শুধু শপথের বাণী পড়লে হবে না প্রতিফলন ঘটাতে হবে

শুধু শপথের বাণী পড়লে হবে না প্রতিফলন ঘটাতে হবে
বিদেশি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশ্বের বুকে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছি। অন্যান্য বছরের মতো গত বছরে বিজয় দিবস পালন হয়েছে দেশে, তবে একটু ভিন্নতা লক্ষণীয় সেটা হলো দেশের জনগণকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শপথ বাণী পাঠ। “আজ বিজয় দিবসে দৃপ্তকণ্ঠে শপথ করছি যে, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। তাহলে সবাই মিলে এখন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ, গণতন্ত্র ও সরকারবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করি। করোনা মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি।”

তাহলে ২০২২ সালের শুরুতেই বিজয় দিবসের শপথের বাণীর প্রতিফলন ঘটাতে হবে কারণ এবারের শপথের বাণীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে যেমন গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি। বর্তমান সরকার সবার সরকার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সবার প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান প্রসাশন সবার জন্য সেখানে বর্ণ, ধর্ম বা বিরোধী দল বলে কিছু থাকার কথা নয়। হচ্ছে কি গণতন্ত্রের সৃজনশীল প্রাকটিস বাংলাদেশে? সেক্ষেত্রে আমি বলবো সরকার যতো শিগগির সম্ভব জনগণের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার এবং বাঁকস্বাধীনতা যেন ফিরিয়ে দেয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশে জিপিএস (গ্লোবাল পাথ সিস্টেম) বা এসওএস-এর সাহায্যে প্রশাসন সহজেই খুঁজে বের করতে পারে কোথায় কী ঘটছে না ঘটছে। তাদের পক্ষে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। দেশের জনগণের যেকোনো সমস্যায় যদি পুলিশ, RAB বা সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য যথাসময়ে না পাওয়া যায় তবে জনগণ নিজেই আইন হাতে তুলে নেয়। সেক্ষেত্রে সমস্যার মাত্রা বাড়ে বই কমে না। প্রায়ই নানা ধরনের উশৃঙ্খল এবং ভয়াবহ ঘটনা যা ফেসবুক বা খবরের মাধ্যমে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে অথচ কর্তৃপক্ষ তার কিছুই জানেনা। না জানার নিশ্চয় যুক্তিসংগত এবং গ্রহণযোগ্য কারণ রয়েছে। যদি SOS এলার্ম সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করে তবে বেশিরভাগ অপ্রত্যাশিত এক্সিডেন্ট, ধর্ষণ, খুন, ছিনতাই, এসিড নিক্ষেপ বা আগুনে পোড়া থেকে অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হওয়ার কথা। যেদেশে এখনও দিনে দুপুরে মানুষ মানুষকে খুন করে। যেদেশে মসজিদ বা মন্দিরে ধর্ষণ হয়। যে দেশের শত শত নারী দূরপরবাসে এবং বিশেষ করে মুসলিম দেশে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত হয়ে জীবন্ত বা মৃত অবস্থায় দেশে ফিরে, সেদেশের আইন বিভাগ এবং তার প্রসাশন বিভাগ যদি দেশের জনগণের নাগরিক নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে কি দরকার আছে সেই আইন আর প্রসাশনের?

গত বছরের ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনা বাংলার মাটিতে রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়েছে, সরকার ইচ্ছে করলে এসমস্ত বর্বরতার নিপাত ঘটাতে পারতো কিন্তু তা করা হয়নি বা হচ্ছে না। অথচ সরকারের গুরুদায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তার ওপর উন্নতমানের পদক্ষেপ নেয়া। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে সবাই যার যার চিন্তায় ব্যস্ত। বর্তমানে দেশের ঘৃণা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির কারণে এমনটি হচ্ছে। কারণ বর্তমান সরকার এবং প্রশাসন ভালো করেই জানে যদি বিরোধী দল ক্ষমতায় আসে তখন কী অবস্থা হবে তাদের, তাই যেকোনো মূল্যে টিকে থাকতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। দেশ জাহান্নামে গেলে কিছু যায় আসে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সরকার এবং তার প্রশাসন বিভাগ নির্লিপ্তভাবে দেশের এই অন্ধকার পরিস্থিতি শুধু দেখছে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের বৃহ্ত্তর স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছেনা।

কী কারণ থাকতে পারে সশস্ত্র বাহিনীর নিরবতার পেছনে? প্রতিদিন যদি একটি দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রতিদিন যদি একটি জীবনের বিলুপ্তি হয়, যথেষ্ট নয় কি সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কাজে লাগানো? শুধু কি বহিঃশত্রুর থেকে দেশকে রক্ষার করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে রাখা হয়েছে? দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানে যেখানে পুলিশ বা RAB বার বার ব্যর্থতার পতাকা উড়িয়েছে, সেখানে কিভাবে নিরবতা পালন করতে পারে দেশের সশস্ত্র বাহিনী? সরকারের গুরুদায়িত্ব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা। তা বজায় রাখতে যদি প্রয়োজন পড়ে পুরো দেশের সশস্ত্র বাহিনীর তা প্রয়োগ করতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক্ত কর্মচারী যদি তার মালিকের জীবনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে দরকার আছে কি তেমন কর্মচারীদের? ভাববার সময় এসেছে আমাদের!

আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টা এবং ভাগ্যকে। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা যে ভাগ্যের ব্যাপার তাও আমি বিশ্বাস করি। একজন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যে কেউ হতে পারে না। এ ধরণের দায়িত্ব যারা পেয়ে থাকেন তাদের উপর স্রষ্টার বিশেষ রহমত রয়েছে।

তবে একটি জিনিস বুঝতে বেশ সমস্যা হচ্ছে তা হলো যারা এমন একটি দায়িত্ব পান কীভাবে তাদের প্রতি বেশির ভাগ মানুষের ঘৃণা জন্ম নেয়? বর্তমানে বিশ্বের সব প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর কাউকেই মানুষ খুব একটা পছন্দ করছে না। কিন্তু কেন? সবাই কি ক্ষমতা পেয়ে খারাপ হয়েছে নাকি আমাদের সমস্যার কারণে তাদেরকে আমরা অপছন্দ করছি? ইদানীং প্রায়ই লক্ষণীয় দেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এ খবর শোনার পর দেশের অনেক মানুষের মধ্যে কেমন যেন একটি সুখের বার্তা বয়ে আনে। জানি না কেন এরা এত মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত!

ক্ষমতা এমন একটি জিনিস যা কেউ সহজে ছাড়তে চায় না তবে কথাটি সব সময় সঠিক নয়। সুইডেনে প্রায়ই এমনটি ঘটে। দেখা যায় দলের প্রধান বা সংসদের এমপি এমনকি প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। আমি অনেকবার বিষয়টি ভেবেছি কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে। গ্রহণযোগ্য কারণ আমার মতে এরা জনগণের প্রতিনিধি। ক্ষমতা এবং তার ব্যবহার যদি সঠিকভাবে না করতে পারে তখন নিজ থেকেই সরে যায়। মনে কী পড়ে কোভিড-১৯ এর শুরুতে জার্মান অর্থমন্ত্রীর সুইসাইডের কথা! তিনি জনগণের সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন এমন ধারণা তাকে কঠিনভাবে পীড়া দেয়, শেষে তিনি সুইসাইড করেন।

পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যেখানে জনগণ তার সরকারকে পছন্দ করছে না। অথচ সরকার দিব্যি মনের আনন্দে ক্ষমতার জোরে দেশ পরিচালনা করে চলেছে। এসব দেশের সরকারপ্রধানদের ধারণা তারা ছাড়া অন্য কেউ দেশ পরিচালনা করতে পারবে না।

বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতেও এসব লক্ষণীয়। এসব ইন্ডাস্ট্রির লিডাররা অনেক সময় নিজেদেরকে এত দক্ষ মনে করেন যে কোম্পানির অন্য কাউকে বিশ্বাস করে না। এমন কি অন্যদের ওপর কোনো কাজ দিয়ে ভরসাও পায় না। এসব ক্ষেত্রে দিনে দিনে কোম্পানির সমস্ত কর্মচারী তাদের ভ্যালু হারিয়ে ফেলে। শেষে এককেন্দ্রিক পরিচালকের ব্যর্থতার কারণে সেই কোম্পানি ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।

একটি দেশের সব ক্ষমতা যখন একজনের কাছে থাকে তখন সে দেশের সমস্ত কর্মীরা উদ্যোগ হারিয়ে ফেলে এবং হয়ে যায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ক্ষমতার সঠিক বিকেন্দ্রীকরণ করাই হচ্ছে একজন দক্ষ নেতার প্রধান গুণ। এই গুণ যার মাঝে গড়ে উঠে না সে কখনও আদর্শ নেতা হতে পারে না। সেক্ষেত্রে দিনরাত খেটে জনগণের কাছ থেকে বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই পায় না। অথচ তারা দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে সেই সাথে দেশের জন্য কাজ করে চলেছে। তবুও ভাবছে না কে দায়িত্ব নিবে হঠাৎ যদি তাদের মৃত্যু হয়ে যায়!

আমার অভিজ্ঞতায় যা শিখেছি তা হলো একজন লিডার তখনই সফল যখন তার অবর্তমানে কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা দেশ সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়। নেতার কাজ নেতৃত্ব দেয়া, আর কর্মীর কাজ তা ফলো করা। যখন নেতার কোন ফলোয়ার না থাকে তখন তিনি সেভেন টু ইলেভেন নয়, টুয়েন্টিফোর আওয়ারস কাজ করেন, তবে ফলাফল আশাতীত হয় না।

১৯৮৬ সালের কোনো এক সময়ের কথা। একটি মেয়েকে হঠাৎ বলেছিলাম তুমি সুন্দর তাই তোমাকে পছন্দ করি। উত্তরে বলেছিল পছন্দ-অপছন্দ তোমার ব্যাপার। তবে আমাকে তোমার মতো করে ভাবতে চাপ দিও না। ভালোবাসা বিশ্বাস এসব জোর করে পাওয়া যায় না। কারণ এসব অনুভূতির বিষয়। সেটার যদি অভাব থাকে তবে হাজার সুন্দর হলেও পছন্দ করে কোনো লাভ হবে না। তবে কাউকে পছন্দ করার মাধ্যমে ভালোবাসা এবং বিশ্বাস জন্মাবার সুযোগটা বেশি থাকে। কিন্তু যদি শুরুটাই অপছন্দের হয় তাহলে ভালোবাসা বা বিশ্বাস জন্মাবার সুযোগটাই আসে না।

যাই হোক আমি আশা এবং বিশ্বাস করতে চাই যেন নতুন বছরের শুরুটা সুন্দর চিন্তা চেতনা দিয়ে হয়। সর্বোপরি ভালোবাসা ধরা বা ছোঁয়া যায় না শুধু অনুভব করা ছাড়া। কারণ ভালোবাসায় রয়েছে শুধু ভালোবাসা।”খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে। দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও, এসো দুই বাহু বাড়ায়ে॥”

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি