ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

একটি নতুন বাংলাদেশের আশা ও হতাশা: সত্যের মুখোমুখি সময়

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ছিল একই সঙ্গে আনন্দ ও বিষাদের এক অনন্য অধ্যায়। একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এক দেশ। তখন আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল— “একটি সোনার বাংলাদেশ গড়ব আমরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম: প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।”

কিন্তু স্বাধীনতার সেই স্বপ্ন আজও অপূর্ণ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আবারও এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশ নতুন করে জেগে উঠেছিল— নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল এক নতুন উদ্দীপনা, এক নতুন বাংলাদেশ।

অপ্রত্যাশিত পরিণতি ও হতাশার সূচনা
কিন্তু সেই বাংলাদেশ আজ স্বপ্নভঙ্গের পথে। আমি কষ্ট পাই কারণ ভেবেছিলাম—ড. ইউনুসের নেতৃত্বে আমরা হয়তো সত্যিকার অর্থে একটি নতুন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে পারবো। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান থেকে পুলিশ প্রধান, প্রশাসন থেকে রাজনৈতিক দল—প্রায় সর্বত্রই দুর্নীতি, প্রভাব, আত্মস্বার্থ ও জবাবদিহির অভাব স্পষ্ট। এই অবস্থায় কীভাবে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক সোনার বাংলা গড়া সম্ভব?

বাস্তব প্রেক্ষাপট ও সাম্প্রতিক ইতিহাস (৫ আগস্ট ২০২৪–এর পর)

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন এবং দেশ ত্যাগ করেন। দেশজুড়ে উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার পর এক অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়— নেতৃত্বে ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস।

প্রথমদিকে অনেকেই আশা করেছিলেন—এই সরকার হবে পরিবর্তনের প্রতীক, দুর্নীতি-নির্মূল ও প্রতিষ্ঠান-সংস্কারের সূচনা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেল, প্রধান অপরাধী বা ক্ষমতার দখলদাররা এখনও অক্ষত, আর কিছু নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে।

শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বাইরে, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ অনেকেই এখনও দায়মুক্ত। রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সেনাপ্রধান, পুলিশপ্রধান—এদের ভূমিকা ও দায় নিয়ে কোনো কার্যকর তদন্ত বা বিচার হয়নি। অথচ প্রশাসনের অনেক ছোট কর্মচারী বা নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা অভিযোগ বা হয়রানির মুখে পড়েছেন।

গভীর সংকট: কেন পরিবর্তন এলেও কাঠামো অপরিবর্তিত?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এখনো ব্যক্তি-নির্ভর, প্রতিষ্ঠান-নির্ভর নয়। বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন—সব জায়গায় রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থদের বড় অংশ অতীতে রাজনৈতিক আনুগত্যে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন। ফলে নতুন সরকার গঠনের পরও একই গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে গেছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন সত্য বলতে ভয় পায়—একদিকে সেন্সরশিপ, অন্যদিকে নিরাপত্তা ঝুঁকি। ফলে রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির ক্ষেত্র সংকুচিত।

জনগণের অবস্থা: ভয়, বিভ্রান্তি ও নিরাশা
আজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দ্বিধায়, কেউ ভয় পায়, কেউ পথভ্রষ্ট। তারা জানে— সত্য কথা বলা মানে বিপদ ডেকে আনা। অথচ সত্য না বললে জাতি আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
আমি চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের জন্য লড়াই করেছি। প্রবাসে থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করেছি। আমি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই, আমি রাষ্ট্রের অন্ন ধ্বংস করিনি।
তাই আমার অধিকার আছে সত্য বলার— কারণ সত্যই একদিন জাতির মুক্তির পথ দেখাবে।
বিশ্লেষণাত্মক প্রবাহ (A–Z Analysis Flow)
A. ঘটনার সারমর্ম
– ৫ আগস্ট ২০২৪: ক্ষমতাসীন সরকারের পতন
– অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের আগমন
– বিচার ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি স্থবির
B. মূল সমস্যা
– অপরাধীদের দায় নির্ধারণে অনীহা
– প্রশাসনের উচ্চস্তরের দুর্নীতি
– গণতন্ত্রে আস্থা হারানো জনগণ
C. প্রভাব
– রাষ্ট্রীয় অচলাবস্থা
– আন্তর্জাতিক আস্থাহীনতা
– অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক হতাশা
D. কারণসমূহ
– আইন-শাসনের দুর্বলতা
– রাজনৈতিক প্রভাব ও দলীয় স্বার্থ
– গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভয়ের সংস্কৃতি
E. সম্ভাব্য সমাধান কাঠামো
1. স্বাধীন তদন্ত কমিশন
2. বিচার বিভাগীয় সংস্কার
3. স্বচ্ছ নির্বাচন প্রস্তুতি
4. গণমাধ্যম স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
5. দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন
গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনা
১. স্বাধীন তদন্ত কমিশন — আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বচ্ছ কমিশন গঠন; আইনজীবী, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক অন্তর্ভুক্তি।
২. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন — সব দলের সমঝোতায় পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন কমিশন নিয়োগ ও নির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা।
৩. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা — সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৪. বিচার বিভাগ ও আইন সংস্কার — আদালতের ডিজিটাল কেস-ট্র্যাকিং ও প্রকাশ্য শুনানি চালু করা।
৫. দুর্নীতি প্রতিরোধ — সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ ঘোষণা বাধ্যতামূলক করা ও অনলাইন স্বচ্ছতা পোর্টাল চালু।
দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও কাঠামোগত সংস্কার
১. শিক্ষায় নাগরিক চেতনা — গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নাগরিক দায়িত্ববোধ শিক্ষা।
২. অর্থনৈতিক ন্যায্যতা — প্রবাসী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা ও স্বচ্ছ বিনিয়োগ নীতি।
৩. নাগরিক তদারকি কাঠামো — মিডিয়া, এনজিও ও নাগরিক সংগঠনের মাধ্যমে টেকসই জবাবদিহি ব্যবস্থা গঠন।
শেষ কথা: সত্যের পথে, নতুন বাংলাদেশের ডাক
বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে। স্বাধীনতার সময় যেমন আমরা শপথ নিয়েছিলাম, আজ আবার সেই শপথ নিতে হবে— “আমরা দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়বো—যেখানে শাসনব্যবস্থা জনগণের সেবায় নিবেদিত থাকবে।” আমি বিশ্বাস করি, সত্য প্রকাশই জাতির পুনর্জাগরণের প্রথম ধাপ। ভয় নয়, দায়িত্বই আমাদের পথ দেখাবে।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার