যাদের কাছে দেশ পরিচালনার জন্য কিছুই নেই, শুধু দুর্নীতি ছাড়া, তারা কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে? হ্যাঁ, বলছি বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের কথা। স্বৈরশাসনের পতনের পর দীর্ঘ চৌদ্দ মাস কেটে গেল, অথচ দেশের স্থিতিশীলতা আজও ফেরেনি। কারণ একটাই: দুর্নীতিবিরোধী স্লোগানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিবাজদের আসল মুখ।
যাদের নেই সৃজনশীল শিক্ষা, নেই সামাজিক দায়িত্ব, নেই কোনো দেশগঠনের দৃষ্টি—তাদের হাতে শুধু ধান্দাবাজি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, হানাহানি ও সন্ত্রাস। এই মানুষগুলোই এখন রাষ্ট্র চালায়! তারা যদি সত্যিই দেশ পরিচালনা করতে পারতো, তাহলে শেখ হাসিনা ষোল বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতো না।
যদি ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে না দাঁড়াতো, তাহলে কি সম্ভব হতো এই দুর্নীতিবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা? একটি দরিদ্র দেশের মানুষ যখন তেল আনতে নুনের খরচ যোগাতে পারে না, তখন সেই দেশের শাসকশ্রেণি যদি বিলাসিতা, ঘুষ ও অরাজকতায় মত্ত থাকে—এটা কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নয়, এটি জাতির আত্মহনন।
আমরা আসলে কী করছি? আমাদের রাজনীতি আজ আত্মবিনাশের পথে, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সেই পচনের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝতে পারছি কেন ভারত আমাদের বারোটা বাজাচ্ছে! এটা ভারতের দোষ নয়—আমরাই সুযোগ তৈরি করছি, আর তারা তা দক্ষতার সাথে কাজে লাগাচ্ছে। ভারত আমাদের প্রতিপক্ষ নয়, আমাদের দুর্বলতার দর্পণ। যে জাতি নিজস্ব নীতি ও মর্যাদায় টিকে থাকতে পারে না, তাকে অন্য কেউ কখনো সম্মান করবে না।
যে সকল দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা বলে তারা বাংলাদেশের ভাগ্য বদলাবে, তারা আসলে নিজেদের ভাগ্য মজবুত করার খেলায় ব্যস্ত। কারণ না আছে তাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, না আছে নীতিনিষ্ঠ পরিকল্পনা, না আছে শক্তিশালী অর্থনৈতিক রিজার্ভ। তাহলে এইসব দুর্নীতিবাজদের পিছনে সময় নষ্ট করে কোনো সমাধান আসবে? কী মনে হয়?
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। রেমিটেন্স যোদ্ধারা বিদেশে প্রতিনিয়ত সমস্যার মুখে পড়ছে। আগামী দিনে যদি শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়, রেমিটেন্স কমে যায়—তখন কী হবে এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার? একটি জাতির জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়, এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে এক প্রকার নির্বাসন।
গণতন্ত্রের ভণ্ডামি ও বাস্তবতার প্রশ্ন
বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্র এক প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে নির্বাচন মানে টাকা, অস্ত্র, আর ভয় দেখানোর প্রতিযোগিতা। রাজনীতি মানে পরিবারতন্ত্র, যেখানে জনগণ কেবল দর্শক আর ভোট কেবল একদিনের মঞ্চনাটক।
এই ভণ্ড গণতন্ত্রের কারণে প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, ন্যায়বিচার বিক্রি হয়েছে, এবং সমাজে নৈতিকতার জায়গা দখল করেছে ধান্দাবাজি ও ভয়। গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ, যখন নেতৃত্ব জবাবদিহি করে; যখন রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দক্ষতা, সততা ও দূরদৃষ্টি থাকে। বাংলাদেশে আজ সেই তিনটি জিনিসই অনুপস্থিত।
তাই গণতন্ত্র নয়—এই দেশের দরকার শৃঙ্খলা, কঠোরতা, এবং বাস্তব উন্নয়নবাদী রাষ্ট্রনীতি। বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র একেবারেই অচল। যে দেশে নির্বাচন মানে অর্থ আর অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, যেখানে রাজনীতি মানে পরিবারতন্ত্র আর দুর্নীতির সমীকরণ, সেখানে গণতন্ত্র নামের নাটক কেবল লুটপাটের বৈধ লাইসেন্স ছাড়া আর কিছু নয়। পশ্চিমা মডেল আমাদের জন্য নয়—আমাদের প্রয়োজন শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও কঠোর রাষ্ট্রচিন্তা। আর এখানেই চীনের পথ বাংলাদেশের জন্য আশার আলো।
চীন কোনো দিবাস্বপ্নের দেশ নয়—চীন হলো প্রমাণ, যে সুশাসন মানে বক্তৃতা নয়, কাজ। সেখানে দুর্নীতি করলে মৃত্যুদণ্ড হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করলে নিজ দলের মধ্যেই বিচার হয়, এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ হয় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে, নির্বাচন কমিশনের নাটক বা তোষণ দিয়ে নয়। বাংলাদেশে এই দৃঢ়তা নেই, কারণ এখানে সবাই দায় এড়িয়ে বাঁচতে চায়। এখানে কেউ চায় না জবাবদিহিতা, কারণ জবাবদিহি মানেই দুর্নীতির পর্দা উন্মোচন।
চীন তার জনগণকে দিয়েছে বাস্তব উন্নয়ন—বিদ্যুৎ, শিল্প, প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান। ওরা সময় নষ্ট করেনি স্লোগানে, তারা সময় দিয়েছে পরিকল্পনায়। বাংলাদেশকে এখন সেই পথেই যেতে হবে। যেখানে দুর্নীতি হবে রাষ্ট্রদ্রোহ, যেখানে নেতার কাজ হবে সেবা, লুট নয়। চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক মানে শুধু বিনিয়োগ নয়, মানে একটি শৃঙ্খলিত প্রশাসনিক কাঠামো শেখা।
আমাদের দরকার developmental authoritarianism—একটি এমন প্রশাসনিক কাঠামো, যা দুর্নীতির নরম সুরে নয়, কঠোর বাস্তবতায় কাজ করে। চীনের শৃঙ্খলা বাংলাদেশের জন্য ওষুধের মতো। আজ যে রাষ্ট্রে স্কুলে ঘুষ, হাসপাতালে দালালি, আদালতে কেনাবেচা, সেখানকার রোগ একটাই—দুর্নীতি। এই রোগে ওষুধ লাগবে; আর এই ওষুধের নাম ‘state discipline’। পশ্চিমা গণতন্ত্র বলবে, “মানবাধিকার।” কিন্তু যে দেশে মানুষ নিজের অধিকারই জানে না, সেখানে মানবাধিকার শুধু মশকরা। প্রথমে দরকার রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা, পরে আসবে মানবাধিকার।
চীনের মডেল বাংলাদেশে আনতে হবে তিন ধাপে –
প্রথম, প্রশাসনে শূন্য সহনশীলতা নীতি; দ্বিতীয়, দলীয় রাজনীতি থেকে আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করা; তৃতীয়, পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও স্থানীয় উৎপাদনমুখী রাষ্ট্রনীতি।
চীন এগুলো করেছে বলেই তাদের গ্রামের মানুষ আজও উন্নয়নের সুফল পায়। বাংলাদেশের মানুষ পায় না, কারণ উন্নয়ন মানে এখানে দলীয় ঠিকাদারি আর মিডিয়ার প্রচার। এখন সময় এসেছে—পশ্চিমা অনুকরণ বন্ধ করে এশীয় বাস্তবতার পথে হাঁটার। যদি সত্যিই বাংলাদেশকে আমরা বাঁচাতে চাই, তাহলে চীনের থেকে শিখতে হবে কীভাবে দুর্নীতিকে কবর দিতে হয়, কীভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে কঠোর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এই দেশের মাটিতে এখন আর স্লোগান নয়—প্রয়োজন লোহার শাসন, কাঠামোগত সংস্কার এবং নতুন রাষ্ট্রদৃষ্টি।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com