কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে অপহরণের শিকার হয় কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পান্টি গ্রামের রেজাউল করিম।প্রাণ বাঁচিয়ে কোনো রকমে বিজিবির কাছে পৌঁছায় তিনি। এরপর তার দেওয়া তথ্যে বেরিয়ে আসে এক ভয়াবহ জগতের সন্ধান! উদ্ধার করা হয় আরো ৮৩ জনকে। রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো এই ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। একে একে বেরিয়ে এসেছে মানব পাচারের এক ভয়ানক চক্রের সন্ধান।
দেশের এক সংবাদমাধ্যমের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে আসে এই ভয়াবহ অধ্যায়। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পান্টি গ্রামের রেজাউল করিম বেড়াতে এসেছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফে। হোটেল আল করমে ওঠার পর অচেনা এক দুঃস্বপ্নে পড়েন তিনি। ৭ সেপ্টেম্বর স্থানীয় এক ব্যক্তি মো. আমিন যিনি হোটেলের সাবেক ম্যানেজার, তিনি রেজাউলকে অপহরণ করে ৫০ হাজার টাকায় পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন। সেই থেকেই শুরু হয় তার বন্দিদশার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
রেজাউলকে প্রথমে টেকনাফ পৌর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের ঝরনা চত্বর থেকে অপহরণ করে পাহাড়ি আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় বুঝতেও পারেননি কোথায় যাচ্ছেন। পরে মুক্তিপণের দাবিতে টানা ১৩ দিন তাকে নির্যাতন করা হয়।
শেষ পর্যন্ত আরো একদল পাচারকারীর কাছে বিক্রি করার পথে জীবন হাতে নিয়ে পাহাড় থেকে পালিয়ে যান তিনি। সরাসরি বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিলে শুরু হয় পুরো ঘটনার মোড় ঘোরা।
রেজাউলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিজিবি ও র্যাব যৌথ অভিযান চালিয়ে টেকনাফের বাহারছড়া কচ্ছপিয়ার গহিন পাহাড় থেকে নারী-শিশুসহ ৮৩ জনকে উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃতরা সবাই সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের উদ্দেশ্যে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। এসময় তিন মানব পাচারকারীকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান এবং র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
পালিয়ে বাঁচা রেজাউল করিম জানান, চোখের বাঁধন খোলার পর দেখি চারপাশে দুই শতাধিক মানুষ আটক। সেখানে টাকার বিনিময়ে মানুষ কেনাবেচা হয়। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হতো নির্যাতন। এক পর্যায়ে আমার পরিবারকে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে পাচারকারীরা। যেদিন পালিয়ে আসি সেদিনও অন্তত ২৫০ জন ছিল সেই আস্তানায়।
তিনি আরো জানান, এখনো শতাধিক মানুষ বন্দি অবস্থায় রয়েছে, যাদের উদ্ধার করা না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
যে হোটেল থেকে শুরু হয় রেজাউলের ভয়াবহ অধ্যায়, সেই হোটেল আল করমের মালিক মোহাম্মদ আলী জানান, হোটেলটি পারিবারিক সম্পত্তি হলেও ১০ বছরের জন্য অন্যদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমিন দুই বছর আগে ম্যানেজারের পদ থেকে বাদ পড়েছিল। বর্তমানে তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
অন্য ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা
একই আস্তানা থেকে টেকনাফের নয়াপাড়ার বাসিন্দা আয়েশা খাতুনও উদ্ধার হন। ঘুরতে গিয়ে অপহৃত হয়ে তিনি ছয় দিন বন্দিদশায় কাটান। নির্যাতনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আয়েশা বলেন, ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল। মুক্তিপণ না পেলে আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার সুযোগ থাকত না।
মুন্সীগঞ্জের অমিত হাসান ও মানিক মিয়াও একইভাবে প্রতারণার শিকার হন। পরিচিত এক কক্সবাজারবাসীর আমন্ত্রণে টেকনাফে এসে তারা পাচারকারীদের হাতে ধরা পড়েন। ২০ দিন পাহাড়ি আস্তানায় আটকে থাকার পর র্যাব-বিজিবির অভিযানে তারা মুক্তি পান।
এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, রোহিঙ্গা শিবির থেকেও প্রলোভনে আনা হচ্ছে অনেক শরণার্থীকে। উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে ৬৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী। তাদের অনেককে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে উন্নত জীবনযাপন ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয়। আবার কয়েকজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েও ফাঁদে ফেলা হয়।
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ এনাম ও আমিন বাহার জানান, তারা সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় পাহাড়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে ১০ দিন আটক রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
এ ঘটনা উন্মোচন হতেই টানা ১২ ঘণ্টার অভিযানে যৌথ বাহিনী পাচারকারীদের তিন রাউন্ড গুলির মুখেও কৌশলে ভুক্তভোগীদের অক্ষতভাবে উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার হওয়া পাচারকারীরা হলেন—আবদুল্লাহ (২১), সাইফুল ইসলাম (২০) ও মো. ইব্রাহিম (২০)। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি বন্দুক, ধারালো অস্ত্র এবং গুলি উদ্ধার করা হয়।
বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘টেকনাফের পাহাড়ে কয়েকটি সক্রিয় মানব পাচারকারী গ্রুপ কাজ করছে। এর নেতৃত্বে আছেন হোসেন, সাইফুল ও নিজাম নামের তিনজন, যারা আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের মূল হোতা।’ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিছু চক্রও পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে নদী ও পাহাড় থেকে পাচারের উদ্দেশ্যে আটকে রাখা ১৭৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২ পাচারকারীকে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।