মত দ্বিমত
ইলন মাস্ক: প্রযুক্তির দুনিয়ায় বিপ্লবের এক অপ্রতিরোধ্য যাত্রা

ইলন মাস্ক, সেই নামটি যা বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, তার অবদান প্রযুক্তির প্রতিটি দিকেই স্পষ্ট। সাধারণ মানুষ তাকে শুধু টেসলা, স্পেসএক্স, সোলারসিটি কিংবা হাইপারলুপ এর মতো বিপ্লবী উদ্ভাবনী প্রকল্পের উদ্যোক্তা হিসেবে জানে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক নন, বরং একটি অসীম সাহসী ব্যবসায়ী এবং ভবিষ্যৎবিদ।
ইলন মাস্কের জীবনে চড়াই-উতরাই ছিলো। এলন মস্কের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৭১ সালে, এবং সেই শিশুকাল থেকে শুরু হয় তাঁর আগ্রহের যাত্রা। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রযুক্তির প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি করেন, আর এই আগ্রহই একদিন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর প্রধান কর্ণধারে পরিণত করে। পেপাল, টেসলা এবং স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর নয়া ব্যবসায়িক সম্রাজ্যের সূচনা হয়।
তবে তার জীবন সহজ ছিল না। টেসলা এর উত্থান থেকে শুরু করে, স্পেসএক্স এর অস্থির যাত্রা এবং সর্বশেষ হাইপারলুপ এর মতো অসম্ভব পরিকল্পনা, প্রতিটি পদক্ষেপে ছিলো অগণিত চ্যালেঞ্জ, বিতর্ক এবং তার উপরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী অঙ্গীকার। অনেকেই মনে করেছিলেন, তাঁর প্রকল্পগুলো শুধুমাত্র আর্থিক সংকট এবং অস্থিরতার দিকে এগিয়ে যাবে, কিন্তু ইলন মাস্কের দৃঢ় সংকল্প এবং ভবিষ্যৎমুখী ভাবনা তাকে সর্বত্র সফলতার চূড়ায় পৌঁছে দেয়।
পৃথিবী বদলে দেওয়ার যাত্রা
বিশ্বে তাঁর শিরোনামে যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম টেসলা। টেসলা একসময় শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন ছিলো, যা অনেকের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছিলো। কিন্তু মাস্ক তার ব্যক্তিগত জীবনের চ্যালেঞ্জ ও ভাঙাচোড়া সম্পর্ক সত্ত্বেও, নিজস্ব প্রযুক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে সেই অসম্ভবকেও সম্ভব করেছেন। প্রযুক্তিগত দিক থেকে, টেসলা এর বৈদ্যুতিক গাড়ি, শক্তি সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব যন্ত্রপাতি বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।
আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী প্রকল্প হলো স্পেসএক্স, যার লক্ষ্য ছিল মহাকাশে বাণিজ্যিকভাবে প্রবেশের জন্য একটি নতুন পথ সৃষ্টি করা। মাস্ক স্পেসএক্সের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বাইরের মহাকাশে মানুষের যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলেন এবং সেখানেও তাঁর আগ্রহ সফল হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন ও একাধিক বিবাহ
তবে, প্রযুক্তির জগতের পাশাপাশি ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত জীবনও বিভিন্ন দিক থেকে আলোচিত। ট্যালুলাহ রেইলি, জাস্টিন মাস্ক, এবং গ্রিমস এর মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার একাধিক সম্পর্ক এবং বিবাহ, তাঁর জীবনকে আরো জটিল করে তুলেছিলো। এসব সম্পর্কের পাশাপাশি, তার সন্তানদের প্রতিও তিনি গভীরভাবে মনোযোগী ছিলেন, তবে অনেকেই তাঁর জীবনযাত্রা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাছাড়া, রোলিং স্টোন এর এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, তিনি ব্যস্ততার কারণে নিজের সন্তানদের সঙ্গ যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি এবং এই বিষয়টি তার কাছে ‘রিগ্রেট’ ছিলো।
রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ট্রাম্প প্রশাসন
এদিকে, ইলন মাস্কের রাজনৈতিক অবস্থানও গত এক দশক ধরে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় তিনি বিল গেটস এবং বারাক ওবামা এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তিনি নিজের অবস্থান অনেকটাই মধ্যপন্থী হিসাবে তুলে ধরেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং মন্তব্য শিরোনাম হয়েছে। সেখান থেকে, তিনি খুবই বিতর্কিত পরিসরে পড়েছিলেন, কারণ তিনি ট্রাম্পের বেশ কিছু সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন। তবে, একসময় তিনি এই প্রশাসন থেকে সরে গিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড এবং ব্যবসায়িক দিক আরও শক্তভাবে পুনর্নির্মাণে মনোনিবেশ করেছেন।
ব্যবসায়িক দিক থেকে নতুন সিদ্ধান্ত
বর্তমানে, ইলন মাস্কের সিদ্ধান্ত ছিলো ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সরে গিয়ে, তার নিজস্ব ব্যবসায়িক দুনিয়ায় ফিরে যাওয়া। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘X’ এর ওপর তার কাজের মাধ্যমে তিনি বিশ্বজুড়ে যোগাযোগের নতুন এক দিগন্ত খুলে দিতে চান, যেখানে তার লক্ষ্য প্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং সামাজিক সংস্কৃতি নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করা। তবে, ইলন মাস্কের মতো একজন বিশাল ব্যক্তিত্বের জন্য নতুন সিদ্ধান্ত সবসময়ই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। টেসলা, স্পেসএক্স, বোরিং কোম্পানি-এর মতো বিপ্লবী উদ্যোগের পাশাপাশি, তাঁর চিন্তাধারা ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদী। অর্থনৈতিক দিক থেকে তিনি বিপুল লাভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তবে তার রাজনৈতিক অবস্থান এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চলমান বিতর্ক তাকে সবার চোখে আরও আলাদা করে তোলে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব: এক নতুন দিগন্তে ইলন মাস্ক
ইলন মাস্ক, যিনি প্রযুক্তির বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন, তিনি ভবিষ্যতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে চলেছেন। তবে, শুধু প্রযুক্তির উদ্ভাবনই নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তার অবদান ও প্রভাব লক্ষণীয়। ইলন মাস্কের কাজের উদ্দেশ্য শুধু পৃথিবী পরিবর্তন নয়, বরং সমাজের মানসিকতাও পরিবর্তন করা। তিনি বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বায়ন এবং উন্নত প্রযুক্তি পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করবে এবং কেবল নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য নয়, বরং সবার জন্য সুফল বয়ে আনবে।
অর্থনৈতিক শক্তি: ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে?
মাস্কের ব্যবসায়িক দিক থেকে, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী, এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সেগুলোর মধ্যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর ব্যাপারে। টেসলা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি, যেটি বিদ্যুৎচালিত গাড়ির বাজারে একাধিক বিপ্লব ঘটিয়েছে। শুধু গাড়ি নয়, তাদের শক্তি সংরক্ষণ প্রযুক্তি, সোলার প্যানেল, এবং নতুন নকশার ব্যাটারি প্রযুক্তি কোম্পানিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও শক্তিশালী করেছে।
তবে, স্পেসএক্স-এর প্রভাব অনেক বিস্তৃত। মহাকাশের বাজারে সাশ্রয়ী ও উন্নত প্রযুক্তি এনে স্পেসএক্স মানুষকে মহাকাশে প্রেরণের জন্য প্রস্তুত করেছে। এলন মাস্কের লক্ষ্য, শুধু পৃথিবী বা রোবোটিক প্রযুক্তির মাধ্যমেই মানুষের জীবন উন্নত করা নয়, বরং মঙ্গলগ্রহের উপনিবেশ স্থাপন করা। এটি একটি দুরূহ পরিকল্পনা হলেও মাস্ক তার অসীম বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, মঙ্গলগ্রহের জন্য উপনিবেশ স্থাপন একমাত্র উপায় হতে পারে যদি পৃথিবী কখনো বিপদে পড়ে বা মানবজাতি একটি নতুন স্থান খুঁজে পায়।
সামাজিক যোগাযোগ ও ডিজিটাল বিপ্লব
একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আসে যখন মাস্ক ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সরে গিয়ে তার নিজের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সম্প্রচার ব্যবসার দিকে মনোযোগ দেন। তার এক্স (X) সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি সামাজিক যোগাযোগের দুনিয়াতে নতুন অধ্যায় রচনা করার জন্য প্রস্তুত। এখানে গণতন্ত্র এবং বিশ্বের নেতাদের প্রতি সংলাপের মাধ্যমে সমাজের প্রভাব পরিবর্তন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় সঠিক তথ্য প্রবাহ, যাতে বিভ্রান্তি এবং মিথ্যা তথ্য রোধ করা যায়।
তিনি মনে করেন, ডিজিটাল স্পেসে তাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। তবে এক্স তার নিজস্ব সামাজিক সংলাপকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে, বিশেষত যখন তার মতো একটি ব্যক্তিত্ব সামগ্রিকভাবে নতুন প্রযুক্তি এবং রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে।
ব্যক্তিগত জীবন: কোনো পরিবর্তন আসছে?
এদিকে, ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত জীবনও অতীতে ছিল বিতর্কিত এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ। একাধিক বিবাহ এবং সন্তানের মধ্যে তার সম্পর্ক অনেকাংশেই আলোচিত। তবে, তার বর্তমান জীবনে, গ্রিমসের সাথে তার সম্পর্কটিকে তিনি প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগ এবং শিল্পের একটি মেলবন্ধন হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। তার সন্তানদের প্রতি গভীর সম্পর্ক, যেখানে তিনি অনেক সময় কাজে মগ্ন থাকলেও তার সন্তানদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। তবে, তার নিজস্ব জীবনের অবিচ্ছিন্ন চাপ তাকে কখনো কখনো বিশেষ মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে বাধা দেয়।
রিগ্রেট এবং নতুন শিখন
ইলন মাস্ক নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশছোঁয়া জীবন থেকেও বলতে দ্বিধা করেন যে, কিছু বিষয়, যেমন অতিরিক্ত কাজের চাপ বা পরিবারে তার উপস্থিতির অভাব, তিনি অতীতে রিগ্রেট করেন। তবে, তিনি একে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে দেখেন এবং মনে করেন, ‘সবকিছু একসাথে থাকা সম্ভব নয়, তবে পরবর্তী সময়ে অন্যদের পাশে থাকতে পারা যাবে’।
রাজনৈতিক ভূমিকা: বিশ্বকে একত্রিত করা
এদিকে, রাজনীতি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে মাস্কের চিন্তাধারা খুবই মৌলিক এবং ব্যক্তিগত। তার মতো একজন প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবসায়ী, বিশ্বের সরকারগুলোর মধ্যে প্রযুক্তি ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি একেবারেই আগ্রহী। বিশ্ব অর্থনীতির উন্নতি এবং বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব করতে তিনি বিশ্বাস করেন, গ্লোবাল প্রযুক্তির একীভূত সহযোগিতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রয়োজন।
মাস্ক জানেন যে, তার পদক্ষেপ শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও হতে হবে। তিনি চান, বিশ্বকে একীভূত করা, যেখানে সবার কাছে সুযোগ থাকবে।
শেষ কথা: অতীতের শিক্ষা, বর্তমানের সংগ্রাম এবং ভবিষ্যতের রূপকল্প
ইলন মাস্কের জীবনে যতই প্রতিকূলতা বা সমালোচনা আসুক না কেন, তিনি একটি নতুন পৃথিবী গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসা নয়, বরং বিশ্বের ভবিষ্যৎ। উন্নত প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান, গ্রহের সুরক্ষা এবং বৈষম্য দূরীকরণ—এগুলোই তার চূড়ান্ত লক্ষ্য।
তবে, পৃথিবীর পরিবর্তন এত সহজ নয়। মাস্কের পথে চ্যালেঞ্জ থাকবে, অনেকটা ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সরে গিয়ে নতুন দিশা খোঁজা যেমন ছিলো, তেমনি প্রতিটি পদক্ষেপ নতুন উত্তরণের কথা বলে। শেষমেশ, ইলন মাস্ক আজ যেভাবে ভবিষ্যতের রূপান্তরের জন্য কাজ করছেন, তাতে একদিন তিনি হয়তো একটি নতুন যুগের সূচনা করবেন, যা প্রযুক্তি, সমাজ এবং অর্থনীতির দিক থেকে ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পরিশেষে, ইলন মাস্কের যাত্রা অবিরাম, দৃঢ়বিশ্বাসী এবং অপ্রতিরোধ্য- এটি প্রযুক্তির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়, যা কেবল ভবিষ্যতের জন্য নয়, বর্তমানে পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার সুযোগ সৃষ্টি করছে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

মত দ্বিমত
জিয়ার উত্তরাধিকার: এক জাতির দ্বন্দ্বপূর্ণ প্রতিবিম্ব

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যাদের অবদান ও বিতর্ক একই ছায়ার নিচে বিরাজমান। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এমন এক চরিত্র। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের সাহসী নেতা ছিলেন না, একজন অপরাজেয় সামরিক কমান্ডার ও কার্যকর প্রশাসক হিসেবেও দেশকে গড়ার পথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তার নেতৃত্ব ছিল শক্তিশালী রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতীক, পাশাপাশি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা ও দলীয় রাজনীতিরও প্রতীক। এই নিবন্ধে তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন মূল্যায়ন করবো এবং আমার স্মৃতিতে একটি মানবিক রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলবো।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এটি শুধু সামরিক ঘোষণা ছিল না, এটি এক অসাধারণ নেতৃত্বের উন্মেষের প্রতীক ছিল। তখনকার শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার পর নেতৃত্বহীন সময়ে জিয়ার এই ঘোষণা সাহস, দিশা ও কৌশলগত বার্তা হিসেবে কাজ করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের গতিবেগ বাড়াতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি সেক্টর ২ এর কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পরে জি ফোর্স গঠন করে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার নেতৃত্ব শুধু সামরিক সফলতা নয়, একটি আদর্শিক সংকল্পের প্রকাশ ছিল। ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত একমাত্র কমিশন্ড অফিসার হিসেবে তার অবদান ঐতিহাসিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সময়ে তিনি পেশাদার সৈন্য থেকে আদর্শবাদী স্বাধীনতাকামী নেতা হয়ে উঠেছিলেন— যার সিদ্ধান্ত, শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তা যুদ্ধের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সংকট ও নেতৃত্ব শূন্যতায় জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় এসেছিলেন। প্রথমদিকে সামরিক শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কঠোরতা ছিল সরকারের মূল ভিত্তি। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সামরিক নীতির চেয়েও বেশি কিছু দরকার। তাই তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তা’, ‘উৎপাদনমুখী অর্থনীতি’ এবং ‘সেবামূলক প্রশাসন’ ধারণা প্রবর্তন করেন। কৃষি বিপ্লব, খাল খনন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, ইসলামী অনুভূতিকে শ্রদ্ধা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সামঞ্জস্য স্থাপন তার কার্যকর রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় বহন করেছিল।
তবে এই সাফল্যের আড়ালে কিছু সীমাবদ্ধতা ও বিতর্কও লুকিয়ে ছিল। বিশেষ করে ১৯৭৭ সালের বিমান বাহিনী বিদ্রোহ দমন, যেখানে প্রায় একশত পনের জনেরও বেশি সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের শিকার হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয় এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস পায়। একই সঙ্গে, সেনাবাহিনী সমর্থিত বিএনপি গঠনের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পথে থেকে সরে যায়।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক অভ্যুত্থানের ছায়া প্রকট ছিল। এই সময়কাল ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের জন্য স্মরণীয়।
১৯৭৭ সালের বিমান বাহিনী অভ্যুত্থানের পর প্রায় এক হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শতাধিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অনেকের অবস্থান পরিবার-পরিজন পর্যন্ত অজানা ছিল। Amnesty International ও Asia Watch-এর রিপোর্টে এই বিচারগুলোকে ‘নির্যাতনমূলক ও অস্বচ্ছ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেমন DGFI ও NSI বিরোধী রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি ও নির্যাতন চালিয়েছিল। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জলিল, কর্নেল আবু তাহের ও ক্যাপ্টেন হকসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। কর্নেল আবু তাহেরকে একটি গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাকে অনেকে ‘বিচারবহির্ভূত’ ও ‘প্রহসন’ মনে করেন।
এই সময়কালে গোপনীয়তার ছায়ায় গণতান্ত্রিক বিরোধীদের গুম, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরিবারকে হয়রানি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল। নির্যাতন ও দমন-পীড়নের এই কৌশল রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতার আড়ালে এই কালো অধ্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থী গোষ্ঠীগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ইতিহাস বলে দেয়, একাধারে ক্ষমতা কেবল শক্তি নয়, ন্যায় ও মানবিকতা থেকেও বিচ্যুত হলে রাষ্ট্র দুর্বল ও অমানবিক হয়ে ওঠে।
সত্যকে স্বীকার করা জরুরি—যে জিয়াউর রহমান, মুজিব, এরশাদ,খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা প্রত্যেকেই এক ধরনের ক্ষমতার খেলা খেলেছেন। ভবিষ্যতের নেতৃবৃন্দও এই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে—যা দুঃখজনক, কিন্তু এ থেকেই আমরা শিক্ষা নিতে পারি।
জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি সংগঠনগতভাবে শক্তিশালী হলেও আদর্শগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। পারিবারিক ক্ষমতার ধারাবাহিকতা, নৈতিকতা বিহীন ক্ষমতার লড়াই, বিদেশি প্রভাব পার্টির অবস্থান জটিল করে তোলে। জিয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘উৎপাদনমুখী গণতন্ত্র’ ও ‘জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন’ শাসনের ভিত্তি দুর্নীতি, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সহিংসতায় দুর্বল হয়ে যায়। আজকের বিএনপি তার আদর্শ ও মানবিক রাষ্ট্রনায়কত্ব থেকে অনেক দূরে।
জিয়াউর রহমান ছিলেন কঠোর বাস্তববাদী। তিনি সামরিক শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও কূটনৈতিক সামঞ্জস্যের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিলেন। তবে পূর্ণ গণতন্ত্রের স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পারেননি, আর তার দল তা আরও দুর্বল করেছে। ইতিহাস তাকে ‘বিবাদময় রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে দেখছে— একদিকে সফল নেতা, অন্যদিকে ক্ষমতার রাজনীতির স্থপতি।
১৯৮০ সালে একদিন জিয়াউর রহমান হেলিকপ্টারে করে মাগুরার নবগঙ্গা নদীর তীরে বাটাজর নামক এক অজানাগাঁওয় পৌঁছান। সেখানে খাল খনন ও গ্রামের স্থানীয় প্রশাসনের অবস্থা নিজ চোখে দেখতে এসেছিলেন তিনি। সেই সময় আমি এক দুরন্ত কিশোর ছিলাম, এবং সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্টকে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল— শুধুমাত্র শীর্ষ নেতাই নয়, এক মানবিক মানুষ হিসেবে যার উপস্থিতি স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটেছে।
আজও মনে পড়ে সেই দৃশ্য— জনগণের সমাবেশ, হেলিকপ্টার ছেড়ে হাঁটাহাঁটি করে সাত মাইল পথ পাড়ি দেওয়া, গ্রামের মানুষের সাথে আন্তরিক আলাপ। রাষ্ট্রনায়ক হলেও তিনি সহজ ও মানবিক ছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি কিভাবে একজন মানুষ অন্যের কষ্ট বুঝতে, শ্রদ্ধা করতে এবং ভালোবাসতে পারে।
সর্বোপরি, শত্রুজিতপুর স্কুলে তিনি বলেছিলেন, “আমি কিছু খাবো না, শুধু লেবুর শরবত চাই।” এটি ছিল একটি অনন্য বার্তা— সর্বোচ্চ ক্ষমতার মাঝেও আত্মসংযম হলো নেতার মৌলিক গুণ, যা জিয়া বহন করতেন।
তার অপ্রত্যাশিত মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করেছিল। আজও মনে হয়, সেদিনের সেই রে-ব্যান পাইলট চশমা পরা মানুষটি শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, এক মানবিক ভ্রমণকারী ছিলেন।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বৈত চরিত্রের প্রতীক— একদিকে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রনায়ক, অন্যদিকে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ ও দলীয় রাজনীতির স্থপতি। তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ সামরিক মনোভাব, প্রশাসনিক বাস্তববাদ ও উন্নয়ন চিন্তাকে মিলিয়েছিলেন।
কিন্তু মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল তার রাষ্ট্রনায়কত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। আদর্শের পরিবর্তে এসেছে পারিবারিক কর্তৃত্ব, জনগণের উন্নয়নের পরিবর্তে রাজনৈতিক পেশাদারিত্ব, স্বাধীন কূটনীতি বাদ দিয়ে বিদেশি নির্ভরতা।
আজকের বাংলাদেশ যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও আদর্শ সংকটে আছে, জিয়ার ‘দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন,’ ‘জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন’ ও ‘আন্তর্জাতিক সামঞ্জস্য’ নীতিগুলো শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক নয়, দেশের পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য।
স্মৃতির পটে, সুদূর সুইডেনের এর এক গ্রামে নির্জন জীবন যাপন করার সময় হঠাৎ করেই বাংলাদেশের সেই উজ্জ্বল দিনগুলো মনে পড়ে, যখন আমি জিয়াউর রহমানের পাশে হেসেছি। তার চোখে ছিল দেশের জন্য অদম্য ভালোবাসা, যা আজও আমার অন্তরে আলোর শিখা জ্বালায়। প্রতিটি কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের শুরুতে সেই স্মৃতি ফিরে আসে— এক মানুষের, যিনি প্রেসিডেন্ট হলেও আমাদেরই একজন ছিলেন: সাধারণ এবং সংবেদনশীল।
এই বিদেশী মাটিতে আমি যখন শাকসবজি চাষ করি, সেখানে লুকিয়ে থাকে ছোট্ট একটা বাংলাদেশ— সেই বাংলাদেশ যা তিনি গড়তে চেয়েছিলেন। সমালোচনার পরেও তিনি আমার স্মৃতিতে জীবন্ত একজন রাষ্ট্রনায়ক, মানবিক, দূরদর্শী ও অনড়।
জিয়াউর রহমান শুধু আমার কাছে একজন সাবেক নেতা নয়, এক পথিকৃৎ যার আদর্শ, ত্যাগ ও দেশপ্রেম আজও হৃদয়ে জ্বলছে। আমি আশা করি তার পরিবার সেই মহান চেতনা ধরে রাখবে ও আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে— তখনই তার স্বপ্ন সত্যিই বাঁচবে। হয়তো একদিন, এই নির্বাসিত জীবনে আমি নতুন প্রজন্মের চোখে সেই আলো দেখতে পাব যা একদিন জিয়ার চোখে দেখেছিলাম। এই স্মৃতির মাঝে আমি নিজেকেই খুঁজে পাই— ইতিহাসে সংরক্ষিত রাষ্ট্রনায়কদের পাশে নিঃশব্দ এক সঙ্গী হিসেবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
নতুন নেতৃত্বের খোঁজে বাংলাদেশ: ছাত্র আন্দোলন, নৈতিক সংকট এবং বিকল্প পথের সন্ধান

একটি রাষ্ট্র তখনই বিকশিত হয়, যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশ্বাসযোগ্যতা, আদর্শ এবং জনসম্পৃক্ততায় অনড় থাকে। বাংলাদেশের বাস্তবতা আজ ঠিক এর উল্টো পথে হাঁটছে। বহুকাল ধরে চলমান শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থান্বেষী ভূমিকা, এবং জাতির অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা গভীর নৈতিক ও সাংগঠনিক সংকট; এই তিনটি উপাদান আজ জাতিকে এক ভয়াবহ মোড়ের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
রাজনৈতিক অপশাসন ও বিরোধী দলের ব্যর্থতা
অতীতের সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থেকেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, আইনের শাসন ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর অবস্থাও খুব একটা আলাদা নয়। বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যজোট গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং সময়োপযোগী কৌশলের দিক থেকে দুর্বল, নানান নৈতিক প্রশ্নে দুষ্ট। এই অবস্থায় জনগণের সামনে বাস্তবিক অর্থেই কোনও কার্যকর বিকল্প নেই।
ছাত্র সমাজ ও নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনা
এই নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক পটভূমিতে নতুন আলো দেখাতে শুরু করেছে কিছু তরুণ নেতৃত্ব ও ছাত্রসমাজ। ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলন’ হোক বা সাম্প্রতিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ—এসব ক্ষণিকের প্রতিবাদ হলেও এতে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। একজন ‘হাসনাত’ বা তার মতো কিছু তরুণ নেতৃত্ব প্রতীক হয়ে উঠছে বিকল্প রাজনৈতিক নৈতিকতার। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করছে। দ্রুত না শুধরালে তারা সংখ্যার ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যাবে। এই মুহূর্তে তাদের জাতীয় নেতৃত্বের আসনে বসানো বাস্তবসম্মত নয়, তবু সমাজের একাংশ এই ধরনের বিকল্প চিন্তার দিকে ঝুঁকছে।
সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও সক্রিয় পর্যবেক্ষণ
যদিও সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে নিরপেক্ষতার ভূমিকা বজায় রেখেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তাদের ভূমিকাও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিগত অভিজ্ঞতা বলে দেয়, সেনাবাহিনীর ‘নীরব উপস্থিতি’ কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের গোপন রক্ষাকবচ হয়ে ওঠে। তবে এই ‘প্রতীক্ষমাণ সংযম’ কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক চিত্রের উপর নির্ভর করছে।
আমলাতন্ত্র ও সচিবালয়ের ভূমিকা
বর্তমানে সচিবালয়ভিত্তিক আমলাতন্ত্র রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দলীয়করণের শিকার। সচিবালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া এখন আর জনস্বার্থনির্ভর নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের অনুগত নীতিগত ‘হ্যাঁ-মানুষ’-এর দল হয়ে উঠেছে। ফলে বাস্তবায়ন-ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে গেছে, এবং জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ক্রমাগত কমে আসছে।
সাংবিধানিক ভারসাম্য ও নৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা
বাংলাদেশে কার্যকর সাংবিধানিক ভারসাম্য আজ একটি রূপকথা মাত্র। নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পারস্পরিক নিরপেক্ষতা ও শক্তি-বণ্টনের যে তাত্ত্বিক কাঠামো সংবিধানে ছিল, তা এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক দখলদারিত্বে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতির সামনে এখন প্রয়োজন এমন একটি নৈতিক নেতৃত্ব, যেটি দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে দেশকে পুনর্গঠন করতে পারবে।
ড. ইউনুস: বিতর্কের মধ্যেও একটি গ্রহণযোগ্যতা
ড. মুহাম্মদ ইউনুস এমন এক ব্যক্তি যাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে এখনো বাংলাদেশি নৈতিক নেতৃত্বের মুখ হিসেবে দেখা হয়। তার প্রতি সরকারের দমনমূলক আচরণ দেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকটকেই স্পষ্ট করেছে। যদিও তাঁকে সরাসরি রাজনীতিতে দেখতে চায় না অনেকেই, তবু একজন পরামর্শদাতা, নীতিনির্ধারক বা তত্ত্বাবধায়ক নেতৃত্ব হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য হতে পারেন।
জাতির সামনে এখন মূল প্রশ্ন দুটি
১. আমরা কি ব্যর্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দলান্ধ নেতৃত্বের গোলকধাঁধায় ঘুরে ঘুরে নিজেদেরই ধ্বংস করছি?
২. নাকি আমরা এখন বিকল্প ভাবনার, নৈতিক নেতৃত্বের এবং নতুন প্রজন্মকে সামনে আনবার একটি ঐতিহাসিক সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে?
আজ আমাদের দরকার সুসংগঠিত একটি জাতীয় জাগরণ—যেখানে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেম, সততা ও সাহসিকতা থাকবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণ আবশ্যক। সময় এসেছে এই প্রশ্নটি জোর দিয়ে তোলার: আমরা কি বর্তমানকে অস্বীকার করে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারি?
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com
অর্থসংবাদ/কাফি
মত দ্বিমত
বিদায় নাডাল: এক কিংবদন্তির শেষ অধ্যায়ে হৃদয়ের র্যাকেট হাতে কিছু কথা

ব্যক্তিগত সংযুক্তি: হৃদয়ের রকেটে বাজে টেনিসের সুর
আমি নিজে কোনো পেশাদার খেলোয়াড় নই। তবে খেলার সঙ্গে আমার প্রেম বহুদিনের। ছোটবেলায় ফুটবল আর ব্যাডমিন্টনে কাটিয়েছি বিকেলগুলো—বন্ধুদের সঙ্গে গলির মাঠে ঘাম ঝরানো সেই সময়গুলো ছিল সরল আনন্দের এক নাম। জীবনের মোড় ঘুরে যখন সুইডেনে পা রাখি, তখন টেনিসের প্রতি আমার আগ্রহ যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আর হবে নাই বা কেন—বিশ্ব ক্রীড়াজগতে সুইডেন তো এক বিস্ময়, এক টেনিস-জাতি। বোর্গ থেকে শুরু করে এডবার্গ—এই দেশকে টেনিসের ‘মক্কা’ বলা হয়, সার্থকভাবেই।
আমি একজন সুইডিশ প্রবাসী ক্রীড়াপ্রেমিক ও অভিভাবক, আমি টেনিস জগতে নিজের সন্তানদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে খেলাটির সঙ্গে গড়ে তুলেছি গভীর সম্পর্ক। আমার এই ভালোবাসা যেন আমার সন্তানদের মধ্যেও রক্তের সাথে বইতে থাকে। আমার ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই সুইডেনের পতাকা বুকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লড়েছে। দেশ, কোর্ট, টুর্নামেন্ট, প্রশিক্ষণ আর প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে টেনিস-যোদ্ধা। শত শত ট্রফি, হাজারো ম্যাচ—সবই যেন আমাদের পরিবারের জীবনরেখায় লেখা এক ক্রীড়া-সাহিত্য।
টেনিসকে আমি কেবল খেলা হিসেবে দেখিনি, দেখেছি এক ধরণের দর্শন, এক জীবনভাবনা হিসেবে। বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, কথা বলেছি, কিছু অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছি—সেইসব দিনগুলো আমাকে শেখায়: খেলার চেয়েও বড় কিছু হচ্ছে মনোবল, সম্মান ও আত্মত্যাগ।
তবে জীবনের পথ সবসময় মসৃণ নয়। আমার ছেলে জনাথনের হঠাৎ করে পাওয়া একটি গুরুতর ইনজুরি আমাদের পরিবারে দীর্ঘ এক নীরবতা এনে দেয়। কোর্ট, র্যাকেট, সেই যুদ্ধ—সব যেন থমকে যায়। তবে থেমে যায় না হৃদয়ের স্পন্দন। প্রতিটি ম্যাচ, প্রতিটি মুহূর্ত মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে।
আজ, জনাথান আবার হাতে তুলে নিয়েছে র্যাকেট। চলছে নতুন প্রস্তুতি। নিজেকে ফিরে পাওয়ার লড়াই। চোখে আগুন, মনে দৃঢ়তা—প্রিপারেশন, ডেডিকেশন এবং মোটিভেশন মিলিয়ে যেন এক নতুন সূচনা। ঠিক এই সময়েই, আরেকজন কিংবদন্তির বিদায় দেখতে বসেছি।
রাফায়েল নাডাল, যিনি ‘ক্লে কোর্টের রাজা থেকে অনুপ্রেরণার প্রতীক’ নামে পরিচিত। ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় করে টেনিস ইতিহাসে নিজের স্থান নিশ্চিত করেছেন। তার মধ্যে ১৪টি এসেছে ফ্রেঞ্চ ওপেনে, যা একটি অনন্য রেকর্ড। তার খেলার প্রতি নিষ্ঠা, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান এবং নম্রতা তাকে কেবল একজন ক্রীড়াবিদ নয়, বরং একজন মানবিক আদর্শে পরিণত করেছে। ২০২৫ সালের রোলাঁ গারোসের প্রথম দিন, এক ঐতিহাসিক আবেগে ভেসেছিল ক্লে কোর্ট। রাফায়েল নাডাল—যিনি আগেই টেনিস থেকে অবসর নিয়েছেন—তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানো হয় তাঁর ভালোবাসার কোর্টেই। ১৪ বারের চ্যাম্পিয়নকে ঘিরে কান্নাভেজা বিদায়ী মুহূর্ত যেন গলে গিয়েছিল কোটি ভক্তের হৃদয়ে। গোটা টেনিসবিশ্ব শোকাহত, আবেগে আলোড়িত।
বিদায়ের মুহূর্ত: নাডালের কণ্ঠে হৃদয়ের স্বর
ফ্রান্সের রোলাঁ গারোস টেনিস টুর্নামেন্ট (ফ্রেঞ্চ ওপেন) ঐতিহাসিক কোর্টে যখন নাডাল বিদায় জানালেন, তখন কেবল একটি প্রতিযোগিতা নয়, এক দিগন্তই যেন অস্ত গেল। তিনি বললেন, ‘আমি শান্তি নিয়ে বিদায় নিচ্ছি, কারণ আমি জানি আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়েছি।’
তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সাথে তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা কেবল প্রতিযোগী ছিলাম না, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সহযাত্রী ছিলাম।’ এই কথাগুলো যেন নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দিল—সফলতা কেবল ট্রফিতে নয়, চরিত্রেও। ‘আমাদের সম্পর্ক কেবল প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; আমরা একে অপরকে সম্মান করতাম এবং একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি।’
এই প্রতিটি শব্দ যেন ক্রীড়া জগতের নৈতিকতা ও সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি।
নাডাল শুধু এক খেলোয়াড় নন, তিনি অধ্যবসায়ের প্রতীক। ইনজুরি, ব্যথা, প্রতিপক্ষ—সব বাধা পেরিয়ে তিনি খেলেছেন হৃদয় দিয়ে। বারবার ফিরে এসেছেন, জিতেছেন, কখনো হেরেছেন, কিন্তু কখনো হেরে যাননি।
ভালোবাসার চোখে বিদায়: একটি ইতিহাসঘন মুহূর্ত
নাডালকে গোটা বিশ্বের টেনিস ভক্তরা বিদায় জানিয়েছেন হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে, তবে সবচেয়ে আবেগময় ও ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিল রোলাঁ গারোসের ক্লে কোর্টে সময়ের সেরা তিন তারকা—নোভাক জোকোভিচ, রজার ফেদেরার এবং অ্যান্ডি মারে—এর সরাসরি উপস্থিতি। এত প্রতিযোগিতা, এত ফাইট, জয়-পরাজয়ের শত শত অধ্যায়—তারপরও আজকের এই বিদায়ের দিনে তাদের চোখে ছিল জলের ঝিলিক, মুখে ছিল ভালোবাসার মৃদু হাসি। তাদের আন্তরিক আলিঙ্গন আর চোখের ভাষা যেন বলে দেয়, খেলার চেয়েও বড় কিছু আছে—মানবতা, শ্রদ্ধা আর বন্ধুত্ব।
এই ভালোবাসার দৃশ্য যেন ছুঁয়ে যাক যুদ্ধবিধ্বস্ত মাটি, রক্তমাখা বুলেট আর বিভক্তির দেয়াল। ছুয়ে যাক ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতির বিভেদ। মুছে যাক অতীতের হিংস্রতা আর ফিরে আসুক শান্তির এক রোদেলা সকাল—সবার হৃদয়ে। আমি কেনো মাঝে মাঝে এমন মানুষদের কথা লিখি? কারণ নাডাল, ফেডেরার বা জোকোভিচ কেবল ক্রীড়াবিদ নন—তারা মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদা ও নৈতিকতার জীবন্ত উদাহরণ। রোলাঁ গারোঁতে টেসলার বিজ্ঞাপন ফিরিয়ে দিয়ে নাদাল আমাদের মনে করিয়ে দিলেন—সবকিছু টাকায় কেনা যায় না। “আমি চাই না আমার সবচেয়ে বিশেষ দিনটি অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হোক”—এই একটিমাত্র বাক্যে তিনি যা বললেন, তা অনেক রাজনীতিবিদও আজ বলেন না। dignity মানে শুধু না বলা নয়, নিজেকে চিনে নিজের মূল্যে অটল থাকা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই নৈতিক সাহসিকতা আজ আমাদের রাজনীতিতে প্রায় অনুপস্থিত। আহা, যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বেও এমন সত্য বলার সাহস থাকত!
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাডাল: একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশে যেখানে প্রতিনিয়ত আলোচনা হয় দুর্নীতি, শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা, লুটপাট আর রাজনৈতিক বঞ্চনার গল্প—সেখানে নাডালের জীবনের গল্প হতে পারে এক বিকল্প আলোকবর্তিকা। টেনিসের কোর্ট থেকে উঠে আসা এক শিক্ষা—কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা, শ্রদ্ধা, সংযম এবং ভালোবাসার শক্তি দিয়ে কীভাবে একটি মানুষ নিজেকে বিশ্ববাসীর কাছে অনুপ্রেরণায় পরিণত করতে পারে।
বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার Pelé-র একটি বাণী এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়: ‘Success is no accident. It is hard work, perseverance, learning, studying, sacrifice and most of all, love of what you are doing or learning to do.’ — Pelé (সাফল্য কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য, শেখা, পড়াশোনা, আত্মত্যাগ এবং সর্বোপরি, আপনি যা করছেন বা যা শিখছেন তা ভালোবাসার ফলাফল।)
নাডাল তার জীবন দিয়ে এই কথাগুলোর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাই আজ যখন তিনি বিদায় নিচ্ছেন, আমি শুধু একজন দর্শক হিসেবে নয়—একজন ক্রীড়ামনস্ক বাবা হিসেবে, একজন সুইডিশ-প্রবাসী অভিভাবক হিসেবে, আর একজন মানবিক চিন্তাবিদ হিসেবে আবেগে আপ্লুত হয়ে লিখতে বসেছি।
শেষ কথা: এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের দিকে
রাফায়েল নাডাল তার বিদায় দিয়ে কেবল নিজের অধ্যায়ের সমাপ্তি টানলেন না, আমাদের জন্য রেখে গেলেন এক জীবন্ত শিক্ষা—কোনো লক্ষ্যই অসম্ভব নয়, যদি থাকে অন্তরের ভালোবাসা, পরিশ্রমের ইচ্ছা এবং মানুষের প্রতি সম্মান।
আমার ছেলে আজ আবার টেনিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, নতুন দিনের জন্য। আমিও প্রস্তুত হচ্ছি—এই খেলার সৌন্দর্যকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে, নতুন করে ভালোবাসতে। আজকের দিনে বিদায় জানাচ্ছি এক কিংবদন্তিকে, আর বরণ করে নিচ্ছি ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে—হৃদয় দিয়ে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
মত দ্বিমত
বারোটা বেজে গেছে, দায়িত্ব ছেড়ে দিন

নাতির বয়সি উপদেষ্টাদের দিয়ে অভিজ্ঞ সরকার হয় না—এই বক্তব্য ইতিহাসের প্রতি অবমাননা, তরুণদের প্রতি ঘৃণা। সম্প্রতি একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদের মন্তব্য— ‘নাতির বয়সি উপদেষ্টাদের দিয়ে অভিজ্ঞ সরকার হয় না’— সমাজের বিভিন্ন স্তরে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন বক্তব্য শুধু তরুণদের নেতৃত্বের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখায় না, বরং এটি ইতিহাস, ত্যাগ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মুখে এক নির্লজ্জ চপেটাঘাত।
ইতিহাস কি বলে?
বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত তরুণদের হাত ধরেই রচিত হয়েছে। যাঁরা আজ ‘নাতির বয়সি’ বলে তুচ্ছ করছেন, তারাই অতীতে যুগান্তকারী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন।
•১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন: স্কুল-কলেজের ছাত্ররাই রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের ‘অভিজ্ঞতা’ ছিল না, ছিল আদর্শ।
•১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ: অসংখ্য তরুণ অস্ত্র হাতে দেশ রক্ষায় লড়েছে। শিশু মুক্তিযোদ্ধারাও জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে নেমেছিল।
•১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন: তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণই স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে।
তাদের তখন কেউ ‘অভিজ্ঞ’ সার্টিফিকেট দেয়নি। তারা নিজেরাই নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করেছেন রক্ত আর ত্যাগ দিয়ে।
একজন শিশু মুক্তিযোদ্ধার আত্মপ্রকাশ
এই বক্তব্যের প্রতিবাদে, আমি নিজেই একজন শিশু মুক্তিযোদ্ধা। কই কেউ তো ১৯৭১-এ আমাকে তখন বলেনি— ‘যুদ্ধে যেয়ো না, স্কুলে যাও!’ আজ ২০২৪-এর নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জ্ঞান-যোগ্যতা, বিশ্বদর্শন, প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ—সবকিছুকে অস্বীকার করে ‘নাতির বয়সি’ বলে উপেক্ষা করা কি সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধাচরণ নয়? এই প্রশ্ন শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়—এটি একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক দাবি, যা গোটা জাতির পক্ষ থেকে উঠে এসেছে।
বিশ্বপরিপ্রেক্ষিত
বিশ্বজুড়ে তরুণ নেতৃত্ব ইতিহাস বদলে দিয়েছে।
•সানা মারিন (ফিনল্যান্ড) ৩৪ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
•জাস্টিন ট্রুডো (কানাডা) ও ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (ফ্রান্স) তরুণ বয়সেই নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন।
তাদের কেউ ‘নাতির বয়সি’ ছিল না—তারা ছিল যথার্থ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।
দেখেছেন সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় তীব্র প্রতিঘাত?
এই বিতর্কিত বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবাদ উঠে এসেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য:
•তরুণদের অবদান অস্বীকার করা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা।
•বয়স দিয়ে অভিজ্ঞতা মাপা যায় না; নেতৃত্ব আসে চেতনা ও দক্ষতা থেকে।
•এই বক্তব্য তরুণদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটি অপচেষ্টা।
এই প্রতিক্রিয়াগুলো স্পষ্ট করে দেয়—জনগণ এমন ধারার অবজ্ঞাপূর্ণ রাজনীতিকে আর গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
বিএনপির পতনের ইঙ্গিত?
এমন অপমানজনক বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি কি নিজেদের রাজনৈতিক পতনের ঘণ্টা বাজাতে শুরু করেছে?
সালাউদ্দিন, রিজভীসহ একদল নেতাকর্মীর অযাচিত ও সময়োচিত অবস্থানহীন কথাবার্তা বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলছে। অন্যদিকে, তারেক রহমান লন্ডনে বসে লংডিস্টান্সে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্দেশনার মাধ্যমে দল পরিচালনার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছেন—তা দল নয়, দেশকেই ভয়ংকর এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ যাদের তিনি ‘সাহসী নেতা’ বলছেন, বাস্তবে তাদের অনেকেই অতীতে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বিশ্বাস না হলে নিরপেক্ষ তদন্ত করুন এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
বিএনপির রাজনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ—নৈতিক, সাংগঠনিক এবং কৌশলগত দিক থেকে। আপনিও কি আমার মত ভাবছেন, নাকি অনেকটা বদলে গেছেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বিএনপি কি চায় বাঁচতে? তাহলে গ্রহণ করতে হবে বাস্তবতা
যদি বিএনপি সত্যিই জনগণের আস্থা ফিরে পেতে চায়, তবে কৌশলগত ও আদর্শিকভাবে তাকে মৌলিক পরিবর্তনের পথে হাঁটতেই হবে। তা না হলে এই দল এক সময় শুধু ইতিহাসের বইতেই রয়ে যাবে।
প্রথমত, বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের সেই মূল আদর্শে ফিরে যেতে হবে—যেখানে আত্মনির্ভরতা, রাষ্ট্রচিন্তা, জাতীয় স্বার্থ, এবং জনগণের শক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। দলকে পুনর্গঠনের কেন্দ্রে থাকতে হবে জনগণকেই—উপদেষ্টা, কর্মী বা বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব নয়। জনগণ হতে হবে বিএনপির প্রাণকেন্দ্র।
দ্বিতীয়ত, তারেক রহমানকে দীর্ঘকাল প্রবাসে বসে ‘নির্দেশনা দিয়ে রাজনীতি’ বন্ধ করতে হবে। তাকে অনতিবিলম্বে দেশে ফিরতে হবে, মাঠে নামতে হবে, জনগণের চোখে চোখ রেখে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। শুধুমাত্র বক্তৃতা আর হুমকি নয়, দরকার বিশ্বাসযোগ্যতা ও সাহসের রাজনীতি।
তৃতীয়ত, নতুন প্রজন্মকে একঘরে করে নয়—তাদের হাত ধরেই ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজাতে হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় পুরাতনদের বিদায় অনিবার্য। শুধু বয়স নয়, সময়, পরিস্থিতি এবং যুগবোধ বিবেচনায় তাদের অবদানকে সম্মান জানিয়ে অবসর নিতে হবে। বাস্তবতা হলো—৫৪ বছর ধরে যারা পারেনি, তারা এই বৃদ্ধ বয়সে পারবে—এই ধারণা শুধু অলীকই নয়, আত্মপ্রবঞ্চনাও।
বারোটা বাজে একবার—তাদের জন্য তা বাজছে দীর্ঘকাল। এখন সময়, সেই শব্দ শুনে স্থান ছেড়ে দেওয়ার।
সবশেষে বলতে চাই, বিএনপির সমস্যার সমাধানই কিন্তু দেশের সর্বাঙ্গীন সমাধান নয় বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং বহুপ্রতিষ্ঠিত সমস্যা দ্বারা বিপর্যস্ত। দুর্নীতি, মতপ্রকাশের সংকট, প্রশাসনিক অবনতি, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং নেতৃত্বহীনতা দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের পথে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে সাধারণ জনগণের বিশ্বাস হ্রাস পাচ্ছে, যা গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ।
তবে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও রয়েছে। প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সংকল্প, স্বচ্ছ প্রশাসনিক সংস্কার, দুর্নীতি দমনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। নতুন ও যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা দেশের উন্নয়নকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারে।
বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের এই প্রতিবেদন এক সুস্পষ্ট আহ্বান—সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রকৃত সংস্কার ছাড়া দেশের প্রগতি সম্ভব নয়। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য। এই প্রতিবেদন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেমিক এবং সচেতন নাগরিকেরা সম্মিলিত উদ্যোগে পরিবর্তনের বাণী ছড়িয়ে দেবেন, তবেই বাংলাদেশকে একটি মুক্ত, সমৃদ্ধ এবং স্বচ্ছ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
মত দ্বিমত
ব্যাংক খাতের সংকট উত্তরণের দশ উপায়

সম্প্রতি বড় অংকের মূলধন ঘাটতির কারণে নিজেদের অ্যাকাউন্ট ফাইনাল করতে পারছে না ১৯টি ব্যাংক। ফলে বড় ধরণের বেকায়দায় পড়েছে ব্যাংকগুলো। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর তারল্য সংকটে পড়ে এসব ব্যাংক। গ্রাহকদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের অবস্থাও ছিলনা কোন কোন ব্যাংকের। নানা রকম গুজবের কারণে কোন কোন ব্যাংকে গ্রাহকরা নিজেদের জমানো টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যংক তারল্য সুবিধা দিয়ে এসব ব্যাংককে সহযোগিতা দিলেও মূলধন ঘাটতির সমস্যা সমাধান হয়নি।
পালাতক আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্ণীতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বিনিয়োগ গ্রহণ, বেনামী বিনিয়োগ ও কোন ডকুমেন্ট বিহীন অর্থ লুটের কারণেই সৃষ্টি হয় এমন বিপর্যয়কর অবস্থা। এ লেখায় ব্যাংক খাতের সমস্যার কারণ ও তা প্রতিকারের কিছু উপায় আলোচনা করব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্যংক খাত ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। আশির দশকে বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংক গড়ে ওঠায় ব্যাংক খাত উন্নত হতে থকে। গড়ে উঠতে থাকে ছোট-বড় নানান শিল্প কারখানা। বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে।
২০০৮ সালের পর দেশের অর্থনীতির উপর শ্যেন দৃষ্টি পড়ে অর্থলোলুপ গোষ্ঠীর। পতিত স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট একটি শ্রেণী অর্থনীতি ধ্বংসের নীলনকশা আঁকতে থাকে। তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দখল করে একের পর এক ব্যাংক। দখল করে নেয় বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ও সুশৃঙ্খল ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কটি ব্যাংক। তাদের ব্যাংক পরিচালনার যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার বিষয় বিবেচনা করা হয় না। রাতারাতি ব্যাংকের মালিক বনে গিয়ে তারা আকর্ষণীয় মুনাফার প্রলোভন দিয়ে ব্যাংকে আমানত রাখতে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে। এক পর্যায়ে জনগণের জমানো অর্থ নিয়ম ভঙ্গ করে তারা নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করে।
আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। পরিচালকরা পরস্পরকে সহযোগিতা করে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে দিতে। এভাবে ব্যাংক খাত থেকে নিয়ম বহির্ভুতভাবে তারা বের করে নেয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। (২৭ আগস্ট ২০২৪, দ্যা ডেইলি স্টার)। এসব পরিচালকদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক আশির্বাদপুষ্ট। ব্যবসায়িক হিসাব, আর্থিক পরিস্থিতি ও ব্যাংকিং নীতি বিবেচনায় নিলে এই ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর বেশিরভাগই ঋণ পাওয়ার যোগ্য ছিল না। তাই তারা একে অপরকে ঋণ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিচালক তার নিজ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট অংকের বেশি ঋণ নিতে পারেন না। এই নিয়ম ফাঁকি দিতেই তারা নিজের ব্যাংক থেকে অপরকে ঋণ দেওয়ার ধূর্ত পদ্ধতি বেছে নেন।
এছাড়া বিভিন্ন নামে বেনামে কোম্পানী খুলে ভুয়া ঋণ গ্রহণ করেছে অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক পরিচালক। তারা গড়ে তুলেছে অদৃশ্য মাফিয়া চক্র। বিভিন্ন প্রলোভন ও টোপ দিয়ে ব্যাংকের অসাধু কিছু কর্মকর্তাকে হাত করে তারা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যেসব ব্যাংকার তাদের অনিয়মের বিরোধিতা করেছে তাদেরকে ব্যাংক থেকে বিতাড়ন, পুলিশি হয়রানিসহ নানানভাবে হয়রানি করা হয়েছে। এসব লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংক খাত থেকে বের করে নিয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় এসব ঘটনা ঘটেছে। (যুগান্তর ১৩ আগস্ট ২০২৪)
এর বাইরে খেলাপী ঋণ ব্যাংক খাতের গলার কাটা। পরিচালকদের এই বড় ধরণের অনিয়মের পাশাপাশি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকা যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২০.২০ শতাংশ (বাংলাট্রিবিউনডটকম ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেয়া এসব ঋণ ও খেলাপী ঋণের বেশিরভাগই পাচার হয়েছে দেশের বাইরে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকারের নেতা ও তাদের দোসর ব্যবসায়ীরা ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। (প্রথম আলো ২ ডিসেম্বর ২০২৪)। অর্থাৎ বছরে গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ব্যাংক থেকে পুনঃপুন অর্থ লোপাটের এসব খবরে গ্রাহকদের মনে দানা বেঁধেছে ভয় এবং হতাশা। ফলে তারা ব্যাংকে জমানো টাকা নিজেদের হাতে সংরক্ষণ করছেন। একদিকে অর্থ পাচার ও খেলাপী ঋণ অন্যদিকে আতঙ্কিত গ্রাহকদের টাকা উত্তোলনের ফলে ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের তারল্য সংকট।
পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখতে পায় ব্যাংক খাত। আর্থিক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদকে গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রতিটি বেদখল হওয়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন নতুন পর্ষদ। এসব পর্ষদ কাজ করছে খাদের কিনারা থেকে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের জন্য। ১৫ বছরের অপশাসন ও লুটপাটে ধ্বংসের দারপ্রান্তে ব্যাংক খাত। এ অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে ফিরিয়ে আনতে এই দশটি উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
প্রথমত: ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনুকূল কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অসাধু, অযোগ্য ও জাল সনদে চাকরি প্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারি অপসারণ করে সৎ, দক্ষ ও পেশাদার ব্যাংকারদের পদায়ন করলে গ্রাহকবান্ধব ব্যাংকিং সেবা প্রদান সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত: যারা নামে বেনামে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে বিদেশে পাচার করেছে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক বসিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়ত: রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যারা অস্ত্রের মুখে ব্যাংক দখল করেছিল সেসব দখলদারদের সকল শেয়ার এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে ব্যাংকের টাকা পরিশেধের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রকৃত মালিকদের হাতে ব্যাংকগুলো ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
চতুর্থত: যেসব পরিচালক নিয়ম ভেঙে নিজ ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংক থেকে নামে বেনামে বিনিয়োগ নিয়ে খেলাপী হয়েছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তারা যে টাকা ব্যাংক থেকে নিয়েছে তা ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
পঞ্চমত: ব্যাংকগুলোতে ঋণ খেলাপীদের তালিকা তৈরি করে তা প্রকাশ করা এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
ষষ্ঠত: যেসব ব্যাংকের টাকা অন্য ব্যাংকে আমানত (প্লেসমেন্ট) হিসেবে রাখা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পাওনাদার ব্যাংককে এসব টাকা ফেরত দেয়ার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সপ্তমত: দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরাদের দোসর ব্যাংক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
অষ্টম পদক্ষেপ হিসেবে ব্যংকগুলো থেকে কি পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে তার সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং যারা এসব কাজে জাড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
নবম পদক্ষেপ হিসেবে লুটেরাদের নিষ্পেষণে যেসব ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সেই ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত তারল্য সরবরাহ করতে হবে। এবং দশম পদক্ষেপ হিসেব ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির অর্থ যেমন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় লুট হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে হবে যেন লুটেরাদের নিয়ে যাওয়া ভুয়া বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংকের কোন প্রভিশন সংরক্ষণ করা না লাগে।
আগামীতে যেন কেউ এভাবে ব্যাংক দখল করতে না পারে সেজন্য ব্যাংকবান্ধব আইন প্রণয়ন করতে হবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দেশের ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: রিয়াজ উদ্দিন, ব্যাংকার। riyazenglish@gmail.com