বাংলাদেশ আজ এক বিভ্রমে দাঁড়িয়ে—আমরা কি সত্যিই নির্বাচন চাই, নাকি দুর্নীতিবাজদের আরেকটি সুযোগ দিতে চাই নিজেদের ভাগ্য ছিনিয়ে নেওয়ার? জনগণ আজ ক্লান্ত, বিভ্রান্ত ও হতাশ। জনগণ ভোট চায় না—তারা চায় ন্যায়, সততা ও জীবনের নিরাপত্তা। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা চায় নির্বাচন, কারণ সেটিই তাদের দুর্নীতির বৈধতার শেষ আশ্রয়।
দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ক্ষমতার লোভে, নানা উপায়ে দুর্নীতির শিকলে জড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, দখল, ডাকাতি ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে জড়িত ছিল। এএসপি ও প্রশাসনের অংশবিশেষ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে—তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনভাবে লিপ্ত, যেন দুর্নীতি এক নতুন পেশা। জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক হিংসা ও দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে—একটি ধর্মভিত্তিক দলের নাম ব্যবহার করে তারা জনগণের বিশ্বাসকে অপমান করেছে। আর রাষ্ট্রক্ষমতার কিছু অংশ এই দুর্নীতিকে দমন না করে বরং উস্কে দিয়েছে, শুধু জনগণকে বোঝাতে যে বিএনপি বা অন্য কেউ আরও ভয়ঙ্কর। এই প্রতারণা, এই রাজনীতির নাটক আমাদের জাতিকে নিঃস্ব করে ফেলেছে।
আজ আমরা রাষ্ট্র হিসেবে পথভ্রষ্ট। আমাদের শাস্তি দরকার—কিন্তু শাস্তি কাকে দেবো? রাজনীতিবিদদের? প্রশাসনকে? নাকি নিজেদের, যারা সব জেনেও চুপ থেকেছি?
আমি একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। আমি সেই দেড় কোটি মানুষের একজন, যারা দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে। আমরা বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরাই, আর আমাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি টিকে থাকে। আমাদের টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে—আর আমরা ঘামে ভেজা পোশাকে দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা করি। আমরা চাই না আমাদের পরিশ্রমের টাকা রাজনৈতিক চোরেরা গিলে ফেলুক। আমাদের কথা শুনতে হবে, কারণ আমরা দেশের হাল ধরে রেখেছি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, প্রশাসন, এবং তথাকথিত নেতৃত্ব—সবাই এখন এমনভাবে নিস্তেজ হয়ে গেছে যেন দেশটা কারো নিজের নয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে, শুধু সরকার নয়—রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ঝুঁকিতে পড়বে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস—যাঁকে একসময় অনেকেই আশার প্রতীক ভাবতেন—তিনিও আমাদের হতাশ করেছেন। যদি তিনি সত্যিই এসব অনিয়ম, এই দুর্নীতির গভীরতা না জানেন, তবে তিনি অন্ধ; আর যদি জানেন, কিন্তু নীরব থাকেন, তবে তিনি এই যুগের সবচেয়ে বড় নৈতিক প্রতারক। তবুও, আমি এখনো বিশ্বাস করি—যদি তিনি সত্যিকারের নৈতিক সাহস দেখাতে পারেন, তবে তাঁর নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে পারে, যেখানে সব দলের প্রতিনিধি থাকবে, কিন্তু কোনো দলীয় দখল থাকবে না।
এই সরকার থাকবে ১ থেকে ২ বছর—এই সময় হবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সময়। এই সময় হবে দুর্নীতির বিচার, প্রশাসনের সংস্কার, এবং জনগণের চেতনা পুনর্জাগরণের সময়। এই সময় হবে বাংলাদেশের পুনর্জন্মের সময়।
এরপরই সম্ভব হবে একটি সৎ, ন্যায়ভিত্তিক নির্বাচন। জনগণ তখন ভোট দেবে, কিন্তু ভয় নয়—বিবেক দিয়ে।
যারা দুর্নীতিতে বিশ্বাস করে, তারা ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। আমার মত কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধা ভয় পায় না। আমরা জানি—ভয় যদি জিতে যায়, তাহলে দেশ হারাবে সম্মান, হারাবে আত্মা। আমরা দেশপ্রেমিক, আমরা সৃজনশীল, আমরা সচেতন। আমরা চাই বাংলাদেশ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াক বিশ্ব মানচিত্রে—একটি সৃজনশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে।
এই জাতি যদি এখনো জেগে না ওঠে, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আজ সময় এসেছে, দুর্নীতিবাজদের পতন ঘটানোর—আর জনগণের, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের, পরিশ্রমী মানুষের কণ্ঠকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করার।
এটাই সময়। এটাই সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। ভয় পেও না—নইলে দেশ হারাবে, আর আমরা হারাবো আমাদের মর্যাদা।
রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com