মত দ্বিমত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দায়, দুর্নীতি ও আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক অদ্ভুত রীতি গড়ে উঠেছে— দেশের যেকোনো ব্যর্থতা, দুর্নীতি বা অন্যায়ের দায় যেন সবসময় এক দলের ঘাড়েই পড়ে। যেন এ দেশের অন্য কারও কোনো পাপ নেই, কোনো অপরাধ নেই, কোনো দায় নেই। দেশে একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে— “সব মাছে গু খায়, ঘাউরা মাছের দোষ হয়।” এই প্রবাদটাই যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার খোলামেলা প্রতিচ্ছবি।
গত পাঁচ দশকের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ক্ষমতার মসনদে বসা প্রতিটি নেতা— শেখ মুজিব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা— সবাই কখনও না কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অন্যায় আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন। তবু আজ যখন ইতিহাসের বোঝা তোলা হয়, তখন সেই সব দোষের ভার যেন একচেটিয়াভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— সব অপরাধ কি এক দলের?
দেশে যে রাজনৈতিক দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, প্রশাসনিক অনাচার আর জনগণের প্রতি অবিচার চলেছে, তার মূল শেকড় তো বহু গভীরে — সব দলের শাসনকালেই এর জন্ম, বিকাশ, আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। তাহলে কেন আজও এই জাতি সেই একই “ঘাউরা মাছের দোষ” সংস্কৃতির শিকার? বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক রসাতলে নেমে গেছে, যেখানে ক্ষমতার লোভ, দুর্নীতির প্রলোভন, এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অদৃশ্য কিন্তু প্রাণঘাতী চক্র। আর সেই চক্রের ভেতরে থেকে সব দলই যেমন অপরাধে জড়িত, তেমনি নিজেদের দায় এড়াতে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত।
আসুন, একটু জানি দেশের প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রীদের কুকর্ম ও তার ফলাফল সম্পর্কে
শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২–১৯৭৫)
কুকর্ম: একদলীয় শাসনব্যবস্থা (BAKSAL) প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, জাতীয় রক্ষী বাহিনীর (Jatiya Rakkhi Bahini) মাধ্যমে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। তিনি এক নায়কতন্ত্র শাসন কায়েম করেন — শতভাগ ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারতন্ত্রের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
ফলাফল: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল অফিসারের হাতে নিহত হন।
জিয়াউর রহমান (১৯৭৭–১৯৮১)
কুকর্ম: সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, সরকারি তহবিলের অপব্যবহার, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার অপব্যবহার। দলীয় স্বার্থে সামরিক প্রশাসনকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেন।
ফলাফল: ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (১৯৮২–১৯৯০)
কুকর্ম: সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, সংবিধান স্থগিত, নির্বাচনী প্রহসন, বিরোধী আন্দোলন দমন, ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অবক্ষয়। জনগণের কণ্ঠরোধ করে নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেন।
ফলাফল: তীব্র গণআন্দোলনের চাপে ক্ষমতা হারান; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সমালোচনার মুখোমুখি থাকেন।
খালেদা জিয়া (১৯৯১–১৯৯৬, ২০০১–২০০৬)
কুকর্ম: দুর্নীতি মামলা (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, গ্যাটকো), রাজনৈতিক সহিংসতা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নেপথ্য অভিযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও দলীয় সন্ত্রাস।
ফলাফল: দেশে ব্যাপক অস্থিরতা বৃদ্ধি; সেনা হস্তক্ষেপের পর ক্ষমতা হারান ও দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে অচল অবস্থায় থাকেন।
উৎস: আমার নিজের দেখা।
শেখ হাসিনা (২০০৯ – ২০২৪)
কুকর্ম: ছাত্র আন্দোলন দমন (১৪০০+ নিহত), গুম, নির্যাতন ও রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক মামলা, দুর্নীতি (পদ্মা সেতু, মেঘনা–গোমতি সেতু, পূর্বাচল প্লট বরাদ্দসহ), সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগের উপর দমননীতি। তিনি একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠেন— যেখানে দেশ, দল ও পরিবার একাকার হয়ে গেছে।
ফলাফল: আইনি অভিযোগ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও ক্ষমতা ত্যাগ করেননি; শেষপর্যন্ত ‘সেফ একজিট’ চুক্তিতে ভারতে আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই নেতাদের কুকর্মের প্রতিফলন আজও সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে রক্তক্ষরণের মতো দৃশ্যমান। কেউ ক্ষমতার নেশায় মানুষ হত্যা করেছে, কেউ জাতির সম্পদ লুটেছে, কেউ স্বাধীনতার নামে স্বাধীনতাকে বন্দি করেছে। অনেকে তাদের অপরাধের ফল ভোগ করেছে—কেউ গুলিতে নিহত, কেউ জনগণের রোষে অপদস্থ, কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হলো—একজনও স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেননি। যেন ক্ষমতা তাদের কাছে এক ঈশ্বরত্ব, যার জন্য জীবন, নীতি, এমনকি দেশকেও উৎসর্গ করা যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোর আচরণে তাই এক ধরনের বেহায়া নির্লজ্জতা ও নৈতিক দেউলিয়াত্ব স্পষ্ট। জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ নেই, লজ্জা নেই, আত্মসমালোচনার ক্ষমতাও নেই। রাজনীতি এখন আর সেবা নয়, এক নির্মম প্রতিযোগিতা— কে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, কে বেশি নিষ্ঠুর, কে ক্ষমতার চাবিকাঠি বেশি শক্ত করে ধরে রাখতে পারে। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি, এবং প্রশাসনিক অপব্যবহারের এক অন্ধকার যুগ সৃষ্টি করেছে, যেখানে রাষ্ট্রের শান্তি, ন্যায় ও স্থিতিশীলতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।
উপরে তো কেবল সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে টপ লেভেলের কিছু নেতার নাম, কিন্তু ভাবুন—যে অসংখ্য নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধ, দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে, তারা দিব্যি বিদেশে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। কেউ লন্ডনে, কেউ দুবাইয়ে, কেউ কানাডায়—সবাই নিরাপদ, অথচ দেশের আইন তাদের নাগাল পায় না।
প্রশ্ন জাগে—বিশ্বজুড়ে যখন আইনের এক জাল আছে, ইন্টারপোল নামের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে, তখন গত ৫৪ বছরে তারা কি একজনকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে? না, একটিও না। কেন? কারণ, বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা এতটাই দুর্বল, দলনির্ভর ও দুর্নীতিগ্রস্ত যে বিশ্বের কোনো দেশই আজ বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চায় না।
যখনই কোনো সরকার ক্ষমতা হারায়, তখনই হাজারো মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রশাসনিক নিপীড়নের শিকার হয় পরাজিত পক্ষ। ফলে সত্য-মিথ্যা, অপরাধ-অভিযোগ— সবই মিশে গেছে এক অনিশ্চিত ধোঁয়াশায়। এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে—আমরা জাতি হিসেবে কতটা দুরবস্থার শিকার, আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।
আমরা এখন এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার বন্দি, যেখানে অপরাধীরা পালিয়ে যায়, কিন্তু ন্যায়বিচার পালানোর পথ খুঁজে পায় না। এখন যেমন সব দোষ শুধু আওয়ামী লীগের ওপর চাপানো হচ্ছে, তার কারণ যেমন;
১. দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীন থাকা: দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে জনগণের প্রত্যাশা বাড়ে, হতাশাও বাড়ে। তাই সরকারের প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রতিটি ক্ষোভ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের দিকেই ধাবিত হয়।
২. মিডিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা:বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলোর একাংশ রাজনৈতিক হিসাবেই সব দোষ একপাক্ষিকভাবে প্রচার করে। তথ্যের চেয়ে আবেগ, যুক্তির চেয়ে প্রতিশোধ প্রবল।
৩. জনমতের মনস্তত্ত্ব: জনগণ প্রায়ই ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করতে চায় না; বরং বৃহত্তম ও দৃশ্যমান শক্তিকে দোষারোপ করাই সহজ। আওয়ামী লীগ সেই দৃশ্যমান শক্তি—তাই দোষারোপের ভার তার ঘাড়েই পড়ে।
৪. প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন: বাংলাদেশ আজ সেই প্রবাদটির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি— “সব মাছে গু খায়, ঘাউরা মাছের দোষ হয়।” সবাই অপরাধ করেছে, সবাই কুকর্মে জড়িত, কিন্তু দৃশ্যমান ও ক্ষমতাধর ঘাউরা মাছের ঘাড়েই এখন দোষের সমস্ত ভার চাপানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি কোনো একক ব্যক্তি বা দলের সমস্যা নয়—এটি পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির মজ্জাগত রোগে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা, সুবিধা, আর ব্যক্তিগত স্বার্থের অন্ধ নেশায় আজ রাজনীতি নীতিহীন, প্রশাসন জবাবদিহিহীন, আর জনগণ নিরুপায়।
•রাজনৈতিক স্বার্থ: ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোধী দল—সকলেই নিজেদের সুবিধার জন্য দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছে। একে অপরকে দোষারোপ করলেও বাস্তবে তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
•আইনি দুর্বলতা: বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট, তদন্ত সংস্থা ভীত, আর আইনের প্রয়োগ বেছে বেছে করা হয়। ফলে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা রাষ্ট্রদুর্বৃত্তি—সবই পার পেয়ে যায় ক্ষমতার ছায়াতলে।
•ভয় ও রাজনৈতিক চাপ: ক্ষমতাধর নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটি “রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র” বলে আখ্যা দেওয়া হয়, আর সেই অজুহাতে আইনি নীরবতা জারি থাকে। ফল—ন্যায়বিচারের বদলে ভয়ই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের নীতি।
•ফলাফল: শেখ হাসিনার শাসনকাল এই সংস্কৃতির চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও তোষণনীতি তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু সেই সুরক্ষাই দেশকে আজ দুর্নীতির এক অশেষ চক্রে বন্দি করে ফেলেছে। তবে শ্রীলঙ্কা প্রমাণ করেছে—জনগণ যদি জাগে, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক টিকতে পারে না। সেখানে মানুষ রাস্তায় নেমে একসময় সর্বশক্তিমান রাজাপাক্ষেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাদের এই গণঅভ্যুত্থান ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক জাগ্রত জাতির গর্জন।
বাংলাদেশও ইতিহাসে এমন গণজোয়ার দেখেছে—স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে, কিন্তু দুর্নীতির শিকড় রয়ে গেছে অটুট। কারণ, আমরা শাসক বদলেছি, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে পারিনি। যতদিন পর্যন্ত জনগণ সত্যিকার অর্থে নৈতিকভাবে সজাগ, ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় হবে না—ততদিন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সহিংসতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বন্দি রাখবে।
এখন কী করা উচিত?
১. দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কার: রাজনীতি হতে হবে সেবা, ক্ষমতা নয়। দলের আগে দেশ, আর দেশের আগে ন্যায়বোধ।
২. সততা ও স্বচ্ছতা: প্রশাসন ও দলীয় কাঠামোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে, কোনো সংস্কারই টেকসই নয়।
৩. আইন ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা: বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে—ন্যায়বিচার যেন কোনো দলের নয়, জনগণের অধিকার হয়।
৪. নাগরিক সচেতনতা: জনগণকে বুঝতে হবে, নীরবতা মানেই অপরাধের পক্ষে থাকা। প্রতিটি নাগরিককে দুর্নীতি ও অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান নিতে হবে।
৫. জনগণের অংশগ্রহণ: শুধু নির্বাচনে নয়—রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পর্যায়ে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে গণচাপই হতে হবে দুর্নীতিবিরোধী অস্ত্র।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আজ এক নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে— ক্ষমতা কখনও কাউকে ন্যায়বান করেনি, বরং দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। এই দেশে অনেক নেতা নিহত হয়েছেন, কেউ স্বৈরাচারের পতনে অপমানিত, কেউ বিদেশে নির্বাসিত, কেউ আজও গোপনে অপরাধের দায় বহন করছে। কিন্তু একটিও ব্যতিক্রম নেই—কেউ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেননি।
ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন, কিন্তু বাংলাদেশে নেতারা ব্যর্থতাকেও সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এ যেন এক বেহায়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে লজ্জা নেই, নীতি নেই, কেবল ক্ষমতার প্রতি অন্ধ আসক্তি। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা— সবাই ক্ষমতার মোহে একই অপরাধ করেছেন, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন নাম নিয়ে। এ যেন এক দীর্ঘ শৃঙ্খল—একটি জাতির নৈতিক পতনের জীবন্ত ইতিহাস।
পাঁচ দশকের বাংলাদেশের রাজনীতি আমাদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে— আমাদের নেতাদের রাজনীতি এখন নীতিহীনতা, ক্ষমতার লালসা ও জনগণের আস্থা হারানোর প্রতীক। ভোট চুরি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হত্যা, গণহত্যা—এসব কেবল অতীতের কাহিনি নয়; আজও এগুলো দেশের শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতা। যারা একসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল, তাদের কুকর্মের ফলেই জন্ম নিয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাজে বিভাজন, আর ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই অন্ধকারের মাঝেও এখনো একটি আশার আলো জ্বলছে।
বাংলাদেশ এখনো পথ হারায়নি—যদি আমরা চাই, আমরা পারি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। যা এখন করা জরুরি
১. গণতান্ত্রিক সংস্কার বাস্তবায়ন: দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে প্রতিটি নেতা ও দলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়—প্রত্যেক শাসককে তার কর্মের দায় নিতে হবে।
২. আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা: বিচার যেন আর কোনো দলের বা ক্ষমতার নয়, কেবল সত্য ও জনগণের হয়। দোষী নেতা, যে দলেরই হোক, আইনের সামনে সমানভাবে দাঁড়াবে—এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।
৩. সচেতন ও সক্রিয় জনগণ: জনগণই রাষ্ট্রের মালিক—এই চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, যখন জনগণ জাগে, দুর্নীতি পালায়। বাংলাদেশেও সেই শক্তি আছে, শুধু ঐক্য আর সাহসের প্রয়োজন।
৪. দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি: রাজনীতিকে পুনরায় নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধে ফিরিয়ে আনতে হবে। সাংবাদিক, প্রশাসক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী—প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে সৎ থাকতে হবে। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই কেবল সরকারের নয়, সমগ্র জাতির।
বাংলাদেশের পাঁচ দশকের ইতিহাস আমাদের শেখায়— ক্ষমতার মোহ শেষ পর্যন্ত কাউকে রক্ষা করেনি। শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত সকল শাসকের কুকর্মের ফলাফল এক— মৃত্যু, নির্বাসন, অস্থিরতা ও জনগণের বিশ্বাস হারানো। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি কিছুই শিখিনি? দেশকে শান্তির পথে ফেরাতে এখনই প্রয়োজন সততা, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং জনগণের একাগ্রতা। আমাদের ভোট, আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের সাহস— এই তিনই পারে বাংলাদেশকে দুর্নীতি, লোভ আর স্বৈরাচারের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করতে। কোনো অপরাধই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে একটি দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেখিয়েছে, জনগণ চাইলে ক্ষমতার অপব্যবহার থামানো যায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে— আজকের বাংলাদেশে কত শতাংশ মানুষ সত্যিই দুর্নীতিমুক্ত? আমরা কি নিজেরাই দুর্নীতির অংশ হয়ে যাচ্ছি না অজান্তেই? যে জাতি নিজের নৈতিকতার কাছে সৎ, সেই জাতির পথ কেউ রোধ করতে পারে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে—সৎ, সাহসী এবং ঐক্যবদ্ধ নাগরিকদের হাতে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া তৈরি হয়নি আমরা তৈরি করেছি
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুলোর একটি হলো রাষ্ট্র এবং নেতৃত্ব কখনো শূন্যস্থান সহ্য করে না। যে সমাজ যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয় সেই সমাজকে একসময় পরিবারতন্ত্র, কৃত্রিম জনপ্রিয়তা এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি গ্রাস করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পর যে রাজনৈতিক আদর্শ, ত্যাগ এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে দেশটি দাঁড়িয়েছিল তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার লোভ, দলীয় স্বার্থ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের কারণে ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে। ফলে নেতৃত্বের অভাব পূরণ করতে গিয়েই আমরা এমন দুই নারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি যারা জন্মসূত্রে নেতৃত্বের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। আর এখান থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র, প্রতিহিংসা এবং দলীয় কাঠামোর ভাঙনের দীর্ঘ পর্ব যা আজ পুরো জাতিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে দুই মহীয়সী নারী নেত্রী রাজনীতিতে এসেছিলেন। একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আর অন্যজন ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। তারা জন্মসূত্রে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যুক্ত হলেও নিজেরা ছিলেন মূলত রাজনৈতিক বা সামরিক ব্যক্তিত্বের পরিবারের প্রতিনিধি এবং তাদের দুজনকেই দলীয় স্বার্থে সামনে ঠেলে এনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাকে ধরে রেখেছিল। একই উপমহাদেশে ইন্দিরা গান্ধি বা বেনজির ভুট্টো বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু তারা রাজনীতির বাস্তবতায় সক্রিয়ভাবে শামিল হয়েই নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন। পার্থক্য ছিল এখানেই। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সেই সরাসরি রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল না কারণ তৎকালীন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বঙ্গবন্ধু এবং জিয়ার জনপ্রিয়তার উত্তরাধিকার ধরে রাখতে পরিবারতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর সেই লালসাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা পরায়ণতার বীজ বপন করে এবং পরবর্তী সময়ে পুরো দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার জন্য যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সত্য হলো শেখ মুজিব এবং জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে দীর্ঘ সময় ছিল না। হয়তো যুদ্ধোত্তর সংকট বা সামরিক বাস্তবতা তাদেরকে সঠিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুযোগ দেয়নি অথবা এক নায়কতন্ত্র তাদেরকে গ্রাস করেছিল যেখানে তাদের চারপাশে এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল যে তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন এবং নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। অথচ তখনই দেশে শত শত যোগ্য আইনজীবী রাজনৈতিক বিজ্ঞানী অর্থনীতিবিদ এবং তরুণ নেতৃত্ব ছিল। তবুও দলীয় সংগঠন যে ভুল রাজনীতির চর্চা বেছে নিয়েছিল তা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় এবং সেই আগুনে দগ্ধ হয়েছে পুরো জাতি এবং দগ্ধ হয়েছেন এই দুই নেত্রীও।
তবু শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মধ্যে যেমন মিল রয়েছে তেমনি রয়েছে বিস্তর অমিল। যদি তখন দলীয় নেতারা বাবার বা স্বামীর প্রভাবকে ব্যবহার করে শুধু ক্ষমতা দখলের পরিবর্তে রাজনীতির ধারাকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতেন তাহলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পরিবারতন্ত্রের আবরণে আবদ্ধ হতে পারত না। যদি দলীয় নেতৃত্ব সাহস করে একজন দক্ষ সৎ এবং শিক্ষিত নেতৃত্বকে সামনে আনত তাহলে তাদের দল আরও শক্তিশালী হত সংগঠিত হত এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই ভিত্তি পেত। নেতৃত্ব ঘর থেকে নয় বরং জনগণের ভিতর থেকে উঠে আসা উচিত ছিল এবং নির্বাসন বা দূরত্ব থেকে নয় সরাসরি রাজনৈতিক মাঠ থেকে উঠে আসাই হতো শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক স্পিরিট এবং ডিসকোর্সের প্রকৃত ধারাবাহিকতা। কিন্তু সেই ভুলের মাশুল আমরা আজও দিচ্ছি।
আজ আমরা অনেকেই শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাকে স্বৈরাচার বানিয়েছে কে? একইভাবে যদি হাওয়া ভবন আরও কয়েক বছর রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেত তবে কি খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী হতেন না? ইতিহাস বলে ক্ষমতার কাঠামো ব্যক্তিকে পাল্টে দেয়। তাই দুই দলই দায়ী দুই দলই এই অনুশোচনার বোঝা বহন করে।
তবু এখনও দেরি হয়নি। প্রয়োজন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির আলাদা করে অনুশোচনা করা জনগণের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া এবং ভুলের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকারোক্তি করা। আজও এই দুই দল নতুন করে দাঁড়াতে পারে যদি তারা আত্মসমালোচনার পথ বেছে নেয় যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করে জনগণের সঙ্গে নতুন আস্থার বন্ধন গড়ে তোলে এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের ভিত্তি হিসেবে সাহস যোগ্যতা নৈতিকতা এবং সততাকে সামনে আনে। তাহলেই শেখ হাসিনা স্বৈরাচারের খেতাব থেকে একদিন মুক্তি পেতে পারেন। তাহলেই বেগম জিয়ার ত্যাগের মর্যাদা রক্ষা পাবে এবং জিয়াউর রহমানের আদর্শের একজন প্রকৃত ধারক বাহক তৈরি হবে।
আমি মনে করি তাদের ব্যক্তিগত দুঃখ কেবল তাদের একার নয়। এটা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যদি এই ইতিহাস নতুন নেতৃত্বকে অনুপ্রাণিত করে তাহলে তাদের জীবনসংগ্রামই ভবিষ্যতের নতুন আলোর পথ তৈরি করবে বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া। কারণ তিনি এখনও আমাদের মাঝে আছেন এবং তাঁর উপস্থিতি স্বয়ং এক দৃঢ়তার উৎস। আজকের তরুণেরা দেখছে এই দেশে একজন নারী আছেন যিনি প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনীতিকে নীরব শক্তি দিয়ে পরাজিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর জীবন নক্ষত্রের মতো দীপ্ত এবং যতদিন তিনি থাকবেন ততদিন সেই দীপ্তি প্রজন্মকে পথ দেখাবে। একদিন তাঁর প্রস্থান আসবে সেটি হবে একটি যুগের অবসান কিন্তু আজ তিনি জীবনের সঙ্গে লড়াই করা এক অদম্য শক্তির প্রতীক।
একই সাথে আমি এটাও বিশ্বাস করি শেখ হাসিনা যে ভুল করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে আমরা কী ফিরে পাবো? কিছুই না। রাষ্ট্রীয় ক্ষতি পূরণ হবে না। বরং যদি শেখ পরিবারের মধ্যে ন্যূনতম মানবিকতা অবশিষ্ট থাকে তাহলে তাদের উচিত জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। কারণ ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের।
বাংলাদেশ একটি নদীবেষ্টিত দেশ যেখানে প্রতিদিন নদী বদলায়, ভাঙে, গড়ে। এই ভাঙন এবং নতুন সৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে যে দেশে টিকে থাকা যায় সেখানে নেতৃত্বও হতে হয় পরিবর্তনের সক্ষম ধারক। কিন্তু পরিবারতন্ত্র সেই পরিবর্তনকে আটকে দিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল দেখলে দেখা যায় যে এই অঞ্চলে নেতৃত্ব যত বেশি গণমুখী হয়েছে দেশ তত বেশি স্থিতিশীল হয়েছে। বাংলাদেশও সেই বাস্তবতা থেকে আলাদা নয়। আজকের বিশ্বব্যবস্থা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল, নতুন আঞ্চলিক জোট, বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক করিডোর এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য রুট বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে নতুন মাত্রায় এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করছে। এমন এক সময়ে পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি, দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং প্রতিহিংসার চর্চা কেবল দেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয় না বরং আমাদের ভূরাজনৈতিক সুবিধাগুলোকেও বিপন্ন করে। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মানুষ। নেতৃত্ব যদি এই জনশক্তিকে সৎভাবে কাজে লাগাতে পারে এবং রাজনীতিকে নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে পারে তবে এই দেশ দক্ষিণ এশিয়ার নতুন শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। তাই নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা, জনগণের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজন নয় বরং বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং বৈশ্বিক ভবিষ্যতের জন্য একটি অপরিহার্য জাতীয় দায়িত্ব।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
খালেদা জিয়ার প্রতি আমাদের আকুলতা এবং নীরব শক্তির প্রতিচ্ছবি
উপমহাদেশের সমৃদ্ধ কিন্তু উত্তাল ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম এক আলাদা অধ্যায়। ব্যক্তিগত বেদনা এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অদম্য পরিচয় যা তাকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে যায়। তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনন্য মর্যাদা অর্জন করেন।
একটি সাধারণ সংসারে বড় হয়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া, স্বামীর হত্যার পর আকস্মিকভাবে রাজনীতিতে উঠে আসা এবং দলকে নেতৃত্ব দেওয়া তাকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরে। তাঁর আদর্শ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি মনোযোগ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর দৃঢ়তা তাকে সমর্থক ও সমালোচকের আলোচনায় রাখে। ২০০৮ সালের মামলায় তোলা বিভ্রান্তিকর অভিযোগ এবং দীর্ঘ আইনি লড়াই তাঁর রাজনৈতিক যাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শীর্ষ আদালত তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিলে তাঁর প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
গত এক বছরে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। এই বছরের মে মাসে লন্ডনে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর হঠাৎ অবস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন যে অনুকূল নয় এমন শ্বাসনালী সংক্রমণ বা নিউমোনিয়ার কারণে তিনি কোরোনারি কেয়ার ইউনিটে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। দল মত নির্বিশেষে মানুষ তাঁর সুস্থতার জন্য দোয়া করছেন।
চিকিৎসায় দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছেন। কয়েকটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ উন্নত চিকিৎসা সহায়তার আগ্রহও প্রকাশ করেছে। এই মানবিক সহযোগিতা এবং সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা জনগণের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত করেছে। জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে এবং দোয়া অব্যাহত রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাসহ উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা চিকিৎসায় পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যথা এখন একটি জাতির বেদনায় রূপ নিয়েছে। একজন নারী হিসেবে রাজনৈতিক শিখরে ওঠা, পরিবার বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান শারীরিক দুর্বলতা মিলিয়ে তাঁর জীবন একটি গভীর মানবগল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর সংগ্রাম, উত্থান পতন এবং বর্তমান সংগ্রাম মানুষের মনে আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা জাগিয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনীতি বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে। সেখানে খালেদা জিয়ার নীরব ধৈর্য, সংযমী আচরণ এবং আধ্যাত্মিক শক্তি অনেকের চোখে অন্যরকম এক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আজ দেশজুড়ে যেভাবে সমবেদনা ছড়িয়ে পড়েছে তা কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রীর প্রতি নয়, বরং একজন মা, একজন বোন এবং একজন রাষ্ট্রনেত্রীর প্রতি মানুষের গভীর মানবিক সাড়া।
এই সময় আমরা যে প্রার্থনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছি তা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি এক মানবিক আবেদন জীবনের বহু ঝড় অতিক্রম করা এক নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। জিয়া পরিবারের প্রতি দোয়া অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাই এবং চিকিৎসা সেবায় যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানাই যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনো কখনো এমন একটি চরিত্র আসে যার উপস্থিতি সময়কে বদলে দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই চরিত্র ছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি ছিলেন এমন এক নারী যাঁর দৃঢ়তা অসংখ্য মানুষকে আত্মমর্যাদার শিক্ষা দিয়েছে এবং যাঁর সাহস রাষ্ট্রক্ষমতার অর্থকে নতুনভাবে বুঝিয়েছে। তাঁর পথচলা ছিল সাহসে ভরা দীর্ঘ যাত্রা যেখানে প্রতিটি অগ্রগতি প্রতিহিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে নীরব অথচ শক্তিশালী ঘোষণা ছিল।
তাঁর জীবন ছিল নিরন্তর সংগ্রামের গল্প। ব্যক্তিগত ক্ষতি, অপবাদ, রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা এবং ষড়যন্ত্রের বহু অধ্যায় তিনি বরণ করেছেন। স্বামী ও সন্তানকে হারানোর বেদনা এবং অন্য সন্তানদের থেকে দূরে থাকার কষ্ট তিনি মর্যাদার সঙ্গে বহন করেছেন। তবুও তিনি ঘৃণার উত্তরে ঘৃণা দেখাননি। তাঁর নীরবতা ছিল তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ।
দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার নৈতিক দৃঢ়তা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রত্যাখ্যান করার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। তাঁর দল আজও তাঁর সমতুল নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেনি কারণ দলটি দাঁড়িয়ে আছে তাঁর নীতি, বিচক্ষণতা এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতে।
একসময় তাঁকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে দেখার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তিনি যদি সেই পদে যেতে পারতেন তাহলে বাংলাদেশ রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং দৃঢ় নেতৃত্বের এক নতুন অধ্যায় দেখতে পেত। কিন্তু প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনৈতিক বাস্তবতা সেই সম্ভাবনাকে থামিয়ে দেয়।
আজ তিনি জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নিবিড় পরিচর্যায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সারা দেশ দোয়া করছে। প্রধান উপদেষ্টাও তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছেন এবং চিকিৎসায় পূর্ণ সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন।
দেশ বিদেশের চিকিৎসকরা নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করছেন এবং কয়েকটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র উন্নত চিকিৎসার আগ্রহ জানিয়েছে। জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর ভালোবাসা ও দোয়ার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে এবং সকলকে দোয়া চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এই সংকটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাবার আকাঙ্ক্ষা একজন সন্তানের কাছে খুবই স্বাভাবিক তবুও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংবেদনশীলতার কারণে হয়তো সব কিছু সম্ভব হচ্ছে না, তবে বিশ্বাস করি পরিস্থিতি শান্ত হলে বহু দিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে এবং স্বদেশে ফিরে মায়ের পাশে দাঁড়ানোর দিন একদিন অবশ্যই আসবে।
তিনি এখনও আমাদের মাঝে আছেন এবং তাঁর উপস্থিতি নিজেই এক দৃঢ়তার উৎস। বর্তমানের তরুণেরা দেখছে যে এই দেশে এক নারী আছেন যিনি প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনীতিকে নীরব সাহস দিয়ে পরাজিত করেছেন। তাঁর জীবন এখনো নক্ষত্রের মতো দীপ্ত এবং যতদিন তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন ততদিন সেই দীপ্তি প্রজন্মকে পথ দেখাবে। এক দিন তাঁর প্রস্থান যখনই আসবে তা হবে একটি যুগের সমাপ্তি, কিন্তু আজ তিনি জীবনের সঙ্গে লড়াই করা এক অবিনাশী শক্তির প্রতীক।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
চট্টগ্রাম বন্দর সংস্কার: কার স্বার্থে ‘নিরাপত্তা’র ভয়
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার। দেশের মোট আমদানি এবং রপ্তানার প্রায় নব্বই শতাংশ এখান দিয়ে সম্পন্ন হয়। তাই বন্দর কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। প্রতিদিন হাজার হাজার কন্টেইনার ওঠানামা করে, জাহাজের হর্ন বাজে, শ্রমিকরা ব্যস্ত থাকে, আর ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করে তাদের পণ্যের মুক্তির জন্য। এই জায়গাই বাংলাদেশের অর্থনীতির নীরব নাড়ি।
কিন্তু বছরের পর বছর দুর্নীতি, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের লুটপাটের কারণে এই নাড়ির গতি ক্রমশ কমে এসেছে। যন্ত্রপাতির অভাব, সমন্বয়ের ঘাটতি, কাগজপত্রের জট এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বন্দরের দক্ষতা বিশ্বের মানদণ্ডের তুলনায় অনেক নিচে নেমে গেছে। ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বলেন, “পণ্য আনতে যত খরচ হয়, তার থেকেও বেশি খরচ পড়ে বন্দরের অদক্ষতা সামলাতে।” প্রশ্ন আসে, একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বপ্ন কি বন্দরেই আটকে থাকবে?
এই সমস্যার মোকাবিলায় বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের পুরনো দুর্নীতিগ্রস্ত অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ভেঙে আধুনিক, দক্ষ ও স্বচ্ছ কাঠামো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ অপারেটরদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে উন্নত প্রযুক্তি, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা, গতি এবং বৈশ্বিক মান বজায় রাখা সম্ভব হয়।
কিন্তু এখানে বাধা সৃষ্টি করেছে দীর্ঘদিনের সুবিধাভোগী দুর্নীতিগ্রস্ত চক্র। তারা “জাতীয় নিরাপত্তা”র নামে ভয় দেখাচ্ছে, প্রকৃত বিষয়টি নিরাপত্তা নয় বরং তাদের নিজের স্বার্থের নিরাপত্তা। নতুন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনায় তাদের অবৈধ আয় এবং প্রভাবের সুযোগ শেষ হয়ে যাবে।
দূরদর্শিতা দেখানো দরকার। ব্যক্তিগত জীবনে বিদেশি প্রযুক্তির প্রতি তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে একদিনও দেরি করে না, বিদেশি ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করে, বিদেশি গাড়ি চালায়, আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করে, বিদেশি ওষুধ এবং পানীয় ব্যবহার করে। কিন্তু রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞ এলে হঠাৎ দেশপ্রেম জেগে ওঠে। এই দ্বিচারিতা ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়।
বাস্তবতা হলো, উন্নত বিশ্বে আউটসোর্সিংই দক্ষতার পথ। বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের বড় অংশই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। উদাহরণ হিসেবে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অংশ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিতরণ, সমুদ্রবন্দর, রেলওয়ের নিরাপত্তা এবং বড় শিল্প কারখানার প্রডাকশন লাইন উল্লেখযোগ্য। এগুলো প্রায় সবই পেশাদার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, যা লং রেঞ্জ প্ল্যানিং এবং দীর্ঘমেয়াদী দক্ষতা নিশ্চিত করে।
সৌদি আরবের ব্যস্ততম বিমানবন্দর বিদেশি কোম্পানি দিয়ে চলে, সিঙ্গাপুরের PSA বন্দর বিশ্বের সেরা বন্দরের একটি, দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দরও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। সেখানে দুর্নীতি নেই, অপদক্ষতা নেই, স্বচ্ছতা আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে এপিএম (বিশ্বসেরা ডেনিশ কোম্পানি) কাজ করতে চাইলে হঠাৎ দেশপ্রেম জেগে ওঠে। এটি দেশপ্রেম নয়, এটি চোরদের আয় বন্ধ হওয়ার কান্না।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো এতটাই দুর্বল যে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর আজ দুর্নীতি এবং অদক্ষতায় ভরা। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্বাস করা যায় না, প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা নেই, কোনো প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সংস্কৃতি নেই, জবাবদিহি দুর্বল এবং স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। এই অবস্থায় দক্ষতা আনার সবচেয়ে যৌক্তিক পথ হলো আউটসোর্সিং।
চট্টগ্রাম বন্দরের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ মানেই স্বাধীনতা হারানো নয়। বরং এটি দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি কমানো এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী পথ। ডিজিটাল সিস্টেম এলে প্রক্রিয়া দ্রুত হবে, দুর্নীতি কমবে, এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
যারা এতদিন খেয়ে এসেছে, তারা চিৎকার করবে “দেশ বিক্রি হয়ে গেলো।” এটা দেশপ্রেম নয়, এটি চোরদের আয় বন্ধ হওয়ার কান্না।
বর্তমান বাস্তবতা বলছে, যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দুর্নীতি মুক্ত করা যেত, হাসপাতালগুলোতে জবাবদিহি জন্মাত, ঢাকা বিমানবন্দরে যাত্রীদের ভোগান্তি কমত, রাজস্ব সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে আজ দেশের জন্য আউটসোর্সিংয়ের প্রয়োজন হতো না। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং অদক্ষতা রাষ্ট্রকে এমন এক অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে যেখানে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র দ্রুত সমাধানের বাইরে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কৌশলগত স্থাপনায় বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনা মানে উন্নয়নকে বাধাহীন করা, দক্ষতা ফিরিয়ে আনা, এবং রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। উন্নয়ন মানে শুধু ভবন নয়, গতি, স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং মানুষের স্বার্থ রক্ষা।
সারমর্ম
বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে দুর্নীতিকে পরাজিত করতেই হবে। রাজনৈতিক শক্তি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে আজ দেশে আউটসোর্সিংয়ের পথ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এটি আমাদের দুর্বলতার প্রমাণ নয়, বরং বাস্তবতার স্বীকারোক্তি। রাষ্ট্রকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে পুরো দেশকেই নতুন করে আউটসোর্সিং করে দক্ষতার পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা আর সময় নষ্ট করার অবস্থায় নেই।
চট্টগ্রাম বন্দর সংস্কার একটি সাধারণ অবকাঠামো প্রকল্প নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। ডিজিটাল সিস্টেম এলে দুর্নীতি কমে, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং কার্যকারিতা দ্রুত হয়। যারা এতদিন খেয়ে এসেছে তারা চিৎকার করে বলবে “দেশ বিক্রি হয়ে গেলো।” এটি দেশপ্রেম নয়, এটি চোরদের আয় বন্ধ হওয়ার কান্না। চট্টগ্রাম বন্দরের স্বচ্ছতা ও উন্নয়ন রুখে দাঁড়ানো মানে দেশের ভবিষ্যৎ রুখে দাঁড়ানো।
রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে চাইলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আউটসোর্সিং হলো দেশের একমাত্র যৌক্তিক পথ, যা দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষতা ফিরিয়ে আনবে, এবং বাংলাদেশকে আধুনিক, স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্র হিসেবে স্থাপন করবে।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
গণতন্ত্রের অপমৃত্যু এবং জনগণের নবজাগরণের অনিবার্য ডাক
বিশ্বে যে উদ্দেশ্যে গণতন্ত্রের জাগরণ হয়েছিলো কোনো এক সময় সেই উদ্দেশ্য আজও সফল হয়নি। দুই হাজার চব্বিশ সালে যে গভীর উদ্বেগ আমাকে আঘাত করেছিলো সেই একই উদ্বেগ আজ আরও তীব্র হয়েছে যদি বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতাকে দেখি। পৃথিবী আজ প্রযুক্তির অসীম অগ্রগতিতে বদলে গেছে, ডিজিটালায়ন মানুষের জীবনযাত্রাকে নতুন রূপ দিয়েছে, তথ্যপ্রবাহের গতি আশ্চর্য দ্রুততায় ছুটছে কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে কোনো অগ্রগতি নেই।
এখনও বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসন টিকে আছে, পরিবারতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র আরও জমাট বেঁধে আছে। শাসন এবং শোষণ যেন একই স্রোতে বইছে, ভাষণের স্বাধীনতা প্রতিদিনই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, মানুষের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
অথচ রয়েছে জাতি সংঘের মতো অচল এবং নিষ্ক্রিয় এক সংগঠন, যার অবস্থান আজ বিশ্বের সামনে এক অবিশ্বাস্য লজ্জা। কোথাও কোনো সাড়া নেই, কোনো দায় নেই, কোনো জবাব নেই। যেন গোটা মানবজাতির দুর্দশা আর অস্থিরতা তাদের বিবেক স্পর্শই করে না।
আজ দিনমজুর মানুষ তার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন পর্যন্ত দিচ্ছে। আর সেই একই সময়ে যাদের আমরা এলিট শ্রেণি বলি তারা বিলাসবহুল জীবনে অন্য দেশে সুরক্ষিতভাবে অবস্থান করছে কিংবা তাদের পরিবারকে বিশ্বের শান্তিপূর্ণ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওদিকে সাধারণ মানুষ পেটে ক্ষুধা হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে মাতৃভূমির জন্য। এই কি সেই গণতন্ত্র যার স্বপ্ন একদিন মানবজাতিকে আলোড়িত করেছিলো। এ লজ্জা এবং এ ঘৃণা কোথায় রাখি।
আজ যুদ্ধ চলছে গাজায় ইউক্রেনে আরও বহু দেশে। অথচ সদ্য আমি এসেছি সিশরে আর দেখছি যে বহু দেশের এলিট মানুষ এখানে নিশ্চিন্তে ছুটি কাটাচ্ছে। তাদের দেশের মানুষ যখন মরছে তখন তারা সমুদ্রের নীল জলে আনন্দে ভাসছে। আমরা খবর দেখছি সাহায্য পাঠাচ্ছি অর্থ দিচ্ছি। কিন্তু সেই অর্থ কতটা যায় সাধারণ মানুষের কাছে আর কতটা চলে যায় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের পরিবারে যারা দূরদেশে লাক্সারি জীবন কাটায়। বহুদিন ভাবতাম এমন জঘন্যতা শুধু বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখন দেখছি এ ভণ্ডামি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন। কোথায় সেই জাতি সংঘ। তারা কী কাজ করছে আর কীই বা করতে পারছে।
বাংলাদেশের স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে তবে সেই স্বৈরাচার পরিবারের কেউ দেশে নেই। তারা বিশ্বের নানা দেশে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নাগরিকত্ব কিনে নিয়েছে। অথচ দেশের মানুষের পেটে ভাত নেই দেখার কেউ নেই। যখন দেশে আইন স্বচ্ছ হলো বিচারিক ব্যবস্থা নিজেদের কাজ করতে শুরু করলো তখনই তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ করছে। বাহ কি আশ্চর্য অভিনয়। আর সব কিছুর ওপরে আছে জাতি সংঘের নিশ্চুপ অবস্থান।
যে দেশে দিনের নব্বই শতাংশ মানুষ দিনমজুর সেখানে কীভাবে এলিট শ্রেণির মানুষ নেতার আসনে বসে। তারা কি কোনোদিন বুঝতে চেয়েছে সাধারণ মানুষের জীবন কতটা কঠিন। না তারা তা বুঝবে কেন। তাদের বোঝার দরকার নেই কারণ বোঝার চেষ্টা করলে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা যাবে না। এবারের এনসিপির নোমিনেশন ফর্ম বিক্রির দৃশ্য দেখে হঠাৎ মনে হলো তারা অবশেষে এক সত্য উপলব্ধি করেছে। বাংলাদেশের পরিচয় শুধু দুর্নীতি স্বৈরাচার পরিবার তন্ত্রের রাজনীতি সীমাবদ্ধ নয় এদেশে সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী যারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দেশের উন্নয়নে। এ দেশ রিকশাওয়ালার দেশ অতএব রিকশাচালকের ভোট তার কণ্ঠস্বর তার প্রতিনিধিত্বই হওয়া উচিত দেশের সরকার গঠনের ভিত্তি। বাংলাদেশ পঞ্চান্ন বছর পার করেছে কিন্তু শাসিত হয়েছে এলিট শ্রেণির হাতে। এটা আর চলতে দেওয়া যায় না।
যে রিকশাওয়ালা দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে ছুটে এসেছিলো যে সাধারণ মানুষ দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় জীবন দিতে দ্বিধা করেনি সেই মানুষই প্রকৃত নায়ক। সুতরাং এবারের জাতীয় নির্বাচন তারই প্রাপ্য। কারণ সেই মানুষই স্বৈরাচার দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির দুষ্টচক্র থেকে সতেরো কোটি মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে পারবে।
আমি দেখতে চাই বাংলাদেশ হোক বিশ্বের প্রথম দেশ যেখানে জনগণ নতুন বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে। আর বিশ্ব সেখান থেকে শিখবে কীভাবে শত বছরের প্রতিজ্ঞা যার নাম গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা যায়। জাগো বাংলাদেশ জাগো।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
এমকে
মত দ্বিমত
বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার
একটি নতুন সময়ের চিত্র
বিশ্ব এখন এমন এক বিনিয়োগ সময়ের মুখোমুখি যেখানে পুরনো স্থিতিশীলতা আর নেই। গত কয়েক দশকের পরিচিত অর্থনৈতিক গতিশীলতা, বাজারের নিয়ম ও নিশ্চিত বিনিয়োগ প্রবাহ ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি, ভূরাজনীতি এবং প্রযুক্তির পরিবর্তনের জটিলতায় বিশ্বব্যাপী পুঁজির গতিপথ নতুন রূপ নিচ্ছে। এই পরিবর্তনের ঢেউ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।
বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবণতা
গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে ক্রমাগত ধীরগতি দেখা গেছে। United Nations Conference on Trade and Development জানিয়েছে যে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং ২০২৫ সাল এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এর অর্থ, উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।
এশিয়া অঞ্চলে পুঁজিবাজার কিছু অগ্রগতির ইঙ্গিত দিলেও বাজারের গভীরতা, দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতার অভাব এখনো প্রকট। উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও ঝুঁকি এবং মানবসম্পদ সংকটে ভুগছে। ফলে অতিরিক্ত বিনিয়োগের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাজার স্থিতিশীল নয়।
বেসরকারি মৌলধন বা প্রাইভেট ইকুইটি বাজার কিছুটা পুনরুদ্ধার করলেও আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। বড় লেনদেন ধীর এবং বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত সতর্ক। এর ফলে উদ্ভাবন এবং উদ্যোগে অর্থায়নের গতি কমে যাচ্ছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি চাপ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি মূল্যায়নে বাধ্য করছে। এসব প্রবণতা মিলিয়ে বিশ্ব এখন নতুন বিনিয়োগ যুগের মুখোমুখি, যেখানে পুরনো নিশ্চয়তা আর নেই এবং বাজারকে নতুন চোখে দেখা ছাড়া বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান চিত্র
“একটি দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার, কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত পুঁজিবাজার।” বাংলাদেশে পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে নির্ভরযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার অভাবে দুর্বল। নীচে মূল বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হলো। ব্যাংক একীভূতকরণ: নীতি, সংকট ও ঝুঁকি কিছু দুর্বল ব্যাংককে অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের জন্য তিনটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে।
১. তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ারের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। বিনিয়োগকারীরা জানে না তাদের অর্থের ফলাফল কী হবে।
২. বিনিয়োগকারীর মতামত উপেক্ষিত। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারের ভোট, স্বাধীন মূল্যায়ন এবং ন্যায্য বিনিময় অনুপাত নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে এগুলো কার্যকরভাবে হয় না।
৩. নৈতিক সংকট। যদি অডিট অনুযায়ী ব্যাংক স্থিতিশীল ছিল তাহলে হঠাৎ পতন কেন। আর যদি দুর্বল ছিল তাহলে অডিটে ধরা পড়েনি কেন। এটি বিনিয়োগকারীর আস্থা ভেঙে দেয় এবং বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে।
শেয়ারহোল্ডারের অধিকার
শেয়ারহোল্ডারের মৌলিক অধিকারগুলো কার্যকর না হলে বাজার টেকসই হয় না। এই অধিকারগুলো হলো:
১. ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা
২. স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ করা যেমন নন-পেরফর্মিং লোন, ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি এবং অডিট রিপোর্ট
৩. শেয়ারহোল্ডারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা
৪. ক্ষতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর ক্ষতিপূরণের অধিকার
বাংলাদেশে এই অধিকারগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত। ফলে বিনিয়োগকারীর আস্থা দুর্বল হয়ে গেছে এবং বাজার অনিরাপদ স্থানে আটকে আছে।
পুঁজিবাজার পতনের মূল কারণ
বাংলাদেশে বাজার পতন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংকটের ফল।
১. নীতির অস্থিরতা: হঠাৎ নতুন নীতি যেমন সার্কিট ব্রেকার, মার্কেট মেকার নীতি বা মার্জিন লোন নীতি বাজারকে অনিশ্চিত করে।
২. স্বচ্ছতার অভাব: ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা জনসমক্ষে আসে না।
৩. গোষ্ঠী স্বার্থে বাজার নিয়ন্ত্রণ: দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু কার্যকর সমাধান নেই।
৪. সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিশ্বাসহীনতা: মানুষ বিশ্বাস করে না যে তাদের টাকা নিরাপদ, নীতি ন্যায্য এবং রেগুলেটর নিরপেক্ষ।
নির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা: নতুন আলো কীভাবে দেওয়া সম্ভব
বাংলাদেশ চাইলে এই সংকট কাটিয়ে পুঁজিবাজারে নতুন আলো দিতে পারে। এর জন্য ধাপমূলক রোডম্যাপ প্রস্তাব করা হলো।
১. নীতি ধারাবাহিকতা এবং পূর্বঘোষণা
নতুন নীতি হঠাৎ পরিবর্তন না করে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে। সার্কিট ব্রেকার, মার্কেট মেকার এবং মার্জিন লোন নীতিকে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে স্থির করতে হবে।
২. বিনিয়োগকারীর অধিকার রক্ষা
মার্জার বা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারের ভোট বাধ্যতামূলক করতে হবে।
রেগুলেটর ব্যর্থ হলে ক্ষতিপূরণের স্বচ্ছ নীতি থাকা জরুরি।
৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠা
কর্পোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী করতে হবে।
ইন্সাইডার ট্রেডিং কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে হবে।
৪. নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা ও স্বাধীনতা
BSEC এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানের অডিট পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. বিনিয়োগকারীর তথ্যপ্রবাহ ও শিক্ষার উন্নয়ন
সহজ ভাষায় তথ্য প্রকাশ, বিনিয়োগ-ঝুঁকি সচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়া ও রেগুলেটরের যৌথ উদ্যোগে বাজার-সচেতনতা তৈরি।
৬. উদ্ভাবনী খাতে পুঁজিবাজারের সম্পৃক্ততা
প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদিতে পুঁজিবাজারের শক্তি ব্যবহার।
৭. ধাপভিত্তিক রূপান্তর রোডম্যাপ
প্রথম বছর: নীতি রিভিউ ও আইন সংস্কার।
দ্বিতীয় বছর: তদারকি শক্তিশালী করা ও শেয়ারহোল্ডারের অধিকার নিশ্চিত।
তৃতীয় বছর: উদ্ভাবনী বাজার ব্যবস্থা চালু করা এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা।
শেষ আহ্বান
বিশ্বের ধনী দেশ, ক্ষমতাধারী ব্যক্তি এবং কর্পোরেট নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা। বিশ্বের অর্থনীতির সংকটের মূল প্রভাবগুলো হচ্ছে বিশ্বরাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা, সামরিক সংঘাত, রোবটিক ও প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব, কুটনৈতিক কুচক্র এবং যুদ্ধ। এই বাস্তবতায় যদি কাগজে কলমে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাহলে এলন মাস্কের মতো একজনের ভোটের মতো আমারও একটি ভোট। এখন ভাবুন যদি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও নেতৃস্থানীয় মানুষকে হারানো সম্ভব হয়নি, তাহলে অর্থ দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা কতটা কার্যকর হবে।
এখন বিশ্বের কাছে প্রশ্ন: আমরা চাই অবিচার ও বিশৃঙ্খলা নাকি ন্যায্যতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা?
Rahman Mridha, গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, Pfizer, Sweden
rahman.mridha@gmail.com



