ভাষা মানে হয়তো মায়ের ধমকানি, চিরসহিষ্ণু বাবার প্রশ্রয়ের হাসি। ভাই/বোনের অহেতুক খুনসুঁটি বা মানুষের ভীরে অযুত আঁখি ফাঁকি দিয়ে প্রেমিকার প্রতি স্বলজ্জ চোরাচাওনি। ওর অভিমানভরা চোখের সামনে কর্তব্যবিমূঢ় হাসি। ভাষা মানে হয়তো কৈশোরের খলখলানি, বার্ধ্যক্যের বিস্ময়ভরা চাহনি, জীবিকার তাগিদে রাস্তার মোড়ে কোন হকারের অনবরত জিহ্বার নাচুনি কিংবা ভাষা মানে আড্ডায় চায়ের কাপে কথার ঝুড়ি অথবা গভীর রাতে ভীষণ একাকীত্বে দুঃখ গলিয়ে টিস্যুর ভাজে ভাজে বিন্দু বিন্দু সুখের চুরি কিংবা ভাষা মানে আরও না বলা অনেক কিছু।
বিশ্বের বুকে ৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারির বাঙালি তরুণরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা প্রমাণ করেছিল এবং সেইসাথে বাঙালি জাতিসত্তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। তাদের অসামান্য অবদান প্রজন্ম হতে প্রজন্ম পর্যন্ত বহাল রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের।
দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের তরুণ শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মনের কথা ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন ও গ্রন্থনা করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অর্থসংবাদ’র প্রতিনিধি মো. সাকিব আসলাম।
আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাঙালী, আমি বাঙাল। আমি গর্বিত আমি বাঙাল।এটা যদি অনাধুনিকতা, অসামাজিকতা বা আভিজাত্যহীনতা হয় তবে তাই সই।
অর্ণব হাসান
লোক প্রশাসন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
যে ভাষা স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে ভিন্ন ভাষার শব্দ গ্রহণ করতে পারে সে ভাষা ততবেশী সমৃদ্ধ, এটা ভাষাতাত্ত্বিকদের অভিমত। তবে, আমরা এ প্রজন্মের কথাতাত্ত্বিক তরু(ণ/ণী)রা আরো এক কাঠি এগিয়ে। বিগত কয়েক বছর ধরে, আমরা কথার মাঝে মাঝে ইংরেজি বা হিন্দি শব্দ ঢালাওভাবে ঢুকিয়ে বাংলা ভাষাকে হাস্যকর ভাবে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছি। শরীর দুলিয়ে, ঠোঁট বাকিয়ে বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে “বাংরেন্দি” নামক এক কিম্ভূত ভাষায় কথা বলাকেই আমরা “স্মার্টনেস” ভাবা শুরু করেছি। আমাদের তারকারা ভূলেভরা ইংরেজিতে কথা বলাকেই আভিজাত্য ভাবছেন, হুজুরেরা কথার মাঝে মাঝে আরবি, ফার্সি, উর্দুকে টেনে এক অদ্ভুতুড়ে ভাষায় কথা বলাকে ধার্মিকতা মনে করছেন। আমি ভিন্ন ভাষার প্রতি বিদ্বেষী হবার কথা বলছিনা। অন্যভাষা জানাটা নিঃসন্দেহে একটা শিল্পকর্ম তবে নিজ ভাষায় শুদ্ধ করে কথা বলাটা তার চেয়েও বড় ও অনুপম এক শিল্প। যে শব্দের প্রচলিত বাংলা শব্দ নেই সেখানে অন্য ভাষার প্রতিশব্দের ব্যবহার নিশ্চয়ই করবো তবে প্রচলিত ও সুন্দর বাংলা শব্দকে হটিয়ে তথায় ভিন্ন ভাষার শব্দকে জোর করে ব্যবহার করে অভিজাত হওয়ার ভান করা যে আধুনিকতার আবরণে অসুস্থতা তা কবে বুঝবো?
আমি বাংলা ভাষার সাধনা করে কাউকে গীতগোবিন্দ বা পদ্মাবতী হতে বলছিনা, বলছিনা ভাষার জন্য জীবন দিয়ে শহীদ মিনারের খুঁটি হতে, আমাদের পূর্বজনেরা তা অনেক আগেই করেছেন, কেবল শুদ্ধ বাংলার চর্চা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। যেদিন ওয়াইক্লিফ ল্যাটিন ছেড়ে ইংরেজি, মধূসূদন ইংরেজি ছেড়ে বাংলা আর রামকৃষ্ণভাবশিষ্য বিবেকানন্দ তাঁর দীক্ষাগুরুর ভাষার বলয় ভেঙ্গে নিজ ভাষায় প্রবেশ করেছিলেন স্বার্থক তারা সে দিনেই হয়েছিলেন এবং আজও স্বমহিমায় টিকে আছেন।
সকল ভাষা শহীদ আর ভাষা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা।ভাষার মাসে কেবল শহীদ মিনার, কালো ব্যাচ, ফুলের তোড়া, খালি পায়ের মধ্যে আটকে না পড়ে আজ থেকে শুরু হোক শুদ্ধ ভাষার চর্চা। একজন বৃদ্ধ আনিসুজ্জামান বা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে যদি হাজারো মানুষকে মুগ্ধ করতে পারেন তবে আমরা প্রাণবন্ত তরুণেরা কেন নয়?
বাংলা ভাষা জীবনের সামগ্রিক যোগসূত্র
শাহানীন সুলতানা মীম
ইংরেজি বিভাগ
শান্ত-মরিয়াম সৃজনশীল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
ভাষা যোগাযোগের একটি অন্যতম মাধ্যম। ভাষার মাধ্যমে আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, ভালো লাগা, খারাপ লাগা প্রকাশ করি। ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আর এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, বরং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদান রাখবে। বাঙালি জাতি নিজের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে বাংলা তাদের নিকট ভালোবাসার মন্ত্র এবং সারা বিশ্বের নিকট তুলে ধরেছে ভাষা একমাত্র হতে পারে ভালোবাসার মন্ত্র। আমাদের মাতৃভাষা দিবসের মধ্যে দেশ, দেশের মানুষ, দেশের সংস্কৃতি ভালোবাসা’সহ নানা প্রেক্ষাপটের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আত্মিক বন্ধনে অতপ্রোতভাবে জড়িত
নাজমুন নাহার
সমাজ কল্যাণ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধুমাত্র একটি উদযাপন নয়, বরং এটি একটি ভাষার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। পুলিশের গুলিতে সেদিন রহিম উদ্দিন, সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিনটি সারা বিশ্বে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। বাংলাদেশে, সরকারিভাবে এই দিনটি শোক ও শ্রদ্ধা দিবস হিসেবে পালিত হয়। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। সারাদেশে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মিছিল ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। মাতৃভাষা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, বরং সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং পরিচয়েরও বাহক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্বের সকল মানুষকে তাদের মাতৃভাষা গর্বের সাথে ধারণ করতে এবং বিশ্বের বহুভাষিকতা রক্ষা করতে অনুপ্রাণিত করে। ২১ ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র মাতৃভাষার জন্য নয়, বরং বাংলার সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন টিকে রাখার দিনও। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরিচয় এবং আবেগের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বাংলা ভাষা আমাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং আমাদেরকে বাঙালি হিসেবে গড়ে তুলেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বাংলা ভাষার জন্য কত মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করা হয়েছে। সেই ভাষার প্রতি আমাদের কতটা দায়িত্ব আছে, তাও এই দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি শুধু একটি দিনের উদযাপন নয়, বরং এটি একটি প্রতিজ্ঞার দিন। আমাদের সকলের উচিত এই দিনে বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা নবায়ন করা। বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব এবং আমাদের পরিচয়। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই ভাষার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করা হয়েছে। আমাদের সকলের উচিত বাংলার সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন টিকিয়ে রাখা এবং এর প্রসার ও বিকাশে ভূমিকা রাখা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধুমাত্র একটি উদযাপন নয়, বরং এটি একটি ভাষার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ।
নিজভূমে পরবাসী
মো. মহাইমিনুল ইসলাম অপু
ইম্পেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, খুলনা
পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত ও সম্মানিত হলেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় খোদ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা ভাষা যেন অবহেলিত। অযত্ন অনাদরে পড়ে আছে দুঃখিনী বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারে যে স্বপ্ন নিয়ে রক্ত দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা, তাঁদের সে স্বপ্ন যেন আজ ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র উপেক্ষিত বাংলা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ ভাষাগত দিক থেকে বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। তথাপি বাংলা যেন নিজভূমে পরবাসী। কবি মাইকেল মুধুসূদন দত্তের ভাষায়- হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন; তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি।
বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের শিক্ষা সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলার গুরুত্ব দিতে হবে সর্বপ্রথমে এবং বাংলা ভাষার সৌন্দর্যকে প্রজন্ম পর প্রজন্মের নিকট সুস্পষ্ট থাকে এ বিষয়ে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
কাফি