ক্যাটাগরি: অন্যান্য

মালদ্বীপে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগটি নজিরবিহীন!

রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাপ্তবয়স্ক যে কাউকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে সরকার। বিদায়ী হাসিনা সরকারের আমলে প্রশ্নবিদ্ধ একাধিক নিয়োগ হয়েছে। চট্টগ্রামের শ্রমিক নেতা থেকে শুরু করে ‘আড়াই ঘণ্টার এমপি’ খ্যাত আখাউড়ার এক শিক্ষক নেতাকে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে পতিত সরকার। যদিও সব ভেসে গেছে ‘৩৬ জুলাই’র রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে। ওয়াকিবহালরা বলছেন- পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রদূতের মতো মর্যাদাপূর্ণ পদে বিতর্কমুক্ত নিয়োগ প্রত্যাশা ছিল জাতির। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে পেশাদারিত্বের মূল্যায়ন কাম্য ছিল। কিন্তু, না সেটি হয়নি। পেশাদার কূটনীতিক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ- উভয় ক্ষেত্রেই বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বিদায়ী সরকারের আমলে ‘মাখন খাওয়া’ লোকজন এ আমলেও সুবিধা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনৈতিক লেনদেনের কথাও চাউর আছে। বিশেষ করে মালদ্বীপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে সম্প্রতি যে নিয়োগ হয়েছে তা নিয়ে গুঞ্জন চরমে। ওই পদে নিয়োগ পেয়েছেন তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী একজন তরুণ শিক্ষাবিদ। যিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি তুরস্ক পার্লামেন্টে অন্যতম বেতনভোগী উপদেষ্টা বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নথি উপস্থাপনা করেছেন। তার নাম ড. মো. নাজমুল ইসলাম। বয়স, অতীত কীর্তি, রাজনৈতিক আনুগত্য এবং বিদেশিনীর সঙ্গে সংসার ইত্যাদি বিবেচনায় তার নিয়োগ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে বলে মনে করছেন পেশাদাররা। বোদ্ধাদের বিবেচনায় এই নিয়োগ ‘নজিরবিহীন’! বলা হচ্ছে- সব কিছুর একটা সৌন্দর্য থাকে। মালেতে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ পাওয়া ড. মো. নাজমুল ইসলামের জন্ম ১৯৯২ সালে। তার বয়স ৩৩ বছর। বাংলাদেশে ৫৪ বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্রদূত পদে এই বয়সে এমন নিয়োগ সম্ভবত এটাই প্রথম।

তাছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে তিনি তুরস্কে বসবাস করেন। সেখানে তিনি তুরস্ক সরকারকে সার্ভ করেছেন। দেশটির পার্লামেন্টে ‘এডভাইজার’ হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সে হিসেবে এতদিন তুরস্কের স্বার্থই দেখেছেন। পাশাপাশি তিনি জন্মসূত্রে সে দেশের একজন নাগরিক এবং সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে সংসার করছেন সফলভাবে। আচমকা রাষ্ট্রদূত পদে তার নিয়োগ দেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন পেশাদাররা। তবে ড. ইসলামের সঙ্গে আলাপে নিজের যোগ্যতা এবং উপযুক্ততার পক্ষে নানা যুক্তি এবং প্রমাণ হাজির করার চেষ্টা করেছেন। তিনি অনেক ডকুমেন্টের রেফারেন্স দিয়েছেন। তার সহধর্মিণীর বিদেশি নাগরিকত্ব এবং তুরস্কে সরকারি চাকরিতে থাকার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন। তবে তিনি জানিয়েছেন- রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের পর তার সহধর্মিণী তুরস্ক সরকারের চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার মনস্থির করেছেন। তবে তিনি তার্কিশ নাগরিকত্ব ছাড়তে পারবেন না জানান। নিজের নিয়োগে অনৈতিক লেনদেন তথা অন্তর্বর্তী সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করতে তুরস্ক সফরকালে তার বাসায় নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত অভিযোগ খণ্ডন করেন মিস্টার ইসলাম। উপদেষ্টার প্রটোকল ভেঙে তার বাড়িতে যাওয়া কিংবা নিজের সখ্যতাকে পুরোপুরি অসত্য বলে দাবি করেন। স্মরণ করা যায়, গত ২৭শে জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আবু সালেহ মো. মাহফুজুল আলমের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে নাজমুল ইসলামকে দুই বছর মেয়াদে মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনার পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা জানানো হয়।

পরবর্তীতে গত ৩রা আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো. আবুল হাসান মৃধার সই করা আরেক অফিস আদেশে নাজমুল ইসলামকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ন্যস্ত করে বাংলাদেশ হাইকমিশন, মালে-তে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। অফিস আদেশে, বর্তমান দায়িত্বভার ত্যাগ করে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নতুন হাইকমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে। ঢাকা-আঙ্কারার নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, নাজমুল ইসলামকে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করার প্রস্তাব করা হয়। যেখানে বর্তমানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন পেশাদার ও অভিজ্ঞ কূটনীতিক এম আমানুল হক।

তবে বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১৮তম ব্যাচের পেশাদার এই কূটনীতিককে সরাতে রাজি হয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে রাষ্ট্রদূতের পদ শূন্য থাকায় মালদ্বীপে নাজমুল ইসলামের নিয়োগ প্রস্তাব (এগ্রিমো) পাঠায় সরকার। মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা তুরস্ক সফর করেন। সেসময় সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় নাজমুল ইসলামকে দেখা গেছে। নাজমুল ইসলামের জমা দেয়া নথি বলছে, তিনি বর্তমানে তুরস্কের আঙ্কারা ইলদিরিম বেয়াজিট বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জন্মসূত্রে নোয়াখালীর বাসিন্দা নাজমুল ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ইলদিরিম বেয়াজিট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

আঙ্কারার একটি সূত্র জানায়, পড়াশোনা এবং চাকরির সুবাদে প্রায় এক যুগ তুরস্কে আছেন মিস্টার ইসলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত বিশেষ বিবেচনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মান বা অনেকক্ষেত্রে পুরস্কার হিসেবে রাষ্টদূত পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। নাজমুল কি বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া নাজমুলের বয়সী পেশাদার কূটনীতিকরা বড়জোর সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার হয়ে থাকেন। পেশাদার কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে গ্রেট থ্রি পদে মহাপরিচালক/কনসাল জেনারেল/মিনিস্টার পদে দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মালদ্বীপে বাংলাদেশের সাবেক দুই হাইকমিশনারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমান নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ২০২০ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর মালদ্বীপে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ। অর্থাৎ নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাজমুল ইসলাম রিয়ার এডমিরাল পদমর্যাদার একজন সামরিক কর্মকর্তার স্থলাভিষিক্ত হবেন।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার