বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার এজেন্সি অফিসারদের বিরুদ্ধে আদালতে হাজিরা-এক নতুন ন্যায়যাত্রার সূচনা
এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার জাগরণ
বাংলাদেশে ‘গুম’ শব্দটি কেবল একটি অপরাধ নয়, এক নিঃশব্দ আতঙ্কের প্রতীক। হঠাৎ মানুষ হারিয়ে যেত, পরিবার জানত না তারা জীবিত না মৃত, অথচ রাষ্ট্রের নীরবতা ছিল আরও ভয়াবহ। কিন্তু এবার সেই নীরবতার দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছে। আজ আদালতে হাজির হয়েছেন ২৫ জন সেনা সদস্য, যারা হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ একাধিক গুম ও গোপন বন্দিশালার ঘটনায় অভিযুক্ত। এটি শুধুই বিচার নয়—এটি সেই রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার সূচনা, যা এতদিন শুধু জনগণের কণ্ঠে ছিল, নীতিনির্ধারকের হাতে নয়।
দেয়ালে লেখা সত্য, রঙে ঢাকা মিথ্যা
তদন্তে উঠে এসেছে, হুম্মাম কাদের চৌধুরী যখন গুম অবস্থায় ছিলেন, তিনি সেলের দেয়ালে নিজের নামের সংক্ষিপ্ত চিহ্ন “HQ” লিখে রেখেছিলেন। পরবর্তী তদন্তে দেখা যায়, সেই লেখাটি আর নেই। দেয়াল নতুন রঙে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবুও ভিডিও কলে হুম্মাম বলেন, “হ্যাঁ, এই দেয়ালেই আমি HQ লিখেছিলাম।” দেয়ালের প্রলেপ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সাদা রঙের নিচে সেই লেখার ছায়া এখনও রয়ে গেছে—যেন মুছে ফেলার চেষ্টা করেও মুছে যায়নি সত্য।
টাইলস, দরজা ও নিখোঁজ সত্য
ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনা অনুযায়ী, তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি টাইলস করা সিঁড়ি বেয়ে একটি রুমে নেওয়া হতো। গুম কমিশন প্রথমে যায় এবং দেখে—টাইলস নেই, বাম পাশে কোনো রুমও নেই। কিন্তু আরও খোঁজে দেখা যায়, টাইলসের দাগ রয়ে গেছে, এবং দেয়ালের বাম দিকে আসলেই একটি বন্ধ দরজার চিহ্ন। দেয়াল ভেঙে বের করা হয় সেই লুকানো দরজা, আর সেখানে পাওয়া যায় ভাঙা টাইলসের অংশ — যা আরমানের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। সেই টাইলসের ভাঙা টুকরো যেন দেশের ভাঙা ন্যায়বোধের প্রতীক—যা আজ আবার জোড়া লাগছে।
প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টায় প্রমাণ আরও স্পষ্ট
হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই এসব স্থানে দ্রুত রঙ ও পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। লক্ষ্য ছিল—প্রমাণ মুছে ফেলা। কিন্তু যতই ঢেকে দেওয়া হয়েছে, সত্য ততই ফুটে উঠেছে। গুম কমিশনের সদস্যরা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে “আয়নাঘর” পরিদর্শন করেন। যারা একসময় এসব কেন্দ্রকে “গুজব” বলেছিল, আজ তারা নিশ্চুপ, কারণ দেয়ালের ভেতরেই লুকানো ছিল মানবতার অপরাধের সাক্ষ্য।
এক নজিরবিহীন বিচার
আজ যখন ২৫ সেনা সদস্য আদালতে হাজির হয়েছেন, এটি কেবল একটি আইনি ঘটনা নয়—এটি ইতিহাসের পাতা বদলে দেওয়ার সূচনা। বাংলাদেশে প্রথমবার এজেন্সি অফিসারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। একসময় যাদের হাতেই ছিল ভয় ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, আজ তারা জবাবদিহির মুখোমুখি। এটাই গণতন্ত্রের প্রথম নিঃশ্বাস, দীর্ঘ অন্ধকারের পর।
এক বৈশ্বিক আহ্বান
আজকের বাংলাদেশ আর একা নয়। আমরা পৃথিবীর নাগরিক—Global Citizen—যারা একই ন্যায়ের মানদণ্ডে বিশ্বাস করি। ন্যায়বিচার কোনো ভূখণ্ডের সম্পত্তি নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির আত্মার দাবি। আমরা বিশ্বাস করি, অপরাধী কে, কোন দলে, কোন পদে — তা বিবেচ্য নয়; ন্যায়বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ, অটল ও মানবিক। এই বিচার শুধু ভুক্তভোগীর জন্য নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যাতে তারা কখনো আবার দেয়াল-ঢাকা রক্ত বা মিথ্যা রঙের ভেতর নিজেদের হারিয়ে না ফেলে।
আমাদের দায়িত্ব
আজ যখন প্রমাণ মিলছে, বিচার শুরু হচ্ছে — তখন সমাজের প্রতিটি স্তরে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সচেতন থাকা, সাহসী থাকা, সত্যের পাশে থাকা। আমরা যেন ভুলে না যাই—রাষ্ট্র মানে কেবল সরকার নয়; রাষ্ট্র মানে আমরা সবাই। সুতরাং, আমরা প্রত্যেকে যদি ন্যায়ের অংশীদার হই, তবে অন্যায় আর টিকবে না। আমরা যদি চুপ থাকি, মিথ্যা টিকে থাকবে। আমরা যদি কথা বলি, সত্য বাঁচবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশ এখন এক নতুন প্রভাতের মুখে দাঁড়িয়ে। গুম, নির্যাতন, ভয়, অন্ধকার—সবকিছুর ওপরে উঠতে হলে আমাদের প্রয়োজন মানবতার সাহস। এই বিচার প্রক্রিয়া যেন কেবল প্রতিশোধের নয়, বরং ন্যায় ও সংস্কারের প্রতীক হয়। আমরা শুধু বাংলাদেশের নাগরিক নই, আমরা পৃথিবীর নাগরিক—Global Citizen—যাদের দায়িত্ব সত্যকে রক্ষা করা, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো, এবং প্রমাণ করা যে—অপরাধ থেকে কেউ মুক্ত নয়, ন্যায়বিচার কারও করুণায় নয়, এটি মানবতার অধিকার।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com