ক্যাটাগরি: পুঁজিবাজার

ডিএসইতে একই ভুল বারবার, মাশুল দিচ্ছে শেয়ারবাজার

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) একই ভুল বারবার সংগঠিত হচ্ছে। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশের শেয়ারবাজারকে। গত দুই বছরে শুধু কারিগরি ত্রুটি সংগঠিত হয়েছে ৫ বার‌। প্রতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তাতে আলোর মুখ দেখেনি একটিও। ফলে দেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। ডিএসইতে অদক্ষ ও অযোগ্য লোকের ভীড়ে দক্ষ ও যোগ্য লোকের মূল্যায়ন না হওয়া যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। যার উদাহরণ রয়েছে অনেক। অভিযোগ উঠেছে গত কয়েক বছরে ডিএসইর কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালকই (এমডি) তাদের পূর্ণ মেয়াদের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ফলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যেখানে অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য লোকের কারণে রোষানলে পড়ে যোগ্য ও দক্ষ লোক টিকতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। যা পৃথিবীর কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে এরকম নজির নেই।

এদিকে, রবিবার (১০ মার্চ) লেনদেন শুরুর কিছু সময়ের মধ্যেই ডিএসইর আইটিতে বড় ধরনের ত্রুটি দেখা দেয়। এর ফলে সারাদিন ট্রেডিং সিস্টেমসে সূচক সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুল তথ্য দেখানো হয়েছে। তবে লেনদেন শেষ হওয়ার মাত্র ১ মিনিট আগে ট্রেডিং সিস্টেমস স্বাভাবিক দেখানো হয়। বাজার শেষে দেখা যায়, একদিনে প্রধান সূচক হারিয়েছে ১৪১ পয়েন্টের বেশি। এই সূচক নিয়েও ডিএসইর বিরুদ্ধে সন্দেহের তীর ছুঁড়েছে বিনিয়োগকারীরা। এই ঘটনাকে ডিএসইর মার্কেট অপারেশন ডিপার্টমেন্ট ও আইটি টিমের পরিকল্পিত কারসাজি বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, রবিবার লেনদেন শুরু থেকেই ডিএসইর ট্রেডিং সিস্টেমসে সূচক সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুল তথ্য দেওয়ায় আতঙ্কে ছিলো বিনিয়োগকারীরা। তবে লেনদেন শেষ হলেও বিনিয়োগকারীদের সেই আতঙ্ক এখনো কাটেনি। একদিনে ডিএসইর প্রধান সূচক ১৪১ দশমিক ১৫ পয়েন্টে হারিয়েছে। হঠাৎ করে ডিএসইর আইটিতে ত্রুটি এবং দিন শেষে বড় পতনে উদ্বেগে বিনিয়োগকারীরা। বার বার ডিএসইর এমন ভুলের পেছনে ডিএসইর মার্কেট অপারেশন ডিপার্টমেন্ট ও আইটি টিমের অদক্ষতা কারণ হিসাবে দেখছে অনেকেই। সেই সঙ্গে এত বড় পতন পরিপকল্পিত বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও বহুবার ডিএসইর প্রযুক্তিগত ত্রুটির কবলে পড়ে। কিছুদিন পর পর ডিএসইর এমন সমস্যায় ভুগতে হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই বছরে যতবার কারিগরি ত্রুটির কবলে পড়ে, তা বিশ্বের কোনো স্টক এক্সচেঞ্জের এমন নজির নেই।

এ বিষয়ে ডিএসইর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) তারিকুল ইসলাম অর্থসংবাদকে বলেন, কর্পোরেট অ্যাকশনে ত্রুটির ফলে এমনটা ঘটেছে। বিভিন্ন কোম্পানির রাইট শেয়ার, বোনাস শেয়ার এডজাস্টমেন্ট করতে গিয়ে সূচকে ভুলভাবে সমন্বয় হয়েছে। আমরা কাজ করছি। দ্রুতই এর সমাধানে কাজ চলছে বলে তিনি জানান।

তবে সারাদিনেও এর সমাধান করতে পারেনি ডিএসইর আইটি টিম। বিপরীতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে ডিএসই। একদিনে একটি শেয়ারে সাড়ে ৫ কোটি শতাংশ শেয়ার দর বৃদ্ধির ঘটনা ঘটিয়েছে একচেঞ্জটি। আমরা নেটওয়ার্কের শেয়ারে এ অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির ঘটনা দেখা যায়। তবে পরক্ষণে কোম্পানিটির সারাদিনের লেনদেন স্থগিত করে ডিএসই।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ অর্থসংবাদকে বলেন, এটি প্রথম নয়। এর আগেও অনেকবার ডিএসইর আইটি জনিত সমস্যার কারণে লেনদেনে বিঘ্ন হয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তদন্ত করে দেখা উচিত। এটি সম্পূর্ন ডিএসইর ব্যর্থতা বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধানে কমিশন থেকে আইটি দক্ষ দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে বিএসইসিতে। রিপোর্টে কোনো ধরণের অনিয়ম পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বিএসইসি।

জানা গেছে, ডিএসইর কারিগরি ত্রুটি বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) খাইরুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদসহ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও বেশি ধোঁয়াশা তৈরি হয়। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। বিভিন্ন সময়ে ভুল তথ্য দেওয়া এবং জানতে চাইলে সঠিক তথ্য না দিতে পারাই ডিএসইর কর্মকর্তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়াও একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। অতীতে কখনো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নিয়োগ নিয়ে, কখনো এমডির পদত্যাগ নিয়ে, কখনো আবার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে এক্সচেঞ্জটি। গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর চারজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা নিয়ে আবারো বিতর্ক তৈরি হয়। শোকজ করার আগেই তাৎক্ষণিকভাবে চার কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেন এক্সচেঞ্জটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ নিয়ে ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।

এর আগেও, দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েন ডিএসইর প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) খাইরুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দেওয়া একটি চিঠির জবাব দেওয়ার ইস্যুতে ডিএসইর সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে দ্বন্দে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দফায় ই-মেইল এবং পাল্টা ই-মেইলের মাধ্যমে ডিএসইর এই দুই কর্মকর্তার মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে। এ নিয়ে ডিএসইর ম্যানেজমেন্টের সব কর্মকর্তাই প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়াও ডিএসইর মার্কেট অপারেশন বিভাগের কয়েকজন ডিজিএমের বিরুদ্ধে তথ্য পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। যার মধ্যে কয়েকজন এখনো দায়িত্বরত আছেন। একই সঙ্গে দুইজন জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। তারপরেও স্বপদেই বহালতবিয়তে রয়েছেন তাঁরা।

সূত্র মতে, ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর প্রতিবেদন দাখিল সংক্রান্ত বিষয়ে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই ও সিএসই) অবস্থান ব্যখ্যা করতে বলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আর বিএসইসির চিঠির জবাব কে দেবে তা নিয়েই দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েন ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সাইফুর রহমান মজুমদার ও প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা খাইরুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ। এ দুই কর্মকর্তার কেউই ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর অবস্থানের ব্যখ্যা বিষয়ে দায়িত্ব নিতে চান না। একজন অপরজনের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন।

সে সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা খাইরুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি অর্থসংবাদকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। এটা অফিসিয়াল বিষয়। ২০২২ সালে এমটিবি ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ ডিএসইর সিআরও পদে যোগদান করেন।

জানা গেছে, প্রায় এক বছর আগে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাকে ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর পুনরায় কাজে ফিরিয়ে আনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। তবে তথ্য প্রযুক্তিতে নিজের ক্যারিয়ার গড়া জিয়াউল করিমকে দেশের প্রধান শেয়ারবাজারের অডিট কমিটির উপদেষ্টা করা হয়। দায়িত্ব অবহেলার কারণে ডিএসইর চিফ টেকনোলজি অফিসারের (সিটিও) পদ হারানো কর্মকর্তা এখন ডিএসইর অডিট কমিটিকে পরামর্শ দেন।

সূত্র মতে, ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর ডিএসইর অডিট কমিটির উপদেষ্টা পদে যোগ দিয়েছেন জিয়াউল করিম। অস্থায়ী ভিত্তিতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে জানানো হয়। তবে অডিটে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও জিয়াউল করিম কিভাবে এই পদে যোগ দিয়েছেন তা নিয়ে খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকে বলছেন, যে বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাই নেই, তিনি কিভাবে সেই বিষয়ে কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেবেন?

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তি শেয়ারবাজারের মতো সংবেদনশীল জায়গায় অডিট উপদেষ্টা হলে সেটি দেশের পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষতি ছাড়া মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনবে না।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ডিএসইর তৎকালীন সিটিও জিয়াউল করিমকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে প্রায় এক বছর তিনি বাধ্যতামূলক ছুটিতেই ছিলেন। এই সময়ে প্রতি মাসে তিনি বেতন-ভাতা বাবদ ডিএসই থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা গ্রহণ করতেন। অর্থাৎ গত এক বছরে জিয়াউল করিম কোন কাজ না করেই ডিএসই থেকে কোটি টাকার বেশি বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ফের ভিন্ন পদে যোগ দিয়েছেন জিয়াউল করিম।

সূত্র জানায়, অডিট অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত ঝুঁকি মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ এবং আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পরিচালনা পর্ষদকে পরামর্শ দেবে। এছাড়াও এ কমিটি পর্যায়ক্রমে এক্সচেঞ্জের অভ্যন্তরীণ আর্থিক খরচ এবং ব্যবস্থাপনা নিরীক্ষার জন্য দায়ী থাকবে। আর এমন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির উপদেষ্টা পদেই যোগ দিয়েছে ডিএসইর সাবেক টেকনোলজি অফিসার জিয়াউল করিম।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ডিএসইর বোর্ড চাইলে যে কাউকে যে কোন পদে নিযুক্ত করতে পারে। এখানে কারও কিছু বলার নেই। তবে কোন পদে কাউকে নিযুক্ত করার আগে অবশ্যই তাঁর অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা দরকার। কেননা, শেয়ারবাজারের মতো সংবেদনশীল জায়গায় অনভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করলে সেটি বাজারের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

এর আগে, গত বছরের ৬ আগস্ট ডিএসইর সার্ভারে ত্রুটি দেখা দেয়। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে লেনদেন শুরু হয়ে দুপুর আড়াইটায় শেষ হয়। আর বিকেল ৩টা বা সাড়ে ৩টার মধ্যে প্রতিদিনের লেনদেনের শেয়ার নিষ্পত্তি হয়। তবে ঐদিন রাত ১১টা নাগাদও অনেক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন নিষ্পত্তি করতে পারেনি ডিএসই। লেনদেন নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা বাসায় যেতে পারেনি।

এছাড়া, ডিএসইর কারিগরি ত্রুটির সঙ্গে ওয়েবসাইটে কিছুদিন পর পর ভুল তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কে ফেলা তো লেগেই আছে। গত ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট ডিএসইর সাপ্তাহিক প্রতিবেদন ছিলো গোঁজামিলে। সেই সপ্তাহের প্রতিবেদনে সংস্থাটি টপটেন লুজারের যে তালিকা প্রকাশ করেছিলো সেটি ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী, শতাংশ হিসেবে তালিকা প্রস্তুত করা হলেও তার ব্যত্যয় দেখা গেছে ডিএসইর ঐ প্রতিবেদনে। শতাংশ হিসেবে কিছু কোম্পানি শেয়ারদর কম হারালেও লুজারের শীর্ষ তালিকার শুরুতে নিয়ে আসা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানকে। আর বেশি দরপতন হওয়া কোম্পানিগুলোকে টপটেন লুজার তালিকার শেষের দিকে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ডিএসইর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেননি।

জানা গেছে, ঐ সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে রুপালী ব্যাংকের সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে। কোম্পানিটির শেয়ারদর গত সপ্তাহে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ কমেছিলো। এ তালিকার (টপটেন লুজার) দ্বিতীয় স্থানে থাকা আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারদর কমেছিলো দশমিক ৪২ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর দশমিক ৫৪ শতাংশ কমেছিলো। তালিকার চতুর্থ স্থানে রাখা হয়েছে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ দরপতন হওয়া ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেডকে। তালিকার ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা সিএপিএম আইবিবিএল ইসলামি মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ারদর কমেছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

নিয়ম অনুযায়ী, শতাংশ হিসেবে টপটেন লুজার ও গেইনার তালিকা প্রস্তুত করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। গেইনার তালিকায় এ নিয়ম মানা হলেও লুজার তালিকায় নিয়মের ব্যত্যয় দেখা গেছে। শতাংশ হিসেবে সিএপিএম আইবিবিএল ইসলামি মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ারদর কমেছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমলেও প্রতিষ্ঠানটিকে লুজার তালিকার ৬ষ্ঠ স্থানে রাখা হয়েছে। অপরদিকে দশমিক ৪২ শতাংশ শেয়ারদর কমা আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংককে রাখা হয়েছে এ তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। শতাংশ হিসেবে কম শেয়ারদর হারানো প্রতিষ্ঠানকে লুজার তালিকার শুরুতেই রাখা হয়েছে। আর বেশি দরপতন হওয়া কোম্পানিগুলোকে রাখা হয়েছে শেষের দিকে। বিষয়টি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, সাপ্তাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের দায়িত্ব ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের গবেষণা বিভাগের। এ বিভাগের দেখভাল করেন খোঁদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। টপটেন লুজার তালিকায় গোঁজামিলের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সাইফুর রহমান মজুমদার অর্থসংবাদকে বলেন, সাপ্তাহিক প্রতিবেদন না দেখে কিছু বলা যাবে না।

সেসময় জানতে চাইলে ডিএসইর গবেষণা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও এজিএম মো. মাহফুজুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, লুজার তালিকা এক্সেলে (মাইক্রোসফট এক্সেল) লিংক করা থাকে। ঠিক বুঝতে পারছি না, হয়তো এক্সেল লিংকে কোথাও সমস্যা হয়েছে। বিষয়টি অফিসে গিয়ে জানাতে পারবো।

২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি তালিকাভুক্ত ইস্টার্ণ ক্যাবলসের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়েও ভুল তথ্য দেয় ডিএসই। ইস্টার্ণ ক্যাবলস দ্বিতীয় প্রান্তিকে আয় করলেও ডিএসইতে সেটি লোকসান হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছিল। এর একদিন পরই তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি বিচ হ্যাচারির আর্থিক প্রতিবেদন নিয়েও ভুল তথ্য দেওয়া হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইস্টার্ন ক্যাবলস থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মার্কেট অপারেশন ডিপার্টমেন্টে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে মার্কেট অপারেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। মার্কেট অপারেশন বিভাগের প্রধান রনি ইসলাম কারসাজির চক্রের ইন্ধনেই এ ভুল তথ্য প্রকাশ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও এসিআই লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। ওই সময় মার্কেট অপারেশন বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডিএসই তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এমনকি মার্কেট অপারেশন বিভাগের তৎকালীন প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে পুনরায় ভুল তথ্য দেওয়া হলেও ডিএসইর বর্তমান মার্কেট অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ডিএসইর পর্ষদ সভায় বিভ্রান্তিকর এসব তথ্য প্রকাশের বিষয়ে এক্সচেঞ্জটির ভারপ্রাপ্ত এমডি এম সাইফুর রহমান মজুমদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে পর্ষদ। সভায় পর্ষদের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভারপ্রাপ্ত এমডিকে পরামর্শ দেয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত এমডি ডিএসইর মার্কেট অপারেশন্স বিভাগের প্রধান ও এক্সচেঞ্জটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রনি ইসলাম, একই বিভাগের ব্যবস্থাপক কামরুজ্জামান ও হুমায়ূন কবীর এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ রাকিবুর রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্তের আদেশ জারি করেন। এসব কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো চিঠিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইস্টার্ন কেবলস ও বিচ হ্যাচারির বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনের বরাত দেয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিভাগটির পক্ষ তথ্য বিতরণরের ক্ষেত্রে করা ভুলের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, অংশীজনদের মধ্য ভুল তথ্য যাওয়ার পাশাপাশি বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এক্সচেঞ্জের সুনামও ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ কারণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে ডিএসই সার্ভিস রুলস ২০১৭ অনুসারে দায়িত্বে অবহেলার কারণে কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তার কারণ ব্যাখ্যা করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

ডিএসইর মার্কেট অপারেশন বিভাগ এর আগেও বিভিন্ন সময় দায়িত্বে অবহেলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কনফিডেন্স সিমেন্ট নিয়ম লঙ্ঘন করে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি ডিএসই। জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করলে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হয়। অথচ কনফিডেন্স সিমেন্ট নিয়ম লঙ্ঘন করে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়নি ডিএসইর মার্কেট অপারেশন বিভাগ।

এছাড়া, ৩০ জুন,২০২২ হিসাববছরের জন্য কনফিডেন্স সিমেন্ট ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ৬ নভেম্বর কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ ঘোষণা দেওয়া হয়। অথচ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে কনফিডেন্স সিমেন্টের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে কোম্পানিটির ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ শেয়ার ছিল। তবে ডিএসইর মার্কেট অপারেশন বিভাগের অবহেলায় ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয় কনফিডেন্স সিমেন্ট।

কারিগরি ত্রুটির কারণে ২০২২ সালেও একাধিকবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বন্ধ ছিল। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর কারিগরি ত্রুটির কারণে লেনদেন শুরুর কিছুক্ষণ পরই তা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও একই বছরের ৩০ অক্টোবরও ত্রুটির কারণে লেনদেন বন্ধ রাখতে হয় ডিএসইকে। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় বাজার সংশ্লিষ্টদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর বিএসইসির সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের ত্রুটি নিয়ে বিভিন্ন কমিটি এক্সচেঞ্জটির আইটি কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় বিএসইসি এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডিএসইর চিফ টেকনোলজি অফিসারকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হলো।

আজ দেশের প্রধান পুঁজিবাজারে ৪৭৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। যা এর আগের কার্যদিবসের তুলনায় ২২৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা কম। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিলো ৭০৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

এসএম

শেয়ার করুন:-
শেয়ার