বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠেছে। যদি আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা অনিবার্যভাবে হার স্বীকার করতে বাধ্য হব। কিন্তু এটি কি শুধুই ব্যক্তিগত পরাজয়ের গল্প? না। এটি একটি সমষ্টিগত মনস্তাত্ত্বিক ধ্বস, যা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সম্পর্ক ভাঙায় এবং সমাজের অন্তর থেকে আশা শুষে নেয়। যেখানে দুর্নীতি, অত্যাচার, অবিচার এবং মিথ্যা অভিযোগ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ সেগুলো দেখার সুযোগ এবং সাহস খুঁজে পাচ্ছে না, সেখানে অস্থিরতা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে হৃদয়ে। এই অস্থিরতা কাটাতে আমাদের সকলকে একযোগে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং সকল ষড়যন্ত্র ভেঙে দিতে হবে।
পরাজয়ের মনস্তত্ত্ব ও সমাজের ভাঙন
পরাজয়ের অনুভূতি যত গভীর হবে তত বেশি মানুষ আত্মরক্ষার পথ গ্রহণ করবে। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে জন্ম নেয় সন্দেহ, প্রতিহিংসা এবং ভুল বোঝাবুঝি। যখন প্রত্যেকে শুধু নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই করে, তখন সহানুভূতির জায়গা শূন্য হয়ে পড়ে। পরিবারিক দ্বন্দ্বে ভালোবাসার বদলে ঘৃণা জমে। ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক দ্বন্দ্বেও মিশ্র আবেগ সমাজকে ভিতরের দিকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে। আর কেউ যদি বলে আমি শুধু হেরেছি, তুমি কি একটুও হারোনি, তখন সেই প্রশ্নই আস্থা ভাঙায় এবং সবচেয়ে ভয়ানক ভূমিকা নেয়।
মুক্তির পথ: নীতি, কৌশল ও অনুশীলন
মুক্তির পথ কেবল স্লোগানের ইস্যু নয়। এটিকে নীতি, কৌশল এবং ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত অপরিহার্য।
১. স্বচ্ছতা
অভিযোগ যদি প্রকাশ্য না হয় এবং তদন্ত স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে না হয়, তাহলে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও গুজব আগুনের কাজ করবে। দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ তদন্ত ব্যবস্থা গড়তে হবে।
২. সহমর্মিতা
দোষীদের বিচার করতেই হবে, কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখার আগ্রহ হারালে পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সহমর্মিতা ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
৩. সংহত আন্দোলন
ভাগ হয়ে থাকা প্রতিবাদ ভাঙনই বাড়ায়। পরিকল্পিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নীতিভিত্তিক আন্দোলনই টেকসই পরিবর্তন আনতে পারে। পাশাপাশি আইনি ও নৈতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করে ক্ষমতার অপব্যবহার দমন করতে হবে।
রাষ্ট্র যন্ত্রের ওপর বিশ্লেষণ
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে মৌলিক কাঠামোগুলো প্রয়োজন, সেগুলো আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কেন পৌঁছেছে? কীভাবে সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব? নির্বাচন কি একমাত্র সমাধান? বাংলাদেশ আদৌ নির্বাচন সম্পর্কে সচেতন ছিল কি? একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অবকাঠামো কিভাবে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে?
রাষ্ট্রযন্ত্র কী
রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে আমরা বুঝি আইনপ্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান, নির্বাহী বিভাগ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী কাঠামো এবং তথ্যমাধ্যম। এগুলো একত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখে। যখন এই স্তরগুলো দুর্বল হয়, তখন রাষ্ট্র কেবল নামমাত্রই থাকে। তখন নীতি, ন্যায় ও দায়িত্ববোধ ভেঙে পড়ে এবং দুর্নীতি ও শক্তির অপব্যবহার সমাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বসে যায়।
নির্বাচন কি সমাধান
নির্বাচন একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া, কিন্তু এটি নিজে এককভাবে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোকে শুধরাতে পারে না যদি পরিবেশ নিরপেক্ষ না থাকে। নির্বাচন যদি হয় কেবল ফর্মালিটি, ভোটচুরি ও প্রভাবের মাধ্যমে পরিচালিত, তাহলে তা জনগণের আস্থা হারায়। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ন্যায্য, মুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে না পারলে নির্বাচন কেবল আড়ম্বর হয়ে থাকে।
নির্বাচন সম্পর্কে সচেতনতা
বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ভোটাররা নির্বাচনকে অনেক সময় শুধু একটি ইভেন্ট মনে করেন, যেখানে কাগজে চিহ্ন দেয়া হয়। সচেতন নাগরিক হওয়ার মানে হলো প্রার্থীর নীতি যাচাই করা, তাদের অনুপ্রেরণা বোঝা, এবং ভোটের ফলাফল ধরে রাখার দায়বদ্ধতা পালন করা। এই সচেতনতা গড়ে ওঠে মিডিয়ার স্বাধীনতা, নাগরিক শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিচারব্যবস্থার স্বতন্ত্রতার মাধ্যমে। যখন এগুলো দুর্বল থাকে, তখন নির্বাচনও দুর্বল হয়।
দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অবকাঠামো ও জনগণের শাসন
দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামো জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বরং তা ক্ষমতাসীনদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ দেয় নিজের অবস্থান দীর্ঘায়িত করার। দুর্নীতি নীতিগত স্বার্থ বিকৃত করে এবং নাগরিকের বিশ্বাস ধ্বংস করে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সততা, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক নীতি। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের ভেতরে স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে, তাহলেই বাহ্যিক নির্বাচনে সঠিক প্রতিনিধিত্ব সম্ভব।
রাষ্ট্রযন্ত্র রক্ষার প্রস্তাবনা
১. বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা শক্তিশালী করা, বিচারব্যবস্থা হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক চাপমুক্ত।
২. নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশাসন নিশ্চিত করা, প্রযুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে উন্মুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৩. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্যের মুক্ত প্রবাহ, তথ্য যাচাই ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
৪. দমনমূলক আইন পর্যালোচনা, সমালোচনা ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার রক্ষায় আইনগুলো পুনর্গঠন করতে হবে।
৫. নাগরিক শিক্ষা ও অংশগ্রহণ, ভোটের মূল্যবোধ, নীতিগত বিচার ও জনগণের অধিকার বিষয়ে শিক্ষা বাড়াতে হবে।
৬. অডিট ও জবাবদিহি কাঠামো শক্তিশালী করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর অডিট ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নিয়ম চালু করতে হবে।
৭. সংগঠিত ও নীতিভিত্তিক অভ্যন্তরীণ আন্দোলন, বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের বদলে কৌশলগত, শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে.
সমাপ্তি
হেরে যাওয়া মানে মরে যাওয়া নয় এই সমসাময়িক ভাবনাটিকে আমাদের ভাঙতে হবে। পরাজয় যদি আত্মসমর্পণ হয়, তা সমাজকে ধ্বংস করবে। কিন্তু পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, কথা বলার দরজা খোলা রাখি, এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনরুজ্জীবিত করি, তবে সেই একই পরিস্থিতিই হতে পারে মুক্তির পথ। রাষ্ট্রের যন্ত্রকে রক্ষা করা শুধু প্রশাসনিক কাজ নয় এটি সামাজিক চুক্তি রক্ষা করা। এর জন্য প্রয়োজন ন্যায়, স্বচ্ছতা এবং সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ।
রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com