বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের খেলা নয়, বরং এটি এক গভীর আদর্শিক দ্বন্দ্ব, যা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছে—বা ভুলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, কাগজে-কলমে আদর্শগতভাবে ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলেও, বাস্তবে তাদের বিভাজন ক্ষমতাকেন্দ্রিক দাপট, পরিবারতন্ত্র, এবং রাজনৈতিক কৌশলের মঞ্চেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এই বিভাজনের পেছনে একসময় ছিল দুটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয়বোধের যুদ্ধ: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ বনাম ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এই দ্বন্দ্ব এখন এতটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে বিএনপির অনেক নেতা আজ আওয়ামী লীগের স্লোগান দিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করেন—নিজেদের ইতিহাস ভুলে, নিজেদের দর্শন বিস্মৃত হয়ে।
ইতিহাস ও গঠনের পটভূমি
•আওয়ামী লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই দলই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় এবং বাংলাদেশের জন্মে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে।
•বিএনপি জন্ম নেয় ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে—একটি সামরিক পরিবেশে। এটি ছিল সেনানিবাস থেকে উঠে আসা এক রাজনৈতিক পরীক্ষা, যেখানে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ছিল অনেকটা পুনঃসংজ্ঞার প্রয়াস।
আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শন
•আওয়ামী লীগ দাবি করে তারা ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল। যদিও সময়ের পরিক্রমায় দলটির এই অবস্থান নানা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
•বিএনপি “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”-এর প্রবক্তা। ধর্ম ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রিক পরিচয় গড়ার চেষ্টা করে তারা। বাস্তবে, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় দলগুলোর সাথে জোট করার ফলে এই দর্শন ইসলামপন্থার আচ্ছাদনে ঢেকে গেছে।
নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র
•আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্ব এখন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। দলটি পরিবারতন্ত্রের প্রবল ছায়াতলে।
•বিএনপি-তে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং এখন পুত্র তারেক রহমান—সবাই একে পারিবারিক কোম্পানির মতো চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক কৌশল ও শাসনধারা
•আওয়ামী লীগ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে আধিপত্য বজায় রাখে। উন্নয়নের কথা বললেও মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
•বিএনপি ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘদিন। বিরোধী দল হিসেবে সোচ্চার থাকলেও নিজের শাসনকালেও দুর্নীতি, অদক্ষতা ও উগ্রবাদে প্রশ্রয়ের দায় এড়াতে পারে না।
জোট ও জনপ্রিয়তা
•আওয়ামী লীগ সাধারণত বাম ও মাঝারি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে জোট করে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য এদের অনেকের কাছে আবেগের জায়গা।
•বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্য গড়ে সমালোচিত। যদিও শাসনবিরোধী অনেক মানুষের কাছ থেকে একপ্রকার “বিকল্প” হিসেবে সমর্থন পায়।
জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব: পরিচয়ের রাজনীতি
•আওয়ামী লীগ প্রচার করে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’—যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক চেতনার ভিত্তিতে জাতির পরিচয় গঠিত।
•বিএনপি দাঁড় করায় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’—একটি রাষ্ট্রভিত্তিক, ধর্ম ও ভূখণ্ডনির্ভর সমন্বিত জাতীয় পরিচয়, যা এক অর্থে ভারতের প্রভাব প্রতিরোধের ভূরাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখা হয়।
এই দুই দর্শনের মধ্যে মূল পার্থক্য হল:
•একজন মানুষ আগে ‘বাঙালি’, নাকি আগে ‘বাংলাদেশি’—এই পরিচয়-সংকটই রাজনৈতিক আদর্শের শেকড়।
কিন্তু আজ এ প্রশ্নগুলো গৌণ। কারণ রাজনীতি এখন আদর্শ নয়, স্বার্থের পেশা। যে দলের ব্যানারে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, সেটাই ‘দর্শন’ হয়ে ওঠে।
অজ্ঞতার রাজনীতিতে স্বপ্নের বাজার
আজকাল যদি কোনো মূর্খ, নির্লজ্জ, ক্ষমতা-লোলুপ ব্যক্তি দিনে-দুপুরে স্বপ্ন দেখে—সে একদিন সংসদ সদস্য হবে—তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন উঠে: তার কি অন্তত নিজের দলের আদর্শ, ইতিহাস কিংবা ন্যূনতম রাজনৈতিক চেতনা জানা আছে?
উত্তর: না। কারণ আজকাল এসব জানার চেষ্টা করাটাই ‘রাজনৈতিক অপরাধ’! বরং বিএনপির নামে রাজপথে দাঁড়িয়ে কিছু নেতা দেদারসে আওয়াজ তোলেন— ‘তুমি কে, আমি কে—বাঙালি, বাঙালি!’
হায়! হায়! তারা হয়তো জানেন না—এই স্লোগান তাদের দলের মূল আদর্শের বিরুদ্ধে এক সরাসরি বিদ্রুপ। বিএনপির জন্মই হয়েছিল ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিপরীতে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা দাঁড় করাতে।
তাহলে এসব স্লোগান কিসের?
বোধহীন বিদ্রোহ, নকল গর্জন, আর আদর্শহীন চিৎকার
শেষ কথা: দেশ কোন দিকে যাচ্ছে?
দেশ কি এখন এমন এক দিকে যাচ্ছে, যেখানে চিন্তাহীন স্লোগান, মুখস্থ আদর্শ আর ভাড়াটে মিছিলই নেতৃত্বের মানদণ্ড? যেখানে জনগণ চায় খাদ্য, শিক্ষা, ন্যায়বিচার—আর রাজনীতি দেয় স্লোগান, গালাগালি, আর গোপন চুক্তি?
এই বাস্তবতায়, সভ্যতা যেন নিছক একটি ঠাট্টা, আর রাজনীতি হয়ে পড়েছে—এক পেশাজীবী প্রতারণার শিল্প।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com