অন্যান্য
কৃষকরাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি: স্পিকার

জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) নিজ নির্বাচনী এলাকা ২৪ রংপুর-৬ এর অন্তর্গত পীরগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর পীরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা তহবিলের অর্থায়নে এ ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষকদের জন্য স্প্রে মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার এ কথা বলেন।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
নয় নম্বর পীরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে পীরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন।
স্পিকার বলেন, আধুনিক কৃষির বিস্তারে কৃষকদের মাঝে সঠিক পরামর্শ প্রদানে উপজেলা কৃষি অফিস সর্বদা নিয়োজিত আছে।
এ সময় তিনি নিয়মিত প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে কৃষকদের মাঝে ১৫০টি স্প্রে মেশিন বিতরণ করেন।
এরপর তিনি পীরগঞ্জ উপজেলা মডেল মসজিদ এবং লালদিঘী হাবিবিয়া কাদেরীয়া সিদ্দিকিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা পরিদর্শন করেন।
তিনি মডেল মসজিদের সামনে একটি দৃষ্টিনন্দন বাগান স্থাপনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদানে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান।
পরে তিনি জয় সদন সংলগ্ন ফতেপুর মিয়াপাড়ার রাস্তাটি পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করেন এবং তার রূহের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করেন।
এরপর স্পিকার বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি জয় সদনে পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন।
এ অনুষ্ঠানে পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এস এম তাজিমুল ইসলাম শামীম, পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন রাজা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

অন্যান্য
হাসিনার বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য আজ, হবে সরাসরি সম্প্রচার

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আজ (রোববার) সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করবে প্রসিকিউশন। একইসঙ্গে শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণও হবে। আজকের বিচারকাজ ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে গণমাধ্যম। প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এই মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য দুই আসামি হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করার শর্তে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে গত ১০ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে এই মামলায় প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন ৩ আগস্ট দিন ধার্য করেন আদালত। পাশাপাশি আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করা হয়। অপর দুই আসামি হলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে ১০ জুলাই বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এর মাধ্যমে জুলাই গণহত্যা মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।
সেদিন আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। তাদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। অপর আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ গঠনের আগে ট্রাইব্যুনাল তাকে কথা বলার সুযোগ দেন। এসময় চৌধুরী মামুন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেন। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেন, জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালীন আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সত্য। এ ঘটনায় আমি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছি। আমি রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালীন যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার বিস্তারিত আদালতে তুলে ধরতে চাই। রহস্য উন্মোচনে আদালতকে সহায়তা করতে চাই। এরপর ট্রাইব্যুনাল ৫টি অপরাধে অভিযোগ গঠন করে তিন আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
মামলার আগের কার্যক্রম
গত ১ জুলাই এ মামলায় অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন। সেদিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের পক্ষে আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৭ জুন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে নোটিশ জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ বিজ্ঞপ্তি জারি করেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে পত্রিকায় এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ৭ দিনের মধ্যে হাজির না হলে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলবে বলে জানানো হয়।
গত ১ জুন জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে এই মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেদিন আদালতে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার ও মিজানুল ইসলাম। যা সব গণমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।
অন্যান্য
জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক অজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের খেলা নয়, বরং এটি এক গভীর আদর্শিক দ্বন্দ্ব, যা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছে—বা ভুলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, কাগজে-কলমে আদর্শগতভাবে ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলেও, বাস্তবে তাদের বিভাজন ক্ষমতাকেন্দ্রিক দাপট, পরিবারতন্ত্র, এবং রাজনৈতিক কৌশলের মঞ্চেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এই বিভাজনের পেছনে একসময় ছিল দুটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয়বোধের যুদ্ধ: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ বনাম ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এই দ্বন্দ্ব এখন এতটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে বিএনপির অনেক নেতা আজ আওয়ামী লীগের স্লোগান দিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করেন—নিজেদের ইতিহাস ভুলে, নিজেদের দর্শন বিস্মৃত হয়ে।
ইতিহাস ও গঠনের পটভূমি
•আওয়ামী লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই দলই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় এবং বাংলাদেশের জন্মে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে।
•বিএনপি জন্ম নেয় ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে—একটি সামরিক পরিবেশে। এটি ছিল সেনানিবাস থেকে উঠে আসা এক রাজনৈতিক পরীক্ষা, যেখানে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ছিল অনেকটা পুনঃসংজ্ঞার প্রয়াস।
আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শন
•আওয়ামী লীগ দাবি করে তারা ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল। যদিও সময়ের পরিক্রমায় দলটির এই অবস্থান নানা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
•বিএনপি “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”-এর প্রবক্তা। ধর্ম ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রিক পরিচয় গড়ার চেষ্টা করে তারা। বাস্তবে, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় দলগুলোর সাথে জোট করার ফলে এই দর্শন ইসলামপন্থার আচ্ছাদনে ঢেকে গেছে।
নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র
•আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্ব এখন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। দলটি পরিবারতন্ত্রের প্রবল ছায়াতলে।
•বিএনপি-তে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং এখন পুত্র তারেক রহমান—সবাই একে পারিবারিক কোম্পানির মতো চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক কৌশল ও শাসনধারা
•আওয়ামী লীগ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে আধিপত্য বজায় রাখে। উন্নয়নের কথা বললেও মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
•বিএনপি ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘদিন। বিরোধী দল হিসেবে সোচ্চার থাকলেও নিজের শাসনকালেও দুর্নীতি, অদক্ষতা ও উগ্রবাদে প্রশ্রয়ের দায় এড়াতে পারে না।
জোট ও জনপ্রিয়তা
•আওয়ামী লীগ সাধারণত বাম ও মাঝারি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে জোট করে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য এদের অনেকের কাছে আবেগের জায়গা।
•বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্য গড়ে সমালোচিত। যদিও শাসনবিরোধী অনেক মানুষের কাছ থেকে একপ্রকার “বিকল্প” হিসেবে সমর্থন পায়।
জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব: পরিচয়ের রাজনীতি
•আওয়ামী লীগ প্রচার করে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’—যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক চেতনার ভিত্তিতে জাতির পরিচয় গঠিত।
•বিএনপি দাঁড় করায় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’—একটি রাষ্ট্রভিত্তিক, ধর্ম ও ভূখণ্ডনির্ভর সমন্বিত জাতীয় পরিচয়, যা এক অর্থে ভারতের প্রভাব প্রতিরোধের ভূরাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখা হয়।
এই দুই দর্শনের মধ্যে মূল পার্থক্য হল:
•একজন মানুষ আগে ‘বাঙালি’, নাকি আগে ‘বাংলাদেশি’—এই পরিচয়-সংকটই রাজনৈতিক আদর্শের শেকড়।
কিন্তু আজ এ প্রশ্নগুলো গৌণ। কারণ রাজনীতি এখন আদর্শ নয়, স্বার্থের পেশা। যে দলের ব্যানারে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, সেটাই ‘দর্শন’ হয়ে ওঠে।
অজ্ঞতার রাজনীতিতে স্বপ্নের বাজার
আজকাল যদি কোনো মূর্খ, নির্লজ্জ, ক্ষমতা-লোলুপ ব্যক্তি দিনে-দুপুরে স্বপ্ন দেখে—সে একদিন সংসদ সদস্য হবে—তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন উঠে: তার কি অন্তত নিজের দলের আদর্শ, ইতিহাস কিংবা ন্যূনতম রাজনৈতিক চেতনা জানা আছে?
উত্তর: না। কারণ আজকাল এসব জানার চেষ্টা করাটাই ‘রাজনৈতিক অপরাধ’! বরং বিএনপির নামে রাজপথে দাঁড়িয়ে কিছু নেতা দেদারসে আওয়াজ তোলেন— ‘তুমি কে, আমি কে—বাঙালি, বাঙালি!’
হায়! হায়! তারা হয়তো জানেন না—এই স্লোগান তাদের দলের মূল আদর্শের বিরুদ্ধে এক সরাসরি বিদ্রুপ। বিএনপির জন্মই হয়েছিল ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিপরীতে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা দাঁড় করাতে।
তাহলে এসব স্লোগান কিসের?
বোধহীন বিদ্রোহ, নকল গর্জন, আর আদর্শহীন চিৎকার
শেষ কথা: দেশ কোন দিকে যাচ্ছে?
দেশ কি এখন এমন এক দিকে যাচ্ছে, যেখানে চিন্তাহীন স্লোগান, মুখস্থ আদর্শ আর ভাড়াটে মিছিলই নেতৃত্বের মানদণ্ড? যেখানে জনগণ চায় খাদ্য, শিক্ষা, ন্যায়বিচার—আর রাজনীতি দেয় স্লোগান, গালাগালি, আর গোপন চুক্তি?
এই বাস্তবতায়, সভ্যতা যেন নিছক একটি ঠাট্টা, আর রাজনীতি হয়ে পড়েছে—এক পেশাজীবী প্রতারণার শিল্প।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
অন্যান্য
জাতীয় সনদের আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায় শেষ, ১৯ বিষয়ে ঐকমত্য

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় সনদ তৈরির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আলোচনায় ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) শেষদিনের আলোচনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, এ নিয়ে ২৩দিন ধরে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে আলোচনা করেছি। এর আগে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রায় দুই মাস ধরে দলগত ও জোটগতভাবে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া ১৬৬টি সুপারিশের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হয়।
এই প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পূর্বেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়। আলী রীয়াজ বলেন, এই ১৯টি বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।
১৯টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট বিশেষত উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি ও এখতিয়ার, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেক্টোরাল কলেজ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে অর্থবিল ও আস্থা ভোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ এবং সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে বিএনপি উচ্চআদালতের সঙ্গে আলোচনা যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার প্রশ্নে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংযোজন না করে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করার বিষয়ে মত দিয়েছে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম, আম জনতার দল এবং বিএনপি।
উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দল ও জোট একমত হলেও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয়তান্ত্রিক দল, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এবং আম জনতার দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে সব দল একমত হলেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এতে ভিন্নমত পোষণ করেছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গণফোরাম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, মার্কসবাদী বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং জেএসডি নোট অব ডিসেন্ট দেয়। মার্কসবাদী বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা সভা থেকে ওয়াকআউট করেন।
নারী প্রতিনিধিত্বে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট এসেছে। অধিকাংশ দল জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ধাপে ধাপে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে একমত হলেও, কিছু দল সরাসরি নির্বাচন এবং কিছু দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে মত দেয়। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মত দেয়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আলোচনা শেষে প্রতিদিনই প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়েছে। আজ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, আগামীকালের মধ্যে আমরা বিস্তারিত আপনাদের কাছে পৌঁছে দেবো।
তিনি বলেন, আজকের আলোচনায় দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা ছিল।
তিনি আরও বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আলোচনা শেষ করার লক্ষ্য ছিল, আমরা তা সফলভাবে করতে পেরেছি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রস্তুত করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেবো।
আলোচনার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে এবং কমিশনকে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনার অনুরোধ জানিয়েছে দলগুলো। কমিশন মনে করে, বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ প্রয়োজন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করবো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে।
অন্যান্য
স্ত্রীকে ভালোবাসা মানে জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা

শেক্সপিয়র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত: সকল স্বামীর জন্য চিরন্তন ভালোবাসার পাঠ
‘She is mine own, And I as rich in having such a jewel As twenty seas, if all their sands were pearl…’— উইলিয়াম শেক্সপিয়র (Othello)
স্ত্রীকে ভালোবাসা মানে কি কেবল একটি নাম, একটি সম্পর্ক, একটি সামাজিক চুক্তি? না, তা তো নয়। স্ত্রীকে ভালোবাসা মানে—একটি ঘুমন্ত শহরের মধ্যে জেগে থাকা একটি আলোকে ভালোবাসা, যে আলোটা জানালার কাচে পড়ে থাকে যখন আপনি দেরিতে বাড়ি ফেরেন। ভালোবাসা মানে সেই হাতজোড়া, যেগুলো সারাদিনের কাজের ক্লান্তি সত্ত্বেও আপনার জামাটা গুছিয়ে রাখে।
স্ত্রীকে ভালোবাসা মানে—একটি ঘরের নিঃশব্দতা ভালোবাসা, যে ঘরটি প্রতিদিন আপনাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করে, ভালোবাসা মানে প্রতিদিনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই অদেখা স্নেহকে চিনে ফেলা, যা হয়তো কখনও উচ্চারিত হয় না—তবু জানালায় শুকিয়ে রাখা আপনার ভেজা শার্টটাই বলে দেয়, সে মানুষটি আপনার কথা ভাবে।
তবু, এই সমাজে, আমাদের রিকশার আড্ডায়, চায়ের দোকানে, কিংবা বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে পুরুষেরা বলে— ‘বউয়ের কারণে মুডটাই অফ’, ‘এই সংসার কি আর ভালো লাগে?’ ‘একঘেয়ে! যেন জীবনটা আটকে গেছে…’
কিন্তু আমরা কি একবারও চুপ করে ভেবেছি? যে নারীটি আপনাকে এই আটকে যাওয়া জীবনের মাঝেও হাসতে শেখায়, যিনি রাতে পাশে না পেলে ঘুমাতে পারেন না, যিনি আপনার প্রতিটি অভিমান মুখ দেখে বুঝে ফেলেন— তাকে কি আমরা ভালোবাসার মতো ভালোবাসতে পেরেছি?
এই লেখা তাদের জন্য নয় যারা ‘ভালোবাসি’ বলে ভোলায়, এই লেখা তাদের জন্য—যারা ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে গেছেন, ভুলে গেছেন ভালোবাসা মানে কী।
একবার শুধু ফিরে তাকান—নতুন করে নয়, পুরনো চোখেই, কিন্তু মন দিয়ে। ভালোবাসা সেখানে ছিল, আছে—শুধু আপনি অনেকদিন দেখেননি।
এই লেখার প্রতিটি শব্দ যেন আপনার হৃদয়ে পড়ে- ঠিক সেইভাবে, যেভাবে আপনার স্ত্রী একদিন চুপচাপ আপনার পকেটে লুকিয়ে রেখেছিল একটা ছোট চিরকুট: “যেও না, আজ একটু আগে ফিরো…”
বিচিত্র জগতে এক নারী: কবিদের চোখে স্ত্রী
‘যে স্বামী সকালে ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীকে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট জড়িয়ে ধরে রাখে, তাঁর কর্মজীবনে বিপদের ঝুঁকি কমে।’ — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘বউয়েরা ঘরের লক্ষ্মী। এদের যত বেশি ভালোবাসা দেওয়া যায়, সংসারে তত বেশি শান্তি আসে।’ — হুমায়ুন আহমেদ
‘স্ত্রীকে সময় দিন, না হলে বিশ্বাস করুন—সংসার আর যুদ্ধক্ষেত্র মনে হবে না।’ — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
‘সেই পুরুষই কাপুরুষ, যে স্ত্রীর কাছে প্রেমিক হতে পারেনি।’ — কাজী নজরুল ইসলাম
‘প্রতিদিন স্ত্রীকে একবার ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বললে মন থেকে সব দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে যায়।’ — সত্যজিৎ রায়
‘মন ভালো রাখতে স্ত্রীকে ফেসবুক, ফোনবুক, সব একাউন্টের পাসওয়ার্ড দিয়ে দিন। নিরাপত্তা আর ভালোবাসা—দুয়োটাই বাড়বে।’ — মার্ক জুকারবার্গ
‘মেয়েদের মনে ভালোবাসা আর অভিমান—দু’টোই প্রবল। অভিমানকে কখনো ভালোবাসার চেয়ে বড় করে দেখবেন না।’ — ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
‘একটি শিশুকে জন্ম দিতে মা যে কষ্ট সহ্য করে, তা বাবা সারা জীবন ভালোবেসেও শোধ করতে পারে না।’ — জীবনানন্দ দাশ
ভালোবাসা—জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রতিজ্ঞা
‘মন দিয়ে ভালোবাসো যদি কাউকে—বিয়ে কর, কারণ ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা।’— রহমান মৃধা
‘বারবার বিয়ে না করে—বিয়ে কর একবার, ভালোবাসো বারবার।’— রহমান মৃধা
যেখানে ক্লান্ত মানুষজন জীবনের একঘেয়েমি ভুলতে নতুন সম্পর্কে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমি সেখানে বলি—
একই মানুষকে নতুন করে ভালোবাসার মাঝেই আছে জীবনের সবচেয়ে গভীর রোমাঞ্চ। ভালোবাসা পুরোনো হয় না—ভালোবাসা প্রতিদিন নতুন হয়, যদি আপনি সত্যিই দেখতে জানেন। ভালোবাসা—সীমাহীন, নীরব এক প্রতিজ্ঞা (সুইডেন থেকেও শিখি)
“Att älska är inte att hitta någon att leva med, utan någon man inte kan leva utan.”
“ভালোবাসা মানে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া নয়, যার সঙ্গে বাঁচা যায়—ভালোবাসা হলো এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া, যার অভাবেই বাঁচা যায় না।” — সুইডিশ প্রবাদ
“Kärleken ser inte med ögonen, utan med själen.”
“ভালোবাসা চোখ দিয়ে দেখে না, দেখে আত্মা দিয়ে।” — শেক্সপিয়র (সুইডিশ অনুবাদ)
“Det finns inget vackrare än en man som älskar sin kvinna i tystnad, men med hela sitt hjärta.”
“নীরবে কিন্তু হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে যে পুরুষ তার নারীকে ভালোবাসে, তার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই।” — মারিয়ানা বাকুনদ
শেষ কথা
ভালোবাসা কেবল একটি আবেগ নয়—এটি প্রতিদিনের চর্চা। একটি নীরব প্রতিজ্ঞা, যা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর, আরও মধুর হয়ে ওঠে।
স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে পবিত্র কাজ আর কিছু হতে পারে না—কারণ সেই হাসির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আপনার জীবনের সৌভাগ্য, সন্তুষ্টি ও সার্থকতা।
তাই বলি—ভালোবাসুন, শ্রদ্ধা করুন, প্রতিদিন নতুন করে কাছে টেনে নিন।
ভালোবাসা তখনই জীবন্ত থাকে, যখন তা নিঃশব্দে, নিঃশর্তে, প্রতিদিন একটু একটু করে দেওয়া হয়।
“ভালোবাসা কোনো দাবি নয়—ভালোবাসা শুধু নিজেকে নিঃশব্দে বিলিয়ে দেওয়া।” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“I do love nothing in the world so well as you—is not that strange?” — Much Ado About Nothing
ভালোবাসা সবসময়ই একটু “অদ্ভুত”। কিন্তু সেই অদ্ভুততাই তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সত্য।
রহমান মৃধা, সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার Rahman.Mridha@gmail.com
অন্যান্য
টোকাইয়ের মৃত্যু, জাতির আত্মা নিহত: শাসকের রাজনীতি বনাম শোষিতের লাশ

ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দিনের আলোয় এক তরুণকে পাথর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হলো। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে দেখেছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ চিৎকার করেনি। এই নীরবতা শুধু আইন-শৃঙ্খলার নয়, এ এক জাতির আত্মার মৃত্যু। সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল—আলোচনায় সবার মুখে এক নাম: ‘টোকাই’।
কিন্তু আমার প্রশ্ন: কে মরেছে, কে মেরেছে—তা নয়। প্রশ্ন হলো: কেন বারবার মরছে এই শ্রেণিটাই? যে মরেছে, সে পথের মানুষ—দিন আনে দিন খায়। যার পেছনে নেই কোনো রাজনৈতিক পরিচয়, নেই কোনো আমলার ছায়া, নেই কোনো সাংবাদিকের কলম বা নেতার পৃষ্ঠপোষকতা। আর যারা মারছে? তারা হলো ক্ষমতার দালাল, রাজনীতির পেছনের অস্ত্রধারী বাহিনী। তাদের হাতে ছুরি থাকে, আর সেই ছুরির পেছনে থাকে রাষ্ট্রের নীরব অনুমোদন।
এদেশে যখন খুন হয় কেউ, যখন লাশ পড়ে থাকে রাস্তায়, তখন খেয়াল করুন—মৃতের নামের পাশে থাকে পরিচয় একটাই: “টোকাই”, “অজানা যুবক”, “কাজের ছেলে”, “ভবঘুরে”, “রিকশাওয়ালা”। কখনো কি শুনেছেন, কোনো মন্ত্রীর ছেলে রাস্তায় গুম হয়েছে? কোনো সচিবের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে? কোনো জেনারেলের ভাগ্নে কুপিয়ে খুন হয়েছে? না—একবারও না। কারণ এই রাষ্ট্র, এই সমাজ ও এই বিচারব্যবস্থা অলিখিতভাবে ঘোষণা করেছে—“মরার অধিকার কেবল শোষিত শ্রেণির।” ঘটনার সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর গেটে আনসার ও নিরাপত্তাকর্মী ছিল। ফুটেজে দেখা যায়—তারা দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু কিছুই করেনি।
পুলিশ পরে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। রিমান্ড দিয়েছে। মামলা হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই বিচার কাদের জন্য? আজ পর্যন্ত কয়টা টোকাইয়ের হত্যার বিচার শেষ হয়েছে?
রাষ্ট্র যখন প্রতিক্রিয়া দেখায় না, সেটি অবহেলা নয়—এটি এক সামষ্টিক নিষ্ঠুরতা।
এই টোকাইরা কারা?
তারা জন্ম নেয় বস্তিতে, ফুটপাথে, কোনো ঘূর্ণিঝড়ের রাতে বা কোনো অস্থির রাজনৈতিক সময়ে। তাদের ঠাঁই নেই স্কুলে, হাসপাতালের ওয়ার্ডেও ‘ভিআইপি রোগী’দের চাপে তারা জায়গা পায় না।
তবু তারা ব্যবহার হয়—
•মিছিলে ভাড়া খাটা শ্রমিক হিসেবে
•গ্যাং লিডারের ছায়া বাহিনী হিসেবে
•লাঠি হাতে স্লোগান দেওয়া পেটুয়া হিসেবে
•ভোট কারচুপির ‘ইতর’ হাতিয়ার হিসেবে
•পিকেটিং, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিরতার ‘ইন্ধন’ হিসেবে তারা গুলি খায়, জেলে যায়, মরেও যায়। আর রাষ্ট্র কেবল দেখে—তামাশা। তবে সত্যিটা আরও নিষ্ঠুর।
এই দেশে ধর্ষণ হয় প্রতিদিন। কিন্তু ধর্ষণের শিকার হয়—
•গার্মেন্টস কর্মীর মেয়ে,
•কোনো পাহাড়ি কিশোরী,
•বাসার কাজের মেয়ে,
•পথে থাকা কিশোরী।
কিন্তু ধর্ষণ হয় না—
•পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা,
•সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীর বোন,
•মন্ত্রীর মেয়ে,
•কোনো সচিবের আত্মীয়া।
এটা কি কাকতালীয়? না। এটা হলো এক নিষ্ঠুর সামাজিক চুক্তি—ক্ষমতাবান নিরাপদ, শোষিত অসহায়। তাদের শরীর স্পর্শের আগেই রাষ্ট্র প্রহরায় দাঁড়িয়ে যায়।
আর আমরা? আমরা দেখি, ক্যামেরা চালাই, পোস্ট দেই। আলোচনায় বলি—“কী ভয়াবহ!” কিন্তু প্রতিরোধ করি না। রাস্তায় দাঁড়াই না। জবাব চাই না। তাহলে আসল অপরাধী কারা? ছুরি চালানো ছেলেটি? না।
সবচেয়ে বড় অপরাধী—
•যারা দেখেছে, কিন্তু মুখ বন্ধ রেখেছে,
•যারা ক্যামেরা ধরেছে, কিন্তু বাঁধা দেয়নি,
•যারা জানে কারা এসব ঘটায়, তবুও চুপ থেকেছে,
• যারা দরিদ্রের রক্ত দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা পোক্ত করে।
তারা রাষ্ট্রের সম্মানিত দানব। আর আমি? আমি নিজেও সেই অপরাধীদের একজন। আমি জানি কারা মারছে। জানি কারা ব্যবহার করছে। জানি কারা এই রাজনীতি পরিচালনা করে। তবুও প্রতিবাদ করিনি। মিছিল করিনি। জবাব চাইনি। শুধু লিখেছি, পড়েছি, চা খেতে খেতে আলোচনা করেছি। এভাবে জাতি বাঁচে না। আমরা গড়ে তুলেছি এক ভয়াবহ মানবিক দেউলিয়াপনার সমাজ যেখানে প্রতিবাদ বিলাসিতা, সহানুভূতি বিলুপ্ত, ন্যায়বোধ নিঃশেষ।
আমরা মানুষ নই, হেঁটে বেড়ানো যান্ত্রিক ক্যামেরা মাত্র—
যারা মৃত্যু দেখে ভিডিও করে, যারা আর্তনাদ শুনে মিম বানায়, যারা বিচার চাইলে বলে—“গেটআউট”। এই সমাজ শুধু ভয়ঙ্কর নয়, আত্মঘাতীও। এই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র নয়, এ এক প্রতিষ্ঠানিক খুনের কারখানা। আজ টোকাই মরেছে। আগামীকাল মরবে গার্মেন্টস কর্মী, তারপর কোনো প্রতিবাদী শিক্ষক, তারপর এক সাংবাদিক, তারপর আপনি। হ্যাঁ—আপনি।
কারণ রাষ্ট্র যখন কেবল গরিবদের মারতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার পরবর্তী শিকার হতে পারে যে কেউ। তাই বলছি— এই লেখা কোনো আবেগ নয়। এটি কোনো পলিশড ভাষণ নয়। এটি একটি জাতির বিবেকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগপত্র। আপনি আজ যদি মুখ না খোলেন, আপনি আজ যদি প্রতিবাদ না করেন, আপনি যদি আজও চুপ থাকেন— তাহলে আগামী লাশটা কাঁধে তোলার সময়, হয়তো আপনি নিজেই হবেন সেই লাশের পরিচিত মুখ।
রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com