মানুষ

মানুষ
রহস্য নিয়ে যদি ধ্যানে মগ্ন হতে ইচ্ছে করে তবে কোনো ছেলে হাফপ্যান্ট পরলো বা কোনো মেয়ে বোরকা পরলো এটা ধ্যানের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত নয়। বরং ভূপৃষ্টের আলো, বাতাস, পানি, মাটি, তাপমাত্রা, অন্ধকার কী, কেন, কখন, কী জন্য এটাই ধ্যানের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবেন মনের দরজা খুলতে শুরু করেছে।

আমাদের দেহের ভেতরের যে কারুকাজগুলো রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা হবে। সর্বশেষে নিজের অস্তিত্ব যখন পরিষ্কার হতে থাকবে তখন ধীরে ধীরে সৃষ্টা এবং তার রহস্য সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে উঠবে। তখন কে মাথা ঢাকলো, কে হাফপ্যান্ট পরলো বা কার বুকের উপর কাপড় রাখলো না এসব জিনিস খুবই তুচ্ছ মনে হবে।

আজ নৈশভোজে গত দিনের রান্না করা খাবারের কিছুটা যা অতিরিক্ত ছিল খেয়েছি। আমি গ্রামের ছেলে, ছোটবেলা থেকেই মাছ, ডাল সবজি, গোসত এসব খেতে অভ্যস্ত। সুইডেনে প্রায় চল্লিশ বছর বসবাস সত্ত্বেও সেটা দিনে একবার খেতে হবেই। তাছাড়া খাবার ফেলতে মায়া লাগে যখন ভাবি অনেকের দু’বেলা খাবার জোটে না অথচ আমি যদি সেটা ফেলে দেই তাহলে কেমন হয়!

বিবেকের কারণে সেগুলো নষ্ট না করে খেতে চেষ্টা করি। কিছু কিছু খাবার আছে যেমন ডাল কোনোভাবেই সহ্য করতে পারি না, যদি তা একদিনের জন্য হলেও পুরোনো হয়। পুরনো রান্না ডাল খেলে ঘুম হবে না, অস্থিরতা দেখা যাবে, গলাবুক জ্বলবে ইত্যাদি।

সবাই এখন দিব্যি ঘুমাচ্ছে আমি বসে লিখছি। ওই যে পুরোনো ডাল খেয়েছি। অন্ধকারে ড্রয়িং রুমে টেলিফোনের স্ক্রিনে দিব্যি লিখছি। চারপাশে অন্ধকার অথচ টেলিফোনের পর্দাটি আলোকিত, চমৎকার এক পরিবেশ ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর।

কে হাফপ্যান্ট বা বোরকা পরলো না, সেটা নিয়ে কত ভাবনা! অথচ একদিনের বাসি ডাল খেলাম সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গেল!

প্রতিদিনই খাবার খাই, দিব্যি চলছে কখনও ভাবা হয় না, যেমন খাবার যে খেলাম এখন, এ খাবার কখন, কোথায়, কী পরিমাণ শক্তি যোগায় এবং কীভাবে কী হচ্ছে পেটের মধ্যে কখনও ভাবি না, ভাববার সময় নেই। তবে সমস্যা হলে চিকিৎসক, কবিরাজ, ওষুধ, বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি, সে এক নান্ডিভাস্টি ব্যাপার। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দেশে প্রচন্ড খরা বা মুষলধারে বৃষ্টির কারণে চাষাবাদ বন্ধ, সমস্যা। হঠাৎ সব ঠিক হয়ে গেল, সমাধান। মহামারি রোগ এসেছে, সমস্যা। টিকা উদ্ভাবন হলো, সমাধান। সমস্যা যে কোনো সময়, যে কোনো মানুষের বা জনগোষ্ঠীর মাঝে আসতে পারে, তবে সমাধান খুঁজতে বা করতে যারা আজীবন সংগ্রাম করে চলছে তাদের সারিতে আমাদের ঢুকতে হবে।

আমরা বলতে আমি বাংলাদেশিদের কথা বলছি। আমরা এখনও অবধি কিন্তু ব্যস্ত শুধু পেটের ক্ষুধা মেটাতে। সমাজে যে আমাদের হাজারও সমস্যা রয়েছে তারও তো সমাধান করা দরকার।

জাতি হিসাবে আমাদের হাজারও সমস্যা রয়েছে তবে বিশেষ কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আমি আলোচনা করবো যেমন বেকারত্ব, দুর্নীতি ও মানবিক অবনতি।

বেকারত্ব

দেশের ফকির মিসকিন থেকে শুরু করে মুচি, মেথর, ঝাড়ুদার পর্যন্ত পেশাদারি মানুষগুলো পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াই এ ধরনের কর্মে লিপ্ত হয়ে যায় জন্মের শুরুতে। এরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে, সত্ত্বেও এদেরকে মানুষ বলে পরিচয় দিতে আমাদের সম্মানে বাধে।

তবে তারা কখনও বেকার থাকে না। কারণ সব সময় কিছু না কিছু করে। কিন্তু দেশের শিক্ষিত শ্রেণির প্রায় ৭০ শতাংশ লোকই বেকার। এরা কিছুই করে না, এদের কাজ শুধু কাজ খোঁজা, কে ঘোমটা মাথায় দিয়ে চললো, কে হাফপ্যান্ট পরলো, কে কী করল এসব দিকে কড়া নজর রাখা, সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করা, বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা ইত্যাদি।

অশিক্ষিত মানুষ কখনও বেকার থাকে না কারণ তারা সমাজের অবহেলিত কাজগুলো শুরু থেকেই করতে শুরু করে। শিক্ষিত লোকের হয়েছে যতো জালা। লেখাপড়া শিখেছে ছোটখাটো কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় তবে অকাম কুকাম করাতে সমস্যা নেই। যেমন দুর্নীতি, অনীতি।

দুর্নীতি

দুর্নীতি করে কারা? সমাজে যার যতো ক্ষমতা বেশি সে ততো অকাম কুকাম করে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। এদের সবারই কম বেশি শিক্ষা রয়েছে। ভিক্ষুকের সঙ্গে এদের হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। মিলটা হচ্ছে এরা পরস্পরের বন্ধু।

যে দেশের মানুষ যতবেশি কার্লপ্রিট, ধুরন্দার, বাটপার, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ সে দেশে বেশি ভিক্ষুকের পরিমাণ বাড়ে। কারণ এ ধরনের অন্যায়কারীরা ভিক্ষুককে দান খয়রাত করতে পছন্দ করে, বিবেকের কাছে ভালো থাকার জন্য। বাংলাদেশে ভিক্ষুকের পরিমাণ বেশি থাকার প্রধান কারণ সেখানে দুষ্ট লোকে ভরা।

মানবিক অবনতি

যে সমাজে মানুষ মানুষকে সাহায্যের নামে ভিক্ষা দেয় সে সমাজে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। সমাজের দৈনিক শিক্ষায় রয়েছে সমস্যা। কারণ পুঁথিগত বিদ্যায় মনুষ্যত্বের ছোঁয়া নেই, সেখানে শিক্ষা সাধারণত কর্মের উপর দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষ মানুষের জন্য এ শিক্ষা নিজ নিজ পরিবার থেকে হওযার কথা এবং সেটাই হচ্ছে।

প্রশ্ন হতে পারে কীভাবে? বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে কয়জন আছে যে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে - আমি কাজের লোককে পরিবারের অন্যান্যদের মতো দেখি বা ট্রিট করি? ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে ঘরে? শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কিভাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করতে হয় এবং সেটা করছে কে? আমি, তুমি এবং সে। মানে? আমরা।

উপরের এই তিনটি সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমার মনে হয় না আমাদের হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলিম, লাট, বারিস্টার, মন্ত্রী, জেনারেল, আইজিপি, সচিব, ফকির, মেথর ইত্যাদি পরিচয় থাকবে। আমাদের পরিচয় হবে একটি; আমরা মানুষ।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি