ক্যাটাগরি: জাতীয়

আজ বিশ্ব হার্ট দিবস, তামাক নিয়ন্ত্রণের জোরালো দাবি

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদরোগ প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ জরুরি এবং এজন্য দ্রুত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব সহকারে হার্টের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মিলে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়।

হৃদরোগ শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সমস্যা নয়; এটি একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট, যা আমাদের অর্থনীতি, পরিবার এবং সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক। এছাড়া হৃদরোগে মৃত্যুর ২৫ শতাংশের পেছনে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে বছরে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকে মারা যান—অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার প্রাণ হারায় এই রোগে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মৃত্যু তামাকজনিত কারণে, যা পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে, যা হৃদরোগ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে।

গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান ৪টি কারণের একটি তামাক। বিশ্বে প্রতিবছর ৮০ লাখের বেশি মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যান, যার মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মৃত্যু ঘটে হৃদরোগ ও রক্তনালির জটিলতায়। বাংলাদেশেও চিত্র ভয়াবহ—প্রতি বছর ১,৬১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ তামাকজনিত কারণে অকালে মৃত্যু হয়।

ধূমপান কিংবা ধোঁয়াবিহীন তামাক—দুটিই হৃদরোগের জন্য দায়ী। নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড রক্তচাপ বাড়ায়, রক্তনালিকে সংকুচিত করে এবং হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়। প্রতিদিন মাত্র একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। এমনকি পরোক্ষ ধূমপান থেকেও হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৫–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

এই প্রভাব শুধু স্বাস্থ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—হৃদরোগে আক্রান্ত একজন ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় অনেক সময় একটি পরিবারকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঠেলে দেয়। তামাকজনিত কারণে যে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগেন, তাদের চিকিৎসা ব্যয় ও শ্রমঘণ্টার ক্ষতি যোগ করলে এই ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান (বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি)। এর বিপরীতে তামাক খাত থেকে সরকার যে রাজস্ব আয় করে, তা তুলনামূলকভাবে অনেক নগণ্য। ফলে, তামাকের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইও বটে।

তামাকের ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত ওজন—সব মিলিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ (প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছেন। হৃদরোগ প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই অকালমৃত্যুর ধারা অব্যাহত থাকবে। এজন্য ব্যক্তিগত জীবনধারায় পরিবর্তন আনা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রসার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

হৃদরোগ প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ একটি কার্যকর উপায়—এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সচেতনতা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শক্তিশালী ও সাহসী পদক্ষেপ। তামাক একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রতিরোধযোগ্য জনস্বাস্থ্য সংকট। এটি শুধু ফুসফুস নয়, আমাদের হৃদযন্ত্র, পরিবার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করছে।

হৃদরোগ প্রতিরোধে তামাক থেকে দূরে থাকা এবং সমাজকে তামাকমুক্ত করা। একটি সুস্থ হৃদযন্ত্র মানে একটি সুস্থ জীবন। এই জীবন নিশ্চিত করতে হলে, এখনই সময় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার