অর্থনীতি
জ্বালানি তেলের ৪৮ কোটি ডলার বিল বকেয়ায় বিপাকে বিপিসি

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জ্বালানি তেলের বকেয়া বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি। চাইলেও ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বকেয়া বাড়তে থাকায় তেলের জাহাজ পাঠাতে চাইছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত সময়ের পর আসছে কোনো কোনো জাহাজ। বিল পরিশোধে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর চাপ বাড়ছে বিপিসির ওপর।
বিপিসি সূত্র বলছে, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিদবস ২২ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার বকেয়া জমেছে বিপিসির। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ভিটলের, তারা পাবে ১৮ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। সোনালী ব্যাংক থেকে তাদের একটি বিল পরিশোধে ইতিমধ্যে ১১০ দিন বিলম্ব হয়েছে। ৯৪ দিন, ৮৫ দিন বিলম্ব হওয়া বিলও আছে কোনো কোনো সংস্থার।
বিপিসির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চুক্তি অনুসারে বিলম্বের জন্য বছরে এখন সাড়ে ৬ শতাংশ হাতে অর্থ মাশুল হিসেবে দিতে হবে। যদিও দীর্ঘ ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে বিলম্ব মাশুলের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো চাপ দেয়নি। তবে দ্রুত বিল পরিশোধে তাগাদা দিচ্ছে নিয়মিত। দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে কিছুটা সময় চাওয়া হয়েছে। মাঝে ব্যাংক বন্ধ থাকায় দেরি হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
চীনের কোম্পানি ইউনিপেক পাবে প্রায় ৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আরব আমিরাতের ইনক পাবে ৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার। ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি পাবে ৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। মালয়েশিয়ার পিটিএলসিএল পাবে ২ কোটি ১৮ লাখ ডলার। আর ভারতের আইওসিএল পাবে আড়াই কোটি ডলার। এর বাইরে বকেয়া কিস্তি জমেছে বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও। জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য পরিশোধে বিপিসিকে নিয়মিত ঋণসহায়তা দেয় ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)। তারা পাবে ৮ কোটি ডলারের বেশি।
জ্বালানি তেল বিক্রি করে দুই বছরের বেশি সময় ধরে মুনাফা করছে বিপিসি। গত মার্চ থেকেই প্রতি মাসে মূল্য সমন্বয় করছে তারা। তাই সংস্থাটির আর লোকসানে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু বিদেশি দেনা পরিশোধে ডলার জোগাড়ে আড়াই বছর ধরেই সমস্যার মধ্যে আছে তারা। এর মধ্যে গত মাস জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তন ঘিরে ব্যাংক বন্ধ ছিল বেশ কয়েক দিন। এতে আরও সমস্যায় পড়েছে বিপিসি। বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি ঋণপত্র খুলতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে।
বিপিসি সূত্র বলছে, প্রতি মাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আনতে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র খোলার দরকার হয় বিপিসির। ডলারে ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলো নিয়মিত গড়িমসি করে। একটি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাঝেমধ্যে ২ কোটি ডলার করে ছাড় করলেও তা দিয়ে বকেয়া পুরোপুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
বছরে বিপিসির ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল লাগে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। বাকিটা সরাসরি আমদানি করা হয়। তবে দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের ৮০ শতাংশ সরাসরি আমদানি করা হয়। জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে বিপিসির কাছে তেল বিক্রি করা বিদেশি সংস্থাগুলো।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) অনুপম বড়ুয়া বলেন, সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে। একটা বিশেষ পরিস্থিতির কারণে দেনা পরিশোধে দেরি হওয়ার বিষয়টি তাদের বোঝানো হয়েছে। ধীরে ধীরে তাদের বিল পরিশোধ করার কথাও বলা হয়েছে। দীর্ঘ ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে তারা তেল সরবরাহ বন্ধ করবে না।
তবে জ্বালানি তেলের মজুত পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। ২২ আগস্ট পর্যন্ত ডিজেলের মজুত আছে ৪ লাখ ২৬ হাজার টন। তা দিয়ে দেশের অন্তত ৩৫ দিনের চাহিদা মেটানো যাবে। পেট্রলের মজুত আছে প্রায় ২৩ হাজার টন, যা দিয়ে ১৮ দিন চলবে। অকটেন আছে ৩৩ হাজার ২২৮ টন, যা ২৫ দিনের চাহিদার সমপরিমাণ মজুত। যদিও পেট্রল ও অকটেনের একটি বড় অংশ দেশে উৎপাদিত হয়। তাই এ নিয়ে অতটা অনিশ্চয়তা নেই। উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল আছে ৪০ হাজার ২৫ টন, যা দিয়ে ২৬ দিনের চাহিদা মেটানো যাবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস তেল আছে ৩৩ হাজার ৪৫২ টন। এ পরিমাণ তেল দিয়ে ১২ দিন চলার কথা। বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখন তেলের চাহিদা আছে। কিন্তু অধিকাংশ সরবরাহকারী ফার্নেস তেল দিতে রাজি হচ্ছে না। ৩০ আগস্টের মধ্যে ফার্নেস তেল নিয়ে একটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। এটি পিছিয়ে গেলে সংকট তৈরি হতে পারে।
সচিবালয়ে গত বুধবার বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানি বিল ২২০ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে বকেয়া পরিশোধে ১০০ কোটি ডলার প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করেন তিনি। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেলে তা বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বকেয়া পরিশোধে গত বৃহস্পতিবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, বিল বকেয়ার এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটা টাকার সমস্যা নয়, অভাব ডলারের। সমস্যাটি থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে এমন অবস্থা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নতুন সরকার জ্বালানি খাতের বকেয়া পরিশোধে যে ডলার চেয়েছে, তা পেলে সমস্যা অনেকটা কাটবে।
এসএম

অর্থনীতি
সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সরকারের ১০ কোটি ২৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৫২ টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফরিদ খানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন বাদী হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ এ মামলাটি করেন। দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মোহাম্মদ ফরিদ খান ছাড়াও মামলার অন্য আসামিরা হলেন—লেক্স কাউন্সিলের স্বত্বাধিকারী ও বিটিআরসির প্যানেল আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রাকিব, বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ, সাবেক কমিশনার (আইন) মো. আমিনুল হক বাবু, সাবেক কমিশনার (স্পেকট্রাম) শেখ রিয়াজ আহমেদ, সাবেক কমিশনার (অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব) ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী ও সাবেক কমিশনার (সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস) মো. দেলোয়ার হোসাইন।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়, বিটিআরসির কর্মকর্তা ও লেক্স কাউন্সিলের প্যানেল আইনজীবীর সহযোগিতায় সামিট কমিউনিকেশনস বেআইনিভাবে ১৪ কোটি ২০ লাখ ৮৮ হাজার ১৩৬টি নতুন অর্ডিনারি শেয়ার ইস্যু করে। যার মধ্যে ৯ কোটি ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯১১টি শেয়ার দেওয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক গ্লোবাল এনারিংয়ে, যা মুহাম্মদ আজিজ খান ও তার পরিবারের মালিকানাধীন।
এছাড়া ৪ কোটি ৪ লাখ ৯৫ হাজার ১১৯টি শেয়ার দেওয়া হয় মরিশাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেকুওয়া ইনফ্রা টেক লিমিটেডকে। বাকি ৭১ লাখ ৪ হাজার ৪০৬টি শেয়ার দেওয়া হয় পূর্বের শেয়ারহোল্ডার মো. আরিফ আল ইসলামের অনুকূলে।
এই শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানির মূলধন প্রায় চারগুণ বাড়ার পাশাপাশি মোট শেয়ার সংখ্যা ৫ দশমিক ০৭ কোটি থেকে বেড়ে ১৯ দশমিক ২৮ কোটিতে পৌঁছে। ফলে মোহাম্মদ ফরিদ খানের মালিকানা ৯৫ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশে নেমে আসে। অন্যদিকে, দুই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানা দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ধারা ২৪ অনুযায়ী, শেয়ার হস্তান্তর বা মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, বিক্রিত শেয়ারের মূল্যের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব পরিশোধ করতে হয়। ২০২২ সালে একই কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব আদায়ে ওই আইনের প্রয়োগ থাকলেও এক্ষেত্রে আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রাকিব সামিট কমিউনিকেশন থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্য পরিশোধ সামিট কমিউনিকেশনসের জন্য প্রযোজ্য নয় মর্মে মতামত দেন।
দুদক বলছে, আইনজীবীর এ মতামতের ভিত্তিতে বিটিআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কমিশনাররা মিলে অবৈধ সুবিধা নিয়ে শেয়ারের অনুমোদন দেন, ফলে সরকার প্রায় ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা রাজস্ব হারায়।
অর্থনীতি
ন্যূনতম কর একটা কালাকানুন: এনবিআর চেয়ারম্যান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, কোনো সন্দেহ নাই ন্যূনতম কর একটা কালাকানুন। এটা স্বীকার করতেই হবে। বিজনেসে কর হবে মুনাফার ওপর। তা না করে মিনিমাম কর নির্ধারণ করছি। সমস্যা হচ্ছে এগুলো ঠিক করতে গেলে আমাদের কর আহরণ কমে যাবে।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানে অভিজাত হোটেলে আয়োজিত এক সংলাপে সিপিডি ওই তথ্য প্রকাশ করে। করপোরেট কর ও ভ্যাট সংস্কার শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিনিয়র গবেষক মো. তামিম আহমেদ। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা আমার একটি নতুন প্রজেক্টে হাত দিয়েছি। আমরা চাই, অটোমেটেড এনবিআর। সবকিছু যদি ডিজিটাল করতে পারি তাহলে বোতাম টিপলেই ভ্যাট রিটার্ন ও কর রিটার্ন হয়ে যাবে। আমাদের অডিট রিপোর্টের কোয়ালিটি নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। অডিটের ঘোষণাগুলো দেখলে বোঝা যায় এখানে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে নাই।
তিনি বলেন, বর্তমানে এনবিআরে অডিটের ম্যানুয়াল সিলেকশন বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ অডিট ম্যানুয়াল সিলেকশন হলে একই ব্যক্তি প্রতি বছর অডিটের আওতায় পড়ে যায়। এটা এখানেও এক ভাই অভিযোগ করল। আমরা বলেছি, অডিট সিলেকশন হবে ঝুঁকিকে ভিত্তি করে। এ কারণে আমরা যতদিন পর্যন্ত ডিজিটাল সিস্টেম করতে না পারব, ততদিন ম্যানুয়াল ভ্যাট অডিট বন্ধ থাকবে। দরকার হলে হলে কেয়ামত পর্যন্ত অডিট বন্ধ থাকবে। আমাদের অটোমেটেড করতেই হবে।
করজাল প্রসঙ্গে আবদুর রহমান বলেন, আমরা করের আওতায় যদি বাড়াতে পারি তাহলে আমরা করহার ও ভ্যাট হার কমাতে পারব। কমপ্লায়েন্স যখন করতে পারব ভ্যাটে এক রেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। রিফান্ড অটোমেটিক করদাতার হিসেবে চলে যাওয়া উচিত বলে মনে করি।
তিনি বলেন, ন্যূনতম কর নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কোনো সন্দেহ নাই ন্যূনতম কর একটা কালাকানুন। এটা স্বীকার করতেই হবে। বিজনেসে কর হবে মুনাফার ওপর। তা না করে মিনিমাম কর নির্ধারণ করছি। সমস্যা হচ্ছে এগুলো ঠিক করতে গেলে আমাদের কর আহরণ কমে যাবে। যখন আমরা মোটামুটি সিস্টেমে চলে আসব তখন ওই বাস্তবায়ন করতে পারব। এ বছর আমরা চেষ্টা করেছি প্রচুর ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে। আসলে ব্যবসায়ীদের সহজ করে না দিলে রাজস্ব আহরণ কঠিন হয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে সিপিডির এক গবেষণায় বলা হয়, ৮২ শতাংশ ব্যবসায়ী বর্তমান কর হারকে ‘অন্যায্য’ ও ব্যবসার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মনে করেন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ কর কর্মকর্তাদের জবাবদিহির অভাবকে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৭২ শতাংশ বলেছেন, কর প্রশাসনে দুর্নীতি তাদের জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ১২৩টি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত এ সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ ব্যবসায়ী নিয়মিত কর দাবিকে কেন্দ্র করে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, যথাযথ ব্যাখ্যা বা পূর্বাভাস ছাড়াই কর কর্মকর্তারা অনেক সময় ইচ্ছেমতো কর আরোপ করেন।
ভ্যাট বিষয়ে অংশগ্রহণকারী ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, জটিল ভ্যাট আইন তাদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া অস্পষ্ট ভ্যাট নীতিমালা, কর কর্মকর্তাদের সীমিত সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার ঘাটতি, পণ্য ও সেবার শ্রেণিবিন্যাসে জটিলতা এবং উচ্চ অনুবর্তন ব্যয় ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এন্টারপ্রাইজ সার্ভের কাঠামো অনুসরণ করে পরিচালিত এ ভ্যাট সমীক্ষায় ঢাকা ও আশপাশের জেলাসহ মোট ৩৮৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
অর্থনীতি
ডিজিটাল ব্যাংকের আবেদনপত্র চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশীয় প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করেছে। চলতি বছরের ১–৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। আবেদনকারীদের পাঁচ লাখ টাকা ফি জমা দিতে হবে, এবং সব সেবা হবে সম্পূর্ণ ডিজিটাল। মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক খাতে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এর লক্ষ্য হলো আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়ানো, সেবার পরিসর বিস্তৃত করা আর ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসই) অর্থায়নের সুযোগ সহজ করা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগিয়ে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখাই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ঋণপ্রবাহ সহজ করতে ডিজিটাল ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার মনে করছে তারা।
আবেদনকারীদের নির্ধারিত প্রস্তাবপত্রের সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা (অফেরতযোগ্য) ফি জমা দিতে হবে। এ টাকা যেকোনো তফসিলি ব্যাংক থেকে ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুকূলে দিতে হবে। শর্ত পূরণ না করলে আবেদন বাতিল হবে।
এ ছাড়া আবেদনপত্র সরাসরি জমা দেওয়ার পাশাপাশি ই-মেইলের মাধ্যমেও সব নথি জমা দিতে হবে। বিস্তারিত নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) মহাব্যবস্থাপক মো. বায়াজিদ সরকার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, ধারাবাহিক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে বৈশ্বিক আর্থিক খাতের চিত্র বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক পণ্য ও সেবা প্রদানে অধিক কার্যকারিতা আনতে এবং আর্থিক ব্যবস্থার বিস্তৃত পরিসর তৈরি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
এর আগে ২০২৩ সালের ১৪ জুন ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ছিল ১২৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বৃদ্ধি করে ৩০০ কোটি টাকা করেছে। প্রচলিত ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে প্রয়োজন ৫০০ কোটি টাকা। ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে। পেমেন্ট সার্ভিস পরিচালিত হবে ২০১৪ সালের বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম রেগুলেশনের অধীন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে। সেবা দেওয়ার বেলায় স্থাপনা লাগবে না। অর্থাৎ এই ব্যাংক ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা দেবে না। ডিজিটাল ব্যাংকের নিজস্ব শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএমও থাকবে না। সব সেবাই হবে অ্যাপনির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে।
অর্থনীতি
মানুষের হাতে নগদ অর্থ আবারও বাড়ছে

মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ আবারও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে মানুষের হাতে বেড়েছে ২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা।
এর আগে এপ্রিলে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ কমলেও মে মাসে তা বেড়েছিল ১৬ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানুষের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ কমছিল। তবে মার্চে হঠাৎ তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। এপ্রিলে আবার কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। পরের মাস মে থেকে নগদ টাকার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে, এজন্য তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও আস্থাহীনতাও নগদ টাকার প্রবাহ বৃদ্ধির পেছনে একটি বড় কারণ।
গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত মানুষের হাতে নগদ টাকা ক্রমাগত বাড়ছিল। তবে ওই বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর ব্যাংক খাতে মানুষের আস্থা কিছুটা ফিরতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বরে নগদ টাকার প্রবাহ কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, অক্টোবরে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি এবং ডিসেম্বরে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আরও কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ কোটি এবং ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।
তবে গত মার্চে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ আবার বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। এরপর এপ্রিলে তা কিছুটা কমলেও মে ও জুনে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।
এদিকে শুধু নগদ টাকার প্রবাহই নয়, বাজারে মুদ্রা সরবরাহও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসে ছাপানো টাকার স্থিতি (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে ১৪ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা।
অর্থনীতি
খেলাপি ঋণের ৪৯.৪৩ শতাংশই শিল্প খাতে

ব্যাংক খাতের ক্যানসার হিসেবে পরিচিত খেলাপি ঋণ এখন উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৪ অনুযায়ী, মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক (৪৯.৪৩ শতাংশ) এখন তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া, জাহাজ নির্মাণসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে কেন্দ্রীভূত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০.২৫ শতাংশ।
এক বছর পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। আগের বছর এই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৭২ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯৮ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।
তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের সংকট
সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৪৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা (১৪.০৪ শতাংশ)। আগের বছর এই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, টেক্সটাইল খাতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে বিতরণকৃত ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৩৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকা (১০.৫৪ শতাংশ)। ২০২৩ সালে এ খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।
অন্যান্য শিল্প খাত
চামড়া খাত: ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ঋণ ১৪ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা, খেলাপি ৫ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। আগের বছর খেলাপি ছিল ২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।
জাহাজ নির্মাণ খাত: ঋণ ২০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, খেলাপি ৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা। এক বছরে বেড়েছে ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
কৃষিভিত্তিক শিল্প খাত: ঋণ ৬৬ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা, খেলাপি ৭ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা।
ব্যবসা-বাণিজ্য খাতেও ঋণখেলাপি
২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা, যা মোটের ২৫.৫১ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পখাতে ঋণ বিতরণে নিয়মকানুন মানা হয় না। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা সহজেই ঋণ পায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তা ফেরত দেয় না। কেউ কেউ আবার নামে-বেনামে টাকা বিদেশে পাচার করছে। ফলে শিল্পখাতের খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে।