বেসরকারি জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান স্বদেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অব্যস্থাপনা ও বিমা আইন লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও বিভিন্ন অনিয়মের জন্য সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইখতিয়ার উদ্দিন শাহীন পদ হারানোর পরেও বিভিন্ন কৌশলে তিনি এখনো ভিন্ন ভিন্ন পদ-পদবী ব্যবহার করে কোম্পানীর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০২১ সাল পরবর্তী ২০২৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানিতে কোন প্রকার অভ্যন্তরীন অডিট হয়নি। এমনকি এজিএম, ইজিএম হয়নি। ২০১৯ সাল হতে এখন পর্যন্ত কোন প্রকার সরকারী ভ্যাট, ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়াও, ২০২৩ সালের ১৭ আগষ্ট হতে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদটি শূণ্য হওয়ার পর থেকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকা স্বত্ত্বেও অদ্যবধি কোন স্থায়ী মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হচ্ছে না। বর্তমানে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কোম্পানীর দায়েরকৃত চুরির চলমান মামলার আসামী আব্দুল জব্বার কাউসারকে। এমতাবস্থায় হাজার হাজার গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা ও সঞ্চিত আমানত ফেরতের বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সোমবার (০৮ ডিসেম্বর) প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান বারবর চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ের অবলিখন ও দাবী বিভাগের ইনচার্জ ও এসভিপি মো. আলমগীর শেখ। চিঠির অনুলিপি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, কর অঞ্চল-৫ এর কমিশনার, আইডিআরএ প্রশাসন আইন ও জীবন বিমা পরিচালক, ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এবং স্বদেশ লাইফের সকল পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহীকে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের ইনচার্জের অভিযোগ, সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইখতিয়ার উদ্দিন শাহীন কোম্পানির গ্রাহকের প্রিমিয়ামের ৬০ লাখ ৭০ হাজার ৭১৭ টাকা ও নিয়ম বর্হির্ভূত ভাবে গ্রহণকৃত ইনসেনটিভ বোনাস বাবদ ৪১ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৫ টাকা সহ সর্বমোট ১ কোটি ০২ লাখ ২৭ হাজার ২২২ টাকা আত্মসাৎ করেন। এই টাকা পরিশোধের জন্য বা কোম্পানী হিসাবে জমা করার জন্য বিগত ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর পত্র জারী করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই টাকা কোম্পানিতে জমা করা হয়নি। যদিও গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকা তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে জমা করার বিষয়টি তিনি নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত ভাবে স্বীকার করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে, সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইখতিয়ার উদ্দিন শাহীন বীমা আইন লঙ্ঘন ও বিভিন্ন অনিয়মের জন্য গত ২০২৩ সালের ১৭ আগষ্ট তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আইন উপসচিব ও পরিচালক মোহা. আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিক পত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়, তিনি স্বদেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর মূখ্য নির্বাহী হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ্য ভাবে তিনি স্বদেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন না বা এতে অংশ গ্রহণ করবেন না। তাছাড়া ও গত ২০২৪ সালের ১৩ জুন তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিত দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলা দায়ের করা হইয়াছে, যা তদন্তাধীন রয়েছে। এ নির্দেশনা থাকার পরও তিনি বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন পদ-পদবী ব্যবহার করে কোম্পানীর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সর্বশেষ কোম্পানীর ৪৯তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনি বর্তমানে আর.এস.আর.এম কোম্পানি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে স্বর্দেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করছেন। যা সম্পূর্ণ অন্যায়। তার ছত্রছায়াই কোম্পানিতে বিভিন্ন প্রকার আর্থিক অনিয়ম হচ্ছে।
চিঠিতে এই কর্মকর্তা জানান, কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন ও মূলধন হতে অর্জিত সুদও খরচ করা হয়েছে। কোম্পানির স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋন গ্রহণ করেছে যা এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। এবিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ ১২ জন পরিচালককে অপসারণ করে। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোম্পানি হাইকোর্টে রীট পিটিশন ২৩৭৪/২০২৪ দায়ের করেন। হাইকোর্ট ০৬ মাসের জন্য কর্তৃপক্ষের আদেশ স্থগিত করেন। কিন্তু বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষের অবহেলা কিংবা তদবীরের অভাবে এখনও পর্যন্ত মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি।
বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত থেকে জানা গেছে, কোম্পানিটি ২০১৪ সাল হতে ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৪ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় কালে যথাক্রমে ২১৯ শতাংশ, ১৪৯ শতাংশ, ১২৬ শতাংশ, ৯৪ শতাংশ, ১১৫ শতাংশ, ৪১ শতাংশ, ৪৫ শতাংশ অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছেন। তাছাড়া, ২০২১ সাল পরবর্তী ২০২৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানিতে কোন প্রকার অভ্যন্তরীন অডিট হয়নি। এমনকি এজিএম, ইজিএম হয়নি। তাছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ কোম্পানীতে একজন সি.এফ.ও এবং কোম্পানির একজন সচিব নেই। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কর্মকর্তাকে এই দায়িত্ব সাময়িক ভাবে প্রদান করা হয়। এতে করে কোম্পানির কোন প্রকার তথ্য ভান্ডার সঠিক নেই।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কোম্পানীতে গত ২০২৩ সালের ১৭ আগষ্ট হতে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদটি শূণ্য হওয়ার পরও থেকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকা স্বত্ত্বেও কোন স্থায়ী মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করছে না। একেক সময় একেক কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই পর্যন্ত ০৩ জন মূখ্য নির্বাহী (চলতি ও একজন প্রশাসক সহ মোট ০৪ জন) কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে আব্দুল জব্বার কাউসার মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তার বিরুদ্ধে কোম্পানির দায়েরকৃত চুরির মামলা সি.এম.এম আদালত, ঢাকাতে চলমান। এছাড়াও, কর্মকর্তাদের নামে ব্যাংক একাউন্ট না থাকায় এবং কোম্পানীটি অনলাইন ভিত্তিক না হওয়ায় মাঠ পর্যায় থেকে হেড অফিসের কর্মকর্তাদের বেতন, ভাতা, কমিশন বিল সহ ভাড়া ভাড়া সমস্ত লেনদেন ম্যানুয়াল সিস্টেম হওয়ার কারণে নামে, বে-নামে বিভিন্ন প্রকার বিল ভাউচার সমন্বয় করা হয়। বিভিন্ন প্রকার ইনসেনটিভ সঠিক বণ্টন না করে কিছু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে যাকে যতটুকু দিয়ে ম্যানেজ করতে পারে তাকে এই দেওয়া হয়। আবার অনেককে কিছুই দেওয়া হয় না। প্রতিবাদ করিলে চাকুরী থাকবে না বলে ভয় দেখানো হয় এবং সংগঠন বিচ্যুতি ঘটানোর ফলে অনেকে কোন প্রতিবাদ করেন না।
কোম্পানী ২০১৯ সাল হতে অদ্য পর্যন্ত কোন প্রকার সরকারী ভ্যাট, ট্যাক্স পরিশোধ করেন নাই। কোম্পানীতে কর্মরত কর্মকর্তাকে তাদের বেতন হতে কর্তনকৃত ভ্যাট, ট্যাক্স এর বৈতনিক সনদ প্রদান করেননি বলে চিঠিতে জানান এই কর্মকর্তা।
প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ গুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চেয়েছে এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, কোম্পানি সাবেক এই মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা তার অন্যায় হস্তক্ষেপ ও আর্থিক দুর্নীতি দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কোম্পানির সকল অন্যায় ও দুর্নীতির মূল সহযোগী উন্নয়ন প্রশাসন এইচ আর এডমিন মো. সাজিদ হোসেন ও কোম্পানির সচিব তাকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে পদোন্নতি দিয়ে বর্তমানে তাকে এডিশনাল এমডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। আগামী দিনে তাকে মূখ্য নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করে সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইফতিয়ার উদ্দিন শাহীন তার অন্যায় কার্যক্রম দীর্ঘায়ু করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা করছেন। এমতাবস্থায় কোম্পানীর সুশান প্রতিষ্ঠা ও গ্রহাকের স্বার্থ সুরক্ষায় সাবেক এই কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ কোম্পানির জন্য এবং কোম্পানির গ্রাহকের জন্য অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ।
এসএম