ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

হাটে জন বিক্রি আধুনিক দাসত্বের অন্ধকার ও রাষ্ট্রীয় দায়

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে আজও “নহাটার হাটে জন (কৃষিশ্রমিক বা কিষাণ) বিক্রি” এক বিভীষিকাময় বাস্তবতা। এই হাটে মৌসুমি জনেরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে-অপেক্ষায় থাকে নিজেদের শ্রমকে নগদ মূল্যে বিকিয়ে দেওয়ার। আর জমির মালিক বা কৃষকরা দরদাম করে তাদের কিনে নেয় দিনের বা মৌসুমের জন্য। আমার শৈশবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় নহাটার হাটে জন বিক্রির ভয়াবহ দৃশ্য চোখে দেখেছি, যা আজও নির্মমভাবে চলমান। একবার হাটে দাসত্বের এই বাণিজ্যে বিক্রি হয়ে গেলে শ্রমিকেরা নিয়োগকর্তার খেয়াল-খুশি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারে না। এই প্রথা শ্রমিকদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে, তাদের অস্তিত্বকে অবমানবিক দাসত্বের গহ্বরে নিক্ষেপ করে।

জন হাটের ইতিহাস গভীর শোষণ ও অমানবিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে গ্রামীণ অঞ্চলে চালু ছিল কুলি বাজার—যেখানে মৌসুমি শ্রমিকদের সস্তায় বিক্রি হতো। পাকিস্তান আমলেও জমিদাররা মৌসুমি শ্রমিক কেনাবেচার মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বজায় রাখত। স্বাধীনতার পরও এই প্রথা এক বিকৃত উত্তরাধিকার হিসেবে টিকে আছে। জন হাট তাই কোনো আকস্মিক উদ্ভাবন নয়; বরং এটি শোষণ, পরাধীনতা ও ক্ষমতাবাদী নিপীড়নের ধারাবাহিক কাঠামোর নগ্ন প্রকাশ।

জন বা কৃষিশ্রমিকদের জীবনযাত্রা একেবারেই ঐতিহাসিক দাসত্বের সমতুল্য। তাদের খাবার অপ্রতুল—এক মুঠো ভাত, সামান্য ডাল, বা কখনো রুটি। ঘুমাতে হয় অস্থায়ী ছাউনিতে বা খোলা আকাশের নিচে। অসুস্থ হলে আয় বন্ধ হয়ে যায়, চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ মেলে না। হাটে দাঁড়িয়ে শ্রম বিক্রি করা তাদের জন্য সামাজিক কলঙ্ক, এক অদৃশ্য শৃঙ্খল। অতীতে দাসেরা যেমন প্রভুর দয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল, আজকের জনেরাও নিয়োগকর্তার করুণার দাস। শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা নিজের বাড়িতে ফিরতে পারে না। গার্মেন্টস শিল্পের উত্থান হয়তো এই শৃঙ্খল কিছুটা আলগা করেছে, দৈনিক মজুরি কিছুটা বেড়েছে—কিন্তু মৌলিক কাঠামো আজও দাসত্বেরই নামান্তর।

আমার ছোটবেলার এক করুণ স্মৃতি—মধুমতি নদীর নৌকাডুবির ঘটনা—প্রমাণ করে জন সম্প্রদায়ের জীবনের তুচ্ছতা ও অবমাননা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, ঐ দুর্ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে চারজন ছিল জন সম্প্রদায়ের। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মূল্যায়নের বিচারে তাদের মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যান হয়ে গিয়েছিল; যেন তারা পূর্ণ মানুষ নয়, অবহেলার ভারে চূর্ণিত আধা-অস্তিত্ব।

ঐতিহাসিক দাসত্বের সঙ্গে জন হাটের তুলনা সুস্পষ্ট। অতীতে দাসেরা ছিল প্রভুর চিরস্থায়ী সম্পত্তি—তাদের কোনো মজুরি ছিল না, স্বাধীনতা ছিল না, মর্যাদা ছিল শূন্য। জন হাটের শ্রমিকরা অল্প মজুরি পেলেও তাদের জীবনযাত্রা অমানবিক, সামাজিক মর্যাদা প্রায় অনুপস্থিত। খাদ্যের অনটন, নিরাপদ ঘুমের অভাব, স্বাস্থ্যসেবার অনুপস্থিতি, সর্বত্র অবহেলা—সব মিলিয়ে তারা আধুনিক ক্রীতদাস ছাড়া আর কিছু নয়। স্বাধীনতার ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল মানুষ মানুষের জন্য হবে, শোষণহীন সমাজ গঠিত হবে। কিন্তু অর্ধশতক পেরিয়েও বাংলাদেশে জন প্রথার অবসান ঘটেনি; বরং শোষণ আরও সূক্ষ্ম, আরও নির্মম হয়েছে।

রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি এই বৈষম্যকে রক্তক্ষরণময় ক্ষত হিসেবে আরও গভীর করেছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুধার্ত, অনাহারী, অমানবিক অবস্থায় দিনাতিপাত করছে—অপরদিকে রাজনীতির তথাকথিত অভিভাবকেরা লুটতরাজে মত্ত। সরকারি প্রকল্প থেকে টাকা আত্মসাৎ, টেন্ডারবাজি, বিদেশে অবৈধ সম্পদ পাচার—সবই রাষ্ট্র ও সমাজকে বিষাক্ত করেছে। বিচারব্যবস্থা, যা ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ আসন হওয়ার কথা, আজ দুর্নীতি, পক্ষপাত ও ক্ষমতার দাসত্বে নিমজ্জিত। এই প্রতিষ্ঠান ন্যায়কে নির্বাসনে পাঠিয়ে অবিচারকে অভ্যাসে পরিণত করেছে। এক কথায়—বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আজ পবিত্রতার মুখোশে লুকানো সবচেয়ে অপবিত্র ক্ষেত্র।

সমাধানের পথ স্পষ্ট, কিন্তু বাস্তবায়নের ইচ্ছা অদৃশ্য। ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের নিবন্ধন ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদান, নিরাপদ আবাসন ও খাদ্যের নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যবিমা ও বয়স্কভাতা চালু করা, স্থানীয় সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, শ্রম আইন ও মানবাধিকার আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, এবং সর্বোপরি সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন—এসব ছাড়া মুক্তি নেই।

কিন্তু নহাটার মতো সারা বাংলাদেশের অগণিত হাটে আজও জন বিক্রি প্রথা নির্মমভাবে বহাল রয়েছে। মধুমতি নদীর নৌকাডুবি, রাজনীতির দুর্নীতি ও চরম বৈষম্য প্রমাণ করে—শুধু নহাটায় নয়, বাংলাদেশের সর্বত্র কৃষিশ্রমিকরা আধুনিক দাসত্বের অন্ধকারে বন্দি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দাসপ্রথার উত্তরসূরি আজকের এই জন হাট; ধনী-দরিদ্রের চরম বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা এবং রাজনীতির কদর্য চরিত্র মিলে এই বর্বরতাকে অমর করে রেখেছে।

প্রশ্ন জাগে—কবে ভাঙবে এই অভিশপ্ত প্রথা? কবে জনরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা পাবে? আজ তারা কেবল জীবনের ঝুঁকি, নিরাপত্তাহীনতা ও অবহেলার বোঝা বইছে। সমাজে ন্যায়বিচার, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ জীবন ও শ্রমিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই অভিশাপ মোচনের কোনো পথ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র কি সত্যিই এই দায় স্বীকার করবে? আজও আমি তা দেখি না। তবে একান্ত সাধ জাগে—একদিন যেন সত্যিই তা দেখি!

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার