ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

একটি নতুন সময়ের চিত্র
বিশ্ব এখন এমন এক বিনিয়োগ সময়ের মুখোমুখি যেখানে পুরনো স্থিতিশীলতা আর নেই। গত কয়েক দশকের পরিচিত অর্থনৈতিক গতিশীলতা, বাজারের নিয়ম ও নিশ্চিত বিনিয়োগ প্রবাহ ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি, ভূরাজনীতি এবং প্রযুক্তির পরিবর্তনের জটিলতায় বিশ্বব্যাপী পুঁজির গতিপথ নতুন রূপ নিচ্ছে। এই পরিবর্তনের ঢেউ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবণতা
গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে ক্রমাগত ধীরগতি দেখা গেছে। United Nations Conference on Trade and Development জানিয়েছে যে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং ২০২৫ সাল এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এর অর্থ, উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।
এশিয়া অঞ্চলে পুঁজিবাজার কিছু অগ্রগতির ইঙ্গিত দিলেও বাজারের গভীরতা, দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতার অভাব এখনো প্রকট। উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও ঝুঁকি এবং মানবসম্পদ সংকটে ভুগছে। ফলে অতিরিক্ত বিনিয়োগের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাজার স্থিতিশীল নয়।

বেসরকারি মৌলধন বা প্রাইভেট ইকুইটি বাজার কিছুটা পুনরুদ্ধার করলেও আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। বড় লেনদেন ধীর এবং বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত সতর্ক। এর ফলে উদ্ভাবন এবং উদ্যোগে অর্থায়নের গতি কমে যাচ্ছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি চাপ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি মূল্যায়নে বাধ্য করছে। এসব প্রবণতা মিলিয়ে বিশ্ব এখন নতুন বিনিয়োগ যুগের মুখোমুখি, যেখানে পুরনো নিশ্চয়তা আর নেই এবং বাজারকে নতুন চোখে দেখা ছাড়া বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান চিত্র
“একটি দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার, কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত পুঁজিবাজার।” বাংলাদেশে পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে নির্ভরযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার অভাবে দুর্বল। নীচে মূল বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হলো। ব্যাংক একীভূতকরণ: নীতি, সংকট ও ঝুঁকি কিছু দুর্বল ব্যাংককে অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের জন্য তিনটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে।

১. তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ারের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। বিনিয়োগকারীরা জানে না তাদের অর্থের ফলাফল কী হবে।
২. বিনিয়োগকারীর মতামত উপেক্ষিত। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারের ভোট, স্বাধীন মূল্যায়ন এবং ন্যায্য বিনিময় অনুপাত নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে এগুলো কার্যকরভাবে হয় না।
৩. নৈতিক সংকট। যদি অডিট অনুযায়ী ব্যাংক স্থিতিশীল ছিল তাহলে হঠাৎ পতন কেন। আর যদি দুর্বল ছিল তাহলে অডিটে ধরা পড়েনি কেন। এটি বিনিয়োগকারীর আস্থা ভেঙে দেয় এবং বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে।
শেয়ারহোল্ডারের অধিকার
শেয়ারহোল্ডারের মৌলিক অধিকারগুলো কার্যকর না হলে বাজার টেকসই হয় না। এই অধিকারগুলো হলো:
১. ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা
২. স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ করা যেমন নন-পেরফর্মিং লোন, ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি এবং অডিট রিপোর্ট
৩. শেয়ারহোল্ডারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা
৪. ক্ষতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর ক্ষতিপূরণের অধিকার
বাংলাদেশে এই অধিকারগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত। ফলে বিনিয়োগকারীর আস্থা দুর্বল হয়ে গেছে এবং বাজার অনিরাপদ স্থানে আটকে আছে।
পুঁজিবাজার পতনের মূল কারণ
বাংলাদেশে বাজার পতন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংকটের ফল।
১. নীতির অস্থিরতা: হঠাৎ নতুন নীতি যেমন সার্কিট ব্রেকার, মার্কেট মেকার নীতি বা মার্জিন লোন নীতি বাজারকে অনিশ্চিত করে।
২. স্বচ্ছতার অভাব: ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা জনসমক্ষে আসে না।
৩. গোষ্ঠী স্বার্থে বাজার নিয়ন্ত্রণ: দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু কার্যকর সমাধান নেই।
৪. সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিশ্বাসহীনতা: মানুষ বিশ্বাস করে না যে তাদের টাকা নিরাপদ, নীতি ন্যায্য এবং রেগুলেটর নিরপেক্ষ।
নির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা: নতুন আলো কীভাবে দেওয়া সম্ভব
বাংলাদেশ চাইলে এই সংকট কাটিয়ে পুঁজিবাজারে নতুন আলো দিতে পারে। এর জন্য ধাপমূলক রোডম্যাপ প্রস্তাব করা হলো।
১. নীতি ধারাবাহিকতা এবং পূর্বঘোষণা
নতুন নীতি হঠাৎ পরিবর্তন না করে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে। সার্কিট ব্রেকার, মার্কেট মেকার এবং মার্জিন লোন নীতিকে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে স্থির করতে হবে।
২. বিনিয়োগকারীর অধিকার রক্ষা
মার্জার বা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারের ভোট বাধ্যতামূলক করতে হবে।
রেগুলেটর ব্যর্থ হলে ক্ষতিপূরণের স্বচ্ছ নীতি থাকা জরুরি।
৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠা
কর্পোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী করতে হবে।
ইন্সাইডার ট্রেডিং কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে হবে।
৪. নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা ও স্বাধীনতা
BSEC এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানের অডিট পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. বিনিয়োগকারীর তথ্যপ্রবাহ ও শিক্ষার উন্নয়ন
সহজ ভাষায় তথ্য প্রকাশ, বিনিয়োগ-ঝুঁকি সচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়া ও রেগুলেটরের যৌথ উদ্যোগে বাজার-সচেতনতা তৈরি।
৬. উদ্ভাবনী খাতে পুঁজিবাজারের সম্পৃক্ততা
প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদিতে পুঁজিবাজারের শক্তি ব্যবহার।
৭. ধাপভিত্তিক রূপান্তর রোডম্যাপ
প্রথম বছর: নীতি রিভিউ ও আইন সংস্কার।
দ্বিতীয় বছর: তদারকি শক্তিশালী করা ও শেয়ারহোল্ডারের অধিকার নিশ্চিত।
তৃতীয় বছর: উদ্ভাবনী বাজার ব্যবস্থা চালু করা এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা।

শেষ আহ্বান
বিশ্বের ধনী দেশ, ক্ষমতাধারী ব্যক্তি এবং কর্পোরেট নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা। বিশ্বের অর্থনীতির সংকটের মূল প্রভাবগুলো হচ্ছে বিশ্বরাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা, সামরিক সংঘাত, রোবটিক ও প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব, কুটনৈতিক কুচক্র এবং যুদ্ধ। এই বাস্তবতায় যদি কাগজে কলমে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাহলে এলন মাস্কের মতো একজনের ভোটের মতো আমারও একটি ভোট। এখন ভাবুন যদি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও নেতৃস্থানীয় মানুষকে হারানো সম্ভব হয়নি, তাহলে অর্থ দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা কতটা কার্যকর হবে।
এখন বিশ্বের কাছে প্রশ্ন: আমরা চাই অবিচার ও বিশৃঙ্খলা নাকি ন্যায্যতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা?

Rahman Mridha, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, Pfizer, Sweden
rahman.mridha@gmail.com 

শেয়ার করুন:-
শেয়ার