ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

সাসপেকশন: একটি জাতির অদৃশ্য মহামারি

সন্দেহ কী? কেন সন্দেহ জন্মায়? আর এই সন্দেহের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র থেকে ভূরাজনীতি, সন্দেহ একসময় সবার ওপর ছায়া ফেলে। রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা কর্মী এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও এই সন্দেহ এমনভাবে ঢুকে যায় যে, তা একসময় একটি অদৃশ্য অস্ত্র হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন পুরো জাতি এক অদৃশ্য মহামারির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।

আজকের পৃথিবীতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল শক্তি তথ্য নয়, বরং সন্দেহের ব্যবস্থাপনা। কূটনৈতিক নীতি, বিশেষ করে ভারতের র (রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং) তাদের নীতি নির্ধারণ করে মূলত কাকে সন্দেহ করা হবে এবং কীভাবে সেই সন্দেহকে সামাজিক মননে স্থায়ী আকার দেওয়া যাবে তার উপর ভিত্তি করে। ফলে এই অঞ্চলে সন্দেহ কেবল অনুভূতি নয়, বরং এক ধরণের স্ট্র্যাটেজি।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সন্দেহ এক অদৃশ্য ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে
সামাজিক বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে
রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল হচ্ছে
রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়ছে
এবং সবচেয়ে ভয়াবহ, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরির মতো পরিবেশ তৈরি হচ্ছে

একটি জাতি যখন বিশ্বাস হারায় তখন যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তার পরিণতি কেবল রাজনৈতিক নয়, রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের সংকট তৈরিরও ঝুঁকি তৈরি করে।

সদ্য আলোচিত ঘটনার প্রেক্ষিতে সন্দেহের বিস্তার
সম্প্রতি BMA (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) ৮৯তম লং কোর্সের ২০২৫ সালের প্রেসিডেন্টস প্যারেড এবং পাশিং আউট অনুষ্ঠানে সোর্ড অফ অনার প্রাপ্ত একজন ক্যাডেটকে কেন্দ্র করে আলোচনার উত্তাপ বেড়ে গেছে। এই প্যারেড ও পাশিং আউট অনুষ্ঠান বাস্তব; ভিডিও, সামাজিক মিডিয়া পোস্ট এবং BMA সম্পর্কিত পেজগুলোর রেকর্ডে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

তবে উল্লেখযোগ্য যে, BMA বা সংশ্লিষ্ট অফিসিয়াল খবরে (সরকারি পৃষ্ঠা বা প্রধান সংবাদমাধ্যমের বিশ্বস্ত প্রতিবেদন) এখনও ওই ক্যাডেটকে ডিজিএফআই প্রধান (হামিদ) এর সন্তান হিসেবে পরিকল্পিতভাবে সোর্ড অফ অনার দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের তথ্য সরাসরি নিশ্চিত করা যায়নি। সমাজে বিষয়টি নিয়ে যে আলোচনা ও অভিযোগ রয়েছে, তা অনিরীক্ষিত সন্দেহ বা ছড়ানো গুজব হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

যদিও তার প্রতি দেয়া এই সর্বোচ্চ সম্মানকে অনেকেই দেখছেন বাবার রাজনৈতিক শক্তি, ব্যক্তিগত প্রভাব বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পক্ষপাতের ফল হিসেবে। যে কারণে সারা দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলছে, যার বাবা অভিযুক্ত, যার পরিবারের ওপর জনমনে সন্দেহের চাপ, সে কীভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান পেল?

এই প্রশ্নগুলো একদিনে তৈরি হয়নি। গুম খুন, পালিয়ে যাওয়া, বিদেশে আশ্রয় নেওয়া এই সব ইস্যু জনগণের মনে এমনিতেই সন্দেহ তৈরি করে রেখেছে। তাই নতুন করে এমন কোনও ঘটনা ঘটলে তা সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।

অতীতে তেমনই দেখা গেছে আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়
স্বৈরাচারী শাসনামলেও দেখা গেছে, কেউ রাজাকার বংশধর, কেউ ইসলামপন্থী পরিবার থেকে এসেছে, কেউ রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসী, এই যুক্তিতে বহু তরুণকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বহু যোগ্য মানুষকে আয়নাঘরে পাঠানো হয়েছে। এতে পুরো একটি প্রজন্মের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালানো হয়েছে।

ফলে আজ যখন দেখা যাচ্ছে যে পূর্বের বিতর্কিত জেনারেলদের সন্তানরা আবারো সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসছে বা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পাচ্ছে, তখন সমাজে স্বাভাবিকভাবেই একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে, অতীতে যেমন প্রতিহিংসা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও একই প্রতিহিংসা ফিরে আসবে।

এই ভয়টাই মানুষকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে। কারণ দেশের তরুণেরা যদি একদিন নেতৃত্বের জায়গায় আসে, তারা কি এই ইতিহাস ভুলে যাবে? নাকি সেই পুরোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা আবারো রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করবে?

তাহলে করণীয় কী?
প্রথমত সন্দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন তিনটি জিনিস
১. স্বচ্ছতা
২. জবাবদিহিতা
৩. প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা

দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে
মেধা এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন যেন ব্যক্তির পরিবার, বংশ, ইতিহাস বা রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে হয়।
তৃতীয়ত প্রয়োজন জনবিশ্বাস পুনঃস্থাপন।

বিশ্বাস ভেঙে গেলে ক্ষমতা বা শক্তি দিয়ে তা পুনর্গঠন সম্ভব নয়।
শুধুমাত্র সত্য, বিচার এবং ন্যায় দিয়ে জাতিকে শান্ত করা যায়।

সারমর্ম
এক কথায় বলতে গেলে;
সন্দেহ আমাদের সময়ের নীরব মহামারি।
এটি ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব জায়গায়
ঢুকে পড়েছে।
গোয়েন্দা নীতি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং অতীতের প্রতিহিংসার কারণে এই সন্দেহ আরও তীব্র হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সোর্ড অফ অনারের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাদের সমাজ এখনও ন্যায় এবং যোগ্যতার চেয়ে সন্দেহ এবং ক্ষমতার প্রতি বেশি সংবেদনশীল।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে কেবল সেনাবাহিনী নয়, পুরো জাতি একটি অবিশ্বাসের গহ্বরে পড়ে যাবে।
তাই আজ সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো সত্য উন্মোচন করা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলোকে একেবারে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা।
সন্দেহকে থামানোর একমাত্র উপায় সত্য আর ন্যায়ের শক্তি।
অন্যথায় এই মহামারি ভেঙে দেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে, ভেঙে দেবে আমাদের রাষ্ট্রকে, ভেঙে দেবে আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার