দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত বিনিয়োগে মমুনাফার হারে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোর সূদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। ফলে সকল ব্যাংক বিনিয়োগরে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯% লাভে বিনিয়োগ এবং ৬% লাভে আমানতের হার বাস্তবায়ন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারি ও পরিপালনগত বাধ্যবাধকতায় ব্যাংকগুলোর লাভের এ হারে সমতা আসায় ব্যবসায়ী ও সাধারণ বিনিয়োগ গ্রহীতাদের মধ্যে স্বস্তির ছাপ দেখা দিয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করায় আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকগুলোর বছর শেষে মুনাফার অংক কম মনে হলেও সার্বিকভাবে লাভবান হবে দেশের সাধারণ মানুষ। স্বল্প খরচে পূঁজি জোগাড় করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে যাবে। কমে যাবে বাজরের দ্রব্যমূল্য। প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। স্বাধীনতার পর দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। উচ্চ ফলনশীল শস্য চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া, স্বাস্থ্যসেবা, বয়স্ক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদানে এনজিওগুলো এগিয়ে আসে। দেশি বিদেশি মিলিয়ে তালিকাভূক্ত এনজিওর সংখ্যা ২ হাজার ৫২৯ হলেও হাতেগোনা সংখ্যক এনজিওর কার্যক্রম চোখে পড়ে। এগুলোর মধ্যে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা ও কেয়ারসহ কয়েকটির নাম উল্লেখযোগ্য।
এনজিওগুলো প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা গ্রাহকের নিকট থেকে সঞ্চয়ও গ্রহণ করে। এনজিওগুলোর বিনিয়োগে সূদের হার ২৪% পর্যন্ত রয়েছে। ব্যাংকিং বিষয়ক ধারণা না থাকা অথবা ব্যাংকিং সুবিধা বঞ্চিত নিরক্ষর ও প্রান্তিকজন এনজিওগুলো থেকে এই উচ্চ মূল্যে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। ঋণ গ্রহণ করে যতটা লাভবান হন তার চেয়ে
চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা ঋণের ভারে জর্জরিত হন বেশি। ব্যবসায়িক বা আয়বর্ধক কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিক ধারণা বা সহযোগিতার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন অনেকে। এক এনজিওর ঋণ পরিশোধ করতে ধার করেন আরেক এনজিওর টাকা। জড়িয়ে পড়েন ঋণের জালে। অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করেন। ক্ষেত্র বিশেষ ঋণের ভয়ে এলাকা ছাড়েন। এনজিও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক।
কোন কোন এনজিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও দরিদ্র গ্রাহকদের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখে না। অথবা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের সূদ মওকুফ করে না। গরীব কৃষকদের গবাদি পশু, হাস-মুরগী এমনকি ব্যবহার্য মালপত্র নিয়ে যাওয়ার সংবাদও পাওয়া যায়।
কিছু এনজিও ক্ষুদ্র ঋণের পাশাপাশি উচ্চ সূদের প্রলোভন দিয়ে আমানত গ্রহণ করে থাকে। অধিক মুনাফার আশায় গ্রাহকরা নিজেরটাসহ আত্মীয় বন্ধুদের থেকে ধার কর্য করে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখে। যুবক-এর মত অনেক এনজিও গ্রাহকদের স্বর্বশান্ত করে দিয়ে উধাও হয়েছে রাতারাতি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় পিরোজপুরে এহসান গ্রুপের ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের খবর। বেশি লাভের প্রলোভনে নিরীহ নিম্ন আয়ের মানুষকে আকৃষ্ট করে তাদের সর্বশান্ত করে দেয় এ প্রতিষ্ঠান।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে পল্লী অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম চালু রয়েছে। এ ব্যাংক দেশব্যাপী প্রায় ১২ হাজার গ্রামে ২৫ লাখ মানুষের মধ্যে পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির পর্যাপ্ত সুনাম রয়েছে। গ্রাহকদের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রেখে ব্যাংকটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে বলে যানা যায়।
ক্ষুদ্র গ্রাহকদের ব্যবসা-বানিজ্য, কৃষি কাজ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে পরামর্শ প্রদান, নবজাতকের জন্য শুভেচ্ছা উপহার প্রদান, সন্তানদের শিক্ষাসামগ্রী প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের বিনিয়োগের লভ্যাংশ মওকুফ, বিনিয়োগ গ্রাহক মারা গেলে তাদের দাফন কাফনে আর্থিক সহযোগিতাও দিয়ে থাকে ব্যাংকটি। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম দেশের এনজিওগুলোর জন্য একটি মডেল হতে পারে। ইসলামী ব্যাংকের মত আরো কয়েকটি ব্যাংক ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সম্প্রতি সিটি ব্যাংক ও বিকাশ যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণ
কার্যক্রম চালু করেছে। এর মাধ্যমে বিকাশের গ্রাহকরা অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই সিটি ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ পেতে পারেন। ডিজিটাল সেবা ও অন্তর্ভূক্তিমূলক কার্যক্রম চালু এবং উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণের ফলে ব্যাংকগুলো এখন পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বঞ্চিত মানুষের দোঁরগোড়ায়। সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হচ্ছে ব্যাংকিং সেবা। ফলে দিন দিন এনজিও নির্ভরতা অনেকটা কমে আসছে পল্লী অঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র মানুষের।
এনজিওগুলোর চড়া হারে ঋণ প্রদান ও প্রতারণা জনগণকে ক্রমান্বয়ে এনজিওবিমুখ করছে। যা এ খাতের জন্য অনেক বড় ঝুঁকি হতে পারে। ব্যাংকগুলোর মত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোকে সিঙ্গেল ডিজিটে বিনিয়োগ ও আমানত কার্যক্রম পরিচালনায় বাধ্য করা না গেলে প্রান্তিক মানুষের সত্যিকারের উন্নয়ন আরো অনেক পিছিয়ে যাবে। এনজিওগুলোর আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার সুষম নিয়ম কাঠামো তৈরি ও তাদের সুদী কারবারে লাগাম পরানোর এখনই সময়।
রিয়াজ উদ্দিন: লেখক ও ব্যাংকার
ইমেইল : riyazenglish@gmail.com