ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

নতুন বাংলাদেশ: যেখানে জনগণের কণ্ঠই হবে সংবিধান

প্রিয় দেশবাসী, আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে রাষ্ট্রের আসল মালিক—আপনি, আমি, আমরা সবাই—নিজের কথা নির্ভয়ে বলতে পারি। যে বাংলাদেশে এক কৃষক, এক রিকশাওয়ালা, এক শিক্ষার্থী কিংবা এক মা যখন কথা বলবে, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান কিংবা পুলিশপ্রধানও তা শুনবে মাথা নিচু করে।

নতুন বাংলাদেশে জনগণ কথা বলবে, আর বাকিরা শুনবে—হোক না সে যত ক্ষমতাধর। এটাই আমাদের গণতন্ত্রের নতুন মানচিত্র, আমাদের আত্মমর্যাদার নতুন পথচলা।

দেশবাসী, মাথা তুলে দাঁড়ান—আমরা এখন প্রতিবাদ করতে জানি, প্রতিরোধ গড়তে জানি। আমরা একা নই—বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এখন জেগে উঠেছে, বুক ভরে নিয়েছে সাহসের শ্বাস।

আমরা চাই ন্যায়, চাই গণতন্ত্র, চাই মানবিকতা। আমরা চাই এমন বাংলাদেশ, যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের কথা হবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

এটাই নতুন বাংলাদেশের ডাক। এটাই আমাদের সময়। এই দেশ আর কানা-ঘুষোর নয়—এটা হবে জনগণের সাহসের বাংলাদেশ।  আপনিও এই যাত্রায় শামিল হোন।

নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমাদের করণীয় ও নীতিমালা

নতুন বাংলাদেশের ডাক শুধু একটি প্রত্যাশা নয়—এটি একটি নৈতিক চুক্তি, একটি সচেতনতার বিপ্লব।
এই পরিবর্তনের জন্য কেবল সরকার নয়, আমাদের প্রত্যেককেই নিজের দায়িত্ব নিতে হবে।

আমাদের করণীয়গুলো পরিষ্কারভাবে নিচে তুলে ধরা হলো:

১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেকে জিরো টলারেন্সে আনতে হবে

– ঘুষ না দেওয়া, না নেওয়া
– অসততা বা সুযোগ সন্ধানী আচরণের প্রতিটি রূপ পরিহার করা
– দৃষ্টান্ত হতে হবে নিজ নিজ জায়গায়

২. সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, গুম-খুনের সংস্কৃতি ঘৃণাভরে বর্জন

– কোনো প্রকার রাজনৈতিক বা সামাজিক সহিংসতা সমর্থন না করা
– অপরাধীদের পারিবারিক বা রাজনৈতিক ছত্রছায়া দেওয়া বন্ধ করা
– ভয় নয়, সত্যের পক্ষে রুখে দাঁড়ানো

৩. মিথ্যাচার, গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা

– যাচাই না করে কোনো তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকা
– গুজব রটনাকারী ও বিভ্রান্তির কারিগরদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়া
– সত্য, যুক্তি ও প্রমাণ-ভিত্তিক আলোচনা চর্চা করা

৪. আইনের শাসন নিশ্চিত করতে নাগরিক দায়িত্ব পালন করা

– আইন মেনে চলা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদে আইনগত পথ বেছে নেওয়া
– রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য সচেতন চাপ প্রয়োগ করা
– সবাই সমান, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়—এই নীতিতে অনড় থাকা

৫. নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দায়িত্বশীলতা চর্চা করা—প্রত্যেকটি ঘরে, প্রতিটি নাগরিকের ভেতর

– আমাদের প্রত্যেককে নিজের জীবনেই সত্য, ন্যায় ও সহানুভূতির অনুশীলন শুরু করতে হবে
– ঘরে, মসজিদে, স্কুলে—যেখানে থাকি, সেখানে নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটাতে হবে
– সমাজ পাল্টাতে চাইলে, আমাদের নিজেদের ভেতরের মানুষটিকেই আগে বদলাতে হবে

আমাদের যাত্রা—বিশ্বমানের দৃষ্টান্ত, জাতীয় বিবেকের অঙ্গীকার

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল আবেগ নয়, এটি হতে হবে কঠোর কাঠামো, প্রমাণভিত্তিক নীতিমালা এবং সামাজিক শুদ্ধির একটি চুক্তিপত্র। আমরা যদি সত্যিই একটি সৎ, ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে আমাদের প্রয়োজন বিশ্বসভায় টেকসইভাবে প্রমাণিত দৃষ্টান্ত থেকে শিখে নিজেদের বাস্তবতায় তা রূপায়ণ করা।

বিশ্বে এমন কিছু দেশ রয়েছে—যাদের সাহসী সংস্কার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের জবাবদিহিমূলক অংশগ্রহণ দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নতুন আদর্শ তৈরি করেছে। বাংলাদেশও চাইলে সেই কাতারে দাঁড়াতে পারে—শর্ত একটাই: আমাদের নিজেরাই শুদ্ধ হতে হবে এবং রাষ্ট্রকে শুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সিঙ্গাপুর: কঠোর শাসন, শূন্য সহনশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সততা

সিঙ্গাপুরের সাফল্য কেবল উন্নয়ন বা প্রযুক্তিতে নয়—বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের Corrupt Practices Investigation Bureau (CPIB) একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা হিসেবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট করে। এই কাঠামোই তাদের রাজনৈতিক জবাবদিহি ও প্রশাসনিক শুদ্ধতার ভিত্তি। ২০২৪ সালের দুর্নীতির আন্তর্জাতিক সূচকে (Transparency International) সিঙ্গাপুর ছিল এশিয়ায় শীর্ষে।

মালয়েশিয়া: নৈতিকতা-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে ‘National Integrity Plan’

২০০৪ সালে প্রণীত এবং ২০১৯ সালে নবায়িত National Anti-Corruption Strategy (NACS)—৬টি মূল স্তম্ভে গঠিত এক সমন্বিত কাঠামো, যা জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণমাধ্যমকে জাতীয় সংস্কারের অংশ করে তোলে। ‘Integrity Institute of Malaysia’ রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণ ও নীতিগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশের সামনে আমাদের পথ

এই উদাহরণগুলো দেখায়—কোনো জাতিকে পরিবর্তন করতে চাইলে শুধু নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্বের কাঠামো। আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য দরকার:
• একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা, যা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পারবে
• নাগরিকদের সরাসরি অংশগ্রহণের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যেখানে জনগণ রাষ্ট্রের জবাবদিহি চায়
• শিক্ষা, প্রশাসন, রাজনীতি ও গণমাধ্যমে নৈতিকতা বাধ্যতামূলক চর্চার কাঠামো
• আইনের শাসন—কেবল কাগজে নয়, মাঠে, থানায়, আদালতে, সংসদে প্রতিফলিত বাস্তবতা

শেষ কথা: যে জাতি নিজের বিবেক জাগাতে পারে, সে-ই পারে পৃথিবী বদলাতে

নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, দলীয় রাজনীতিরও নয়—এটি প্রত্যেক সৎ নাগরিকের শপথ। আমরা যদি নিজেরা বদলাই, তাহলে রাষ্ট্রও বদলাবে। আমরা যদি সত্যকে ভালোবাসি, তাহলে মিথ্যা একদিন বিদায় নেবে।

আজকের এই অঙ্গীকার কেবল আন্দোলনের ডাক নয়—এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া একটি মূল্যবোধের ভিত্তিপ্রস্তর।
নতুন বাংলাদেশ হবে সাহস, সততা ও শৃঙ্খলার দেশ—যেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আর প্রতিটি কণ্ঠই গণতন্ত্রের স্বর।

পরিশেষে: যে জাতি নিজের বিবেক জাগাতে পারে, সে-ই পারে পৃথিবী বদলাতে

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল আবেগের ফোয়ারা নয়—এটি হতে হবে একটি নৈতিক সমাজ চুক্তি, যার শিকড় গাঁথা থাকবে সৎ নেতৃত্ব, আইনসম্মত রাষ্ট্রচর্চা এবং জনগণের জবাবদিহিমূলক অংশগ্রহণে। উন্নত বিশ্বে এই ধারণাটি আজ আর কল্পনা নয়, বরং বাস্তব।

সিঙ্গাপুরের CPIB বা মালয়েশিয়ার Integrity Plan কেবল প্রশাসনিক কৌশল নয়, বরং তারা সমাজের গভীরে থাকা দুর্নীতি ও দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত মূল্যবোধের যুদ্ধ। বাংলাদেশে এখন সেই যুদ্ধ শুরুর সময় এসেছে—আমাদের ঘরে, সমাজে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে।

আমাদের প্রয়োজন:
• একটি স্বাধীন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশন
• শিক্ষা ও গণমাধ্যমে নৈতিকতা বাধ্যতামূলক চর্চার কাঠামো
• নাগরিকদের সরাসরি অংশগ্রহণের ডিজিটাল গণশুনানি প্ল্যাটফর্ম
• সাংবিধানিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা—যেখানে প্রধানমন্ত্রী বা সেনাপ্রধান, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়

এটাই নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার—যেখানে ‘ভবিষ্যৎ’ কোনো অজানা নিয়তির নাম নয়, বরং সক্রিয় নাগরিক দায়িত্ব ও নৈতিক শুদ্ধির নির্ভরযোগ্য গন্তব্য।

আজ যদি আমরা নিজেদের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পারি, তাহলে আমরা হবো সেই জাতি—যে শুধু নিজের ভাগ্য নয়, পৃথিবীর ইতিহাসও বদলে দিতে পারে।

এই যাত্রা এখানেই থেমে থাকুক না। আপনার সাহসই হোক বাংলাদেশের নতুন সংবিধান।

রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com 

শেয়ার করুন:-
শেয়ার