মনোনয়নপত্র জমার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসন বণ্টনের তীব্র দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) বিএনপি তার শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শেষ করার পর জামায়াতে ইসলামী এনসিপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। বিএনপির কাছ থেকে প্রত্যাশিত আসন না পাওয়া কয়েকটি দল এবং ক্ষুব্ধ নেতারা সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, যাতে নতুন রাজনৈতিক মিত্রতা তৈরি করা যায়।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতায় যাচ্ছে—এমন গুঞ্জন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হচ্ছে না। বরং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গী হতে যাচ্ছে এনসিপি। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের একাধিক বৈঠকে নীতিগতভাবে এ সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দুদফায় বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভাগুলো থেকে জোটের বিষয়ে আলোচনা হলেও তা এড়িয়ে শুধু আসন সমঝোতার বিষয়টিতে নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন দুই দলের নেতারা। সংস্কার, বিচারসহ বেশ কিছু মৌলিক ইস্যুতে একমত হয়েছেন তারা।
আসন সমঝোতা হলে এনসিপিকে কত আসন ছাড়তে হবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্র বলছে, এনসিপি অন্তত ৫০টি আসনের নিশ্চয়তা চায়। তবে জামায়াতে ইসলামী ৩০টি আসন দেওয়ার আলোচনা করেছে। বৈঠকে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও ৩০-৫০টি আসন এনসিপিকে ছাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে এসব আসনে এনসিপির বর্তমান জোটসঙ্গী আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনও থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
তবে এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতের ১৮ আসন নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে টানাপোড়েনও শুরু হয়েছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ১০০ আসনের দাবি করলেও জামায়াত এতে সহজে সাড়া দিচ্ছে না। একইভাবে, মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও অন্তত ২৫টি আসনের জন্য অনড়। কিছু দল এমন শর্তও দিয়েছেন, যদি প্রত্যাশিত আসন সংখ্যা না পান, তারা সমঝোতা থেকে সরে যাবে। এই দলগুলো চাচ্ছে জামায়াত ১৫০ আসনে প্রার্থী দেন, বাকি ১৫০ আসন তাদের পক্ষের হবে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আসন বণ্টন তিন দফার জরিপের ভিত্তিতে করা হচ্ছে। দলগুলোর মধ্যে কিছু মিত্র এমন আসন চাচ্ছে যেখানে তাদের হার নিশ্চিত, অথচ সেই আসনগুলোতে জামায়াতের প্রার্থীরা অবস্থান করছেন। নেতারা বলেছেন, প্রার্থীর পরিচিতি এবং জায়গার গুরুত্ব বিবেচনা করে সেই আসন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, কিন্তু নিশ্চিত পরাজয়ের জন্য আসন কমানো হবে না।
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, তারা দুই শতাধিক আসনে প্রার্থী দেবে। এনসিপি, এবি পার্টি এবং অন্যান্য মিত্রদের সঙ্গে মিলিয়ে প্রায় ৮০টি আসন তারা ছেড়ে দেবে।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের বাসায় যান। আনুষ্ঠানিকভাবে অসুস্থ নেতাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলা হলেও, দুই দলের সূত্র বলছে, আসন সমঝোতার বিষয়টিও বৈঠকে আলোচিত হয়েছে। আবদুল্লাহ তাহের বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে।’ নাহিদ ইসলামের বক্তব্য সরাসরি পাওয়া যায়নি, তবে তার দলের নির্বাহী পরিষদের সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ সদস্য জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার পক্ষে মত দিয়েছেন।
এই জোট ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের আজ বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) সকালে ফেসবুকে লিখেছেন, তারুণ্যের রাজনীতির কবর রচিত হতে যাচ্ছে। এনসিপি অবশেষে জামাতের সঙ্গে সরাসরি জোট বাঁধছে। সারাদেশে মানুষের এবং নেতাকর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে কিছু নেতার স্বার্থ হাসিল করতেই এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও লিখেছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল এই জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। জোট চূড়ান্ত হওয়ার শর্তাবলীও স্পষ্ট করা হয়েছে। এনসিপি জামাত থেকে প্রাথমিকভাবে ৫০ আসন চেয়েছিল, কিন্তু আলোচনা শেষে চূড়ান্ত সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ আসনে। এছাড়া, জোটের শর্ত অনুযায়ী বাকি ২৭০ আসনে এনসিপি কোনো প্রার্থী দিতে পারবে না এবং ওই আসনগুলোতে জামায়াতকে সমর্থন করবে। জোটসঙ্গী হিসেবে জামায়াত এনসিপিকে আসন প্রতি ১.৫ কোটি টাকা নির্বাচনী খরচও প্রদান করবে।
সমঝোতার আওতায় ৩০ আসনে কোন প্রার্থী চূড়ান্ত হবেন, তা নির্ধারণ করা হয়েছে দু’জনের মাধ্যমে—জামায়াতের পক্ষে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং এনসিপির পক্ষে নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী। এই দুইজন মিলিতভাবে এনসিপির ৩০ জন প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন।
এছাড়া, নাহিদ ইসলাম এবং ছোটন গং-এর মধ্যে আরও এক ধাপের সমঝোতা হয়েছে। ছোটন গং জানিয়েছেন, পশ্চিমারা প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জামায়াতকে সংসদে দেখতে চায় না। সেই অনুযায়ী, নির্বাচনে জিতলে নাহিদ ইসলাম প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং বিরোধী দলে গেলে তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হবেন।
তবে এই জোট ঘোষণার প্রক্রিয়া তরুণ রাজনীতিবিদদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।