সম্পাদকীয়
‘অক্সিজেন সংকট’ ভাবতে হবে এখনই

করোনা মহামারী। লকডাউন। কঠোর লকডাউন। সর্বাত্মক লকডাউন। কোনকিছুতেই যেন থামছে না সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল। একদিকে জীবন। অন্যদিকে জীবিকা। সবকিছুই যেন লণ্ডভণ্ড।
করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। বেড়েছে মৃত্যু আর সংক্রমণের হারাও। সেই সঙ্গে নতুন আতঙ্ক যোগ হয়েছে ভাইরাসের ভারতীয় ধরণ। যা তিনগুণ শক্তিশালী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি যদি আঘাত হানে তাহলে সুনামী বয়ে যাবে বাংলাদেশে। সেই আতঙ্কে ইতোমধ্যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে কি ভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি আটকানো যাবে? আপাতত এটিই প্রথম চ্যালেঞ্জ।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতজুড়ে চলছে করোনা সুনামী। এটিকে যুদ্ধকালই বলছে বিশেষজ্ঞরা। বেচে থাকার যুদ্ধ, শ্বাসবায়ু চালু রাখার যুদ্ধ। হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাই নেই। ভারত এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। পুরো ভারতজুড়ে অক্সিজেনের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। কোথাও অক্সিজেন না পেয়ে মৃত্যু হচ্ছে করোনা রোগীর। তাই অক্সিজেন সরবরাহকে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের আওতায় আনছে দেশটি।
বাংলাদেশে যদি করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরণের প্রবেশ ঘটে, তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তুতি কি? এমন পরিস্থিতিতে অক্সিজেন সঙ্কটের বিষয়টি ভাবতে হবে সবার আগে। ইতোমধ্যে ভারত বাংলাদেশে অক্সিজেন রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সঙ্কট বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিমুনাফা লাভের আশা মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে পারে, আবার বিত্তবানরাও আগাম অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করে সে সঙ্কট বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়গুলো মাথায় রেখে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে এখনই।
ভারতের করোনা সুনামী পর্যবেক্ষনে দেখা যাচ্ছে, অক্সিজেনের সঙ্কট মোকাবিলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

শরীফ নিজাম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অর্থসংবাদ
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

সম্পাদকীয়
উন্নয়ন ও উন্নতি

বাংলাদেশের ৫১ বছর বয়সে বেশ আলোচনায় আসছে উন্নয়নের প্রসঙ্গ। আমার মত মুক্তিযোদ্ধার কাছে আশার সংবাদ। আমরা বুঝতে পারছি আমাদের পরিকল্পনাবিদরা আগামি প্রজন্ম নিয়ে একটু বেশী চিন্তা করছেন। উন্নয়নের আলোচনায় জিডিপি, পার ক্যাপিটা ইনকাম আলোচনায় আসছে। আমার মনে হয় বিশ্বের এক দেশ অন্য দেশের সাথে উন্নয়ন নিয়ে আলোচনায় জিডিপি, পার ক্যাপিটা হতে পারে মাপকাটির একক। কিন্তু বাংলাদেশের মত একটি দেশ, যেদেশ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল দেশের অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি।
সেই মুক্তির সংগ্রামে বর্তমানে ১৮ কোটি মানুষ, মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ আজও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত। একটি দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন মানে বেকারের সংখ্যা হ্রাস, অধিকাংশ মানুষের কাজের ব্যবস্থা, আয়ের নিশ্চয়তা।
বিগত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে, ভালো কাজ, শুভ সংবাদ। সরকারের উন্নয়ন কাজের প্রভাব আসে দেশের অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে। সরকারের উন্নয়ন কাজে দেশের প্রধানত প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসার প্রসার ঘটে ফলে নতুন নতুন কাজ করার পদ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পের কাজের করোনার মত মহামারি এসে হাজির। ফলে বিগত দুই বছর যাবত প্রাইভেট সেক্টরের কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের যুবক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ কাজের সন্ধানে বেকার ছিল, তাঁদের সাথে যুক্ত হচ্ছে একটি বড় সংখ্যার যুবক। বাংলাদেশে যেহেতু সমসাময়িক তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা নাই বা সহজ নয় তাই এই মুহুর্তের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলা যাবে না বা সম্ভব নয়। আমরা সামাজিক জীব, আমাদের অনেক নিকট এবং পরিচিত জন যে বেকার আছে তা প্রতি মূহুর্তে বুঝতে পারছি। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে মধ্যম আয় শ্রেনির একটি শিক্ষীত বেকারের সংসারে কেমন সমস্যা হতে পারে তা বলে বা উদাহরণ দিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বেকার সমস্যা নিয়ে আলোচনায় সংবাদ পত্রের মাধ্যমে প্রায়ই শোনা যায় আমাদের অর্থনীতিবিদের বক্তব্যে যে, নতুন নতুন কর্ম সৃষ্টির মাধ্যমেই আসল উন্নয়নের হয় তার কথা। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয় আলোচনায় চলে আসছে বাংলাদেশ, নেপালে অর্থনৈতিক বিষয় পর্যালোচনার সময়। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতেই পারে কারণ বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পের ব্যয় অনেকের দৃষ্টিতে তুলনামূলক বেশি, পরিকল্পনার চেয়ে সময় বেশি লাগছে, রপ্তানীর চেয়ে আমদানী বেশি। উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে দেশের অনেক সেক্টর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত।
বৈদেশিক ঋণ নির্ভর উন্নয়ন কাজ যদি সময় মত বা পরিকল্পিত সময়ে শেষ না হয় তাহলে উক্ত কাজের পরোক্ষভাবে সূষ্ট কাজও দেরিতে শুরু হয় ফলে অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সক্ষমতা অর্জনেও বিলম্ব হয় ফলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ পরিকল্পিত সময়ে কাজ শেষ না হলে সূষ্টি হয় বহুবিধ সমস্যা, যার দায়ভার জনগণকেই বইতে হয়। শ্রীলঙ্কার মানুষ আজ নিত্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য পাচ্ছে না দেখা দিয়েছে বহুবিধ সমস্যা।

আমাদের উন্নয়ন দরকার। উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের মত দেশের অর্থনীতি যেহেতু আমদানি নির্ভর তাই বৈদেশিক মূদ্রাও দরকার বেশি। আমাদের উন্নয়নও করতে হবে এবং সমস্যাও যেন না দেখা দেয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন কাজের জন্য এসেছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে সরকারের কাজ যেমন সহজ করেছে তেমনি দ্রুত করারও ব্যবস্থা রয়েছে। সরকার যদি পিপিপি পদ্ধতিতে উন্নয়ন কাজ অনেক পদ্ধতিতে করা যায়, তারমধ্যে বিল্ড-অপারেট- ট্রান্সফা (বিওটি) পদ্ধতি আমাদের মত দেশে যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করা কঠিন তাই এই পদ্ধতি হতে পারে উন্নয়ন বান্ধব।
তবে ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারের চুক্তির সময় সরকারকে হতে হবে সময়ের সুযোগের সফল ক্রেতা। এখানে দুইটি পক্ষ একদিকে সরকারের পক্ষে আমলা আর অন্য পক্ষ ব্যবসায়ী। সরকারী চাকুরীতে নিয়োজীত কর্মকর্তারা প্রতিযোগীতার বিচারে সবচেয়ে কর্মক্ষম। অপর দিকে ব্যবসায়ীর হাতেও দক্ষ জনবল থাকা স্বাভাবিক কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারের সাথে ব্যবসা করতে যাবেন তাঁদের জনবলও কোন অংশে কম না তাই স্বাভাবিক। তেমনি স্বাধীনতা তাঁদের বাড়তি সক্ষমতা। সরকারের যেমন বাজেট এবং সিদ্ধান্ত নিতে জটিলতা একটি বাড়তি সমস্যা। তেমনি আবার জবাবদিহিতার বিষয়টিও এক দৃষ্টিতে যেমন ভালো তেমনি সময়ে অসময়ে ব্যয়বহুল হতে পারে।
সম্প্রতি এক সংবাদে (প্রথমআলো, ০৭ মে ২০২২) প্রকাশ বাংলাদেশে ”বিনা টিকিটে এসি কামরায় রেলমন্ত্রীর আত্মীয়, জরিমানার পর টিটিই বরখাস্ত”। অন্য এক সংবাদে প্রকাশ হয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে জরিমানা করেছিল। এখানে উভয় দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সবাই নিজের যোগ্যতা প্রমানে স্বচেষ্ট। তবে মত ও পথ ভিন্ন। একদল থাকেন দায়িত্বপালনের যোগ্যতার বিচারে উত্তীর্ণ হতে। অন্য দলের কথা না বলাই ভাল। যেমন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে আত্মপক্ষ সর্মথনের সুযোগ না দিয়ে দোষি সাবস্ত করা। বাংলাদেশের এক সরকারি কর্মকর্তা সঠিক দায়িত্ব পালনে বরখাস্ত আর যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে জরিমানা পরিশোধ করতে হয়েছে তাঁদেরই সরকারের এক কর্মকর্তার আদেশে। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল বা অন্যকিছুর সংবাদ যেহেতু পাওয়া যায় নাই তাই বলা চলে সে রায় বহাল আছে। আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা যদি দায়িত্ব পালনের পর এমন অবস্থার সম্মূখীন হন তাহলে কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ কমে যাবে। সব ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে তারপর মানুষ সুবিচার পাবে তা আশা করা যেমন ঠিক নয় বা তা সবক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। সরকারি অফিসে স্বাভাবিক নিয়মে সুবিচার নিশ্চিত হলেই আশা করা যায় সরকারি কর্মকর্তারা যোগ্যতার বিচারে উত্তীর্ণ হবেন।
সব দিক বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতার বিচারে সফলতা প্রমান দিয়ে সরকার যদি ব্যবসায়ীর সাথে পিপিপি (বিওটি) পদ্ধতিতে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করতে পারেন তাহলে একদিকে যেমন উন্নয়ন কাজ চলমান করা যাবে তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার পরিশোধের সক্ষমতার বিচারে সরকারের বাড়তি চিন্তা করতে হবে না। মনে রাখতে হবে আমাদের হাতের সময় মূল্যবান। রক্তের বিনিময়ের অর্জিত স্বাধীনতার স্বাধ পেতে ৫০ বছরের বেশি লাগবে বা মানা কষ্টকর।
হায়দার আহমদ খান এফসিএ
চেয়ারম্যান: এডুকেশন ডেভেলপমেনট এসোসিয়েশন-ইডিএ
akc@bol-online.com
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
সম্পাদকীয়
কাজ চলুক, চলুক লড়াই….. নতুন লড়াই

২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহানে শুরু। তারপর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী কোভিড-১৯-এ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে দেশ থেকে মহাদেশ। থমকে দাঁড়ায় মানব সভ্যতা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশে দেশে শুরু হয় লকডাউন। বিপর্যস্ত হয়ে অর্থনীতি। পৃথিবীর বাঘা বাঘা অর্থনৈতিক শক্তিগুলো মহামন্দায়।
গেল ২৪ ঘণ্টায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ মানুষ। এতে বিশ্বজুড়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ৬৯ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। করোনা কেড়ে নিয়েছে ৮ লাখ ৮০ হাজারের বেশি প্রাণ।
বলা বাহুল্য, আক্রমণের শিকার বাংলাদেশও। তবে, করোনা ভাইরাসের বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ ঘটেছে বেশ পরে। তিন-চার মাস পরে। ততদিনে ইউরোপ, মার্কিন মুল্লুক করোনা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড। সব মিলিয়ে সারা পৃথিবীতে করোনা সংক্রমণের শিকার প্রায় ২ কোটি ৬৯ লাখ মানুষ। ৮ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ মারাও গিয়েছেন। সংক্রমণের বিরাম নেই বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই। ইতোমধ্যে টিকা আবিষ্কারের দাবি করেছে রাশিয়া। তা নিয়ে বিতর্কও চলছে। ব্রিটেন, ভারত, চীনসহ আরও কয়েকটি দেশের গবেষণা সাফল্যের সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আগামী বছরের আগে টিকা সাধারণ মানুষকে দেওয়া সম্ভব হবে বলে কেউ আশা করছেন না। চ্যালেঞ্জটা বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়ানক। কারণ বাংলাদেশের ১৭ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য টিকা পাওয়া সহজ নয়। পেলেও দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়।
বিশ্বের বড় বড় মহামারী বিশেষজ্ঞরা এবং খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য ধরেই নিয়েছেন, এখনও কিছুকাল কাটাতে হবে করোনার সঙ্গে সহাবস্থানে। এই সহাবস্থানে কাটানোর কৌশল রপ্তটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা আতঙ্কে, ভয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকা কিংবা হাত-পা ছুঁড়ে বিলাপের মধ্যে আপাতত সমাধান নেই। সেটা কোনওভাবেই কাম্য হতে পারে না। যদিও নতুন অচেনা এই ভাইরাসটিকে চিনতে আমাদের সময় লেগেছে। প্রথম দিকে বোঝা যায়নি লড়াইয়ের কৌশলটা ঠিক কী হবে। একাধিক পন্থা মাথায় এসেছে বিশেষজ্ঞদের। তার মধ্যে একটি লকডাউন। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরা, কিছুক্ষণ অন্তর হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। কৌশলের এই দিকগুলি নিশ্চয় কাজে এসেছে। তবে আংশিক। বিশেষ করে লকডাউনের ক্ষমতাকে যতটা বড় বলে ভাবা হয়েছিল, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে বাস্তবে তা নয়। তাই আমাদের উচিত, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মানুষ কত দ্রুত নিজ নিজ কাজেকর্মে ফিরতে পারেন তার চিন্তা করা। কারণ, জীবিকাকে স্তব্ধ করে দিয়ে, অর্থনীতিকে জুজুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বাঁচা যাবে না। পেটে খেলে তবেই পিঠে সইবে। ভাইরাসের আঘাত সইতে গেলে পেটের জোগাড় নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। তার মানে, সবার পকেটে প্রয়োজনমতো টাকার জোগান থাকা চাই। টাকার উৎস উৎপাদন। কেউ পণ্য উৎপাদন করেন। কিছু মানুষের উৎপাদন নানা রকমের পরিষেবা। পণ্য ও পরিষেবার যুগপৎ উৎপাদনে ফিরতে পারলেই অর্থনীতি ফের গতিশীল হয়ে উঠবে। চিকিৎসার জন্যও তো টাকা দরকার। কিন্তু অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে চিকিৎসার খরচ আসবে কোত্থেকে।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছিলেন, টাকা দেবে সরকার। ভাবতে হবে, সরকারের কাছে আলাদ্দীনের চেরাগ নেই যে, সরকার দেবে আর জনগণ বসে বসে খাবে। দেশের মানুষই সরকারের ভরসা। জনগণই আসলে সরকার। মানুষ সম্পদ তৈরি করার অজস্র পর্বে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে থাকে। সরকারি কোষাগারের সব টাকা সাধারণ মানুষের দান। সেই মানুষ যদি ঘরকুনো হয়ে বসে থাকেন উৎপাদন কীভাবে হবে? মানুষ উৎপাদন না করলে কোষাগারের জমা টাকা শূন্য হতে বেশি সময় লাগবে না। তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, এ লকডাউনে ব্রিটেন তার দেশের কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে গিয়ে দুই ট্রিলিয়ন পাউন্ড দেনার দায়ে পড়েছে। দেশকে সেই পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়া কোনও বুদ্ধিমান জাতির কাজ হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভীতির মধ্যেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য শ্রমঘন শিল্প চালু রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। যার ফলে পোশাক শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আশি শতাংশ হারানো ক্রয় আদেশ ফিরে এসেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সর্বকালের মাইলফলক ছুঁয়েছে। লকডাউনে নগর জীবন স্থবির হলেও গ্রামীণ জনপদে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। যা ইতিবাচক। ইতোমধ্যে করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরোর্দ্ধারকারী দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

করোনা আতঙ্কে দেশের বেশিরভাগ সরকারি মেগা প্রকল্পও থমকে গিয়েছে। এ প্রকল্পগুলো চালু হলে বহু শ্রমজীবি মানুষের কর্মযজ্ঞ শুরু হবে আবার। করোনার অজুহাতে প্রকল্প থেমে থাকলে পিছিয়ে যাবে দেশ। শ্রমিকদের মজুরি এবং নানা ক্ষেত্রে মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য আটকে রাখা যাবে না। ইতোমধ্যে প্রান্তিক মানুষের জন্য সমস্ত অনুদান দেয়ার ব্যবস্থাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই নির্দেশ ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কি না জানার জন্য শ্রম দপ্তরের নজরদারির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী এসব সময়োপযোগী সিদ্ধান্তগুলো প্রশংসার দাবিদার। সত্যি কথা হচ্ছে, সরকার যদি পথ দেখায়, সাহস জোগায় তবে অর্থনীতির বাকি ক্ষেত্রগুলির পক্ষেও ভয় কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।
সরকারের পাশাপাশি সব শ্রেণীপেশার মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই নয়, দ্বিগুণ শক্তি ও মনোবল নিয়ে অর্থনীতি পুনরোর্দ্ধারে মনোনিবেশ করাটাই আসল লড়াই।
যে লড়াইটা লড়তে সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে।
শরীফ নিজাম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অর্থসংবাদ
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
সম্পাদকীয়
টুঙ্গিপাড়ার কাদামাটি থেকে উঠে আসা মহাকাব্যের মহানায়ক

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ছিল দুর্গম এক অজপাড়া গাঁ। সেই গাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারের শেখ লুৎফর রহমান ও সাহেরা খাতুন দম্পতির কোল আলো করে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আসে এক পুত্রসন্তান। মা-বাবা আদর করে তাকে ডাকতে থাকেন ‘খোকা’ বলে। টুঙ্গিপাড়ার সেই ছোট্ট খোকা একসময় হয়ে ওঠেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মহানায়ক। পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙ্গে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করে হয়ে যান মুক্তির দিশারী। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালি মুক্তির মাস্টারমাইন্ড। বাংলার রাজনৈতিক মহাকাব্যের মহানায়ক
কালের পরিক্রমায় টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি হয়ে উঠেন আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রসৈনিক। বাঙালীর অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে হয়ে উঠেন অগ্রনায়ক। যার ফলশ্রুতিতে টুঙ্গিপাড়ার খোকাবাবু, শেখ মুজিবুর রহমান নামের মানুষটি হয়ে উঠেন বাঙালী জাতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। যার বাঁশির সুরে বাঙালী এক হয়ে এক সূতোয় স্বপ্ন বুনে, স্বাধীন হবার স্বপ্ন।
সময় টুঙ্গিপাড়ার সেই মানুষটিকে বাঙালী আপন করে নেয়। তিনি হয়ে উঠেন বাংলার প্রাণপুরুষ। তাই তো প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা তার শেখ মুজিবুর রহমান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।’
বঙ্গবন্ধুর ছিল বুকভরা দেশপ্রেম, অসীম আত্মত্যাগ ও অতুলনীয় নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে আসীন করেছে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতার আসনে। তার বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে নেতৃত্বের জন্য জনগণ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম, নির্যাতন-কারাবন্দিত্ব তাকে জাতির পিতার অভিধায় অভিষিক্ত করেছে।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ভাষ্যমতে, বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করা ছিল সুচিন্তিত এবং সমাজসেবামূলক। শিক্ষাজীবনে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুষ্টি মুষ্টি চাল উঠিয়ে গরিব ছাত্রদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরিয়ে দিতেও তিনি কার্পণ্য করতেন না। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের দায়িত্ব নেয়ার মতো মহৎ গুণ শক্তভাবেই বঙ্গবন্ধু ধারণ করেছিলেন সেই শৈশবে।

১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সারাদেশে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু বলেন, “দিন রাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন। ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো, এতো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না। আরেকটা কথা মনে রেখ- sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না’। আব্বার এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।”
বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া ‘দায়িত্বশীলতা’ ও ‘দেশপ্রেম’র শিক্ষা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত করেছেন পুরো জীবনে। পরাধীন এবং দিশাহীন জাতিকে লক্ষ্যস্থির করতে এবং সোনার বাংলা গড়তে বাঙালী জাতির মননে যে বীজ বুনন তিনি করেছেন, তা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণেই সম্ভব হয়েছে।
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এতো সাহসী নেতা আর দ্বিতীয়টি নেই। অসীম সাহসিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পেতেন না বঙ্গবন্ধু। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি বলেন, “ছাত্রলীগের বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল- বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। এই সময় একদিন শহীদ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, ‘আমি বললাম, কখনোই তা হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভালো কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না।’ শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘Who are you? you are nobody.’ আমি জবাবে বললাম, ‘If I am nobody, then why you have invited me? you have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir. I will never come to you again.’ এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম।”
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ভাষ্যমতে, ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জের মাথুরানাথ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তার সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সবাই ব্যস্ত। দু’সপ্তাহ আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেয়া হয়েছে, সেদিন যেন সবাই পরিষ্কার-পরিছন্ন মার্জিত পোশাক পরে স্কুলে হাজির হয়। স্কুল পরিদর্শন শেষে মুখ্যমন্ত্রী ডাকবাংলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। ছাত্রদের এমন কাণ্ড দেখে হেডমাস্টার সাহেব রীতিমত ভড়কে গেলেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছ রাস্তা ছেড়ে দাও।’ এমন সময় হ্যাংলা পাতলা লম্বা ছিপছিপে গড়নের মাথায় ঘন কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করা খোকা (বঙ্গবন্ধু) একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়ালেন। মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাও?’ বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে খোকা উত্তর দিলেন, ‘আমরা এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না।’ কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলতে বাধ্য হলেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা করছি।’ তিনি অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। এ ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু মাত্র অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
বাংলার স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এর ভেতর দিয়ে তিনি আবির্ভূত হন বাঙালি জাতির মহানায়ক। সময় বঙ্গবন্ধুকে শ্রেষ্ঠ নেতা বানিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার রাজনৈতিক সঙ্গীরা ডাকতেন ‘মুজিব ভাই’ বলে। এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন বন্ধু থেকে শুরু করে নেতা-কর্মী সবার কাছে। ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবরণ করেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিন ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের এক বিশাল জনসভায় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন থেকে তিনি আর শেখ মুজিব বা নেতা-কর্মীদের মুজিব ভাই নন, বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু।
একজন নেতা সংগঠনের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, সেটা ভাবাও যায় না। বঙ্গবন্ধুর বাবা তাকে বলেছিলেন, তিনি চাইলে বিলেতে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারবেন। কিন্তু তিনি যাননি। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু লন্ডনে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে, কিন্তু পকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা দেবে না। প্রবাসীদের সহায়তায় লন্ডনে বসেই সশস্ত্র যুদ্ধের সব কৌশল ও পরিকল্পনা করেন বঙ্গবন্ধু। সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তত থাকতেও নির্দেশ দেন। নির্বাচনের পরে তার সেই পরিকল্পনা মতোই সব হলো।
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বাঙালি জাতির জন্য এক স্মরণীয় দিন। এদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সেদিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা নিরস্ত্র-নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। একটানা নয় মাস চলে যুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেই রেসকোর্স ময়দানেই আত্মসমর্পণ করে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন বাঙালি জাতির মহানায়ক। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর দেশকে পুনর্গঠনে তিনি মনোনিবেশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অন্যান্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বারবার জেল খেটেছেন। ফাঁসির মঞ্চে নিয়েও তাকে মারতে পারেনি পাকিস্তানিরা। বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসীর চাপে কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানিরা। সেই নেতা, সেই পিতা, সেই মহানায়ককে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য সপরিবারে হত্যা করলো। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই দেশটা হয়ে উঠতো স্বপ্নের সোনার বাংলা।
সোনার বাংলা গড়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ নামক বইতে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতো ৯ শতাংশ।’
বঙ্গবন্ধু কেবল বাংলার সীমানায় আবদ্ধ থাকেননি, কালক্রমে তিনি এখন বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও দলিত গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার একটি লেখায় বলেছেন, ‘আমার আব্বার নানা শেখ আবদুল মজিদ আমার আব্বার আকিকার সময় তার নাম রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমার দাদির দুই কন্যা সন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান আমার আব্বা। আর তাই আমার দাদির বাবা তার সব সম্পত্তি দাদিকে দান করেন। নাম রাখার সময় বলে যান, ‘মা তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎজোড়া বিখ্যাত হবে।’ সত্যি হয়েছে তার নানার কথা। আজ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খ্যাতি জগৎজোড়া।
আজ ১৫ আগস্ট। বাঙালির সবচেয়ে বেদনার দিন। আজ শোকাতুর বাঙালীর মাতমের দিন। আজকের কালো রাতে ঘাতকেরা বাঙালীর প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেই ভয়াল কালো রাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি ঘাতকের দল, হত্যা করেছে পুরো পরিবারসহ অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনকেও। আজ বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম মৃত্যুদিবসে সেদিনের নিহত সবার মাগফিরাত কামনা করছি। আজকের কঠিন শোকের দিনে সবার শপথ হোক একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলার গড়ার। তবেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে।
শরীফ নিজাম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অর্থসংবাদ
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
সম্পাদকীয়
করোনা আতঙ্কে আস্থায় ফেরাতে হবে পুরো জাতিকে

করোনা সতর্কতায় আমরা যে ভুলটি করছি, সেই ভুল ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ইরান করেছিল। তার মাশুলও দিচ্ছে তারা। আজকে স্পেনিশ সরকার বলছে, খোদ মাদ্রিদেই ৮০% মানুষ করোনা আক্রান্তের শঙ্কায় রয়েছে। কতটা ভয়ঙ্কর! আর চীনের পাশাপাশি যে ক’টি দেশ সময়োপযোগী এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল তার মধ্যে ভুটান, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। এসব দেশে ভাইরাস সংক্রমন নিম্নগামী।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এনডিটিভির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ছড়ায় চার ধাপে। প্রথম ধাপে আক্রান্ত দেশ থেকে আরেকটি দেশে ভাইরাস বহনকারী প্রবেশের মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাপে সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবার এবং নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ। তৃতীয় ধাপে প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি এবং অন্যান্য আক্রান্তদের মাধ্যমে লোকালয়ে ছড়িয়ে যাওয়া। যে পর্যায়ে এখন ইতালি ও স্পেন। চতুর্থ ধাপ ভয়াবহ। পুরো দেশই তখন আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যেটি হয়েছিল চীনের উহান প্রদেশ। যার ফলে চীন সরকার উহানকে লকডাউনই করেনি, উহানের নাগরিকদের বাসা থেকে যেন নামতে না পারে সে জন্য ভবনগুলোর লিফট পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। কেউ করোনাভাইরাস বহন করে লুকিয়ে রাখলে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণাও দিয়েছিল সরকার। চীনের সব ধরণের আধুনিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল, এতে সুফলও পেয়েছে তারা। গতকালের খবর হচ্ছে খোদ উহানে একজনও সংক্রমিত হয়নি। খবরটি নিঃসন্দেহে আনন্দের।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক কাটছে না। দেশে দেশে জরুরি অবস্থা, লকডাউন, কারফিউ জারির মাধ্যমে প্রায় স্থবির, নিস্তব্ধতায় নিমগ্ন গোটা পৃথিবী। অপেক্ষাকৃত দূর্বল অর্থনীতির দেশগুলো রয়েছে ঝুঁকির মুখে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে যদি করোনার বিস্তার তৃতীয় ধাপে এসে পড়ে। তাহলে সেটা হবে ভয়াবহ। কতটা প্রস্তুত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে সেটার কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে, তিনি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেন, “করোনা আতঙ্কের মুখোমুখি হয়েছে ১৩০কোটি ভারতীয়। প্রত্যেক ভারতীয় পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু গত কয়েকদিনে এটা মনে হয়েছে যে, আমরা এই সঙ্কটে আক্রান্ত হয়েছি। মহামারিতে আমরা এখনও নিরাপদ আছি; এমন চিন্তা-ভাবনা করাটা ভুল। আমাদের প্রত্যেক ভারতীয়র সতর্ক হওয়া উচিত।” করোনার বিস্তার ঠেকাতে নরেন্দ্র মোদি ভারতবাসির কাছে অনেকটা মিনতির সুরে বলেছেন, ‘আমি যখনই আপনাদের কাছ থেকে কিছু চেয়েছি, তখন আপনারা কখনই আমাকে হতাশ করেননি। আজ আমি আপনাদের কাছে কিছু চাইতে এসেছি। আমি আপনাদের কাছ থেকে কয়েক সপ্তাহ চাই। আমি আপনাদের সামনের দিনগুলো চাই। বৈশ্বিকভাবে করোনার কোনও নিরাময় নেই। এখন পর্যন্ত কোনও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। করোনা যেসব দেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে; সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বরং প্রথম কয়েকদিন পর এর বিস্ফোরণ ঘটেছে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ সাধারণ কোনও বিষয় নয়। ভারতে এর কোনও প্রভাব পড়বে না; এমন ধারণা ঠিক নয়। দুটি বিষয় অনুস্মরণ করা দরকার: সজাগ এবং সতর্ক।”
করোনার বিস্তার ঠেকাতে ভারত আগামী রবিবার থেকে ‘জনতা কারফিউ’ জারি করেছে। দিল্লীর কেজরিওয়াল সরকার ২০ জনের সমাগমকে নিষিদ্ধ করেছেন। শ্রীলঙ্কায় ১৪ ঘণ্টার কারফিউ চলছে আজ সন্ধ্যা থেকে।
করোনা বিস্তারের দ্বিতীয় ধাপে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার সে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে না দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর। যার খেসারত কতটা ভয়াবহ হবে, সেটি সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।

বর্তমান সময়কে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস বিস্তারের দ্বিতীয় ধাপ যদি ধরা হয়, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় আমাদের প্রস্তুতিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। সরকার বলছে, প্রস্তুত। কিভাবে প্রস্তুত? কোন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার কোন রোডম্যাপ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষে একেকজন একেক পদক্ষেপের কথা বলছেন। আইইডিসিআরের মতে, আজ পর্যন্ত ২০ করোনা আক্রান্ত রোগীর তথ্য দিচ্ছেন তারা। মৃত্যু হয়েছে ১ জনের এবং ২ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এসব তথ্যে নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক কমছে না। তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে সেটা অবশ্যই স্বস্তির। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তরা বিদেশফেরত অথবা তাদের আত্মীয় স্বজন। তাহলে গত তিন সপ্তাহে কতজন প্রবাসী দেশে এসেছে, তাদের অবস্থান কি? তারা কি করোনাভাইরাস বহন করছিল কিনা? যদি করে থাকে তাহলে তাদের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনরা সংক্রমিত হয়নি? এতদিনে প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সংক্রমিত আত্মীয়-স্বজনরা ভাইরাসটি লোকালয়ে ছড়িয়ে দেয়নি তো? প্রশ্ন অনেক, উত্তর দেবে কে?
করোনাভাইরাস বিস্তারের দ্বিতীয় ধাপে যদি বাংলাদেশ পৌঁছে যায়, তখন স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জামের কি হবে? হাসপাতাল? হাসপাতালে আইসিইউ? জরুরি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস? সর্বোপরি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে যদি বিদেশফেরতদের লকডা্উন করার এ্যাকশনে গেলে সে পরিমান জনবল প্রস্তুত আছে কিনা? এমনিতে আতঙ্কে সারাদেশ ঘোষণা ছাড়াই লকডাউনের পথে। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরাও বড় চ্যালেঞ্জ।
করোনাভাইরাস রোধে যা কিছু করার দু’একদিনের মধ্যে করা জরুরি। এ মুহূর্তে পুরো জাতিকে আতঙ্কমুক্ত এবং আস্থায় আনা সবচেয়ে জরুরি। যে কাজটি করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী।
শরীফ নিজাম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অর্থসংবাদ
অর্থসংবাদে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
সম্পাদকীয়
বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী, বাজিমাতের সুযোগ নিন

করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর চীন। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর। করোনা আক্রমণে তখন বিধ্বস্ত উহান। চীন সরকার এ করোনাভাইস যেন চীনের ১শ’ ৪০ কোটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য তারা প্রথম বলিদান করে উহান শহরকে। উহানকে পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তারা। একে একে লকডাউন করতে থাকে চীন। বন্ধ হয়ে যায় সব কলকারখানার উৎপাদন। পুরো জাতি ঝাপিয়ে পড়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে। অনেকটা সফল তারা। এরই মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিমপিং ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করে করোনা প্রতিরোধে এবং পুঁজিবাজারসহ অর্থনীতি ঠিক রাখতে।
ইতোমধ্যে করোনা ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে স্কুল-কলেজ, বন্দর ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে, তখন চীনের ম্যানুফেকচারিং খাতের জন্য দ্বিগুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে আসছে। করোনাভাইরাস আউটব্রেক ইস্যুতে চীনের অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্ক কত তা এখনও আমরা জানি না। এটুকু সবাই জানে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব ঠেকাতে জানুয়ারীতে চীন ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছিল। তবে আতঙ্ক কাটিয়ে চীনের পুরোমাত্রায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসার আগেই করোনা ভাইরাসের বিপর্যয় থেকে অকল্পনীয় মুনাফার সুযোগ হাতছাড়া করেনি চীন।
গত ৫ দশকে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে তার মুক্ত বাজার অর্থব্যবস্থায় পদার্পণ ও পশ্চিমা কপোর্রেট বিনিয়োগের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। একইভাবে চীনা বিনিয়োগকারী ও রফতানীকারকরা মার্কিন বাজার ও অর্থনীতিতে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। নতুন শতাব্দীর শুরুর দিকে ২০০৩ সালে চীনে করোনা সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে চীনা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুড়ে দাঁড়ানো চীনা অর্থনীতিকে আর একবারের জন্যও থমকে দাঁড়াতে হয়নি। এবার তা থমকে দাঁড়ানোই শুধু নয়, মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে আগের চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে ঘুঁড়ে দাঁড়ানোর পথে পা বাড়াতে শুরু করেছে।
প্রথমত: উহান করোনাভাইরাস নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারনার কারণে ধস নামা চীনা পুঁজিবাজার থেকে পশ্চিমাদের পুঁজি প্রত্যাহারের হিড়িককে কোনো রকম সময়ক্ষেপণ ছাড়া কাজে লাগিয়েছে চীন সরকার। দর পতনের ধারাবাহিকতায়, হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের পুঁজি হারিয়ে হতাশ পশ্চিমা কর্পোরেট বিনিয়োগকারিরা তাদের শেয়ার ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই স্থানীয় বিনিয়োগকারিদেরকে এসব শেয়ার কিনে নিতে উৎসাহিত করে চীন সরকার। পতনশীল মূল্যে শেয়ার কিনে নেয়ার পরই চীনে করোনাভাইরাসের দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়লে চীনের ম্যানুফেকচারিং খাত ও অর্থনীতি আবারো বিপুল সম্ভাবনাময় হয়ে দেখা দেয়ার পর পশ্চিমা বিনিয়োগকারিরা বুঝতে পারেন, তারা কত বড় বোকামি ও ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন। বড় বড় চীনা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে হাজার হাজার কোটি ডলারের পশ্চিমা বিনিয়োগ ছিল, এ সময়ে তারা বিপুল পরিমান পুঁজি হারিয়ে কম মূল্যে চীনাদের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের পর এসব কোম্পানীতে চীনাদের একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের পুঁজি হারানোর পরিমান কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে জানা যায়।
দুর্যোগ ও দরপতনের সময়কে পুঁজিবাজারের সুযোগসন্ধানীরা কাজে লাগিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সময়ে চীনা বিনিয়োগকারিরা বাজিমাৎ করে দেখিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এমনিতে তলানীতে বেশিরভাগ শেয়ারের মূল্য পেসভ্যালুর নিচে। তার উপর গুজব আতঙ্কে দরপতন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা পতনমূল্যে শেয়ার ক্রয় করতে পারে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকার দেশীয় বড় বড় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে পারে।
আমাদের অর্থমন্ত্রী বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী। চাইলে বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী সুযোগটা নিয়ে চীনের মতো বাজিমাত করতে পারেন।
শরীফ নিজাম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অর্থসংবাদ