তাদের পরিবারগুলোর দিকেও রাষ্ট্রের নজর খুবই কম। দেশে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পরিবারের আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসা, শিক্ষা, কিংবা জীবননিরাপত্তা — এসব নিয়ে কোনো সুসংহত পরিকল্পনা কি সরকারের আছে? যদি থাকে, তবে তা কি আমরা জানি? আর যদি না থাকে, তাহলে কেন নেই?
সরকার কি কখনও পেনশন পরিকল্পনার কথা ভাবছে এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য? তাদের সন্তানদের জন্য কি কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা বৃত্তি, কোটা বা রাষ্ট্রীয় সহায়তা রয়েছে? যদি থাকে, তাহলে তা জনসম্মুখে প্রকাশ হোক। আর না থাকলে, এখনই সময় তাদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করার।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে—বাংলাদেশ কি সত্যিই কৃতজ্ঞ? নাকি কেবল সেই কৃতজ্ঞতার মুখোশ পরে বসে আছে, যেটার নিচে লুকিয়ে আছে চরম স্বার্থপরতা?
রিজার্ভের সংখ্যা বাড়া বড় কথা নয়—কৃতজ্ঞতা, সম্মান আর ন্যায়ের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ করাই বড় কথা। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যদি আজ না থাকতেন, তবে আমাদের বাজেটের অঙ্কগুলো কেমন হতো, সে প্রশ্ন আমাদের প্রতিটি নীতিনির্ধারক ও নাগরিকের নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিত।
আমরা কি শুধু সুযোগসন্ধানী এক জাতি? নাকি সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধাশীল, কৃতজ্ঞ ও ন্যায়বোধসম্পন্ন জাতি হয়ে উঠতে চাই?
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ঢাকাতেই বসবাস করতে হবে

এখন যদি নিরাপত্তাহীনতা, অব্যবস্থা বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাবি—তবে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে। কারণ গোটা বিশ্বেই আজ স্থিতি ও শান্তির অভাব। ইউক্রেন, গাজা, আফগানিস্তান, সুদান—প্রত্যেকটি অঞ্চল আমাদের শেখাচ্ছে: আজ কোথাও নিরাপদ আশ্রয় নেই। তবুও, যখন গাজার বুলেটবৃষ্টি দেখি, মনে হয় আমরা যারা ঢাকায় বা অন্য কোথাও থাকি, তারা তুলনায় অনেক ভালো আছি। কিন্তু কতদিন?
কয়েক দিন আগেই ঢাকার বিমান দুর্ঘটনায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের করুণ মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—আমরা যেন এক ঘুণে ধরা রাষ্ট্রে বসবাস করছি, যেখানে দুর্নীতি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এটি রক্তের মধ্যেও মিশে গেছে। এই দুর্ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না—এটি ছিল একটি অপরাধ, একটি মৃত্যুর পূর্বঘোষণা, যা রক্ষণাবেক্ষণের নামে লুটপাট, নিরাপত্তার নামে অবহেলা, আর দায়িত্বের নামে দুর্নীতির হাত ধরে আসছিল বহুদিন ধরে।
দুর্নীতি কীভাবে প্রতিরক্ষা বাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সেটাই এখন আরেকটি বড় প্রশ্ন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর ভেতরের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায়ও আজ প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। দুর্নীতি, গাফিলতি ও অপেশাদারিত্ব মিলিয়ে আজ পুরো নিরাপত্তা খাতটাই নৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
তাহলে কে রক্ষা করবে বাংলাদেশকে? সরকার? বিরোধী দল? সামরিক বাহিনী? বুদ্ধিজীবী সমাজ? নাকি সেই সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াই লড়ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এখনো মেলেনি। কিন্তু আরেকটি প্রশ্ন আজকের বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে তুলছে—
কী পরিমাণ দুর্নীতি হলে একটি দেশের হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনী পর্যন্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণে ধরে?
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
যখন—
• হাসপাতাল রোগী মারে,
• চিকিৎসক হয়ে ওঠে দালাল,
• শিক্ষক হয়ে ওঠে সেশন ফি ব্যবসায়ী,
• প্রশাসন হয়ে ওঠে চাঁদাবাজ,
• মসজিদে উঠে আসে রাজনীতির চোরাগলি,
• মন্দিরে বাজে তদবিরের সুর,
• ঘরে নেই শান্তি,
• বাইরে নেই নিরাপত্তা,
• আর কবর পর্যন্ত নিতে হয় ঘুষ—
তখন বলুন, কোথায় যাবেন আপনি? আর কোথায় আপনি নিরাপদ? এই দেশ, এই রাষ্ট্র, এই ঢাকা—সবই কি কিছু সুবিধাভোগী আর দুর্নীতিবাজদের জন্যই? নাকি এখনো কিছু মানুষ বাকি আছে, যারা বলবে—না, আর না। এবার সত্যকে ঢেকে রাখব না। এবার জেগে উঠতেই হবে। এতকিছুর পরেও কি সবকিছু ঢাকতেই থাকবে, হতে থাকবে? নাকি এবার ঢাকায় থেকেই আমরা বলব—এখান থেকেই শুরু হবে পরিবর্তনের ঝড়?
বিশ্বের কোথাও এখন আর শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ বা ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার নিশ্চয়তা নেই। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, গাজা-ইসরায়েল সংঘাত, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিভাজন, ফ্রান্সের দাঙ্গা, আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর অভ্যুত্থান—সবকিছু বলে দিচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতা এখন কেবল কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়—এটি এক বৈশ্বিক ব্যাধি। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলাদা, কারণ এখানে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও নৈতিক দেউলিয়াপনা রাষ্ট্রকে ভিতর থেকে গিলে খাচ্ছে।
এবং এই গিলে খাওয়ার প্রক্রিয়া এখন আর রাজনৈতিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি ঢুকে পড়েছে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, পরিবহন, চিকিৎসা, শিক্ষা—সব খাতে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও জাতীয় আত্মার ভেতরেও।
সুতরাং, যদি আমরা কিছু না করি, তাহলে কী দাঁড়াবে শেষটায়?
• দুর্নীতি অব্যাহত থাকবে
• অব্যবস্থাপনার কারণেই মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে ধামাচাপা পড়বে
• গাজা আমাদের জন্য এক রূপক হয়ে উঠবে — “আমরাও এক অন্তর্জাত যুদ্ধক্ষেত্র”
• রাষ্ট্র ক্রমশ তার আত্মাকে হারাবে, নাগরিক হারাবে বিশ্বাস, আশা, এবং সর্বোপরি—জীবনের অর্থ
আপনি যদি প্রশ্ন করেন—কে রক্ষা করবে বাংলাদেশকে? উত্তর একটাই—আপনি। আপনার বিবেক, আপনার কণ্ঠস্বর, আপনার প্রতিবাদই পারে এই দেশকে রক্ষা করতে। বাকি কেউ আসবে না।
এতকিছুর পরেও সব কিছু কী ঢাকতেই থাকতে হবে, হতে হবে? একটি দেশের আকাশে আগুন জ্বলে—আর আমরা তার ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। একটি পাইলট মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন শহর বাঁচাতে—কিন্তু তার আত্মত্যাগ ধামাচাপা পড়ে যায় দায়সারা তদন্ত আর অপ্রকাশিত রিপোর্টের আড়ালে। আমাদের চারপাশে প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছিল ছোট ছোট বিপর্যয়—আর আমরা বলছিলাম, “এটাই তো বাংলাদেশ!”
কিন্তু আজ যখন এই মৃত্যুর কণ্ঠস্বর আমাদের ঘুম ভাঙায়, তখন অন্তত প্রশ্নটা তোলা জরুরি হয়ে পড়ে:
এতকিছুর পরেও কি সবকিছু ঢাকতেই থাকবে? সরকারি বিবৃতি দিয়ে? সামরিক গোপনীয়তার নামে? জাতীয় ভাবমূর্তির কথা বলে? না কি জনতার নিরবতা দিয়ে? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি শুধুই ঢাকার উপর নির্ভর করবে—অর্থাৎ, রাজধানী ঢাকার, কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তির, কিছু নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের দয়া বা দৌরাত্ম্যের ওপর? না কি সেই ঢাকা একদিন সত্যিই হবে বিবেকের রাজধানী—যেখানে প্রতিটি মৃত্যু প্রশ্ন তোলে, প্রতিটি অন্যায় প্রতিরোধ পায়, প্রতিটি নাগরিক জবাবদিহি দাবি করে?
আমরা কী শুধুই একটি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার ভেতরে বেঁচে থাকবো? নাকি বেছে নেবো বেঁচে ওঠার সাহস? এই লেখার শেষ পঙক্তি যদি আপনি মন দিয়ে পড়েন—তবে এটিই আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আমার আহ্বান:
তথ্য ঢেকে রাখার সংস্কৃতি শেষ হোক। সত্য কথা বলার সাহস শুরু হোক। বাংলাদেশের প্রাণটুকু যেন শুধু ঢাকায় আটকে না থাকে-সে ছড়িয়ে পড়ুক জনগণের চেতনায়, হৃদয়ে, এবং শেষমেশ—প্রতিবাদে।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী আমাদের করণীয় কী?

যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে রাজধানী ঢাকার মাইলস্টোন নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ওপর আছড়ে পড়ার ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমরা শুধু হতবাকই নই, বরং গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় শঙ্কিত। এ ঘটনা আমাদের শুধু হতবিহ্বলই করেনি, বরং দুর্ঘটনা-উত্তর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের দক্ষতা, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা, পেশাগত নীতি-নৈতিকতা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের জাতীয় প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মনে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা নিছক কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি কিংবা বিভ্রান্তি নয়; এটি রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের সামগ্রিক অদক্ষতা, পূর্বপ্রস্তুতির অভাব এবং দায়িত্বশীলতার সংকটকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে। এতে করে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো: সরকারের, প্রশাসনের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে নাগরিক নিরাপত্তা আদৌ কতটা সুরক্ষিত? জনস্বার্থের প্রশ্নে যখন নিরাপত্তা, প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়ার দায় আসে, তখন দায়িত্বশীলতার মানদণ্ডে কে কোথায় দাঁড়ায় এখনই সময় সেই কঠিন প্রশ্নের জবাব খোঁজার। এই নিবন্ধ সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার এক আন্তরিক প্রয়াস।
এই দুর্ঘটনার পর আমরা যেভাবে সরকারের কর্তাব্যক্তি (শাসকশ্রেণি), পেশাজীবী এবং রাজনীতিবিদদের একাংশের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে একটি বৃহৎ দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা কতটা কার্যকর সে বিষয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই হাসপাতাল ও দুর্ঘটনাস্থলে যেভাবে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও দায়িত্ববহির্ভূত পেশাজীবীরা অবিবেচকের মতো ভিড় জমিয়েছেন, তা শুধু উদ্ধার ও চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত করেনি, বরং জননিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মৌলিক নীতিমালাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে আগুনে ঝলসে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসায় যে সংবেদনশীলতা ও শৃঙ্খলা জরুরি, সেই প্রেক্ষাপটে এমন হঠকারী আচরণ চরম অজ্ঞতা, আত্মপ্রচারপ্রবণতা এবং রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির ভয়ানক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। এখানে ‘সহযোগিতা’ বা ‘সহমর্মিতা’র নাম করে দুর্ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে ঊদেশ্যপ্রণোদিত ‘উপস্থিতি’ নিশ্চিত করাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ সেখানে প্রয়োজন ছিল প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের নির্বিঘ্ন কাজ করার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা। দুর্যোগকালীন সময়ের এই অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপ শুধু দৃষ্টিকটু নয়, বরং তা এক ধরনের ‘নৈতিক সহিংসতা’ বলেও চিহ্নিত করা যায়।
ফলে দেশের অধিকার সচেতন নাগরিকেরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, আমরা কি সত্যিই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত? এই প্রশ্নটি শুধু প্রতীকী নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে একেবারে বাস্তব ও নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দরকার। দুর্যোগ মোকাবিলাকে আমরা এখনো অনেকাংশে একটি কারিগরি, সামরিক কিংবা বিশেষ বাহিনিনির্ভর কার্যক্রম হিসেবে ভাবি যেন এটি শুধু শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী পাঠিয়ে সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করার বিষয়। অথচ বাস্তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি সর্বাঙ্গীন ও সমন্বিত জাতীয় প্রস্তুতির বিষয় যেখানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সামর্থ নিয়োগের প্রতিফলন থাকা চাই। এটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও মনো-সামাজিক সহায়তা, প্রশাসনিক সমন্বয়, নাগরিক শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার এক সম্মিলিত ফসল। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্ঘটনা ঘটলে, আমাদের হাতে কি আছে সুনির্দিষ্ট ও দ্রুত গতিসম্পন্ন উদ্ধার উপকরণ ও সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা? কোথায় ছিল দুর্ঘটনার পর পরই জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দল? কোথায় ছিল পুড়ে যাওয়া কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য মনো-সামাজিক পরামর্শ (কাউন্সেলিং)-এর ব্যবস্থা? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোথায় ছিল দুর্যোগকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, নির্দেশনা ও সমন্বয় যা একটি দুর্যোগ মুহূর্তে দেশের নাগরিকদের আস্থা ও কার্যকর সাড়া দেওয়ার প্রধান শর্ত? ঘটনার দিন বাস্তবে এই শূন্যতাগুলো দেখিয়ে দেয়, দুর্যোগ আমাদের কাছে এখনো পরিকল্পনা নয়, কেবল প্রতিক্রিয়ার বিষয় হয়ে রয়ে গেছে।
এই দুর্ঘটনা আমাদের সামনে যেটি অনিবার্যভাবে তুলে ধরেছে, তা হলো এখনই সময় আত্মসমালোচনার এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের জন্য সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত ও নৈতিকভাবে সুসংহত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি নেওয়ার। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিচে কিছু জরুরি করণীয় তুলে ধরা হলো:
১. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্যোগ মুকাবিলার নীতিমালা প্রণয়ন ও দুর্যোগকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল গঠন জরুরি। দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে বারবার সমন্বিত ব্যবস্থাপনার দুরাবস্থা ও মানুষের হাহাকার দেখে হাত তুলে শোক প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নীতিগত স্পষ্টতা এবং সংবেদনশীল প্রশাসনিক কাঠামো। এ লক্ষ্যে কিছু জরুরি করণীয় এখনই নির্ধারণ করতে হবে, যার প্রথম ধাপ হলো দুর্যোগ মুকাবিলার জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন। এই নীতিমালায় স্পষ্টভাবে নির্দেশ থাকতে হবে দুর্যোগের মুহূর্তে কোন সংস্থা কী দায়িত্ব পালন করবে, কে কোথায় থাকবে, কে কোথায় যাবে, কার ঘটনাস্থলে যাওয়ার অধিকার আছে আর কার নেই এবং কোন কর্তৃপক্ষের অধীনে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এটি কেবল প্রশাসনিক বা সামরিক মহড়ার অনুশীলন বা সক্ষমতার প্রদর্শনী নয়, বরং এটা হবে এক ধরনের ‘নাগরিক নিরাপত্তা কাঠামো’ যা দুর্যোগে দায়িত্ব ও সীমারেখা নির্ধারণ করে সমাজের সর্বস্তরের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়টি আর শান্তি-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনির দক্ষতার উপর ছেড়ে দিলে চলবে না। এটি একটি যৌথ, নীতিনির্ভর এবং মূল্যবোধভিত্তিক কাঠামোর দাবি রাখে যা সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে, যার মূল লক্ষ্য হবে মানুষের জীবন রক্ষা, রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে শৃঙ্খলা বিধান এবং নাগরিক আস্থা পুনর্গঠন।
২. রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের জন্য আচরণবিধি ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ চালু করা এখন সময়ের দাবি। দুর্যোগকালীন সময়ে শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক ও পেশাগত পরিসরে আচরণগত নীতিনৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের জন্য বিশেষ ‘আচরণবিধি’ প্রণয়ন করতে হবে, যাতে দুর্যোগকালে কী করতে হবে এবং কী করা যাবে না তা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকে। এই আচরণবিধির বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাদেরকে আইনের আওতায় শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনীতি কেবল বক্তৃতা, উপস্থিতি আর ব্যানার টানানোর কাজ নয়; এটি এক ধরনের সামাজিক দায়দায়িত্ব ও জননিরাপত্তা সংরক্ষণের অঙ্গীকার। একইভাবে চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব পেশাজীবীদের জন্যও এমন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি চালু করা দরকার, যেখানে তারা শিখবেন সংকটকালে কীভাবে দায়িত্বশীল, মানবিক এবং পেশাগত আচরণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। এটি শুধু উদ্ধার কাজের কার্যকারিতার জন্য নয়, বরং নৈতিকতার প্রশ্ন যেখানে জনস্বার্থই হবে সর্বোচ্চ বিবেচ্য। দুর্যোগকালীন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ কোনো ব্যক্তিগত ভুল নয়; এটি একটি কাঠামোগত ব্যর্থতা, যার প্রতিকারে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দুর্যোগ মোকাবিলার গাইডলাইন প্রণয়ন এবং বাধ্যতামূলক প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ চালু করা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু পাঠদানের স্থান নয়। এগুলোর সাথে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের শিশু, কিশোর ও তরুণদের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক নিরাপত্তা জড়িত। ফলে দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এজন্য প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার একটি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবমুখী গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তারা জানে দুর্ঘটনার সময় কীভাবে দ্রুত এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এই গাইডলাইনে থাকবে জরুরি নির্গমনপথ, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, দিকনির্দেশনামূলক সংকেতচিহ্ন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের তালিকা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ পদ্ধতি। শুধু গাইডলাইন থাকা যথেষ্ট নয়, এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়াও বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্যোগ প্রতিক্রিয়াকে যদি আমরা সামাজিক শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে এর চর্চা শুরু হওয়া উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কারণ ভবিষ্যতের সচেতন নাগরিক তৈরি হয় এখানেই।
৪. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গণশিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা অত্যাবশ্যক। আগেই বলা হয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেবল পেশাদার বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। এটি একটি সামাজিক চর্চা, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তাই দুর্যোগ বিষয়ে গণশিক্ষার মাধ্যমে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা সঠিক সময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং উদ্ধার ও চিকিৎসা কাজে অনভিপ্রেত বাধা সৃষ্টি না করেন। দুর্যোগকালে বহু মানুষ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে, আবেগতাড়িত হয়ে বা ভিড়ের চাপে দিশেহারা হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করেন। ফলে উদ্ধার ও প্রাণরক্ষাকারী প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ে। গুজব, আতঙ্ক ও দায়িত্বহীন প্রচারপ্রপাগান্ডা যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ডিজিটাল মিডিয়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে গণসংযোগের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ধরনের কর্মকান্ড প্রতিরোধে গণশিক্ষাকে শুধু সামাজিক অভিযান হিসেবে না দেখে, এটি নাগরিকত্ব শিক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে মানুষ জানেন, কীভাবে দায়িত্ব নিয়ে দুর্যোগের মুহূর্তে নিজের এবং অন্যের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। যেমনভাবে প্রাচীন গ্রিসে ‘সক্রিয় নাগরিকত্ব’ (একটিভ সিটিজেনশিপ) মানে ছিল ‘অবস্থা অনুধাবন ও প্রতিক্রিয়া জানার সক্ষমতা’, তেমনি আজকের নাগরিককেও গড়ে তুলতে হবে এমনভাবে যাতে সে দুর্যোগের সময় আতঙ্কে ভেঙে না পড়ে, বরং সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতিতে নিজের ও অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেন।
৫. গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্য নৈতিক আচরণবিধি তৈরি এবং পেশাগত বিধিনিষেধের বাধ্যতামূলক প্রয়োগ ব্যবস্থা চালু করা। দুর্যোগকালীন সময়ে তথ্যের গতিপ্রবাহ শুধু জনগণের আচরণ নয়, উদ্ধার ও চিকিৎসা কার্যক্রমের সফলতাকেও সরাসরি প্রভাবিত করে। এই বাস্তবতায় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল এবং নীতিনির্ভর হওয়া উচিত। এজন্য একটি সুনির্দিষ্ট নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি, যাতে সংবাদকর্মী, ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা, ব্লগার কিংবা সাধারণ ব্যবহারকারীরা জানেন দুর্যোগকালীন সময়ে কী তথ্য প্রকাশ করা উচিত, কীভাবে সেটি প্রকাশ করতে হবে এবং কোন তথ্য প্রচার বিভ্রান্তিকর কিংবা একেবারেই বর্জনীয়। কারণ ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য সেটা চিকিৎসা, উদ্ধার তৎপরতা কিংবা জননিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট হোক তা জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক ও আবেগোন্মত্ততা (হিস্টেরিয়া) তৈরি করতে পারে, যা কখনো কখনো সংঘবদ্ধ সহিংসতায়ও রূপ নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে একটি অসতর্ক পোস্ট, একটি বিভ্রান্তিকর শিরোনাম বা একটি গুজব গোটা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই এ খাতে শুধু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সততা নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে দিকনির্দেশনা, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে যাতে বাকস্বাধীনতা ও জনস্বার্থের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করে সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহ মানবিক, কল্যাণমুখী ও গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দুর্যোগ-পরবর্তী মুহূর্তে মিডিয়ার নৈতিকতা কেবল সাংবাদিকতার প্রশ্ন নয়, এটি এখন নাগরিক দায়িত্বেরও অন্তর্গত।
৬. ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উন্নত চিকিৎসা ও মনো-সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা। দুর্ঘটনায় আহতদের উন্নত ও টেকসই চিকিৎসার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশেষ করে অভিজ্ঞতাজনিত আতঙ্ক (ট্রমা) নিরসনে অব্যাহত পরামর্শ দেওয়া অত্যাবশ্যক। দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি যে অনির্দেশ্য ও গভীর ক্ষত মানুষের মনোজগতে সৃষ্টি হয়, তা আরও দীর্ঘমেয়াদি ও মারাত্মক হতে পারে। তাই কেবল আহতদের শারীরিক চিকিৎসা নয়, দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের জন্য মনো-সামাজিক পরামর্শ সহায়তা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব। আধুনিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ‘মনো-সামাজিক প্রাথমিক চিকিৎসা’ (সাইকো-সোসাল ফাস্ট এইড) একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও তরুণদের জন্য যারা এমন দুর্ঘটনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু উন্নত হাসপাতাল নয়, প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলর, কমিউনিটি সাপোর্ট সেন্টার, এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা। রাষ্ট্রের উচিত ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে কেবল দাতা বা করুণাদৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে সহানুভূতিশীল ও ন্যায়ভিত্তিক অবস্থান নেওয়া যেখানে প্রত্যেক মানুষ তাঁর পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে পুনরায় সমাজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। এই দায় শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি একটি সভ্য রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানগত কর্তব্য।
রাষ্ট্রীয় পরিসরে নাগরিকের জান, মাল ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব কোনো গৌণ বা আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক শপথ। এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই; বরং রাষ্ট্র এবং তার বিভিন্ন অঙ্গের উচিত নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার স্বরূপ শনাক্ত করে এখনই কার্যকর ও মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। প্রতিটি দুর্ঘটনা আমাদের সামনে সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরে একটি আয়নার মত যেখানে প্রতিফলিত হয় দুর্যোগ মুকাবিলার প্রস্তুতির ঘাটতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের শূন্যতা, এবং দুর্যোগকালীন সংকট অনুধাবনের ব্যর্থতা। বিশেষ করে যুদ্ধবিমানের মতো উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্র কীভাবে একটি স্কুল ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে সেই প্রশ্নটিকে শুধুই যান্ত্রিক বিভ্রাট হিসেবে দেখা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও নৈতিক ব্যর্থতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পূর্বপ্রস্তুতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জবাবদিহিতার প্রতিটি স্তরে ঘাটতি বিদ্যমান। যদি আমরা এসব থেকে শিক্ষা না নিই, যদি প্রতিটি বিপর্যয়কে কেবল কিছুদিনের ক্ষোভ আর শোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে ভবিষ্যতের আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় গোটা জাতিকে বহন করতে হবে।
রাষ্ট্র যদি আত্মসমালোচনার সাহস না দেখায়, যদি নেতৃত্ব নিজেকে দায়মুক্ত রাখে, তাহলে আমাদের নাগরিক অধিকারের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই সময় এসেছে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভাষা পরিহার করে আত্মশুদ্ধির পথে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করার যাতে প্রত্যেক দুর্ঘটনার পেছনে থাকা কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত ও সংস্কার করা যায়।
আমরা কি সত্যিই পরিবর্তন চাই? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের ভাষায় নয়, কর্মে স্পষ্ট হতে হবে। যদি সত্যিই আমরা পরিবর্তন চাই তবে প্রয়োজন নেতৃত্বে নৈতিক শুদ্ধতা, পেশাগত জীবনে দায়বদ্ধতা, এবং নাগরিক চেতনায় সক্রিয় সচেতনতা। দুর্যোগ-পরবর্তী আবেগ দিয়ে নয়, বরং দুর্যোগ-প্রতিরোধে রূপরেখা তৈরি করেই আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা এগিয়ে নিতে হবে। এখনই সময় চোখ মেলে দেখার, সাহস করে প্রশ্ন তোলার, এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিপর্যয় রোধের। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া আমাদেরকে আরেকটি দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দেয়। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিলে তা শুধু ভুল হয়ে থাকবে না, অপরাধে পরিণত হবে যার দায় এড়াতে পারবে না কেউই। রাষ্ট্র যদি না জাগে, নাগরিক যদি না জাগে, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আজকে শিক্ষা না নিলে, কাল আর বাঁচার সুযোগ থাকবে না।
ড. মাহরুফ চৌধুরী
ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য
Email: mahruf@ymail.com
মত দ্বিমত
দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যে প্রাণসংহারী দুর্ঘটনা ঘটে, তা শুধু হতাহতের দিক থেকেই নয়, বরং একটি জাতির চেতনায়ও গভীর দাগ কেটে দিয়েছে। বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সামনে ঘটে যাওয়া এই বিভীষিকাময় দৃশ্য শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা বা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। বরং এটি আমাদের দুর্যোগ-প্রস্তুতির সীমাবদ্ধতা, অব্যবস্থা ও অবিবেচনার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ যারা প্রাণ হারিয়েছেন বা দগ্ধ হয়েছেন, তাদের শারীরিক যন্ত্রণা যেমন বাস্তব, তেমনি গোটা জাতি মানসিকভাবে গভীরভাবে আহত হয়েছে। দুর্যোগ বলে কয়ে আসে না। তবে কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে, সেই বিবেচনা ও প্রস্তুতির দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সমাজের এবং প্রতিটি পেশাজীবি ও সাধারণ নাগরিকের। এই প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন উঠছে: এমন দুর্যোগকালে যারা দায়িত্বের চেয়ে উৎসুকতা, দায়িত্বশীলতার বদলে স্বেচ্ছাচার কিংবা সাহায্যের নামে অদক্ষতা প্রদর্শন করেন তাদের আমরা কি আদৌ দায়িত্বশীল ভাবতে পারি?
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জরুরি উদ্ধার ও চিকিৎসা প্রস্তুতি, এমনকি নাগরিক ও পেশাজীবিদের আচরণগত দায়িত্ববোধ সবই নড়বড়ে, ভঙ্গুর কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ। একটি সামরিক বিমান শহরের আকাশে ভেসে বেড়ানো মানেই কেবল ‘মহড়া’ নয়; তা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতির অদূরদর্শিতা ও নাগরিক নিরাপত্তা ভাবনার সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ করে। প্রশ্ন জাগে: কেন ঘনবসতিপূর্ণ এবং শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঘেরা এলাকায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ মহড়া চলতে পারে? কতটা কার্যকর ছিল নিরাপত্তা প্রটোকল? দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিতে বা প্রাণ বাঁচাতে আমরা কতটা প্রস্তুত ছিলাম? আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এমন সংকট মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও পেশাগত নেতৃত্বের আচরণ কেমন ছিল। এ প্রশ্নগুলো শুধু এই দুর্ঘটনার জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে থাকা সামাজিক চুক্তি, দায়বদ্ধতা ও নেতৃত্বের নৈতিকতা সম্পর্কেও পুনর্বিচার দাবি করে।
এই আলোচনার উদ্দেশ্য কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব উত্থাপন করা নয়, কিংবা অন্ধ তর্কের আবর্তে জনমতকে বিভ্রান্ত করা নয়। বরং আমাদের লক্ষ্য হলো এই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার একটি গঠনমূলক পরিসর সৃষ্টি করা যেখানে দায় এড়িয়ে নয়, বরং দায়িত্ব নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রস্তুতির পথ খুঁজে নিতে পারি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখানে দুটি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাই। প্রথমত, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের বাস্তব প্রস্তুতির যে ঘাটতি তা নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা ও সমাধানমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার (বিস্তারিত থাকবে পরবর্তী লেখায়)। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার আচরণ যেন দায়িত্বশীলতা, বিবেকবোধ ও পেশাগত নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করা যা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
প্রথম ও প্রধান বিষয় হলো দুর্যোগ মুহূর্তে ঘটনাস্থলে সর্বাগ্রে উপস্থিত হওয়ার অধিকার একমাত্র সেইসব বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর, যারা উদ্ধার ও সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম। যেমন ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। অথচ বাস্তবতায় আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখেছি। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মিডিয়া কর্মী এবং উৎসুক সাধারণ মানুষের ভিড়ে দুর্ঘটনাস্থল পরিণত হয়েছে বিশৃঙ্খল প্রদর্শনমঞ্চে। কেউ ফেসবুক লাইভ করছেন, কেউ বেদনাদায়ক দৃশ্যের ছবি তুলছেন, কেউবা বিভৎসতার সরাসরি সম্প্রচার করছেন যা উদ্ধারকাজকে শুধু ব্যাহতই করেনি, বরং তা দুর্গতদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই ‘উপস্থিতির প্রতিযোগিতা’ আমাদের এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করেছে যে, আমরা এখনো নাগরিক ও পেশাগত দায়িত্ববোধের মৌলিক শিক্ষায় নিজেদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে পারিনি। দুর্যোগে কেবল উপস্থিত থাকা নয়, সময়মতো সরে দাঁড়ানোর সংবেদনশীলতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গুণ। উদ্ধার অভিযানের শুরুতেই প্রয়োজন ছিল প্রশিক্ষিত বাহিনীগুলোর সুসমন্বিত পদক্ষেপ। কিন্তু তারা যে বিশৃঙ্খল দৃশ্যের ভিড়ে কার্যত পিছিয়ে পড়ল, সেটিই প্রমাণ করে যে আমাদের নাগরিক শিষ্টাচার ও দুর্যোগ-সচেতনতা এখনো শূন্যের কোঠায় রয়ে গেছে। এ যেন আলবেয়ার কামুর ভাষায় ‘চেতনার সংকট’ (ক্রাইসিস অব কনসাসনেস) যেখানে মানুষের উপস্থিতি হয়ে ওঠে প্রতিকারের নয়, বরং প্রতিকূলতার অংশ।
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা যেকোনো গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি। সংবাদ পরিবেশন শুধু তথ্য দেওয়ার বিষয় নয়। এটি নৈতিকতা, সহানুভূতি ও মানবিক বোধের পরীক্ষাক্ষেত্র। কিন্তু মাইলস্টোন কলেজের দুর্ঘটনার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা প্রতিফলিত হয়েছে, তা এক কথায় নির্মমতার প্রদর্শনী। নিহত ও দগ্ধ শিশুদের অনাবৃত ছবি, অগ্নিদগ্ধ শ্রেণিকক্ষের বিভৎস ভিডিও, কান্নারত শিক্ষার্থীদের লাইভ সাক্ষাৎকার এবং হাসপাতালের বেডে কাতরানো শিশুর মুখের ক্লোজ-আপ এসব কিছুই শুধু নৈতিক সীমানা লঙ্ঘন করেনি, বরং একটি জাতির মানসিক স্বাস্থ্যকেই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাংবাদিকতার মূলনীতি ‘ক্ষতি না করা’ (ডু নো হারম) এখানে যেন পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছে।
জনসচেতনতা তৈরির নামে যেসব চিত্র বারবার প্রচার করা হয়েছে, তা সাংবাদিকতার আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং সংবাদকর্মীদের পেশাগত শপথের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। এর ফলে আমরা যা পেয়েছি, তা তথ্য নয়, একটি জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া সামষ্টিক আতঙ্ক (ট্রমা)। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ নয়, বরং সংবেদনবর্জিত বাণিজ্যিকতা ও ‘রেটিং’র নির্মম প্রতিযোগিতাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। মিশেল ফুকোর ভাষায়, এটি একটি ‘দৃশ্যমান শক্তি’ (ভিজিবল পাওয়ার) যা মানুষের দুর্বলতা ও দুর্দশাকে পণ্য করে তোলে। আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি তবে দায়িত্বশীলতার বদলে নিষ্ঠুর কৌতূহলের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে?
সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও গভীরভাবে চিন্তার বিষয় হলো যাঁদের সেখানে সরাসরি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না, সেইসব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিরা দলে দলে দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন। এটি নিছক সহানুভূতির প্রকাশ নয়; বরং আত্মপ্রচারের দায়ত্বজ্ঞানহীন ও আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা, যা দুর্যোগকালীন মানবিকতা ও পেশাগত শালীনতাকে চরমভাবে আঘাত করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে জানা কথা, দগ্ধ রোগীরা সংক্রমণের চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অথচ বার্ন ইউনিটে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জনারণ্যে চিকিৎসা পরিবেশ হয়ে উঠেছিল বিশৃঙ্খল ও হুমকিপূর্ণ। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা দেখেছি কেউ কেউ ছিলেন চিকিৎসক পরিচয়ের অধিকারী যাঁরা চিকিৎসা শাস্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো যেমন ‘ক্ষতি না করা’ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে সুপরিচিত। তবুও তাঁরা রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে পেশাগত জ্ঞান ও নৈতিকতা উভয়কেই উপেক্ষা করেছেন। এখানে একটি গভীর রাজনৈতিক প্রশ্ন সামনে আসে, যখন পেশাগত দায়িত্ববোধকে ছাড়িয়ে রাজনৈতিক আত্মপ্রচার প্রাধান্য পায়, তখন রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও নাগরিক সুরক্ষা কতটা নিরাপদ থাকে? মাকিয়াভেলি রাজনীতিকে বাস্তববুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, যখন সেই বুদ্ধিমত্তা জনকল্যাণ নয়, বরং ক্ষমতার ক্ষণস্থায়ী প্রদর্শন হয়ে ওঠে, তখন তা বিপজ্জনক। এই লেখার মূল অনুসন্ধান তাই এখানেই যে সময় মানুষ বাঁচানোর লড়াইয়ে অন্যরা ব্যস্ত, সেই সময় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিদের সদলবলে উপস্থিতি যদি হয়ে ওঠে এক প্রকার জনদর্শন, তাহলে সেই রাষ্ট্রিক নৈতিকতার ভবিষ্যৎ কতটা ভঙ্গুর?
একটি রাষ্ট্র হিসেবে, একটি জাতি হিসেবে, এমনকি একটি সমাজ হিসেবে আমাদের এখনই সময় আত্মসমালোচনার। আমরা জানি, অতীতের দুর্ঘটনা ফিরিয়ে আনা যায় না; কিন্তু ভবিষ্যৎকে প্রস্তুত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় কেবল সামরিক কৌশল কিংবা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথেষ্ট নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে মানবিকতা, নৈতিকতা ও কাঠামোগত প্রস্তুতির দৃঢ় ভিত্তি। নাগরিকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কি কোনো সুনির্দিষ্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আছে? দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং কি প্রস্তুত ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের নিরাপত্তা কাঠামো নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, পেশাগত সংগঠন, প্রশাসনিক মহল এবং নাগরিক সমাজের সামনে এখন আত্মসমালোচনার একটি কঠিন আয়না তুলে ধরা। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘অপরীক্ষিত জীবন মূল্যহীন’ (এ লাইফ আনএক্সামিন্ড ইজ নট অরথ লিভিং)। একইভাবে, একটি দুর্যোগ-অভ্যস্ত সমাজও যদি আত্মসমীক্ষা না করে, তবে তার ভবিষ্যৎ কেবল পুনরাবৃত্ত দুর্ভোগই ডেকে আনবে। যদি এখনই আমরা নিজেকে প্রশ্ন না করি, নিজের দায় স্বীকার না করি এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি না নিই তবে বড় কোনো দুর্যোগ সামনে এলে জাতির প্রতিক্রিয়া কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের দুর্ঘটনা যেন আমাদের সামনে একটি নির্মম আয়না যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সামষ্টিক অপ্রস্তুতি, দায়িত্বহীনতা এবং সহানুভূতির সংকট। এ আয়নায় আমরা দেখতে পাচ্ছি এক গভীর কাঠামোগত ত্রুটি, যা শুধু দুর্ঘটনা-প্রস্তুতির ঘাটতিই নয়, বরং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংবাদিকতার নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক দায়িত্ববোধ এবং সাধারণ নাগরিক আচরণ সবকিছুর মধ্যেই একধরনের মানবিক, পেশাগত ও নৈতিক রূপান্তরের জরুরি প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে এসেছে। দুর্যোগের মুহূর্তে কেবল প্রযুক্তি নয়, মানবিকতাও যদি ভেঙে পড়ে, তবে সে সমাজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। এখনই সময় আমাদের গভীরভাবে ভাবার জাতীয় দুর্যোগের মুহূর্তে আমরা আসলে কাদের হাতে নিজেদের নিরাপত্তা তুলে দিচ্ছি? যাঁরা দায়িত্ব পালনের নামে দায়িত্ব এড়িয়ে যান, মানবিকতার নামে আত্মপ্রচার করেন, কিংবা পেশাগত শপথের বদলে রাজনীতির রঙে নিজেদের মুখ রাঙান তাঁদের হাতে কি একটি জাতি নিরাপদ থাকতে পারে? এই প্রশ্ন শুধু এই লেখার নয়, বরং একটি সময়ের প্রতি জাতির দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।
দুর্যোগ কখনো শুধু একটি মুহূর্তের বিপর্যয় নয়, বরং তা একটি জাতির চেতনা, কাঠামো এবং দায়িত্ববোধের পরীক্ষাক্ষেত্র। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের দুর্ঘটনা সেই পরীক্ষায় আমাদের কতটা অকূলে ভেসে গেছে, তা আমরা নিজেদের চোখেই প্রত্যক্ষ করেছি। এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের মধ্যে প্রস্তুতির অভাব আছে, আছে সহানুভূতির সংকট এবং রয়েছে নৈতিক দায়িত্ববোধের দুর্বলতা।
আমরা যদি সত্যিই একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও সচেতন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের দেশটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তবে দুর্যোগকে কেবল সহানুভূতির ভাষণে না রেখে, তা থেকে নৈতিক ও কাঠামোগত শিক্ষা নিতে হবে। এ শিক্ষা শুরু করতে হবে শাসকের আত্মসমালোচনা থেকে, রাজনৈতিক নেতাদের কান্ডজ্ঞান অর্জন থেকে, পেশাজীবির দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি থেকে এবং নাগরিকের আচার-আচরণ সংস্কারের মাধ্যমে। দুর্যোগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগ্রহ নয়; বরং প্রয়োজন কাজের যোগ্যতা, সংবেদনশীলতা এবং সময়জ্ঞান। আর সাংবাদিকতার নামে বিভৎসতা নয়, প্রয়োজন দায়িত্বশীল তথ্য পরিবেশন ও মানুষের হৃদয় বোঝার ক্ষমতা। রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসক ও প্রশাসকেরা যদি সত্যিই মানুষকে ভালোবাসে, তবে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে হবে দুর্যোগকালে, কেবল বক্তব্যের ফুলঝুড়িতে নয়, সঠিক কর্মের মাধ্যমে। সচেতনতা, শৃঙ্খলা ও সহানুভূতির একত্র প্রয়োগেই সম্ভব ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবিলা করা। তা নাহলে, আমরা শুধু ভবিষ্যৎ ভয়াবহ ঘটনার অপেক্ষায় থাকব আর প্রতিবারই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কিছু মানুষের অবিবেচনার ফল ভোগ করবে জাতি।
ড. মাহরুফ চৌধুরী
ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য
Email: mahruf@ymail.com