আমরা আর চোখ বুজে থাকতে পারি না। আমরা আর শুনে যেতে পারি না যে কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী শক্তি ও অর্থের পেছনে লুকিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দিচ্ছে। দুর্নীতি কেবল আর্থিক চুরি নয়, এটি আমাদের ন্যূনতম মর্যাদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতাকে ক্ষতবিক্ষত করে। যখন আদালত, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন কিংবা স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় জবাবদিহি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। বিশেষত সেই পরিশ্রমী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা, যাদের কষ্টের অর্থে আজও দেশের অর্থনীতি টিকে আছে।
এই কষ্ট আমরা আর মেনে নেব না। দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার, যে অভিযোগই উঠুক, সেটির নিরপেক্ষ তদন্ত এবং প্রমাণভিত্তিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রভাব, দরদাম বা রাজনৈতিক সুবিধার নামে বিচারপ্রক্রিয়া যেন বিকৃত না হয়, সেটাই আজকের সবচেয়ে বড় দাবি।
কিন্তু শুধু অভিযোগ নয়, আমাদের কাঠামোই বদলাতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন হবে স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা, যোগ্যতা, প্রযুক্তি এবং জনসম্পৃক্ততার সমন্বয়।
কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে যেমন;
১) স্বচ্ছতা ও তথ্য অধিকার প্রসার: সরকারি প্রকল্পের ব্যয়, উন্নয়ন বাজেট এবং লেনদেনের তথ্য সহজে নাগালের মধ্যে আনতে হবে, যাতে জনগণ দেখতে পারে কোথায় কীভাবে টাকা খরচ হচ্ছে। তথ্যের অভাব অনিয়মের জন্ম দেয়; স্বচ্ছতা দুর্নীতির মৃত্যু ঘটায়।
২) স্বাধীন তদন্ত ও অডিট ব্যবস্থা: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দ্রুত ও পেশাদার তদন্ত এবং অডিট প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে, যাদের প্রতিবেদন বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশিত হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপে রূপ নেবে।
৩) যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে সরকারি নিয়োগ: ব্লাডভিত্তিক বা রাজনৈতিক নিয়োগের সংস্কৃতি বন্ধ করে দক্ষতা, নৈতিকতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে নিয়োগ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ বাড়াতে হবে।
৪) নাগরিক অংশগ্রহণ ও স্থানীয় তত্ত্বাবধান: জনগণকে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের নজরদারি থাকলে কাঠামোগত দুর্নীতি অনেকাংশে রোধ করা যায়।
৫) ডিজিটাল রেকর্ড ও ট্রেসেবল সেবা: সরকারি নথি, লেনদেন ও সেবায় ডিজিটাল রেকর্ড রাখলে অনিয়ম লুকানো যায় না। এতে সেবা দ্রুত হয়, জবাবদিহি নিশ্চিত হয়।
এই পরিবর্তনগুলো শুধু নীতি নয়, এগুলো সততা ও দায়িত্ববোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার পথ। এটি একদিনের কাজ নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম যেখানে প্রতিদিন ন্যায্যতার জন্য দাঁড়াতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হলে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে কারণ ভোট মানে দায়িত্ব।
সেক্ষেত্রে একজন দুর্নীতিবাজকে দল মনোনয়ন দিলেও আপনি তাকে সমর্থন করবেন না, হোক না সে আপনার দলের কেউ, ভোট দিয়ে দুর্নীতিকে সমর্থন করবেন না। হ্যাঁ, আমি বলছি বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষকে। যদি আমরা সত্যিই বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদা রাখতে চাই, তবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা কখনোই সম্ভব নয় যদি চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের হাতেই আমরা দেশকে জিম্মি করে রাখি।
বিশ্বজুড়ে দেড় কোটিরও বেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা আজ এই দেশকে সচল রাখছেন, তাদের কষ্টের টাকা যেন দুর্নীতির পকেটে না যায়, সেটি আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। আমরা চাই মানবিক মূল্যবোধ, সততা, নিষ্ঠা এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব। কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত অমানুষের দেশ পরিচালনার অধিকার নেই এবং ভুল করেও আমরা যেন তাকে সেই সুযোগ না দিই। এটি শুধু অধিকার নয়, এটি আমাদের জাতিগত দায়িত্ব।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এত আহ্বান, এত ত্যাগের পরও আমরা কেন একই জায়গায় ঘুরপাক খাই? কেন বারবার সেই পুরোনো নেতৃত্ব, সেই পুরোনো দুর্নীতির চক্র ফিরে আসে? এই প্রশ্নই আমাদের ইতিহাসের আয়নায় তাকাতে বাধ্য করে। ভাবুন গত পঞ্চাশ বছরের বাস্তবতায় আমরা কী পেয়েছি! দীর্ঘ চুয়ান্ন বছর কেটে গেছে, কিন্তু আমরা প্রকৃত অর্থে পরিবর্তন দেখিনি। এক রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে আরেক রোগে আক্রান্ত হয়েছি—কলেরা থেকে যক্ষ্মা, কিন্তু সুস্থ হতে পারিনি। কারণ আমরা বারবার একই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব ও বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। এখন যদি আবারও আমরা ব্যর্থ হই, তবে হেরে যাবে আমাদের মনুষ্যত্ব—সাথে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশও।
আমি/ আপনিই কিন্তু বাংলাদেশ, আমি/ আপনিই সেই জাগ্রত জনতার কণ্ঠ আমার আছে সততা, আর সততার সঙ্গে লড়াই করার সাহস। অসততার সঙ্গে আমার কোনো আপস নেই। অসততা সবসময় অন্ধকারে লুকায়, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বৈরশাসন জন্ম দেয়। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের মানুষ বহুবার দেখেছে। অতএব, আমরা জানি, এই অপকর্মের প্রশ্রয় আমরা আর দিতে পারি না। আমাদের করণীয় একটাই: সততার পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলা, এবং প্রতিটি দুর্নীতিকে ঘৃণা করা।
এক সাগরের রক্তের বিনিময় আবারও আমরা নতুন একটি সুযোগ পেয়েছি, এখনই সময়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে যেভাবে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন চলছে, তা দেখে স্পষ্ট, মানুষের মুখোশধারী রাক্ষসরা আবারও আমাদের গণতন্ত্রকে গ্রাস করতে চায়। কিন্তু আমরা ভুলে যেতে পারি না, এই দেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটি আঠারো কোটি মানুষের দেশ। যদি আমরা সত্যিই নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চাই, তবে এখনই সময়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, সত্যের পক্ষে বলার, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার।
আসুন সকলে মিলে সত্যের পথে দাঁড়ানোর শপথ নিই সত্য বললে শক্তি শঙ্কিত হয়, কিন্তু ন্যায়ের পথে তা-ই দরকার। আমাদের কণ্ঠ হতে হবে যুক্তিনির্ভর, প্রমাণভিত্তিক ও দায়িত্বশীল। কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, চাই কাঠামোগত সংস্কার; কেবল আবেগ নয়, চাই কার্যকর নীতি ও জবাবদিহি।
আমাদের সংগ্রাম কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধারের লড়াই। আমাদের লক্ষ্য একটিই, একটি দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক এবং দায়িত্বশীল বাংলাদেশ। আমি বলি, প্রশ্ন করুন, তথ্য চান, বিচার চাই। আমাদের সন্তানদের জন্য, আমাদের স্বপ্নের জন্য, আমাদের দেশের জন্য, এখনই সময়। নিজের কণ্ঠ তুলুন, সত্যের পক্ষে লড়ুন, এবং রক্ষা করুন ভবিষ্যৎ। রক্ষা করুন বাংলাদেশ।
লেখক: রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com