ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

জাতিসংঘ: পতনের ছায়া নাকি পুনর্জাগরণের আলো?

গাজায় শিশুর কান্না, ইউক্রেনে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘশ্বাস—তাহলে জাতিসংঘ কোথায়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মানবতার শান্তি, ন্যায় ও নিরাপত্তার আশায় ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল—একটি বৈশ্বিক মঞ্চ, যেখানে সব রাষ্ট্র সমানভাবে অংশ নেবে, আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা হবে, আর মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা পাবে। কিন্তু প্রায় আট দশক পর প্রশ্ন উঠছে—জাতিসংঘ কি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে, নাকি এটি আজ পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে?

আমি ব্যক্তিগতভাবে গত কয়েক বছরে সুইডেনসহ বিশ্বের নানা দেশে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেছি এবং বহু নিবন্ধ লিখেছি। কারণ কথা ছিল—যুদ্ধ নয়, আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা হবে। সেই স্বপ্নের নাম ছিল জাতিসংঘ। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠার সময় ৫১টি রাষ্ট্র বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করেছিল। আজ সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৩-এ।

প্রতিষ্ঠার সময় কাঠামো ও লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক আদালত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ—এসব অঙ্গ সংস্থা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের জন্য ভেটো ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা তখন মনে করা হয়েছিল বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাত প্রতিরোধ করবে। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে, এই ভেটোই মানবিক সংকট মোকাবিলার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক তীব্র সমালোচনামূলক ভাষণ দেন। তিনি সংস্থাটিকে “বিকল” এবং “অকার্যকর” বলে আখ্যা দেন, দাবি করেন এটি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। এমনকি তিনি জাতিসংঘ ভবনের একটি ভাঙা এস্কেলেটর ও টেলিপ্রম্পটারের ত্রুটি পর্যন্ত তুলে ধরেন, যদিও জাতিসংঘের মুখপাত্র পরে স্পষ্ট করেন—এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কারণে হয়েছিল। ট্রাম্পের বক্তৃতায় অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রসঙ্গও উঠে আসে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসন নীতি ও সবুজ জ্বালানি প্রকল্পের সমালোচনা করেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে “বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতারণা” বলে উল্লেখ করেন এবং ন্যাটো দেশগুলোর রাশিয়ার জ্বালানি ক্রয়কে দ্বৈত নীতি হিসেবে আখ্যা দেন।

ট্রাম্পের এ বক্তব্য বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জাতিসংঘকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন, যা ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা তাঁর একতরফা নীতির সমালোচনা করে বলেন, এটি সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও ট্রাম্পের মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সংস্থাটির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করেন।

কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, জাতিসংঘ প্রায়ই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের গাজা সংকট তার বড় উদাহরণ। নিরাপত্তা পরিষদে মানবিক ত্রাণ পাঠানোর প্রস্তাব ভেটোর কারণে স্থগিত হয়, ফলে হাজারো শিশু, বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষ খাদ্য ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু গাজাই নয়, ইউক্রেন, মিয়ানমার, আফগানিস্তান বা হাইতির মতো দেশগুলোতেও জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনকে তার সাফল্যের নিদর্শন হিসেবে দেখাতে চায়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কিন্তু হাইতিতে শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন ও শিশুশোষণের অভিযোগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। ২০১০ সালে হাইতিতে চোলেরা মহামারির জন্যও শান্তিরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করা হয়েছিল। এসব ব্যর্থতা জাতিসংঘের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে।

বাজেটের ক্ষেত্রেও অসমতা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র একাই প্রায় ২২% অর্থায়ন করে, যার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার প্রভাব অস্বাভাবিকভাবে বেশি। ছোট দেশগুলোর কণ্ঠস্বর প্রান্তিক হয়ে পড়ে। মানবাধিকার কাউন্সিলও প্রায়শ দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করে—ফিলিস্তিন বা ইয়েমেনে নীরবতা, অথচ তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান। আন্তর্জাতিক আদালত ও অপরাধ আদালত প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর হতে ব্যর্থ, কারণ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এসব আদালতের রায় মানতে অস্বীকার করে।

আজ জাতিসংঘের সামনে এক কঠিন বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে। ভেটো ক্ষমতার সংস্কার, মহাসচিব নির্বাচনে স্বচ্ছতা, বাজেটে ভারসাম্য, শান্তিরক্ষা মিশনে জবাবদিহিতা, মানবাধিকার কাউন্সিলের নিরপেক্ষতা—এসব ছাড়া জাতিসংঘকে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ আধুনিক ইতিহাসে এক অমূল্য প্রতিষ্ঠান—দুর্যোগে ত্রাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রকল্পে এর অবদান অনস্বীকার্য। তবুও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এটি প্রায় অচল হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের জন্য এই সংকট আরও গভীর। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমান্ত সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা—এসবই আমাদের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ফেলছে। বৈশ্বিক সংহতি ও কার্যকর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের সংস্কার কেবল বৈশ্বিক শান্তির জন্য নয়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের টিকে থাকার জন্যও অত্যাবশ্যক।

তাহলে প্রশ্ন একটাই—জাতিসংঘ কি পতনের পথে যাবে, নাকি পুনর্জাগরণের আলোয় বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে? আজ আমাদের দৃঢ় কণ্ঠে বলতে হবে—সংস্কারই জাতিসংঘের পুনর্জন্মের একমাত্র পথ।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার