ক্যাটাগরি: জাতীয়

ধর্ম অবমাননায় সমান শাস্তিসহ ৪ দাবি হিন্দু যুব মহাজোটের

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সব ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায্যতার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু যুব মহাজোট। একই সঙ্গে দেশে বিদ্যমান সব ধর্মের অবমাননা রোধে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন ও সব ধর্মের অবমাননার বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করাসহ চার দাবি জানিয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এ সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু যুব মহাজোট আয়োজিত বাংলাদেশের বিদ্যমান সব ধর্মের অবমাননা রোধে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন ও সব ধর্মের অবমাননার বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।

লিখিত বক্তব্য পাঠ করে হিন্দু যুব মহাজোটের সভাপতি প্রদীপ কান্তি দে বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমাগতভাবে ধর্ম অবমাননার বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। আগে সাধারণত ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু ধর্ম অবমাননা ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা যেতো। বর্তমানে সংখ্যায় কম হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বা মহাপুরুষদের প্রতিও অবমাননাকর মন্তব্য করাটাও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায় বিদ্যমান সব ধর্মের অবমাননার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বর্তমানে সবাই অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি যে, ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত করলে সেটা হৃদয়ে কতোটা কষ্টকর অনুভূতি তৈরি করে। এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা দাবি করছি যে, বাংলাদেশের বিদ্যমান সব ধর্মের অবমাননা রোধে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন ও সব ধর্মের অবমাননার বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক।

প্রদীপ কান্তি দে আরও বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে আমরা বিগত দুই দশক ধরে রাজপথে সক্রিয়ভাবে অসংখ্য আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছি। আমরা সবসময় দাবি করেছি যেন প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে কোনো ঘটনারই দৃশ্যমান বিচার হয়নি। এখন সময় এসেছে ধর্মীয় অবমাননা প্রতিরোধে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন ও সেটার বাস্তবায়ন করা। এ আইনের সুফল যেন বাংলাদেশের প্রতিটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী পায় সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই যার যার ধর্ম তার কাছে সর্বোচ্চ আবেগের বিষয়। রাষ্ট্র তার নাগরিক হিসেবে সবার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে বাধ্য।

‘তাই ধর্ম অবমাননা প্রতিরোধে আইনে সুস্পষ্টভাবে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডায় হামলা; প্রতিমা ভাঙচুর; সব ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ অবমাননা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব ধর্মের ধর্মীয় মহাপুরুষ/পয়গম্বরদের অযৌক্তিক কটুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দোষীর শাস্তি নির্দিষ্ট করে পেনাল কোডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে যেন ফাঁসানো না হয়। বিচার যেন ত্রুটি ও প্রভাবমুক্ত হয়। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলছি প্রতিটি ধর্মের অবমাননা ঘটনা ঘটলে আইনের প্রয়োগ যেন সমান হয়।’

‘কারণ পূর্বের বাস্তবতায় আমরা দেখেছি যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম অবমাননার ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরার ক্ষেত্রে যে তৎপরতা দেখায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্ম অবমাননার ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরতে ঠিক ততোটা উৎসাহী থাকে না। প্রতিমা ভাঙচুর করা হলে সেটার ক্ষেত্রে প্রথাগতভাবে বলা হয় অপরাধীকে ধরতে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন অতিক্রান্ত হলেই সবাই এ অপরাধের কথা ভুলে যায়। আর যেসব ক্ষেত্রে প্রতিমা ভাঙচুর করার সময় হাতেনাতে অপরাধীদের ধরা হয়, তাদের অধিকাংশকেই মানসিক রোগী বলে ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে।’

‘অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এদের প্রায় সবাই মানসিকভাবে সুস্থ এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে এরা সচেতনভাবে প্রতিমা ভাঙচুর করে। তাই প্রতিমা ভাঙচুরের ব্যাপারে আইনে সুস্পষ্টভাবে শাস্তির ব্যবস্থা উল্লেখ করতে হবে এবং সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে।’

ধর্মীয় কোনো সভা থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম/উপাস্য নিয়ে কুৎসা/কটুক্তি করা হলে আইনগতভাবে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে জানিয়ে ধর্মীয় এ নেতা বলেন, কোনো ধর্মের ধর্মীয় বক্তা অন্য ধর্মকে কটুক্তি করতে পারবে না। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে আন্তঃধর্মীয় সুস্থ আলোচনার পথ যেন রুদ্ধ না হয়। সব ধর্মের ক্ষেত্রেই যেন সবাই সমানভাবে সুবিচার পেতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ফেসবুকে গুজব রটিয়ে রামুতে সাম্প্রদায়িক হামলার মাধ্যমেই মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রথম বড়সড় সাম্প্রদায়িক হামলার সূচনা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক হামলা, যশোরের অভয়নগর মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা, কুমিল্লার হোমনায় সাম্প্রদায়িক হামলা, ভোলার বোরহানউদ্দিনে সাম্প্রদায়িক হামলা, হবিগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাসহ আরও অসংখ্য আলোচিত ঘটনা সবারই জানা। সব ক্ষেত্রেই একই প্যাটার্নে এ হামলা হয়েছে। প্রথমে ফেসবুকে কোনো হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে কথিত ধর্ম অবমাননার গুজব তৈরি করা হয়েছে। এরপর মব তৈরি করে সংগঠিতভাবে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে, বাড়িঘর লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে।

‘দেখা যাচ্ছে অনলাইনের একটি কটুক্তির সূত্রে অফলাইনে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ধর্ম অবমাননা করা হচ্ছে। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন কোনো সরকারই হিন্দুদের ওপর এই সাম্প্রদায়িক হামলার চূড়ান্ত কোনো বিচারের আগ্রহ দেখায়নি। ঘটনার পর প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, অভিযুক্ত হিন্দু ব্যক্তি নির্দোষ। তার মানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্লট রচনার জন্যই এই ধর্ম অবমাননার কাহিনী সাজানো হয়। কিন্তু প্রকৃত ধর্ম অবমাননাকারী রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা সেই ধর্ম অবমাননাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, তা সে ব্যক্তি যেই ধর্মেরই হোক না কেন।’

‘সেই সঙ্গে ধর্ম অবমাননার নাম করে মব তৈরি করে নির্দোষ জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত সব ব্যক্তিকেও শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। ব্যক্তির দায়ে সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সুস্পষ্ট দাবি, হামলাকারীদের সম্পত্তি রাষ্ট্র কর্তৃক ক্রোক করে সেই অর্থ দিয়ে হামলার শিকার নির্দোষ ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে মব তৈরি করে সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।’

বিগত ২০২১ সালের দুর্গাপূজার রক্তাক্ত শারদের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে জানিয়ে প্রদীপ কান্তি দে বলেন, কুমিল্লার এক মণ্ডপে কোরান শরিফ পাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য পূজামণ্ডপে হামলা ও দুর্গাপ্রতিমা ভাঙচুর ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। পরে সিসিটিভি ফুটেজ ও তদন্তে জানা যায় মো. ইকবাল নামে এক ব্যক্তি মণ্ডপে কোরান রেখে এসেছিল, যার ফলশ্রুতিতে সেদিনের দুর্গাপূজায় নিরীহ হিন্দুদের ওপর তাণ্ডব নেমে এসেছিল। যারা ধর্মীয় সংঘর্ষ তৈরির জন্য এরকমভাবে উসকানি দেয় আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন করার দাবি জানাচ্ছি। সম্প্রতি মো. অপূর্ব রাদ (ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্বের নাম অপূর্ব পাল) ফেসবুকে কোরান শরিফ অবমাননা করেছে। এ ঘটনা সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আহত করেছে।

তিনি বলেন, আমরা এই ধর্মগ্রন্থ অবমাননার প্রতিবাদ করছি। কোনো ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ কেউ এভাবে অবমাননা করার অধিকার রাখে না। আমরাও চাই তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যেমনটা কুমিল্লার ইকবালের মতো সব ধর্মীয় অবমাননাকারী উসকানিদাতাদের হওয়া উচিত। মন্দির-প্রতিমা ভাঙচুরকারী আর কোরআন অবমাননাকারী সবাই সমান দোষে দোষী। অপরাধী যেকোনো ধর্মেরই হতে পারে, তাই অপরাধীর ধর্ম না দেখে সবার জন্য সমানভাবে আইন প্রয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি করা জরুরি।

ইসলামিক ধর্মীয় সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয় আলেম ওলামাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রদীপ কান্তি দে বলেন, আমাদের প্রিয় দেশটিতে সবাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাই। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় আপনাদের ভূমিকা ও সামর্থ্য স্বাভাবিকভাবেই আমাদের চেয়ে বেশি থাকবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় আমরা একে অন্যের হাত ধরে রাখতে চাই। অস্বীকার করার উপায় নেই, বিগত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার সময় হামলাকারী উগ্র ধর্মীয় মব নিয়ন্ত্রণে আপনাদের ভূমিকা আরও জোরদার করার আহ্বান জানাই।

তিনি বলেন, সব ধর্মের ধর্মীয় নেতৃস্থানীয়দের প্রভাব নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর ওপর থাকে। নিয়মিত বিরতিতে সব ধর্মীয় নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যকার অবিশ্বাস দূর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় করতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

এসময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে চার দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো-
১. সব ধর্মের অবমাননার জন্য সমান আইন ও শাস্তির বিধান করতে হবে।

২. ধর্ম অবমাননার অজুহাতে কোনো গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক হামলা চালালে তাদের জন্য শাস্তির বিধান করতে হবে।

৩. বিগত সময়ে ধর্ম অবমাননার অজুহাতে যেসব সংখ্যালঘু এলাকায় হামলা হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির বিধান করা হোক।

৪. অতীতে কথিত ধর্ম অবমাননার মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত সবাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হোক।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, হিন্দু যুব মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ নাহা, সাবেক সভাপতি সজীব বৈদ্য, ঢাকা মহানগর হিন্দু যুব মহাজোটসহ ছাত্র ও যুব মহাজোটের নেতারা।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার