২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয়ের একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। করোনা মহামারীর একটি গুরুতর প্রভাব হতে পারে বলে মনে করছে সানেম।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালের তুলনায় গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ২০২৩ সালে তিন গুণ বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাসিক ১ হাজার ৭০৪ টাকা।
তবে এ বর্ধিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় সব আয়ের মানুষের মধ্যে সমান নয়। দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের জন্য এই বৃদ্ধি মাত্র দ্বিগুণ ছিল, যেখানে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের জন্য বৃদ্ধি ছয়গুণ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনা মহামারী মোকাবিলায় বাংলাদেশে একটি প্রধান সাফল্য ছিল যথাসময়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা। বাংলাদেশে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে কভিড-১৯ টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এ সময় ৭৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ মহিলা (পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সী) ভ্যাকসিনের দুটির বেশি ডোজ পেয়েছেন।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে, যা স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। করোনা ও করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের উৎপাদনমুখী বিভিন্ন খাত মুনাফা সংকটে ভুগলেও ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ভালো প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে।
ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফার প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি, যা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো খাতের তুলনায় আকর্ষণীয়। ওষুধের দাম বাড়ায় অনেক কোম্পানির মুনাফা বাড়লেও সামর্থ্যহীন মানুষজন ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
সার্বিক দারিদ্র্য কমে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ :
কভিড মহামারীর পর দেশে দারিদ্র্য কমে ২০ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। তবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র কমলেও শহরে বেড়েছে। ২০২৩ সালে দারিদ্র্যের হার দেশের গ্রামীণ এলাকায় ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
‘কভিড-১৯ মহামারী এবং মহামারী-পরবর্তী প্রতিবন্ধকতা কীভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয় বৈষম্য, শিক্ষা এবং খাদ্য-সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে?’ শীর্ষক এ যৌথ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সাল শেষে মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে ২৮ শতাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশের সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কম খাচ্ছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বাড়ায় দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বেড়েছে তিনগুণ।
২০১৮ সালে দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ যা এখন ২০ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। যৌথ গবেষণায় বলা হচ্ছে, বর্তমানে দেশে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ। এ হার গ্রামীণ এলাকায় বেশি। গ্রামীণ এলাকায় চরম দারিদ্র্যে রয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার রংপুরে, দ্বিতীয় অবস্থানে বরিশাল। দারিদ্র্যের হারে রংপুর ও বরিশালে যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ।
উল্লেখযোগ্যভাবে, বাংলাদেশে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ২১ দশমিক ৬ শতাংশে কমে এলেও শহুরে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে গবেষণ।
কভিডে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে :
এ গবেষণায় দেখা গেছে, মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের ওপর মহামারীর প্রভাবে ৫৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৪ শতাংশ নারী মহামারী চলাকালে তাদের চাকরি হারিয়েছিলেন।
এ শ্রমিকদের বেশিরভাগই তিন-চার মাসের বেশি সময় ধরে বেকার ছিলেন। প্রায় সব শ্রমিকই মজুরি হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছেন। অকৃষি খাতের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি স্বনিযুক্ত কর্মী মহামারী চলাকালে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
তাদের অর্ধেকেরও বেশিকে এক-তিন মাসের জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কৃষি, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি বা মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে, পরিবারগুলো মহামারী চলাকালে উচ্চ কাঁচামালের মূল্য, উৎপাদিত পণ্যের কম দাম, শ্রমিকের অভাব, পরিবহন সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
এ গবেষণায় অভিবাসী পরিবারের ওপর মহামারীর প্রভাবও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। মহামারীর শুরু থেকে অনেক আন্তর্জাতিক অভিবাসী শ্রমিককে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়েছে।
২০১৮ সালে অভিবাসী কর্মীদের সংখ্যার অনুপাত হিসাবে, জাতীয়ভাবে ২০২৩ সালে জরিপ চলাকালে আন্তর্জাতিক অভিবাসী পরিবারের ৯ শতাংশেরও বেশি পরিবারে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী কর্মী ছিল। এ প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসীদের ফিরে আশার পেছনে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মহামারী চলাকালে চাকরি হারানো (৩৩ শতাংশ), চুক্তিসংক্রান্ত সমস্যা (২০ শতাংশ), নিয়োগকর্তার সঙ্গে বিরোধ (১৪.৭ শতাংশ), মিথ্যা/ভিসা বা প্রতারণার শিকার হওয়া (৪ শতাংশ)।
মূল্যস্ফীতিতে ৭০ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন :
এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ পরিবার মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে, ৩৫ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করেছে, ২৮ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে এবং ১৭ শতাংশ সঞ্চয় হ্রাস করেছে। খাদ্যাভ্যাসের এমন হ্রাসমান তারতম্য পরিবারগুলোকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
দরিদ্র পরিবারের মধ্যে, মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে ৫ শতাংশ পয়েন্ট (এপ্রিল ২০২৩-এ ২৫ শতাংশ থেকে অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৩-এ ৩০ শতাংশ), যেখানে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ৩ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে (৪ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে)।
শহুরে এলাকার দরিদ্ররা গ্রামের তুলনায় বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীন ২৯ শতাংশ গ্রামীণ দরিদ্র পরিবার এবং ৩২ শতাংশ শহুরে দরিদ্র পরিবারকে ২০২৩ সালের অক্টোবর/নভেম্বর মাসে মাঝারিভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। গ্রামীণ এবং শহর উভয় ক্ষেত্রেই দরিদ্র পরিবারের মধ্যে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ছিল ৭ শতাংশ।
সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে, গবেষণায় পাঁচটি মূল নীতিমালা সুপারিশ করে। প্রথমত, সরকারকে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (ঘঝঝঝ) অনুযায়ী সারা দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করতে হবে। শহুরে দরিদ্র এবং নব্য দরিদ্র পরিবারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুপস্থিত শিশুদের সমস্যা সমাধানের জন্য, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমাতে এবং মহামারী চলাকালে প্রতিবন্ধকতাঘটিত শিক্ষাক্ষতি (লার্নিং লস) পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতে আরও বাজেট বরাদ্দ এবং নির্দিষ্ট নীতিমালা জোরদার করা উচিত।
তৃতীয়ত, সরকারের কর সংগ্রহের আওতা বাড়ানো এবং বিদ্যমান কর কাঠামো পুনর্গঠনের ওপর জোর দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য আরও বড় আর্থিক জোগানের প্রয়োজন হবে।
চতুর্থত, পুরুষ, তরুণ এবং স্থায়ীভাবে ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার কমাতে সরকারকে আরও সক্রিয় শ্রমবাজার নীতি গ্রহণ করতে হবে।
পরিশেষে, গৃহস্থালির মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকারকে বিকল্প ও পরিপূরক নীতি গ্রহণ করতে হবে।
এর মধ্যে বাজারের ওপর নজরদারি বাড়ানো এবং বাংলাদেশের অনেক প্রধান খাদ্যের আমদানি শুল্ক উদারীকরণ নীতি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অত্যাবশ্যকীয় খাবারের (যেমন দুগ্ধজাত খাবার, মাংস, ফলমূল ইত্যাদি) বর্ধিত সরবরাহ বাংলাদেশকে দামের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে। এর সঙ্গে সঙ্গে সহায়ক রাজস্ব ও আর্থিক নীতিমালা পরিপূরক হিসেবে জোরদার করা উচিত।