মত দ্বিমত
সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৩ বছর অতিক্রম করলেও, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। বরং, ক্রমবর্ধমানভাবে দেশের জনগণ প্রতিবেশী দেশগুলোর—বিশেষত ভারতের, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের—স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই নির্ভরশীলতা কেবল দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঘাটতি তৈরি করেনি, বরং দেশের অর্থনীতির ওপরও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। চিকিৎসা সেবার জন্য প্রতিটি বছর লক্ষাধিক বাংলাদেশি বিদেশে যাত্রা করে, যার ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় হচ্ছে। এটি শুধু জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই অবনতি তৈরি করছে না, একইসঙ্গে স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নেও বাধার সৃষ্টি করছে।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সংকটকে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সংকট হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। দেশের নেতৃবৃন্দের কাছে এটি বড় কোনো সমস্যা না হলেও, দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এই সংকটের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা বিশেষভাবে দুঃখজনক এবং শহুরে এলাকার মানুষও প্রতিদিন ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন। কিন্তু নেতাদের কাছ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপের দেখা মেলেনি। তাদের দৃষ্টি বিদেশি চিকিৎসকদের ওপর, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব যেন সেখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে, জনগণের আস্থা ক্রমাগত ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং তাদের নিজস্ব স্বাস্থ্য সেবায় আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।
সুইডেনের উদাহরণ: একটি সফল স্বাস্থ্যসেবা মডেল:-
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সুইডেন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে তার উদাহরণে অনুপ্রাণিত করে, বিশেষ করে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং বিকেন্দ্রীকৃত স্বাস্থ্যসেবা মডেলের মাধ্যমে। সুইডেনে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা স্থানীয় পর্যায়ে পরিচালিত হয়। প্রতিটি এলাকার স্থানীয় কাউন্সিল বা পৌরসভাগুলো স্বাধীনভাবে তাদের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে থাকে। এই মডেল, সুইডেনের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন, জনগণের আস্থা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এছাড়াও, সুইডেনের পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস এবং জাপানও বিকেন্দ্রীকৃত স্বাস্থ্যসেবা মডেল প্রয়োগ করে উন্নত সেবা প্রদান করছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শুধু সেবার প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায় না, বরং জনগণের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা পরিচালনার ফলে কর্মক্ষেত্রেও উন্নতি আসে, যা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র:-
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যধিক কেন্দ্রীভূত, যার ফলে রাজধানী ঢাকা অতিরিক্ত চাপের শিকার। প্রতি বছর ঢাকায় রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ঢাকার হাসপাতালগুলো চাপের মুখে পড়ে রীতিমতো সীমিত সামর্থ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে অত্যধিক চাপ এবং রোগীর দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে সেবা দেওয়ার গুণগত মান কমে যাচ্ছে, যা একদিকে রোগীদের জন্য একটি বড় দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরদিকে, গ্রামীণ এলাকার হাসপাতালগুলো অবকাঠামো এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে ভুগছে। অধিকাংশ গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং উপজেলা হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নেই, ফলে গ্রামের মানুষরা উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসকদের অভাব এবং তাদের সীমিত প্রশিক্ষণ এই সমস্যাকে আরও প্রকট করছে। বিশেষ করে, গ্রামের অদূরে এবং দুর্গম এলাকায় চিকিৎসা সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনকি যেখানে কিছু হাসপাতাল আছে, সেখানেও সেবা পর্যাপ্ত নয়, যা জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
এছাড়া, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থার ঘাটতির একটি অন্যতম উদাহরণ। দেশীয় হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে তারা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের হতাশা এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। এর ফলে স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য যথাযথ বিনিয়োগ ও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। জনগণ দেখতে পাচ্ছে যে, দেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজস্ব সুবিধার্থে বিদেশি চিকিৎসা ব্যবস্থা বেছে নিচ্ছেন, যার ফলে স্থানীয় স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের উৎসাহ কমে যাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের সংকটের কারণেই স্বাস্থ্যসেবা খাতে পরিবর্তন ও সমাধানের জন্য বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান:-
সুইডেনের সফল স্বাস্থ্যসেবা মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একটি সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। বিকেন্দ্রীকরণের পথ বেছে নিলে আমরা দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবো। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সহজ এবং প্রভাবশালী হবে।
১. স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতায়ন: স্থানীয় প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার এমপিদের তাদের নিজ এলাকায় বসবাস করা এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি তাদের সরাসরি জনগণের সমস্যার মুখোমুখি করবে এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে আরও তৎপর করে তুলবে।
২. অবকাঠামোগত উন্নয়ন: গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে, গ্রামের মানুষও উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবেন, যা তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করবে।
৩. স্বাস্থ্যসেবায় নৈতিক চর্চা প্রতিষ্ঠা: স্বাস্থ্য খাতে নৈতিকতার উন্নতি ও স্বচ্ছতার জন্য কঠোর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। চিকিৎসকদের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক নিরসন করতে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে কড়া তদারকি প্রয়োজন। এটি জনগণের আস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে।
৪. ঢাকার ওপর চাপ কমানো: বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকায় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং অন্যান্য মৌলিক পরিষেবাগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বিকল্প আঞ্চলিক কেন্দ্র গড়ে তুলে ঢাকার ওপর চাপ কমানো যেতে পারে। এতে উন্নত পরিষেবাগুলো শহরের বাইরেও সহজলভ্য হবে এবং গ্রামীণ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক উপকারিতা ও সামাজিক উন্নয়ন:-
স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন দেশের জনগণের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হলে, দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিমাণ কমে যাবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করবে। প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ যেমন ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে চলে যায়, যার ফলে দেশের অর্থনীতির উপর বিরাট চাপ পড়ে। এই অর্থ যদি দেশের মধ্যে থাকে, তবে তা দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে এবং স্থানীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার পথ খুলবে।
এছাড়া, স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন শহর ও গ্রামীণ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করবে। স্বাস্থ্যসেবার দ্রুত ও সহজলভ্য পৌঁছানোর মাধ্যমে জনগণের শারীরিক সুস্থতা এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
স্বাস্থ্যসেবায় আন্তঃপেশাগত সহযোগিতা ও বৈশ্বিক দক্ষতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা:-
একটি আধুনিক ও কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে চিকিৎসক, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কেমিস্ট, নার্সসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা অপরিহার্য। এই সহযোগিতা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে না, বরং বৈশ্বিক দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। পেশাজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কাজের সুযোগ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে, তারা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করবে।
এ ধরনের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ পেশাজীবীদের জন্য দুটি উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনবে:
১. বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি: দক্ষ পেশাজীবীরা বিশ্বের যেকোনো দেশে চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের গৌরব বৃদ্ধি করবে এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত করবে।
২. রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি: এই দক্ষ মানবসম্পদ বিদেশে কাজ করার মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে হলে, দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। দেশের মানুষ যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় সেবা গ্রহণে আগ্রহী হয়, তবে তা স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করবে। এর ফলে, চিকিৎসকসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা দেশে থেকেই কাজ করতে আরও আগ্রহী হবে।
একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য পেশাজীবীরা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যখাত শক্তিশালী হবে। এটি দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে শুধুমাত্র উন্নত করবে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগও সৃষ্টি করবে।
উপসংহার:-
বাংলাদেশের জন্য স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ শুধুমাত্র একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নয়; এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের মৌলিক দায়িত্ব। দেশের প্রতিটি নাগরিক, তাদের অবস্থান যাই হোক না কেন, সমান স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রাখে। এটি একটি মানবিক ও সমতাভিত্তিক সমাজের প্রাথমিক শর্ত। সুইডেনের মতো একটি সফল মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশ তার স্বাস্থ্যসেবা খাতকে শক্তিশালী করতে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে।
বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্যখাতে নানা ধরনের দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, ভেজাল ওষুধ, মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি এবং সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থার গুণগত মান একেবারে নড়বড়ে। তাই সরকারকে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে উদ্যোগী হতে হবে এবং স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে, রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনকে যৌথভাবে একসাথে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি, একটি কার্যকর মনিটরিং সিস্টেম এবং দুর্নীতি রোধকল্পে দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন সম্ভব। এখনই সময় সাহসী এবং সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার, যাতে আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিক তার প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিতে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পায়। যেন আর কারও জন্য বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটতে না হয়, বরং বাংলাদেশে তাদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত হয়। তাছাড়া বিদেশি চিকিৎসার উপর ভরসা করলে তো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হবে না। এই পদক্ষেপগুলো যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি স্বাস্থ্যবান, সুখী জাতি—যা বিশ্বে তার উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য পরিচিতি লাভ করবে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

মত দ্বিমত
সাহাবুদ্দীন আহমদের আয়নায় রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার হারানো মানচিত্র

দেশ যখন দুঃসময়ে, নেতৃত্ব যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন কিছু নাম, কিছু জীবনচর্যা আমাদের সামনে উঠে আসে আলো হয়ে—অন্ধকারে পথ দেখানোর জন্য। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন তেমনই এক মানুষ, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আজও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এক পরিপাটি নৈতিক সংবিধান হয়ে আছে।
এই মানুষটিকে স্মরণ করা মানে কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতায় সততা ও সংযমের চর্চা ফেরত আনার আহ্বান। আজকের বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে ব্যক্তি সুবিধার সমার্থক করে ফেলেছে, তখন সাহাবুদ্দীন আহমদের জীবন যেন আমাদের মুখের ওপর একটি বিপরীত, নির্মম প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—ক্ষমতা কী শুধুই ভোগের জন্য?
তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন দেশের ইতিহাসের এক চরম সংকটকালে। তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাঁকে নিরপেক্ষ অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বসেও তিনি কখনো বঙ্গভবনের আড়ম্বর নিজের জীবনে ঢুকতে দেননি। রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত গাড়ি, পোশাক, আয়োজন—সবকিছুর ভেতরে তিনি খুঁজে নেন ন্যূনতমের সৌন্দর্য। নিজের পরিবারের প্রতিদিনকার বাজারের খরচ পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে দিতেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিতেন না।
একবারের জন্যও তাঁর স্ত্রী বঙ্গভবনে আসেননি। সন্তানরা থেকেছেন আড়ালে, রাষ্ট্রীয় সুবিধার ছায়া পর্যন্ত গায়ে লাগতে দেননি। তাঁর বিদেশে থাকা ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলার বিল সতেরশো টাকা—সেটিও নিজে দিয়েছেন, রাষ্ট্রকে দেননি। ভিডিও ক্যাসেট বানিয়ে রাষ্ট্রপতির ভাষণ সংরক্ষণ করতে চাইলেও রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে কিছু না নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনকে দিয়েছেন নিজের কেনা ক্যাসেট।
এই সংযমের চর্চা কেবল কাগজে-কলমে নয়, জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটিতে। এমনকি সহকর্মী বিচারপতির পর্দার কাপড়ের দাম বেশি পড়ে গেলে, তিনি বলেন: “আপনি সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে দিন, বাকিটা সরকার দেবে।” রাষ্ট্রীয় খরচে সৌখিনতা বরদাশত নয়—এই ছিল তাঁর নীতিতে কঠোরতা।
এই জীবনের গায়ে কোনো রাজনীতির গন্ধ ছিল না, ছিল শুধু এক শুদ্ধ মানুষের নীরব প্রতিজ্ঞা—রাষ্ট্র আমার সুবিধার উৎস নয়, এটি আমার দায়বদ্ধতার মঞ্চ। তিনটি রাজনৈতিক জোট যখন তাঁকে অনুরোধ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে, তিনি তখনও বলেন, “আমি এই শর্তে রাজি—যে নির্বাচনের পর আমি যেন ফিরে যেতে পারি প্রধান বিচারপতির পদে।”
আজকের বাংলাদেশে যাঁরা একবার ক্ষমতায় বসেন, তাঁরা আর নামতে চান না। কিন্তু সাহাবুদ্দীন আহমদ নিজে চাইছিলেন ফিরে যেতে তাঁর আসল জায়গায়—যেখানে তিনি আইন রক্ষা করতেন, নীতি রক্ষা করতেন, নিজের আত্মাকে রক্ষা করতেন।
তাঁর সন্তানরাও বাবার মতোই ছিলেন মিতভাষী, আত্মপ্রবঞ্চনামুক্ত, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অপ্রবেশকারী। কলকাতায় রাষ্ট্রপতির মেয়েরা সরকারি গাড়িতে উঠতে রাজি হননি, সাধারণ গেস্টহাউসে থেকেছেন, শপিং মলে গিয়ে কাপড় কেনার সময় ভেবেছেন—বাবা যদি দাম বেশি দেখে, পরে হয়তো গ্রহণই করবেন না! ভাবা যায়, এমন এক রাষ্ট্রনায়কের সন্তান?
সাহাবুদ্দীন আহমদের এই গল্পগুলো আজ প্রজন্মের কাছে যতটা বিস্ময়কর, ততটাই অনুপ্রেরণার। অথচ এই দেশ তাঁকে নিয়ে বড় কোনো প্রচারণা চালায়নি। আমরা জানি ভারতের এপিজে আবদুল কালামকে। জানি কেন তিনি জনপ্রিয়। অথচ আমাদের নিজস্ব সাহাবুদ্দীন আহমদ আজও নিভৃত এক কিংবদন্তি—শ্রদ্ধায় নয়, অবহেলায় ঢাকা।
এমন এক মানুষ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে একবার এসেছিলেন, যেন বলে দিয়ে যান—রাষ্ট্রপ্রধান মানেই আড়ম্বর নয়, ভোগ নয়; রাষ্ট্রপ্রধানও হতে পারেন সাদামাটা, স্বচ্ছ এবং এক আদর্শে প্রতিষ্ঠিত সাধক। আজ এই কথাগুলো শোনা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে, কারণ চারদিকে আমরা যা দেখছি তা হলো ঠিক উল্টো—লুটপাট, আত্মীয়প্রীতি, এবং আত্মসুখের রাষ্ট্রায়ন।
এই মুহূর্তে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাঁরা দায়িত্বে আছেন—তাঁদের জন্য সাহাবুদ্দীন আহমদ কেবল একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি নন; তিনি এক আয়না, যার সামনে দাঁড়ালে নিজেদের মুখ দেখা যায়। যারা সত্যিকারের জনসেবক হতে চান, তাঁদের উচিত সাহাবুদ্দীনের জীবন অধ্যয়ন করা — দেখার জন্য, ক্ষমতার চূড়ায় থেকেও কেমন করে একজন মানুষ সংযম, সততা ও আত্মমর্যাদাকে জীবনের একমাত্র পোশাক বানিয়ে নিতে পারেন।
আমরা এখন এমন এক সময়ে আছি, যেখানে বিশ্বাস ও আস্থার সংকট, দায়িত্বে নৈতিকতার অনুপস্থিতি, আর নেতৃত্বে আত্মনিমগ্নতার ব্যাধি প্রকট। এই মুহূর্তে সাহাবুদ্দীন আহমদের জীবনের গল্পগুলো ছড়িয়ে দেওয়া শুধু অতীত চর্চা নয়—এটা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি।
আমরা যদি কখনো সত্যিকারের নেতৃত্বের সন্ধান করতে চাই, সাহাবুদ্দীন আহমদের মতো মানুষের দিকে তাকাতে হবে—যিনি ক্ষমতার শিখরে থেকেও মাথা নিচু রেখেছিলেন, নিজের পরিবারকেও রেখেছিলেন নীতির নিচে।
এই দেশে সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন—এটা আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু যদি তাঁকে অনুসরণ না করি, তাহলে সে সৌভাগ্যই একদিন হয়ে উঠবে এক অবর্ণনীয় আফসোস।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও সততা: সত্যিকারের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি

গণতন্ত্র শব্দটি উচ্চারণ করা যত সহজ, তার নৈতিক ভার বহন করা ততটাই কঠিন। আমরা প্রায়শই গণতন্ত্রকে বুঝি একটি নির্বাচনী পদ্ধতি হিসেবে—যেখানে জনগণ ভোট দেয়, সরকার গঠিত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণ করে নীতি। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি গড়ে ওঠে অসৎ, প্রভাবশালী কিংবা অর্থবিত্তনির্ভর প্রার্থীদের মধ্যে, যারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব নয় বরং ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে আসে—তবে সেটি গণতন্ত্রের বিজয় নয়, বরং তার পরাজয়।
নির্বাচন তখন কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে ভোটের বাক্সে পড়ে থাকে মানুষের প্রত্যাশা, অথচ উত্থিত হয় দুর্নীতির দাপট, গোষ্ঠীস্বার্থের বিভাজন আর নৈতিক শূন্যতা। কেবল ভোট গ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না—যদি সেই ভোটে জনগণের সামনে প্রকৃত পছন্দ না থাকে, যদি প্রার্থী বাছাই হয় অনৈতিক, দলীয় সুবিধা ও টাকার বিনিময়ে—তবে গণতন্ত্রের ভিত নিজেই ধসে পড়ে।
একটি মানচিত্র রাষ্ট্র হতে পারে মাত্র কাগজে-কলমে, কিন্তু একটি জাতিকে গণতান্ত্রিক করতে হলে চাই এমন নেতৃত্ব, যারা জনগণের হৃদয় থেকে উঠে আসে। চাই এমন নেতৃত্ব, যার ভিত্তি নীতিতে, দায়বদ্ধতায় ও মানবিকতায় গাঁথা। কারণ গণতন্ত্র কেবল ভোটের সংখ্যা নয়—গণতন্ত্র মানে মানুষের প্রতি আস্থা, নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা, এবং ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতি।
গণতন্ত্রের কথা যখন বলি, তখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ব্যালট বাক্স, ভোটার সারি, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক রূপরেখা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দৃশ্যপটটি কি যথেষ্ট?
একটি ভোটগ্রহণ যদি নিয়মমাফিক, শান্তিপূর্ণ ও সময়মতো অনুষ্ঠিত হয়, তবু যদি সেই নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়া হয় অনৈতিক, স্বার্থান্বেষী এবং পুঁজিশ্রেণিনির্ভর, তাহলে সেই গণতন্ত্রের ভিত কতটা দৃঢ়? গণতন্ত্র কি কেবল সেই কাঠামো, যেখানে টাকার জোর, গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও দলীয় আনুগত্যই মনোনয়নের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়? তাহলে সেখানে জনগণের ভূমিকা কী? একজন ভোটার কি শুধু সংখ্যার অংক, না কি তিনি জাতির নৈতিক ভবিষ্যতের রচয়িতা? নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যদি জনগণের সামনে প্রকৃত বিকল্প না থাকে—যদি প্রার্থী বাছাই হয় সৎ, যোগ্য ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে নয়, বরং দুর্নীতি, ভয় এবং ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায়—তাহলে সেই গণতন্ত্র একটি নিঃসাড় প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাষ্ট্র গঠন করা যায় সীমান্ত টেনে, পতাকা টাঙিয়ে, সংবিধান লিখে। কিন্তু একটি জাতিকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক জাতিতে রূপ দিতে হলে চাই নৈতিকতা, যোগ্যতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নেতৃত্ব। চাই এমন নেতৃত্ব, যারা জনগণের ভালোবাসা অর্জন করে; যারা ব্যালট পায় ভয় দেখিয়ে নয়, আস্থা জাগিয়ে। কারণ গণতন্ত্র মানে কেবল সরকার গঠন নয়—গণতন্ত্র মানে মানুষের মর্যাদা, ভবিষ্যতের প্রতি নৈতিক দায়, আর নেতৃত্বের চরিত্রের ওপর জাতির বিশ্বাস স্থাপন।
কেমন প্রার্থী চাই—জনগণের প্রতিনিধি না হলে কিসের গণতন্ত্র? গণতন্ত্র কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি হলো বিশ্বাস ও প্রতিনিধিত্বের পবিত্র চুক্তি।
কিন্তু সেই চুক্তি তখনই অর্থহীন হয়ে যায়, যখন নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীরা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন না—বরং হয়ে ওঠেন দল, ধনিকশ্রেণি বা গোষ্ঠীস্বার্থের বাহক।
প্রকৃত গণতন্ত্র চায় মানবিক, বিবেকবান, এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব—যেখানে একজন প্রার্থীর পরিচয় হবে তাঁর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সততা, জবাবদিহি ও জনসেবার মানসিকতা দিয়ে।
একজন যোগ্য প্রার্থীর মধ্যে থাকতে হবে:
• জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবার সাহস,
• এলাকার সমস্যা বোঝার জ্ঞান ও আন্তরিকতা,
• সংসদে গিয়ে নীতিনির্ধারণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা,
• এবং—সবচেয়ে জরুরি—নিজেকে দেশ ও মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার অটল মানসিকতা।
তিনি জনপ্রিয় নন, হবেন প্রাসঙ্গিক। তিনি বড় পোস্টারে নয়, থাকবেন মানুষের বিশ্বাসে। তাঁর পরিচয় হবে না কোনো মিডিয়া-মেড প্রভাবশালী নেতা হিসেবে, বরং তিনি হবেন আস্থা, সততা ও সক্রিয় দায়বদ্ধতার প্রতীক।
তিনি দলীয় সিদ্ধান্তে মনোনীত হবেন না, তাঁকে মনোনীত করবে জনতার বিবেক। এবং এটি কোনো কল্পলোকের আকাশকুসুম ভাবনা নয়—এটি আমাদের ন্যায্য দাবি। জনগণের দাবি, গণতন্ত্রের দাবি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দাবি। কারণ, যদি প্রতিনিধি না হন জনগণেরই, তবে তিনি কিসের প্রতিনিধি?
যদি তাঁর হৃদয়ে না থাকে মানুষের জন্য ব্যথা, তবে তাঁর হাতে ব্যালট তুলে দেওয়া মানে নিজেদের ভাগ্য নিজ হাতে নষ্ট করা। গণতন্ত্রকে যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র করতে হয়, তাহলে নেতা হতে হবে আদর্শের, প্রতিশ্রুতির, এবং সেবার প্রতীক—ক্ষমতার নয়।
ভয়মুক্ত ভোটাধিকার—গণতন্ত্রের প্রাণস্পন্দন। একটি সত্যিকারের গণতন্ত্রের মূলে আছে ভোটারদের ভয়মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচনাধিকারের মর্যাদা। কোনো নাগরিক যেন কোনো ভয়, হুমকি, দমনে বা লোভ-প্রলোভনে আটকা পড়ে ভোট দিতে বাধ্য না হয়—এটাই হতে হবে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অপরিহার্য শর্ত। ভোটার যখন ভোট দেয়, তখন তাঁর হাতে থাকতে হবে একটি শক্তিশালী অস্ত্র—বিবেকের স্বাধীনতা ও গর্বের অনুভূতি। ভোট হতে হবে ভয়ভীতির নয়, বরং নিশ্চিত বিশ্বাসের প্রকাশ। আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ভোটারের পছন্দের ওজন আছে, তাঁর ভোটের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, এবং তাঁর ভোটই নির্ধারণ করে দেশের ভবিষ্যৎ পথচলা। কেউ যেন না বলে—“আমার ভোট কোনো কিছু বদলাতে পারে না।”
ভোটের আগে ছড়িয়ে পড়তে হবে ভয়ের নয়, আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহের জোয়ার। ঘরে ঘরে, কমিউনিটি থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র যেন শোনা যায়—“আমি ভোট দেব কারণ আমি বিশ্বাস করি।” এমন বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য দরকার এমন প্রার্থী, যাঁরা সত্যিকার অর্থে জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন, যাঁরা ভোটারের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। ভয়মুক্ত ভোটাধিকার হলে গণতন্ত্র বাঁচে, শক্তিশালী হয়, এবং মানুষের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়। এটাই হবে আমাদের ন্যায্য অধিকার, আমাদের জাতির গৌরব।
এই অচল অবস্থা থেকে উত্তরণের পাঁচটি রূপান্তরমূলক পথ;
গণতন্ত্রের বর্তমান সংকট কোনো সাময়িক সমস্যা নয়—এটি একটি নৈতিক, কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চাইলে শুধু প্রতিরক্ষা নয়—পুনর্নির্মাণ করতে হবে গণতন্ত্রকে, গড়ে তুলতে হবে এমন এক কাঠামো যা নেতৃত্বে আনে সততা, প্রজ্ঞা ও জনকল্যাণ। এ জন্য জরুরি পাঁচটি নির্ভুল ও অনিবার্য পরিবর্তন—যা একযোগে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক অংশগ্রহণকে নতুন করে গড়ে তুলবে:
১. নৈতিক নীতিমালা-ভিত্তিক মনোনয়ন প্রক্রিয়া: রাজনীতিতে নৈতিক ফিল্টার চাই।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবকাশ নেই। তাদের অবশ্যই এখনই যৌথভাবে একটি ন্যূনতম নৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যার ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া হবে। অতীতে দুর্নীতি, সহিংসতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িত—এমন কেউ মনোনয়নের যোগ্য হতে পারেন না। নৈতিকতা আর দলীয় আনুগত্যকে এক পাল্লায় তোলা যাবে না। এই শর্তটি হতে হবে অনড়, অচলযোগ্য এবং সর্বজনগ্রাহ্য।
২. নির্বাচন কমিশনের তথ্য যাচাই ও সর্বজনীন উন্মোচন: গোপন নয়, স্বচ্ছতা চাই।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু ভোট আয়োজন নয়, নির্বাচনের নৈতিক কাঠামো নিশ্চিত করাও তার কাজ। প্রার্থীদের আর্থিক, সামাজিক ও আইনগত পটভূমি—সহ সব তথ্য কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে। এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, যাতে ভোটাররা অন্ধ নয়, সচেতনভাবে ভোট দিতে পারেন। ভোটার যেন জানেন—আমি যাকে ভোট দিচ্ছি, সে কে? তাঁর অতীত কী? তাঁর জনসেবা কতটা প্রমাণিত?
৩. “Public Scrutiny Platform”: জনগণের হাতে নেতার হিসাব চাই।
একটি স্বাধীন ও সর্বজনসম্পৃক্ত “Public Scrutiny Platform” গঠনের আহ্বান জানাতে হবে, যেখানে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ মিলে প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে পারবে। এটি হবে নাগরিক পর্যায়ে একটি জবাবদিহিমূলক শক্তি, যেখান থেকে কেউ রেহাই পাবে না। রাজনীতিকে বাঁচাতে হলে—নেতাদেরও মানুষের সামনে দাঁড়াতে হবে খোলা হাতে ও খোলা চোখে।
৪. রাজনৈতিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে সংযুক্তি: সচেতন নাগরিক ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন।
রাজনৈতিক অশিক্ষা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। আজ আমাদের দরকার রাজনৈতিক সাক্ষরতা (Political Literacy)—যাতে নতুন প্রজন্ম বুঝে তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও রাষ্ট্রের কাঠামো। এই বিষয়টি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যেন ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে কেবল পাস নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরীক্ষায়—নাগরিকত্বে—পাস করতে পারে।
৫. তরুণ সমাজ ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নৈতিক জাগরণ: নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনুক তার আসল রূপ।
এই সময়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তরুণদের বিবেক ও তাদের প্রশ্ন করার সাহস। তাঁরা শুধু ভোটার হয়ে থাকবে না—হবে পরিবর্তনের মূল চালক। তাঁরা প্রচার চালাক, বিতর্কে যুক্ত হোক, সৎ প্রার্থীর জন্য গণজোয়ার তৈরি করুক—এভাবেই শুরু হবে নতুন ধারার রাজনীতি। নেতৃত্ব কেবল অভিজ্ঞতায় নয়—নৈতিকতাতেও জন্ম নিতে পারে, এবং সেই জন্ম দিতে পারে আজকের শিক্ষার্থী, আজকের তরুণ, আজকের সোচ্চার নাগরিক। এই পাঁচটি স্তম্ভ দিয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি নৈতিক, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক গণতন্ত্র। এটা কোনো স্বপ্ন নয়, এটা এখন সময়ের দাবি। এবং এই দাবির পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস আজ আমাদের সবার থাকা উচিত। আমরা কী চাই—সুন্দর নির্বাচন, না সৎ নির্বাচন?
আমরা যেন আর কেবল “সুষ্ঠু নির্বাচন চাই” এই নিরাপদ বাক্যে আটকে না থাকি। আমরা বলি—“আমরা চাই এমন নির্বাচন, যেখানে প্রার্থীরা হবেন নৈতিক, যোগ্য ও জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি।” আমরা আর “কম খারাপ” কে বেছে নেওয়ার সংস্কৃতি চাই না। আমরা চাই, “সেরা মানুষটি”—সততার প্রতীক, জনসেবার সৈনিক, মানুষের আশা ও আস্থার বাহক—তাঁর হাতে তুলে দিতে দায়িত্ব।
এই সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি নৈতিক।এটি কেবল একটি ভোট নয়—এটি একটি জাতির আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তখনই ফুটে ওঠে, যখন তা কেবল নিয়ম নয়—প্রতিটি মানুষের মঙ্গলচিন্তার আঙিনায় দাঁড়ায়। এবং সেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ তখনই উজ্জ্বল, যখন নেতৃত্বের ভিত্তি হয় সততা, দায়িত্ব ও ভালোবাসা। গণতন্ত্র মানে কেবল ব্যালট নয়—এটি বিবেকের প্রতি শ্রদ্ধা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, এবং সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস।
রাজনীতি যদি সৎ মানুষের জায়গা না হয়, তবে অসৎ মানুষের আসন নিশ্চিত হয়। যেখানে ভালো মানুষ চুপ থাকে, সেখানেই দুর্নীতি কথা বলে। এখনই সময়—নির্বাচনের নামে চলা প্রহসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। এখনই সময়—যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও সততার পক্ষে কণ্ঠ মেলানোর। গণতন্ত্রকে রক্ষা করার একটাই উপায়— তাকে নৈতিকতা দিয়ে পূর্ণ করা, মানুষ দিয়ে অর্থবহ করা, এবং বিবেক দিয়ে পরিচালিত করা।
রহমান মৃধা
লেখক ও গবেষক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
খাদ্য, নৈতিকতা ও নেতৃত্ব: জাতিকে আলোর পথে নিতে যাঁরা নিঃশব্দে কাজ করছেন

সুইডিশ ভাষায় কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে। এমনই একটি শব্দ ‘livsmedel’—অর্থাৎ ‘জীবনের উপকরণ’। শব্দটি শুধু খাদ্য বোঝায় না, বোঝায় এমন কিছু যা আমাদের পুষ্টি দেয়, শক্তি জোগায়, এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সামর্থ্য গড়ে তোলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের বাজারে আমরা যে খাদ্য কিনছি—তা কি সত্যিই জীবনের উপকরণ? নাকি সেগুলো এমন কিছু, যা ধীরে ধীরে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে রোগব্যাধি, ক্লান্তি, নির্ভরশীলতা আর নিঃশব্দ বিষক্রিয়ার দিকে?
আমরা প্রায়ই বলি, সুইডেন এমন একটি দেশ যেখানে গুণমান (quality) পরিমাণের (quantity) চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘লগোম’—অর্থাৎ পরিমিতিবোধ—এখানে একপ্রকার সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবে, খাদ্যের ক্ষেত্রে আমরা এমন এক বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে পড়েছি, যেখানে ‘লগোম’-এর জায়গা দখল করে নিয়েছে—‘যত সস্তা সম্ভব’, ‘যত দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য’, এবং ‘শিল্পের সুবিধার জন্য যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত’ এই নীতিগুলো।
আজ আমরা সুইডেনে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যে খাবার আমদানি করছি, তা দেখতে যতই ঝকঝকে হোক না কেন, তার পুষ্টিমান প্রায়শই শূন্য। এসব খাবারে থাকে সংরক্ষণের রাসায়নিক, কৃত্রিম রং, স্বাদ বাড়ানোর উপাদান, ফিলার—আরও কত কী! এই তালিকা শুধু দীর্ঘ নয়, দিনে দিনে আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও সুইডেন কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বলছে—livsmedel, এই শব্দটির প্রকৃত মর্যাদা আমাদের ফিরিয়ে আনতেই হবে।
অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে এখনো এমন কোনো সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, যা দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার—‘ভেজালমুক্ত ভাতে-মাছে বাঙালির বাঙালিত্ব’—পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে—আমরা কী চাই? এমন খাদ্য যা সত্যিকার অর্থে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, নাকি এমন কিছু, যা ধীরে ধীরে আমাদের ভেতর থেকে ভেঙে দেয়?
এখানেই আসে স্বনির্ভরতার প্রসঙ্গ। আমাদের সাহস করে বলতে হবে—নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদন করতে না পারলে, স্বাধীনতা অর্থহীন। মহামারির সময় আমরা এক ঝলক দেখেছিলাম—যখন বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন কীভাবে খাদ্যনিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে, সেখানে নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদনের সক্ষমতা শুধু যুক্তিসঙ্গত নয়—জীবনের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দরকার এমন খাবার যা শুধু পেট ভরে না, আমাদের বিশ্বাস, স্বাস্থ্য ও মর্যাদাও রক্ষা করে। আমাদের দরকার নিরাপদ খাবার। প্রকৃত খাবার। এমন খাবার, যার উৎস আমরা জানি—আর যেটি কেবল আহার নয়, এক ধরনের আশ্বাস।
আমি সুদূর প্রবাসে বসে যখন এ রকম একজন মাটি-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখি, তখন এক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে—দেশের মানুষ কেন এমন একজন সম্পদকে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমন একজন দূরদর্শী কৃষিবিজ্ঞানীর আলোর রেখা আমরা জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারছি না?
খাদ্যই উন্নয়নের মূল: কৃষকের পাশে ড. আলী আফজাল এবং একটি জাতির কৃতজ্ঞতা
যেহেতু জীবন ধারণের সবকিছুই শুরু হয় খাদ্য দিয়ে। খাদ্য শুধু আমাদের শরীরের জ্বালানি নয়—এটি মনের বিকাশ, সৃজনশীলতা এবং উন্নয়নের ভিত্তি। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মক্ষমতা ও সমাজব্যবস্থার ভিত্তি ভেঙে পড়ে। একজন রাজনীতিবিদ হোন বা প্রকৌশলী, শিক্ষক হোন বা সেনা সদস্য—সবার অস্তিত্বের পেছনে নির্ভরতা এক জায়গাতেই খাদ্য।
কিন্তু যে মানুষগুলো প্রতিদিন আমাদের এই খাদ্যের নিশ্চয়তা দেন—কৃষক, খামারী, মৎস্যজীবী ও গ্রামীণ পরিশ্রমজীবী জনগোষ্ঠী—তাঁদের অবদান আজও সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায্য সম্মান পায় না। বরং অবহেলা, অনিশ্চয়তা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপে তাঁরা পিছিয়ে থাকেন। এই বাস্তবতায় একজন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে নিরবে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মাগুরার সন্তান, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত কৃষিবিজ্ঞানী, সফল উদ্যোক্তা এবং দূরদর্শী সমাজগঠক—ড. মো. আলী আফজাল।
একজন কৃষকের সন্তান থেকে কৃষি-নেতা হওয়ার গল্প
১৯৬৭ সালের ২২ মার্চ মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. আফজালের শিকড় পল্লির মাটিতে। কৃষকের সন্তান হিসেবে তিনি জানতেন, কৃষির প্রকৃত সমস্যা কী, এবং সেগুলোর সমাধান কোন পথে সম্ভব। শিক্ষা ও গবেষণায় অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনের পর তিনি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (BARI) কাজ করেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে। এ সময় তিনি ২২টি নতুন ফসল উদ্ভাবন করেন এবং ৮২টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকেননি। গবেষণাকে মাঠে, কৃষকের হাতে, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৯ সালে মাত্র ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ৫ জন সহকর্মীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন Krishibid Group Bangladesh (KGB)—যা আজ দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষি-ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
এক ছাতার নিচে কৃষির পূর্ণ সমাধান
বর্তমানে KGB-এর অধীনে ৩৩টি কোম্পানি রয়েছে যা মাটি ও বীজের গুণমান, সার, কীটনাশক, আধুনিক যন্ত্রপাতি, পশুখাদ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ-মাংস উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত। কৃষকদের জন্য এটি একটি বাস্তব “ওয়ান-স্টপ সার্ভিস” ব্যবস্থা, যা তাদের শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়—আর্থিক সুরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসও দিচ্ছে।
KGB-তে বর্তমানে ৬৫০০ জন বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই সরাসরি কৃষক বা কৃষক পরিবারের সদস্য। গত দুই দশকে এই বিনিয়োগকারীদের গড় বার্ষিক রিটার্ন ১৯%, যেখানে মোট Tk ২৫০ কোটি বিনিয়োগের বিপরীতে Tk ৩১৫ কোটি ফেরত দেওয়া হয়েছে—এটাই প্রমাণ করে, এই উদ্যোগ শুধুমাত্র ব্যবসায়িক নয়, এটি একটি সামাজিক বিনিয়োগ ও কৃষক-ক্ষমতায়নের মডেল।
স্থানীয় উদ্যোগ, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
ড. আফজাল শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও সিরিয়া-তে কাজ করেছেন উন্নত ফসল উদ্ভাবন এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে, যা তাঁর দর্শনে এক বৈশ্বিক মাত্রা এনেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন—যে জাতি খাদ্যে স্বনির্ভর নয়, সে কখনো স্বাধীন নয়।
রাজনীতির আহ্বান: নীতির মানুষকে নেতৃত্বে চাই
যদিও ড. আলী আফজাল এখনো সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হননি, কিন্তু আমাদের সমাজে আজ এমন নেতৃত্বের অভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়—যেখানে জ্ঞান, সততা ও জনসেবার মানসিকতা একত্রে থাকে। তাঁর মতো মানুষদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা মানে হলো নীতিনির্ভর উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আমরা চাই, আগামী দিনে তিনি বাংলাদেশের কৃষিনীতি নির্মাণ ও বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিন—এমনকি ভবিষ্যতের একজন যোগ্য ও জনমুখী কৃষিমন্ত্রী হিসেবেও তাঁর অংশগ্রহণ দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হবে।
একজন মানুষের পেছনে একটি জাতির স্বপ্ন
ড. আফজাল আজ শুধুমাত্র একজন সফল ব্যক্তি নন, তিনি একটি দর্শনের প্রতীক—যে দর্শন বলে: “কৃষক যদি বাঁচে, দেশ বাঁচে। খাদ্য যদি নিরাপদ হয়, জাতি সুস্থ থাকে।” আমি সুদূর প্রবাসে বসে যখন এ রকম একজন মাটি-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখি, তখন এক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে—দেশের মানুষ কেন এমন একজন সম্পদকে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমন একজন দূরদর্শী কৃষিবিজ্ঞানীর আলোর রেখা আমরা জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারছি না?
আমি বহু বছর বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন, সুইডেনের মতো শীতল আবহাওয়ায়, কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও কৃষিকাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছি—শুধু একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য:
“খাদ্য কেবল পেট ভরানোর মাধ্যম নয়; এটি সভ্যতা ও নৈতিকতার বিষয়।” নিরাপদ খাদ্য মানে সুস্থ জাতি, আর ভেজাল মানে বিপর্যয়।
বাংলাদেশে ড. আলী আফজালের মতো একজন বিজ্ঞানী ও সংগঠক থাকা সত্ত্বেও, আমরা আজও কেন নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্যের জন্য হাহাকার করছি? কেন এখনও কৃষকের ঘাম ও পরিশ্রম যথাযথ সম্মান পাচ্ছে না? কেন জাতি তার প্রকৃত নায়ক ও পথপ্রদর্শককে চিনতে এত বিলম্ব করছে? এই প্রশ্নগুলো শুধুমাত্র প্রশ্ন নয়; এগুলো সময়ের কাছে আমাদের দায়। জবাব চাই, জাগরণ চাই। জাগো বাংলাদেশ, জাগো!
আমি ১৯৮৬ সাল থেকে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধাকে দেখছি—তিনি কেবল একজন শিক্ষাবিদ নন, বরং নিবেদিত সমাজসেবক ও গবেষক, যিনি দেশের শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়নে অগ্রদূত। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেশের গ্রামীণ কৃষকদের পাশে থেকে মাঠ পর্যায়ের গবেষণামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে এলাকার প্রথম গবাদি ফার্ম গড়ে উঠেছে, মাছচাষসহ বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। তার গবেষণার মূল লক্ষ্য সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলন ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন।
তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দু শুধুমাত্র কৃষি নয়; তিনি সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর ক্ষমতায়নে দৃঢ় বিশ্বাসী। এলাকার শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রান্তিক কৃষকদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অসংখ্য শিক্ষার্থী ও গবেষকের তিনি পথপ্রদর্শক, যারা দেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে অবদান রাখছেন।
একই লক্ষ্য নিয়ে তিনি আজও নিরলস পরিশ্রম করছেন—বাংলাদেশী মানুষের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনা, তাদের ভাগ্যে নতুন আলো জ্বালানো, এবং একটি উন্নত, মানবিক ও সম্মানজনক সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি কৃষক ও গ্রামীণ জনগণ সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও মর্যাদাবান জীবন যাপন করবে।
আমরা ড. মান্নান মৃধা ও ড. আলী আফজালের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রার্থনা করি তারা দীর্ঘদিন সুস্থ ও সক্রিয় থাকুন, কৃষক ও দেশের মানুষের পাশে থেকে জাতিকে আলোর পথে নিয়ে যান। যেন বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর মুখে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের হাসি ফুটে ওঠে—এটাই আমাদের সম্মিলিত আশা ও স্বপ্ন।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
কাফি
মত দ্বিমত
তরুণদের আহ্বান: বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রচিন্তা

একটি নৈতিক বিপ্লব, যা শুধু সরকার নয়-সমাজের বিবেককেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখন আর নিছক শ্রেণিকক্ষের পাঠেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা রাস্তায়, চত্বরে, ডিজিটাল মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে জোরালো কণ্ঠে বলছে এ দেশের কাঠামোগত বৈষম্য, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদ আর চলতে পারে না। এই তরুণদের নৈতিক জাগরণ কেবল একটি সরকারের পতনের প্রতীক নয়, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা।
এটা আর শুধু প্রতিবাদ নয়—এটা এক নৈতিক অভ্যুত্থান। রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা কোনো দলীয় চেতনার বাহক নয়, বরং তারা এক দগ্ধ সমাজের বিবেক হয়ে উঠেছে। তাদের চোখে লজ্জা, প্রশ্ন, এবং জেগে ওঠা মূল্যবোধ—যা রাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন বৈষম্য ও সুবিধাভোগী শ্রেণিকাঠামোর বিরুদ্ধে এক অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। দুর্নীতির অন্ধকার গলিতে যখন ন্যায়বিচার নিঃশব্দে কাঁদে, তখন এই তরুণরাই বলে ওঠে: “আমরা চুপ থাকবো না।”
তারা আজ দাবি করছে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার, যেখানে শিক্ষক, কৃষক, গৃহকর্মী কিংবা ঝাড়ুদার—সবাই পাবেন সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা। রাষ্ট্র যদি কেবল কিছু মানুষের সম্পদের পাহারাদার হয়ে থাকে, তবে সেটি আর জনতার রাষ্ট্র নয়। এই আন্দোলন সেই ব্যবধান ভাঙতে এসেছে—চেতনাকে বদলাতে, কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে। এটি কোনো গুজবনির্ভর আবেগ নয়—এটা এক বিবেকসচেতন, তথ্যভিত্তিক বিপ্লব।
বছরের পর বছর ধরে একটি ক্ষুদ্র, শক্তিশালী শ্রেণি সরকারি প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য উচ্চপদে থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে আসছে। তাঁরা চাকরি চলাকালীন উচ্চ বেতন, নানা ভাতা এবং অবসরে প্রতীকী মূল্যে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্লট পাচ্ছেন। অথচ যারা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিকাজ, শ্রম কিংবা সাধারণ সরকারি চাকরিতে দেশের প্রকৃত সেবা করে যাচ্ছেন—তাঁদের জন্য নেই সম্মানজনক অবসরজীবন কিংবা ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা পাঁচটি স্পষ্ট দাবিতে সংক্ষেপ করা যায়:
১. ঢাকার চাপ কমাতে সেনানিবাস, প্রশাসনিক ভবন ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন জরুরি। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ, যানজটপূর্ণ ও দূষিত শহর। অথচ এই শহরের কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত রয়েছে সেনানিবাস, মন্ত্রণালয়, সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো বহু দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, যা বিকল্প স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব।
এছাড়া, হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ—বিশেষ সুবিধাসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাস করছেন। তাঁদের জন্য রাজধানীর বাইরে আধুনিক ও সম্মানজনক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে নাগরিক সুবিধা সবার জন্য উন্মুক্ত হয় এবং রাজধানীর ভারসাম্য রক্ষা পায়।
রাজধানীকে শুধু ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ না রেখে একটি বসবাসযোগ্য মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানচ্যুতি এখন সময়ের দাবি।
২. পরিশ্রমজীবী মানুষ যেন আর বস্তিতে না বাস করেন। যারা বাস চালান, রাস্তায় ঝাড়ু দেন, বিভিন্ন সেবা দেন—তাঁরা যেন সারাজীবন কাজ করেও বস্তিতে বাস করতে বাধ্য না হন। এটি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। তাঁদের জন্য ন্যূনতম আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও অবসরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
৩. দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোকে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে দূষিত করে রাখা চলবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগ, ভূমি অফিসসহ সরকারি রাজস্ব ও জবাবদিহির সংস্থাগুলোর ভেতরে ঘুষ ও অবৈধ সমঝোতার চক্র গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন, কার্যকর ও জনদায়িত্বশীল করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।
৪. নৈতিক শিক্ষা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ শুরু করতে হবে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনৈতিকতা বাড়ছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল আইন দিয়ে নয়—শুরু করতে হবে শিক্ষালয় থেকে। শিশুদের মধ্যে ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাস, আত্মসংযম, দায়িত্ববোধ ও অসততার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
৫. যাঁরা সেবা দেন, তাঁরা যেন সম্মান ও নিরাপত্তা পান। অফিসের গাড়িচালক, বাসার সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা কৃষক—যাঁরা নীরবে সেবা দিয়ে যান—তাঁরা যেন অবহেলার শিকার না হন। তাঁদের জন্য পেনশন, চিকিৎসা ও অবসরের সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা থাকা উচিত। এই অবহেলা মানবিকতাবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় নীতির চরম ব্যর্থতা।
এই শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন একটি মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের ডাক দিয়েছে। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি এক নৈতিক পুনর্জাগরণ। এখন সময় এই তরুণদের কণ্ঠস্বরকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার। সময় এসেছে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ার।
এই আন্দোলন শুধু পাঁচটি দাবি পূরণের জন্য নয়—এটি রাষ্ট্রকে তার আয়নায় নিজের মুখ দেখানোর আহ্বান। আমরা কীভাবে এতদিন কিছু মানুষকে বিশেষ সুবিধার পাহাড়ে বসিয়ে রেখেছি, আর যারা প্রকৃত সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের ঠেলে দিয়েছি অবহেলার প্রান্তে? তরুণরা সেই প্রশ্ন তুলছে, এবং সেই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া মানেই ভবিষ্যতের দায় এড়িয়ে যাওয়া।
এখন আর কেবল সরকারি নীতিমালার কসটিতে চলা চলবে না—চাই নতুন রাষ্ট্রচিন্তা, যেখানে মূল্যায়ন হবে সেবার ভিত্তিতে, সুবিধার নয়। এই আন্দোলনের অন্তরে যে নৈতিক সুর বাজছে, তা কোনো সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলাদেশের আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা এক ধ্বনি—ন্যায়ের, মর্যাদার ও গণতন্ত্রের। যারা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, তারা কেবল বিদ্রোহ করছে না—তারা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে।
এখন সময় এসেছে কানে শোনা নয়—হৃদয়ে ধারণ করার। এই তরুণ কণ্ঠস্বর যদি অবহেলা করা হয়, তবে রাষ্ট্র শুধু একটি প্রজন্ম নয়—হারাবে নিজের ভবিষ্যৎ, মানচিত্র ও আত্মপরিচয়।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে চাই ন্যায়ের ভিত্তিতে মর্যাদা, চাই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা।
এই বিপ্লবের আত্মত্যাগ তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন রাষ্ট্র নিজেই উচ্চারণ করবে— সবাই গুরুত্বপূর্ণ, কেবল সুবিধাভোগীরা নয়।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো না?

ভুলের স্মৃতি, ভালো কাজের আহ্বান, এবং বিবেকের এক নীরব সংলাপ। নিজেকে ফিরে দেখা: ভুলের প্রতিচ্ছবি। আমার জীবনে ভুল ছিল। কিছু ভুল ছিল আবেগে, কিছু সিদ্ধান্তে, কিছু নীরবতায়। কিন্তু আমি কখনোই তাদের অস্বীকার করিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি— ভুলের স্বীকারোক্তিই আত্মশুদ্ধির প্রথম ধাপ।
এই ভুলগুলোকেই আমি আজ স্মরণ করি, যেন অন্যরা আমার পথে হেঁটে সেই একই গর্তে না পড়ে। আমার অভিজ্ঞতা হয়তো কারও জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে।
ভালো কাজ: নিজেকে ছাপিয়ে অন্যের জন্য। আমার কিছু কাজ ছিল—যেগুলো শুধু আমার জন্য ছিল না। আমি চেয়েছি, যেন সেই কাজগুলো অন্যের জীবনেও আলো ফেলে। ভালো কাজের সার্থকতা তখনই, যখন তা শুধু নিজের আত্মতৃপ্তি নয়—অন্যের কল্যাণে রূপ নেয়।
আমার কিছু সিদ্ধান্ত হয়তো কাউকে সাহস জুগিয়েছে, কেউ হয়তো আমার লেখায় খুঁজে পেয়েছে নিজের আত্মপ্রত্যয়। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের বড় অর্জন।
বিবেকের সাথে সংলাপ। আমরা কি বিবেকের সাথে কথা বলি? আমরা কি প্রতিদিনের কাজের পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি—“আমি সঠিকটা করলাম তো?” আমি এই সংলাপ করি—প্রতিদিন না হোক, প্রহরে প্রহরে নিজের ভেতরের সেই নীরব কণ্ঠস্বর শুনি। তাতে আমি সব সময় উত্তম হতে পারি না, কিন্তু আমি সচেতন থাকি।
আমরা যখন “হ্যাঁ” বলি, তখন কি তার পেছনে সাহস থাকে? আমরা যখন “না” বলি, তখন কি বিবেক খুশি থাকে? এই চিন্তা আমাদের নৈতিকতা গড়ে দেয়, মানবিকতা জাগায়।
নিজের জীবনের আলো অন্যের পথ দেখাতে পারে। এই লেখাটি শুধু আত্মজিজ্ঞাসা নয়—এটি একটি ডাকে, যেখানে আমি চাই, আমার জীবনের যাত্রা যদি অন্যকে একটু ভাবায়, একটু আলো দেয়—তবেই তা অর্থপূর্ণ। আমরা সবাই ভুল করি, কিন্তু সবাই যদি সেই ভুল থেকে কিছু শিখি এবং অন্যকে বলি—“এই পথে যেয়ো না”, তখন সমাজ বদলায়।
আমি চাই, আমার অভিজ্ঞতা, আমার শিক্ষা, আমার ছোট ছোট উপলব্ধি। তোমার জন্য বড় কোনো সত্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠুক।
এক নিঃশব্দ আহ্বান: নিজেকে জানো, অন্যকে জানতে দাও। এই জীবন এক প্রশিক্ষণ, প্রতিদিন নিজেকে জানার। যেখানে ভুলেরা শুধু কষ্ট নয়, শিক্ষাও দেয়। যেখানে ভালো কাজ কেবল বাহবা পাওয়ার জন্য নয়, অন্যকে জাগিয়ে তোলার জন্য।
তুমি যদি নিজের গল্প বলতে পারো, তাহলে কেউ না কেউ একদিন বলবে “তোমার অভিজ্ঞতা আমাকে বদলে দিয়েছে।”
তাই আজকে বলি— নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো না? হয়তো তোমার উত্তরই অন্য কারও জীবনের সবচেয়ে জরুরি আলো হতে পারে।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com