ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

অভিবাসীদের শহর থেকে এক নতুন রাজনৈতিক আলোর ডাক

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যখন একটি শহরের ভোট শুধুই প্রশাসনিক রদবদল নয়, বরং এক নতুন রাজনৈতিক কল্পনার সূচনা করে। নিউ ইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র জোহরান মামদানির বিজয় সেই রকমই এক মুহূর্ত।

মামদানির (Mamdani) ভাষণ কোনো ব্যক্তিগত জয়গাথা নয়, এটি সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের পুনর্জন্ম। তাঁর কণ্ঠে ছিল না ক্ষমতার অহংকার; ছিল মানুষের বিশ্বাসের ধ্বনি, একটি শহরের প্রাণে ফের জ্বালানো আগুনের গল্প।

তিনি বলেন, “এই শহরের সূর্য হয়তো অস্ত গেছে, কিন্তু মানবতার জন্য এক নতুন ভোর আসছে।” এই জয় তাঁর একার নয়, এই জয় সেই বাংলাদেশি আন্টির, যিনি শত কষ্টেও মানুষের দরজায় কড়া নাড়েন; সেই অভিবাসীর, যিনি দিনরাত ট্যাক্সি চালিয়ে সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন; সেই নারীর, যিনি একা সংসার চালান কিন্তু স্বপ্ন ত্যাগ করেন না।

তিনি ঘোষণা দেন, ক্ষমতা তোমাদের, এই শহর তোমাদের।

এ বাক্যগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, এটি এক গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের ঘোষণা। মামদানি মনে করিয়ে দেন, শহর তখনই জেগে ওঠে, যখন তার মানুষ জেগে ওঠে। আর তার জয় শুধু আনন্দ নয়, বরং এক আত্মবিশ্বাসের ডাক, ভয় নয়, আশা; বিভাজন নয়, ঐক্য; শাসন নয়, অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য ঠিক তেমন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তবে প্রশ্ন বাংলাদেশ কী পারবে সেটাকে বরণ করতে? মামদানির কথা গুলো ধরেছে আমার মনে, তাই ভাবলাম বাংলাদেশের মানুষের জন্য মামদানির দেওয়া গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের ঘোষণা হতে পারে শিক্ষণীয়।

বাংলাদেশে আজ রাজনীতি অর্থ-ক্ষমতা, দখল ও গোষ্ঠী-স্বার্থের ঘূর্ণাবর্তে আটকে পড়েছে। মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ, রাজনীতি থেকে জনগণ দূরে, আর নৈতিক নেতৃত্ব যেন বিলুপ্তপ্রায়।

মামদানির বার্তা আমাদের শেখায়, রাজনীতি তখনই জীবন্ত হয়, যখন তা ফিরে আসে মানুষের দরজায়।

শিক্ষণীয় তিনটি দিক:
১. রাজনীতির কেন্দ্র জনগণ: ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব। প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, অংশগ্রহণ। রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে জনগণের কাছে, গ্রামে, মহল্লায়, বাজারে, শ্রমিকের ঘরে।
২. নৈতিক নেতৃত্বের পুনর্গঠন: মামদানির সততা ও আদর্শিক দৃঢ়তা মনে করায়, নেতার কাজ জনগণকে ব্যবহার করা নয়, ক্ষমতা তাদের ফেরত দেওয়া।
৩. সমতার চেতনা: অভিবাসী, সংখ্যালঘু, নারী, সবাই রাজনীতির সমান অংশীদার।

আমরা কী ধরনের নেতা আশা করতে পারি
একজন নতুন প্রজন্মের নেতা:
-শ্রোতা, প্রশ্নকে ভয় না পাওয়ার;
-ক্ষমতা নয়, আস্থা গড়ে তোলার;
-ব্যর্থতাকে লজ্জা নয়, শিক্ষার সুযোগ মনে করার;
-জনগণের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার;
-রাজনীতিকে লাভ নয়, দায়িত্ব হিসেবে দেখার।
এ ধরনের নেতা জন্ম নেবে তখনই, যখন নাগরিক সমাজ সাহসী হবে প্রশ্ন করতে, তরুণেরা রাজনীতিকে ঘৃণা নয়, পরিবর্তনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখবে, এবং বুদ্ধিজীবীরা পুনরায় সমাজের বিবেক হয়ে উঠবে।

অতএব যে নেতা এখন আপনার দুয়ারে ঘুরছে ভোটের জন্য, তাকে আগে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন, আপনি কী সেবা দিতে নাকি নিতে রাজনীতি করছেন? যদি সত্যিই সেবা দিতে রাজনীতি করতে এসে থাকেন তবে আপনার ভোট টাকা দিয়ে কিনবে না বরং আপনার ভোট আপনার মনকে জয় করে নেবে।

প্রশ্ন হতে পারে তাহলে এখন বাংলাদেশের জন‍্য কী করণীয়?
-রাজনীতি পুনর্গঠন করতে হবে নৈতিক ভিত্তিতে: দুর্নীতি, সুবিধাভোগ ও ক্ষমতার আসক্তি থেকে মুক্ত হতে হবে।
-তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে: দলীয় গণ্ডি ভেঙে নাগরিক অংশগ্রহণের সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে।
-রাজনীতির শিক্ষা পুনর্লিখন: স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক শিক্ষাকে আদর্শ, ন্যায় ও দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে শেখাতে হবে।
-জনমত গঠনের নতুন মাধ্যম তৈরি করতে হবে: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় ফোরামগুলিকে জনগণের আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, দলে প্রচারমাধ্যম হিসেবে নয়।

কী বর্জনীয়?
-ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন
-ব্যক্তিপূজা ও দলনির্ভর অন্ধ আনুগত্য
-রাজনীতিকে ব্যবসায় রূপ দেওয়া
-ভয়ের সংস্কৃতি ও মতপ্রকাশ দমন

এখনই সম্ভব নতুন গণতান্ত্রিক উত্থানের বাংলাদেশ আজ যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে, সেখান থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ হলো, একটি গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ।

মামদানির ভাষণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়: গণতন্ত্র কোনো ভোটের ফল নয়, এটি একটি সম্পর্ক, নেতা ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক।

যদি আমরা সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারি, যদি মানুষ আবার রাজনীতিকে নিজের মনে করে, যদি তরুণেরা নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখে, তবে একদিন আমরাও বলতে পারব, “এই দেশ আমাদের, এই ক্ষমতা আমাদের, এই ভবিষ্যৎ আমাদের।”

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার