শতবর্ষের মঞ্চ হোক সুশিক্ষিত জাতি গঠনের মঞ্চ

শতবর্ষের মঞ্চ হোক সুশিক্ষিত জাতি গঠনের মঞ্চ
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার একটি গ্রাম, যার নাম নহাটা। ইতিহাসের পাতায় নহাটা স্কুল প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। মাগুরায় স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৫৮ সালে। অনতিদূরে নবগঙ্গার ওপারে গঙ্গারামপুরে ১৯০০ সালে এবং বিনোদপুরে ১৯০৮ সালে। এসময় নহাটা অঞ্চলে একটি স্কুলের দারুণ অভাব অনুভূত হতে থাকে। এহেন প্রেক্ষাপটে বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস ও বিদ্যোৎসাহী বাবু শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্যের উদ্যোগে স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের দান ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও অদম্য প্রচেষ্টার ফলে ১৯২৪ সালে স্থাপিত হয় নবগঙ্গা বিধৌত মাগুরা জেলার প্রত্যন্ত জনপদ নহাটায় মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের একটা উজ্জ্বল বাতি ঘর, নহাটা স্কুল।

শতবর্ষ প্রাচীন এই বিদ্যালয় এই অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষা লাভের গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়ে গর্বের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। শতবর্ষ আগে গড়ে উঠেছিল এই মহান প্রতিষ্ঠান, যার ছোঁয়ায় আমরা অন্ধকারের মাঝে খুঁজে পেয়েছি আলোর দিশা। রাজা প্রমথ ভূষণ দেবরায় বাহাদুর ও তার স্ত্রী রাণী পতিত পাবনী এই বিদ্যালয়ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কালীগঞ্জের নলডাঙ্গা রাজস্টেটের রাজা প্রমথ ভূষণ দেবরায় বাহাদুরের স্ত্রীর নামানুসারে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় রাণী পতিত পাবনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

এই স্বনামধন্য রাজার রাজবাড়ী তখন নহাটায় অবস্থিত। আজ এই বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর অগণিত ছাত্রছাত্রী দেশে-বিদেশে সাহিত্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, গবেষণা ইত্যাদি বহুবিধ খাতে সুনামের সঙ্গে মানবসেবা করে চলেছেন। ইছামতি বিলের উত্তরে এবং নবগঙ্গা নদীর পূর্বতীরে এক মনোরম পরিবেশে প্রায় ৯ একর জমির ওপর কয়েকটি আলাদা আলাদা ভবন নিয়ে বিদ্যালয়টি অবস্থিত।

আমার দাদারা ছিলেন দুই ভাই ইয়াসিন মৃধা এবং অহেদ মৃধা। আমার দাদার নাম অহেদ মৃধা। তার ছিল পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে। আমার বাবা পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান, মজিদ মৃধা। তার সাত ছেলে তিন মেয়ে। আমরা সবাই আমাদের গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের কিছু সময় পড়েছি। ৬৮ হাজার গ্রামের মতো আমাদের গ্রামটিও চমৎকার। একটি আদর্শ গ্রামে যা কিছু থাকা দরকার তার সব কিছুই রয়েছে এখানে। আমার বাবার ছোট ভাই সাত্তার মৃধা এই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন বহু বছর ধরে। বিদ্যালয়টি এতদঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপীঠ।

১৯২৪ সালে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও আমরা এখনও বিদ্যালয়ের একটি স্বীকৃত সংগঠন তৈরি করতে পারিনি। স্বাভাবিকভাবেই নহাটা রাণী পতিত পাবনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যা প্রশংসনীয়। সাধারণত স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মিলে এ ধরনের সংগঠন তৈরি করে থাকে। এই সংগঠনের মূল কাজ স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্কুলের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং অর্ধ-শতবর্ষ বা শতবর্ষ পালন উৎসব ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা নিয়ে কাজ করা ইত্যাদি।

১৯২৪ সাল থেকে এই স্কুলে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী দেশ-বিদেশে নানা কর্মে জড়িত ছিল বা রয়েছে নানাভাবে। ২০২৪ সালে স্কুলটির বয়স হবে একশত বছর। আমরা আলোচনার মাধ্যমে এমন একটি শতবর্ষ পূর্তি উৎসব পালন করবো যার মাধ্যমে এই জনপদের বর্তমান মানুষের কাছে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিত, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সেইসব বিদ্যানুরাগী দানশীল উদ্যোগপতি মানুষদের ও মহান শিক্ষকদের অবদানকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। আমরা সবাই যাতে উপলব্ধি করতে পারি তাদের এই অবদান শতবর্ষ ধরে কী প্রভাব রেখে চলেছে আমাদের জীবন ও জনপদে। আমরা সবাই তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারি, আমাদের দেশ ও জনপদের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করার।

কিন্তু আমরা কি খুব মনে রেখেছি সেই বিদ্যানুরাগী উদ্যোক্তাদের, স্কুল প্রতিষ্ঠাকালীন সেই শিক্ষকদের, যারা শতবর্ষ পূর্বে তাদের অকল্পনীয় দূরদর্শিতার মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন এই দরিদ্র জনপদে শিক্ষার এই বাতিঘর? আমরা কি অনুসন্ধান করেছি তাদের জীবন ও দর্শন? প্রসঙ্গত, আমি ব্যক্তিগতভাবে পাশের একটি স্কুল গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক স্কুলের শতবর্ষ পালনে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছি। কারণ সেখান থেকে আমি নবম এবং দশম শ্রেণি শেষ করেছিলাম।

গঙ্গারামপুর স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত নিবেদিতপ্রাণ সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কৃষ্ণগোপাল ভট্টাচার্যের বর্তমান দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করা যায়। তার ছাত্রছাত্রী হিসেবে আমরা তাকে একটা বাড়ি করে দিতে পেরে আনন্দ লাভ করছি। একজন শিক্ষাগুরুর প্রতি এটা আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই বিষয়টিকে উৎসব পালনের মঞ্চ থেকে দেশের সকল মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলে দেশে ছাত্র-শিক্ষক স্নেহভালোবাসার একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

নহাটা রানী পতিত পাবনী স্কুলের শতবর্ষ উদযাপনে আমার প্রস্তাবনা:

নহাটা রাণী পতিত পাবনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পালন উৎসবের অনুষ্ঠানকে প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই স্কুলে পাঠরত সন্তান-সন্ততি ও দরিদ্র শিক্ষকদের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখার জন্য সকলের নিকট আহ্বান জানাচ্ছি। সকল শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্র/ছাত্রী আনন্দ এবং গর্বের সঙ্গে যেন এই স্কুলের শতবর্ষ পালনে অংশ গ্রহণ করতে পারে সে দিকে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তাছাড়াও রয়েছে হতদরিদ্র অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সন্তান যারা মাধ্যমিক পাসের পর লেখাপড়া আর চালিয়ে যেতে পারে না। তাদের সাহায্যের বিষয়টিসহ আরো কিছু বিষয়ের ওপর আমি স্কুলের পরিচালনা কমিটি ও শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সকলের বিবেচনার জন্য নিম্নোক্ত ১০টি সুপারিশ পেশ করছি-

১। স্কুলটিকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা এখনি দরকার।
২। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তায় একটি স্থায়ী তহবিল গড়ে তোলা যায়।
৩। দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রতি ক্লাসে উক্ত তহবিল থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করা।
৪। দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য তহবিল থেকে এককালীন কিছু অর্থ প্রদান করে তাদেরকে ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা।
৫। প্রাক্তন সফল ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে একটা পরামর্শক কমিটি গঠন করে বর্তমান উচ্চশিক্ষা স্তরে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদেরকে নিয়মিত গাইড করা।
৬। স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে সংস্কৃতিমনা, বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
৭। স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত দরিদ্র শিক্ষক ও অসহায় ছাত্রছাত্রীদেরকে তহবিল থেকে প্রয়োজন মতো সহায়তা প্রদান করা।
৮। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হাইজনিক শৌচালয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত এবং দূরবর্তী ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছাত্রাবাস নির্মাণ করা।
৯। ছাত্র-ছাত্রীদের সুস্থতার লক্ষ্যে নিয়মিত খেলাধুলার ব্যবস্থা করা উচিত।
১০। স্কুলের পরিচিতি ও সার্বিক যোগাযোগের জন্য একটা হোমপেজ তৈরি ও তথ্যাদি নিয়মিত আপডেট করতে হবে।

জন্মের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ এক স্বপ্নতাড়িত দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরও সেই স্বপ্ন অর্জিত হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষা, কর্ম, খেলাধুলাসহ নৈতিকতার প্রয়োজন, আমরা তা এখনো গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন-রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সবার সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন এবং সেটা সম্ভব যদি আমরা সৃজনশীল এবং সুশিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি করতে সক্ষম হই। সৃজনশীল সুশিক্ষা হোক জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকরা হোক তার কারিগর। আমরা সুশিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাই সত্যিকারের দেশ গঠনের লক্ষ্যে।

আমার এ লেখা শুধু নহাটা স্কুল নয়, এ লেখা অনুপ্রেরণা বয়ে আনুক সমগ্র বাংলাদেশের স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মনে। মনে রাখতে হবে local concern global solution সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে নহাটার সমস্যার সমাধান মানে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান। নহাটা স্কুলের শতবর্ষ পালনের মঞ্চ হোক নতুন সুশিক্ষিত জাতি গঠনের শপথ গ্রহণের মঞ্চ।

লেখক: রহমান মৃধা, (নবম শ্রেণী ১৯৮০ সাল নহাটা, এসএসসি ১৯৮২ সাল গঙ্গারামপুর, এইচএসসি ১৯৮৪ সাল ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, ১৯৮৫ সাল- সুইডেন। শিক্ষা: প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট এবং এক্সিকিউটিভ এমবিএ। পেশা: পরিচালক, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং), rahman.mridha@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি