ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে আগে দরকার প্রশাসনিক সংস্কার

প্রযুক্তির যুগে আমরা প্রায়শই দেখে থাকি-যা ভালো লাগে, তা-ই নকল করতে চাই। হতে পারে পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান বা শাসনব্যবস্থা। তবে স্থান, কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সবকিছু একেবারে হুবহু স্থানান্তর সম্ভব নয়। যেমন—সুইডেনে বসবাস করে সুন্দর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা দেখা যায়, তবে তা বাংলাদেশে সরাসরি প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনে Proportional Representation (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। এই পদ্ধতিতে জনগণ যে ভোট দেয়, তার অনুপাতে সংসদীয় আসন বণ্টন হয়। ফলে কোনো একক দল একচেটিয়া ক্ষমতা পায় না; সরকার পরিচালনার জন্য জোট গঠন অপরিহার্য।

সুইডিশ রাজনীতির বৈশিষ্ট্য:
– স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় কঠোর নিয়ম ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র মেনে চলে।
– দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ: অর্থের প্রভাব কার্যত সীমিত।
– জনঅংশগ্রহণ: ভোটের ফল যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়; সংসদ সদস্যরা জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কার্যকর।
– শিক্ষার মান ও সামাজিক চুক্তি: জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বাস দৃঢ়। ভোট কেবল ক্ষমতার বণ্টন নয়, নাগরিক অধিকার ও কল্যাণের প্রতিফলন।
– নির্বাচনের স্বচ্ছতা: ভোট গ্রহণ, গণনা ও পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন।

ফলস্বরূপ, সুইডেনে সংসদ কার্যকর ও স্থিতিশীল; মতবিরোধ থাকলেও আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সঠিকভাবে নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে PR পদ্ধতি সরাসরি চালু হলে সুইডেনের মতো ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায় না। কারণ:
– মনোনয়ন বাণিজ্য: প্রার্থী তালিকায় স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ও অর্থের প্রভাব প্রচলিত।
– প্রচণ্ড ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া: প্রতিযোগিতা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল।
– ক্ষমতার অপব্যবহার: সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নের বদলে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন।
– দলীয় প্রধানের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা: সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় একক নেতা বা ছোট গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি।
– রাজনৈতিক প্রভাব প্রশাসনে: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন রাজনৈতিক চাপের অধীনে কাজ করে।

ফলাফল: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বৃদ্ধি এবং অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন।

কাঠামোগত সংস্কারের প্রধান ধাপ
১. সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা সীমিতকরণ: মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ। প্রশাসনিক ক্ষমতা তাদের হাতে থাকা উচিত নয়।
২. স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা: ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে আইন বাস্তবায়ন, বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনার দায়িত্ব দেওয়া।
৩. জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি:
– মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
– দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ।
– জনগণের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক।
৪. দলীয় অর্থায়নের স্বচ্ছতা: তহবিল ও দানের হিসাব প্রকাশ বাধ্যতামূলক।
৫. গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা: রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি উন্মোচন নিশ্চিত করবে।

ফলস্বরূপ, রাজনীতি হবে নীতি নির্ধারণ ও দূরদর্শিতার স্থান, প্রশাসন হবে জনগণের সেবার মঞ্চ।

নিরপেক্ষ প্রশাসনের মডেল: সুইডেন
সুইডেন দেখায়, একটি দেশের অগ্রগতি তখনই স্থায়ী হয় যখন প্রশাসন রাজনীতির হাত থেকে স্বাধীন।
– স্বাস্থ্যসেবা: জাতীয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বোর্ড।
– সামাজিক নিরাপত্তা: Försäkringskassan (সোস্যাল ইন্সুরেন্স এজেন্সি)।
– শ্রমনীতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও অন্যান্য: প্রতিটি খাতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।

রাজনীতিবিদরা কেবল নীতি নির্ধারণে সীমাবদ্ধ থাকেন, বাস্তবায়ন পেশাদার প্রশাসন সম্পন্ন করে। বাংলাদেশেও যদি প্রতিটি খাতে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, রাজনীতি আর দুর্নীতির বাহন হবে না।

সুইডেনের সংসদীয় ব্যবস্থা শেখায়, PR কার্যকর হতে হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। বাংলাদেশে PR সরাসরি প্রয়োগ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই জরুরি:
– সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা সীমিত করা,
– স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়িত করা,
– নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি সত্যনিষ্ঠ, শিক্ষিত ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

-বাংলাদেশ যদি এই সংস্কারগুলো কার্যকর করতে পারে, তবে এক প্রজন্মের মধ্যে রাষ্ট্রীয় রাজনীতি ধ্বংসের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
-শুধুমাত্র PR নয়, সুস্থ প্রতিষ্ঠান ও নিরপেক্ষ প্রশাসনই প্রকৃত পরিবর্তনের চালিকা শক্তি।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com 

শেয়ার করুন:-
শেয়ার