দীর্ঘ সময় ধরে লোকসানে জর্জরিত পুঁজিবাজারে প্রকৌশল খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে এবার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) সঙ্গে ডিপিএমের মাধ্যমে ডব্লিউপিপি ও পিই ব্যাগ সরবরাহের লক্ষ্যে চুক্তি করেছে। বিসিআইসি এখন থেকে তাদের প্রয়োজনীয় ওভেন পলিপ্রোপিলিন ও পলিথিন ব্যাগের ৫০ শতাংশ সরাসরি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড থেকে কিনবে।তবে নতুন এই চুক্তি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের কাছে গোপন করেছে কোম্পানিটি। অর্থাৎ মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা পিএসআই প্রকাশ করা হয়নি, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
এর আগেও, বিসিআইসি থেকে বড় অংকের ক্রয়াদেশ পায় লোকসানি এই কোম্পানিটি। তবে সেই তথ্যও গোপন করা হয়। পিএসআই প্রকাশ না করে আইন লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের তথ্য পিএসআই আকারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রকাশ করার বিধান রয়েছে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি সরকারি মালিকানাধীন বিসিআইসির কাছ থেকে কোম্পানিটি বড় অংকের ক্রয়াদেশ পেয়েছে। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানায়নি। যা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, এরআগে বিসিআইসি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে সরাসরি ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩ লাখ পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগ কিনতে চুক্তি করে। প্রতিটি ব্যাগের দাম ধরা হয়েছে ৩৭ টাকা ৪৪ পয়সা। এই ব্যাগগুলো ব্যবহার হবে ইউরিয়া সার বস্তাবন্দী করতে। তবে সেই তথ্যও বিনিয়োগকারীদের কাছে গোপন করে কোম্পানিটি।
আইন অনুযায়ী, ইনসাইডার ট্রেডিং প্রভিশন বিধিমালা-২০২২ (যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) বিধিমালা, ২০২২ নামে পরিচিত) অনুযায়ী, যদি কোনো তথ্য ‘প্রাইস সেনসেটিভ’ হয়, অর্থাৎ যা প্রকাশিত হলে স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো সিকিউরিটির বাজার মূল্য বা কোনো কোম্পানির নিট সম্পদ মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হতে পারে, তবে সেই তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করে আইন লঙ্ঘন করেছে তালিকাভুক্ত মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, বিসিআইসির সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে কোম্পানি থেকে কোনো তথ্য ডিএসইকে জানানো হয়নি। তবে সম্প্রতি দরবৃদ্ধির কারণ জানতে কোম্পানিকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এর জবাবে কোম্পানিটি জানায়, কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ার দর বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, কোম্পানিটি পিএসআই প্রকাশ করেনি, তবে এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রমাণ ও সত্যতা মিললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এবিষয়ে জানতে মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব ওমর ফারুকের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্র মতে, গত ০১ সেপ্টেম্বর মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের নিকট হতে ডিপিএমের মাধ্যমে মোট ক্রয়ের ৫০ শতাংশ ডব্লিউপিপি ও পিহ ব্যাগ ক্রয়ের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মানিক উদ্দিন সই করা এ সংক্রান্ত এক চিঠি বিসিআইসির চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, বিসিআইসির যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগ সরবরাহে ব্যর্থ হলে বিসিআইসি বিকল্প উৎস হতে ব্যাগ ক্রয়ের নিশ্চয়তা সাপেক্ষে এবং বিসিআইসি পরিচালনা পর্ষদের ২১০৬তম সভার সিদ্ধান্তের আলোকে মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজের নিকট থেকে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা ও বিসিআইসির প্রকৃত চাহিদার নিরিখে মোট ক্রয়ের ৫০ শতাংশ ডব্লিউপিপি, পিই ব্যাগ ক্রয়ের প্রক্রিয়াটি পিপিআর-২০০৮, পিপিএ-২০০৬ ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ (অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন)-২০১৫ অনুসরণপূর্বক বিধি মোতাবেক নিষ্পত্তি করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৯৭ সালে বিসিআইসির প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত হয়, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের উদ্যোগে। শুরুর দিকে সরকার সরাসরি ব্যাগ কিনত (ডিপিএম) প্রতিষ্ঠানটি থেকে, ফলে লাভজনক ও স্থিতিশীল ছিল ব্যবসা। কিন্তু ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কোম্পানিটি থেকে সরকারের সরাসরি ব্যাগ কেনা বন্ধ হয়ে যায়, শুরু হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া। এর ফলে প্রতিযোগিতা বাড়লে বাজার হারাতে থাকে মিরাকল, মালিকানা বদলায়, কোম্পানি জর্জরিত হয় লোকসান ও ঋণে। বর্তমানে মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০.২৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক ৪.৮৯ শতাংশ, বিদেশীদের ০.২০ শতাংশ আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে বাকি ৬৪.৬৫ শতাংশ।
এসএম