বাংলাদেশে প্রকৌশল পেশা কেবলমাত্র একটি কর্মসংস্থান নয়—এটি একসময় ছিল জাতি গঠনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু আজ সেই পেশা অদৃশ্য এক চক্রের হাতে বন্দি। দেশের স্বাস্থ্য খাত, কারিগরি প্রতিষ্ঠান, এবং বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি-সবখানেই আমরা দেখতে পাচ্ছি অভিন্ন চিত্র: নিষ্ক্রিয়তা, দুর্নীতি, অযোগ্যতা, এবং প্রকৌশলচর্চার প্রতি চরম অবহেলা। আর এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না কোনো সরকার—চাই তা ড. ইউনূস হোন, শেখ হাসিনা হোন কিংবা অতীতের কোনো তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
যে দেশে মেধাবী তরুণেরা প্রকৌশলী হয়ে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে, সেই দেশেই তারা হয়ে পড়ে অবাঞ্ছিত। ক্লাসরুমের শেখানো জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। বাস্তবতার নাম—ক্রয়চর্চা, কমিশনভিত্তিক সিদ্ধান্ত, এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় বিদেশ সফর। প্রকৌশলীর কাজ হয় না নতুন কিছু উদ্ভাবন, বরং হয় “নতুন যন্ত্রপাতি কেনা”—যেখানে থাকে কমিশনের ফাঁদ। এমনকি বিদেশ সফরের দলে প্রকৌশলীরা স্থান পান না; স্থান পান মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক অনুসারীরা।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা এ চিত্রকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে থাকে হাসপাতালের গুদামে—অচল হয়ে। নেই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, নেই প্রশিক্ষিত জনবল। দেশে শত শত কোটি টাকার মেডিকেল সরঞ্জাম থাকলেও তার অপারেটর নেই। চিকিৎসা এখন প্রযুক্তিনির্ভর, কিন্তু প্রযুক্তির ব্যর্থ ব্যবস্থাপনাই রোগীর মৃত্যুকে অনিবার্য করে তুলছে।
প্রতিভাবান নবীন প্রকৌশলীরা যখন উদ্ভাবনী কিছু করতে চান, তখন অভিজ্ঞ সহকর্মীরা “বাজার নষ্ট” করার অভিযোগে তাদের গলা চেপে ধরেন। এ এক কুৎসিত পেশাগত রাজনীতি। যারা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে, তাদের কণ্ঠরোধ করা হয়। ফলে, উদ্ভাবন থেমে থাকে, জ্ঞানের অগ্রযাত্রা আটকে যায়।
ড. ইউনূস বারবার বলেছেন—বাংলাদেশ নামক দেশটা ভেতর থেকে পচে গেছে। চারপাশে ভাঙন, ক্ষয়, অস্থিরতা। তিনি “নতুন করে গড়ার” আহ্বান জানালেও বাস্তবে তা রয়ে গেছে বক্তৃতা ও স্লোগানের গণ্ডিতে। যখন প্রতিদিন দেশের রাস্তাঘাটে রক্ত ঝরে, টোকাই শ্রেণির মানুষের মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, তখন প্রশ্ন জাগে: এই বাস্তবতায় প্রযুক্তি ও প্রকৌশলচর্চা কোথায়? কীভাবে সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী বা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কোন কাজে লাগবে, যদি দক্ষতা, ন্যায় ও মানবতা অনুপস্থিত?
গত ৫৪ বছরে আমরা সামরিক, বেসামরিক, তত্ত্বাবধায়ক, গণতান্ত্রিক এবং তথাকথিত নোবেল বিজয়ীর সরকার দেখেছি—কিন্তু একটিবারও দেখিনি স্বাস্থ্য বা প্রকৌশল খাতে দীর্ঘমেয়াদি, পেশাভিত্তিক উন্নয়ন নীতি। বরং প্রতিবারই সমস্যাগুলো আরও ঘনীভূত হয়েছে।
প্রথমত, প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পখাতের মধ্যে বাস্তব সংযোগ স্থাপন জরুরি। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে প্রকৃত ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান—বিশেষ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেলওয়ে ও বিসিআইসির ভিতরে একটি স্বাধীন গবেষণা সেল গঠন করতে হবে। এই সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাথে সমন্বয়ে প্রযুক্তিগত সমস্যার বাস্তব সমাধান খুঁজবে।
তৃতীয়ত, প্রকৌশলীদের প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ সফর হোক রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়—দক্ষতা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে। প্রকৌশলীদের অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করা উচিত নয়।
চতুর্থত, স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা প্রশিক্ষিত টিম গঠন করতে হবে। কেবল কেনা নয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি—এই পুরো চক্রটি ইনস্টিটিউশনালাইজ করতে হবে।
আজ বাংলাদেশ প্রতিদিন রক্তাক্ত—গলাকাটা, পাথর ছোড়া, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির মহোৎসব। রাস্তায় টোকাই শ্রেণির মানুষের ন্যূনতম মানবাধিকার নেই। এরকম এক অমানবিক বাস্তবতায় প্রযুক্তি বা যন্ত্রকৌশলের চর্চা এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক চিন্তা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই সঠিক ব্যবহার, নেই পেশাদারিত্ব। চিকিৎসা নয়, চলছে কেবল ব্যবসা ও অনিয়ম। দেশের সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজ গণমাধ্যমে দাঁড়িয়ে নিজেদের অসহায়তা প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন—এই রাষ্ট্রটা পচে গেছে। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নষ্টের গন্ধ।
নতুন ভবন বা মেগা প্রজেক্ট দিয়ে দেশ গড়ে না। গড়তে হয় মানুষের ভিতরের শক্তি, নেতৃত্বের সততা, প্রশাসনের জবাবদিহিতার মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়: আমরা কি এখনও কেবল পর্যবেক্ষণ করবো, নাকি বাস্তব পদক্ষেপ নেবো?
বাংলাদেশের দরকার সত্যিকার অর্থে একটি কার্যকর পদক্ষেপ—যেখানে প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, এবং নেতৃত্ব নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বকে সামনে রেখে এগিয়ে আসবে।
‘নতুন বাংলাদেশ’ শুধু এক রাজনৈতিক শ্লোগান নয়—এটি হতে হবে বাস্তব সাহসের প্রতিফলন। কারণ, আজকের নির্মম সত্য হলো: শুধু রাজনীতি দিয়ে কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না।
রাজনীতি যদি হয় রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি, তবে তা হতে হবে নীতি, মূল্যবোধ এবং পেশাদারিত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ বাংলাদেশে রাজনীতি হয়ে উঠেছে হিংসা, দখলদারিত্ব, ধান্দাবাজি আর দুর্নীতির বিষবৃক্ষ। রাজনীতির নাম করে চলছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মিডিয়া কেনা, প্রশাসন দখল, আর জনগণকে ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখার সংস্কৃতি।
আমরা উন্নয়নের নামে কেবল রাজনীতিকে সমাধানের একমাত্র বাহন ভেবে ভুল করেছি। সেই ভুলের মাশুল আজ দিচ্ছি হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা এবং পরিবারে। যেখানে প্রযুক্তিবিদেরা অবহেলিত, প্রকৌশলীরা হতাশ, গবেষকেরা অনুদানবঞ্চিত—সেখানে উন্নত বাংলাদেশ এক মরীচিকা।
আমরা ভুলে যাই—দেশ গড়ে শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক, এবং একজন সৎ কৃষক। দেশ গড়ে তাদের হাত ধরে যারা নীরবে-নিভৃতে কাজ করেন মানুষের কল্যাণে, প্রযুক্তির বিকাশে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়।
তাই প্রয়োজন এক বাস্তবমুখী জাগরণ: রাজনীতি থাকবে, কিন্তু রাজনীতি হবে বাহক—লক্ষ্য নয়। আমরা যদি প্রকৌশল, প্রযুক্তি ও পেশাদারিত্বকে অবহেলা করি, তাহলে শত শত পদ্মা সেতুও আমাদের উন্নয়নের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। বরং এসব মেগা প্রজেক্টই হয়ে উঠবে দুর্নীতির নতুন প্রতীক, জনগণের আস্থাহীনতার কারণ।
এখন দরকার এক বৈপ্লবিক ভারসাম্য—রাজনীতি ও পেশাদারিত্বের মধ্যে। রাষ্ট্র হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রশাসন হতে হবে জবাবদিহিমূলক, আর শিক্ষা হতে হবে নৈতিকতার আধার।
আজকের প্রশ্ন একটাই: আমরা কি সত্যিই পরিবর্তন চাই, নাকি শুধু কথা বলেই সন্তুষ্ট?
জাগো বাংলাদেশ, জাগো।
রহমান মৃধা, সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি।
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন।
Rahman.Mridha@gmail.com