ক্যাটাগরি: সারাদেশ

শোকের দিনে ক্রীড়া অনুষ্ঠান: প্রশ্ন করায় ফের বিতর্কে চাঁদপুরের ডিসি

রাষ্ট্রীয় শোকের দিনে যখন সারাদেশে আনন্দ-উৎসবসহ সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত ছিল, তখন চাঁদপুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) শহীদ শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে সরকার ঘোষিত শোক দিবস চলাকালেই চাঁদপুর স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় মাদকবিরোধী ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। অথচ এদিন ঢাকায় শহীদ শরীফ ওসমান হাদির জানাজা ও দাফন চলছিল। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার মতো চাঁদপুরেও চলছিল গায়েবানা জানাজা ও শোক মিছিল সহ নানাবিধ কার্যক্রম। এনিয়ে প্রশ্ন করায় বিরূপ মন্তব্য করে ফের বিতর্কে জড়িয়েছে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি)।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল ইসলাম সরকার। এ ঘটনাকে ঘিরে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

শহীদ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে যখন সারা দেশে শোকের আবহ বিরাজ করছিল, তখন চাঁদপুরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাতিল করা হয়। চাঁদপুর প্রেসক্লাবের ফ্যামিলি ডে-সহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্থগিত থাকলেও ব্যতিক্রম হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান।

স্থানীয়দের দাবি, শোকের দিনে খেলাধুলা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান স্থগিত রাখলেও প্রশাসনের কোনো সম্মানহানি হতো না। বরং অনুষ্ঠানটি পরবর্তীতে আয়োজন করা হলে বিপুল সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে আয়োজনটি আরও সফল হতে পারত। যেহেতু এটি একটি মাদকবিরোধী প্রচারণামূলক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, তাই অন্য যেকোনো সময় ফাইনাল খেলা ও পুরস্কার বিতরণের আয়োজন করলে দর্শকদের উপস্থিতি আয়োজনকে সার্থক করে তুলত। বিভিন্ন মহলের দাবি; শহীদের মৃত্যুতে যখন রাষ্ট্র নিজেই গুরুত্ব দিয়ে শোক পালন করছে, তখন একজন জেলা প্রশাসকের এমন সিদ্ধান্ত জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে।

বিষয়টি অনুষ্ঠানস্থলে জেলা প্রশাসককে ব্যক্তিগতভাবে অবহিত করেন এক সাংবাদিক। তিনি জেলা প্রশাসককে জানান, শোকাবহ এই দিনে খেলাধুলা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান কতটা প্রয়োজনীয় ছিল-এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

এর জবাবে জেলা প্রশাসক সাংবাদিকের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, আপনার এই প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। এ সময় ওই সাংবাদিক তাকে জানান, এটি তার ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়, বরং জনমনের প্রশ্ন হিসেবেই তিনি বিষয়টি অবগত করেছেন।

পরে জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি কোথায় কী করেন, এগুলো বের করতে আমার সময় লাগবে না। এক সপ্তাহের মধ্যেই সব বের করে আনব।

এ ধরনের বক্তব্যকে সাংবাদিকের প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে কি না-সে প্রশ্নও উঠেছে।

একাধিক গণমাধ্যমকর্মীর সামনে জেলা প্রশাসক দাবি করেন, তাকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, তিনি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন এবং কে কোথায় কী করেন-সবই তিনি জানেন।

একপর্যায়ে তিনি ওই সাংবাদিককে উদ্দেশ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- আপনি একজন সাংবাদিক, আপনার কি মিছিলে যাওয়া ঠিক হয়েছে?

এছাড়া আগের দিন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ‘জেলা প্রশাসকের বাসভবন ঘেরাও’ শব্দচয়ন নিয়েও আপত্তি তুলে তিনি বলেন, ৭০/৮০ জন মানুষ হলে কি সেটাকে ঘেরাও বলা যায়?

উল্লেখ্য, গত ১৯ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর শহীদ শরীফ ওসমান হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে চাঁদপুরে ছাত্র-জনতার একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি শহরের বাইতুল আমীন চত্বর থেকে শহর প্রদক্ষিণ শেষে বাস স্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান করে। পরে সেখান থেকে জেলা প্রশাসকের বাসভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়ে মিছিলটি জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। সে সময় জেলা প্রশাসক নিজে বাইরে এসে আন্দোলনকারীদের দাবি শোনেন এবং তা পূরণের আশ্বাস দেন।

এই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর থেকেই জেলা প্রশাসকের মন্তব্য ও আচরণ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।

এদিকে, খেলার বিষয়টি প্রশাসনকে আগেই অবহিত করার জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বিষয়টি চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) এবং জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালককে (ডিডি) অবহিত করা হয়।

পরে জেলা প্রশাসক অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে জানাতে চাইলে তিনি প্রকাশ্যে জানাতে বলেন। এরপরই গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে তার বক্তব্যগুলো উঠে আসে।

এসময় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মাদকবিরোধী ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন এবং খেলোয়াড়দের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। তবে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন থেকেই যায়-রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে এমন আয়োজন কি প্রশাসনিক সংবেদনশীলতার অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ নয়?

এর আগে গত বৃহস্পতিবার হাজীগঞ্জ উপজেলায় অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসকের দেওয়া কয়েকটি বক্তব্য নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা হয়।

উল্লেখ্য, চাঁদপুরে যোগদানের আগে মো. নাজমুল ইসলাম সরকার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার