'দুর্নীতি কখনও বাংলাদেশের জন্য একটি নীতি হতে পারে না'

'দুর্নীতি কখনও বাংলাদেশের জন্য একটি নীতি হতে পারে না'
গোটা বিশ্বজুড়ে মানসিক অশান্তি, দুখের দহনে করুণ রোদনে তীলে তীলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অসংখ্য তরুণ তরুণীর জীবন। নির্জনতা, ধৈর্য, নির্মমতার ব্যথা বুকে চাপিয়ে ধুকে ধুকে একাকীত্ব জীবন পার করছে মানুষ জাতি। ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য এবং নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে করছে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত। ঠিক একই সময় অন্যদিকে একই বিশ্বের এক প্রান্তে চলছে লুটপাট, দুর্নীতি, রাহাজানি, হয়রানি এমনকি ডাকাতি। জাতির দুর্দিনে অবৈধ অর্থের প্রাসাদ গড়ছে অনেকে। মানব জাতির এই দুর্দিনে যারা কু-কামে লিপ্ত তাদেরকে যদি আমরা সঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হই তবে জাতি হিসাবে আমরা সবাই হবো নির্লজ্জ, বেহায়া এবং বেশরম।

অনেকে পেটের দায়ে অন্যায় করে। এমন লোকের অভাব নেই মেনে নিলাম কিন্তু যারা লোভ-লালসা এবং বিলাসের জন্য অন্যায় করে কীভাবে মেনে নিবো তাদেরকে? এরা পেটের দায়ে নয় এরা অন্যায় করে চলছে এদের পাশবিক ও বিকৃত রুচির তৃপ্তি মিটাতে। কিন্তু এই তৃপ্তিটা কতক্ষণ রাখতে পারবে সেটার জন্যও কি ভাবা হচ্ছে?

এই কাজগুলো যারা করছে তারা মনেই করে না যে এটা অন্যায়, কারণ সমাজের সব অন্যায় এদের কাছে এখন ন্যায়সঙ্গত। তাদের ধারণা তারা সৃজনশীল কর্মের মধ্যেই আছে। তাদের চোখে এখন আঙ্গুল দিয়ে জানাতে হবে যে এ কাজগুলো সৃজনশীল বা বাস্তব সম্মত নয়। একই সাথে জানতে হবে কেন তাদেরকে এটা আকর্ষণ করছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সমাজ এখন অনেকটাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এটার সীমাহীনতা কঠিন হয়ে আরও গভীর সীমাহীনতায় ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বজনীন দুর্নীতি হচ্ছে যা সর্বজনীন নয়। কারণ দুর্নীতি কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না।

আসলে কোথাও এর তেমন শক্ত জবাবদিহিতা নেই। আমি মনে করি, সুশাসনের মূলনীতি হচ্ছে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতা। এটি প্রতিষ্ঠা না করা গেলে সুশাসন আসবে না। এটা আসতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।

দুর্নীতির সব সঞ্চয় জমা হয় শেষে ব্যাংকে, আসুন জেনে নেই কী হচ্ছে সেখানে। দেখা যাচ্ছে সরকার কর্তৃক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮০ শতাংশ, আগে যা ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। শুধু একজন চেয়ারম্যান ও এমডির কারণে ব্যাংকটির এমন অবস্থা হয়ে গেল! ৮০ শতাংশ ঋণ যখন খারাপ হয়ে গেল, তখন তো সরকারে উচিত কাউকে না কাউকে দায়ী করা। আর এত ঋণ যে খারাপ হয়ে গেল, তা তো কোনো শাখা ব্যবস্থাপকের জন্য হয়নি। চেয়ারম্যান-এমডি ছাড়া একটি ব্যাংক এত খারাপ হতে পারে না। কিন্তু চেয়ারম্যান দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার মানে চেয়ারম্যানকে যাঁরা রক্ষা করছেন, তাঁরা দুদকের চেয়ে শক্তিশালী। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

মূলত ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিকীকরণ করতেই এমন পরিবর্তন। কিন্তু ব্যাংক রাজনীতির জায়গা না। একটি ব্যাংকের শতকরা ১০ ভাগ টাকা মালিকের বা সরকারের। বাকি টাকা পুরোটাই জনগণের আমানত। এই আমানতের টাকা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর যতো চাপ, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ না দেখে যারা লুটপাট করে তাদের স্বার্থ দেখে। এটা বলতে ভালো না দেখালেও বাস্তবটা এটাই।

সমস্যা হচ্ছে আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার জন্য যারা আছে তারাও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই বলতে হয় অভাগা দেশের মানুষের চোখ থাকতেও তারা অন্ধ নইলে এসকল ব্যাংক চেয়ারম্যানদের কিছু হতো। সব কিছু জানার পর মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে, যেমন এদেরকে কারা রক্ষা করা হচ্ছে, কিসের বিনিময়ে রক্ষা করছে?

আমার প্রশ্ন দুর্নীতি কি তাহলে অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাজনীতির মতোই একটি নীতি? নাকি সবকিছুর সমন্বয়ে গঠিত এই নীতি যাকে ধরতে গেলে যায় না ধরা, ছুতে গেলে যায়না ছোঁয়া। নাকি এটা জাতির হৃদয়ে লতার মতো জড়িয়ে পড়েছে! আমার পরের প্রশ্ন অভাগা তরুণ প্রজন্মের কী হবে?

‍কিছু কথা মনে রাখতে হবে, এই দেশটাকে আমরা কীভাবে পেয়েছি। এই দেশের মানুষ কারা? আমাদের জাতীয় পরিচয় কী? কীভাবে আমরা তাকে সোনার বাংলা করতে পারবো? ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবা দরকার।

দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পেতে ডিজিটালকরণ করা আশু প্রয়োজন যেমন ক্যাশ টাকা তুলে নিতে হবে দেশ থেকে। আমাদের সীমার বাইরে, আকাশের ওপরে গিয়ে সাংঘাতিক কিছু কল্পনা করলে তো লাভ হবে না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে সম্পদে সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও আমরা সারাবিশ্বের মধ্যে নিজেদের প্রচারিত ও প্রসারিত করতে শুরু করেছি। পজিটিভভাবে সবাইকে ভাবতে হবে। এখন শুধু দুর্নীতি, অনীতির কারণে যে ভালো আবেগটুকু, তাঁর সঙ্গে প্রাপ্তির কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ তৃপ্তিটাই বড় হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু ইদানীং অনেকেই তৃপ্তির চেয়ে প্রাপ্তির পেছনে বেশি দৌড়াচ্ছে। যার কারণে সেই প্রাপ্তিটা উপযুক্ত পরিমাণে তাদের কাছে না আসার কারণে তারা নিজেদের কিছুটা ব্যর্থ মনে করছে। আমি বিষয়টি কিছুটা অন্যভাবে মনে করি। আমি মনে করি সৃজনশীল ব্যক্তিদের দরকার হলো সৃজন করা। সৃজন যখন মানুষের কাছে আদৃত হবে, মানুষের কাছে যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, মনে হবে আমার জীবনে না চাইতেও আমি অনেক কিছু পেয়ে গেলাম।

আমাদের সব থাকতেও কেন যেন মনে হচ্ছে অনেক কিছুই নেই। যেমন স্বামী তার স্ত্রীকে বলছে, বেবি আমি তোমাকে ভালোবাসি। স্ত্রী উত্তরে বলছে কোথায় কীভাবে এবং কখন, আমি তো কিছুই বুঝতে, দেখতে, শুনতে বা অনুভব করতে পারছিনা? ঘটনাটা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো, মনে হচ্ছে ছুটির ঘন্টা বাজতে শুরু হয়েছে। পৃথিবীটা বড্ড মায়ার জায়গা, ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে তবুও ছেড়ে যেতে হবে। ভাবছি জীবনে শুধু নিয়েই গেলাম কিন্তু দিতেও যে হবে এটা কেন ভুলে গেলাম? সময় কি আছে সুদ আসলে ফেরত দেবার নাকি সে ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে? বিবেক কি তাড়া করছে না? আমাদের সকলের একটু সহানুভূতি দিতে পারে একটি জাতির পরিবর্তন। আসুন সবাই মিলে কিছু করি, সার্থক আমরা হবোই।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে,

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি