১৯৭১ – বিজয়ের অন্তর্নিহিত শিক্ষা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি রাষ্ট্রের জন্ম নয়—এটি ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় ও মানবিক ন্যায়ের পুনর্জন্ম। সেই যুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় তখন কোনো অত্যাচার, কোনো শাসক, কোনো বাহিনীই টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীনতার অর্থ তখন কেবল পতাকা নয়, বরং মানুষের সম্মান, অধিকার এবং জীবনের নিরাপত্তা।
২০২৪ – গণঅভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সূচনা
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর আবারও বাংলাদেশের রাস্তায় ফুটে উঠেছে প্রতিরোধের আগুন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একটি অগ্নিকণিকা, যা মুহূর্তেই রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। যুবসমাজের রক্ত, ছাত্রদের সাহস এবং জনতার নির্ভীক সমর্থনেই পতন ঘটে স্বৈরাচারী সরকারের। এবারের বিজয় বন্দুক নয়—মানুষের বিশ্বাস, ঐক্য ও সত্যের শক্তিতে অর্জিত।
রক্ত, সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই অভ্যুত্থান ছিল রক্তাক্ত, তবুও তা ছিল ন্যায়ের পথে। শত শত প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে একটি নতুন ভোরের আশায়। সেনাবাহিনী শেষ মুহূর্তে সংযমের ভূমিকা নেয়, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকৃতি জানায়। বিশ্ব এবার তাকিয়ে আছে—বাংলাদেশ কীভাবে নিজের ভবিষ্যৎ লিখবে।
নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
দেশ যখন বিশৃঙ্খলার মুখে, তখনই আবির্ভূত হন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একদিকে আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতীক, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের আশার মুখ। তার নেতৃত্বে শুরু হয় নতুন বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা—দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার অঙ্গীকার। তবে তাঁর সামনে আছে বড় চ্যালেঞ্জ—রাজনীতির বিষাক্ত সংস্কৃতি ও দীর্ঘদিনের পচন।
দুর্নীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পুনর্গঠন
বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বহু বছর ধরে দুর্নীতি ও অনিয়মে আক্রান্ত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো—একটি স্বাধীন ও কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, এবং সরকারি প্রশাসনে প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্র নিজের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে না, সে রাষ্ট্র কোনোদিনই সত্যিকারের স্বাধীন নয়।
ভারতের ভূমিকা ও আঞ্চলিক বাস্তবতা
ভারত সবসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে আগ্রহী এক প্রতিবেশী। ২০২৪–এর পর ভারতের অবস্থানও নীরব পর্যবেক্ষক থেকে কৌশলগত সহযাত্রীতে রূপ নিতে পারে। তবে বাংলাদেশের উচিত নিজস্ব স্বার্থ ও সার্বভৌম নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া—বন্ধুত্ব বজায় রেখে নির্ভরশীলতা নয়, বরং পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করা।
আমেরিকার ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সমর্থন জানালেও বাস্তবতা হলো—তাদের স্বার্থও নীতির অন্তরালে লুকিয়ে থাকে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের অবস্থান ধরে রাখা। অন্ধ অনুকরণ নয়—দৃঢ় কূটনৈতিক ভারসাম্যই এখন সময়ের দাবি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: নতুন রাষ্ট্রচিন্তার তিন দিক
একটি জাতি এখন মোড় ঘুরিয়েছে। সামনে তিনটি পথ—
প্রথমত, সংস্কার, ন্যায়বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা করে সীমিত পরিবর্তনের বাস্তবমুখী পথ। তৃতীয়ত, বিভাজন ও অনৈক্যের কারণে আবারও অচলাবস্থায় পতন।
কোন পথ বেছে নেবে বাংলাদেশ—এটাই আজকের মূল প্রশ্ন।
রাষ্ট্রপুনর্গঠনের করণীয় ধাপ
প্রথম ৬ মাসে নাগরিক নিরাপত্তা, আইনি স্থিতি ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ছয়–আঠারো মাসে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। আঠারো–ছত্রিশ মাসে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বড় নীতি সংস্কার আনতে হবে। এই রোডম্যাপই হতে পারে একটি টেকসই রাষ্ট্রের ভিত্তি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি: বাস্তববাদ ও মর্যাদা
ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেও বাংলাদেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশীয় অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক সম্মান ও জাতীয় স্বার্থনির্ভর। একটি ছোট রাষ্ট্রও যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তবে কোনো পরাশক্তিই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
মূল প্রশ্নগুলোর বাস্তব পর্যালোচনা
ড. ইউনূসকে সরানো মানে কেবল একজন ব্যক্তিকে নয়—একটি আশা ও আস্থার প্রতীককে সরানো। বাংলাদেশ কোনো পরাশক্তির অঙ্গরাজ্য হবে না, যদি সে নিজের আত্মসম্মান ও জনগণের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস রাখে। তরুণদের নেতৃত্ব, ন্যায়ের রাজনীতি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি গড়বে।
সমাপ্তি: দ্বিতীয় স্বাধীনতার আহ্বান
১৯৭১ ছিল স্বাধীনতার প্রথম জন্ম, ২০২৪ তার আত্মার পুনর্জন্ম। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা কেবল সরকারের পরিবর্তন নয়—এটি এক মানসিক বিপ্লব, যেখানে নাগরিক নিজেই রাষ্ট্রের মালিক। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার মানুষের সততা, সাহস ও ঐক্যের ওপর। আমরা যদি নিজেদের দায়িত্ব বুঝি, তবে এই দেশ আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে—সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলোর পথে।
স্বাধীনতার অব্যাহত যাত্রা
বাংলাদেশ এখনো জন্ম নিচ্ছে— প্রতিদিন, প্রতিটি মানুষের সিদ্ধান্তে। ৭১ আমাদের দিয়েছে ভূখণ্ড, কিন্তু ২০২৪ আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে আত্মার আয়না। “স্বাধীনতা কোনো সমাপ্তি নয়, এটি এক অবিরাম যাত্রা। আর বাংলাদেশ সেই যাত্রায় আজ নিজের নাম, ভাষা ও আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে।” আজ সময় এসেছে প্রতিটি নাগরিকের ভেতরের বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলার—কারণ সত্যিকারের স্বাধীনতা তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন জনগণ জেগে ওঠে রাষ্ট্র হয়ে।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com