থ্রি জিরোর (Zero Poverty, Zero Unemployment, Zero Net Carbon Emission) স্বপ্ন দেখিয়ে যিনি গোটা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, আজ সেই মানুষটাই জাতির সামনে দাঁড়িয়ে এক ভয়াবহ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে উঠেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবমূর্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, আর এখন তো প্রশ্ন উঠছে—এই যাত্রার শেষ প্রান্তে প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস নিজেই জিরো হয়ে যাচ্ছেন না তো?
এটা শুধুমাত্র আমার প্রশ্ন নয়। এটা গোটা জাতির এক চাপা কণ্ঠস্বর, এক ব্যর্থ স্বপ্নের অদৃশ্য বিলাপ।
একদিন যে আস্থা নিয়ে আমরা তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, আজ সেই আস্থাই পরিণত হয়েছে চরম হতাশায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যে ভূমিকা তাঁর পালন করার কথা ছিল, বাস্তবে তা এক কথায় বললে “গুড ফর নাথিং”। পদের ভার ছিল পাহাড়সম, কিন্তু দায়িত্ব পালনে ছিলেন হাওয়ার মতো হালকা। দীর্ঘ এক বছর ধরে এই পদ আঁকড়ে রেখেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই দায়িত্ব তিনি আদৌ বোঝেন কি?
সোনালী প্রতিশ্রুতির কালো পরিণতি
গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য থেকে নোবেল, আন্তর্জাতিক সম্মান থেকে বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট—সবকিছুই এক অনন্য ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিল ইউনূস নামকে। কিন্তু কী লাভ সেই ব্র্যান্ডের, যদি সেটি দেশের অভ্যন্তরে ন্যূনতম বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে না পারে?
৩জিরোর কথা বলেছিলেন তিনি, অথচ তার নিজের প্রতিষ্ঠানেই দেখা গেছে শ্রমিক শোষণ, লভ্যাংশ-বঞ্চনা আর নৈতিক দ্বিচারিতা। বিশ্বকে বুঝিয়েছেন আমরা বাঙালিরা সামাজিক ব্যবসার অগ্রদূত। অথচ দেশের ভেতরে তিনি এক পুঁজি-আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার দালাল হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছেন দিনকে দিন।
নিরব জাতি, মুখোশধারী নেতৃত্ব
সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, জাতি আজও নিরব। এতদিন যারা তাঁর পাশে থেকেছেন, তাঁর সঙ্গে একসাথে ছবি তুলেছেন, তাঁর নামে মঞ্চে উঠেছেন—তাঁরাই আজ মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এই নীরবতা কি সম্মতির ছায়া? নাকি নিজেদের স্বার্থে চোখ বুঁজে থাকার সহজ বুদ্ধি?
একজন ব্যক্তি যখন আন্তর্জাতিক খ্যাতির ভারে জাতীয় দায়বদ্ধতা ভুলে যান, তখন তাকে আর নেতা বলা যায় না—তাকে বলা হয় এক ব্যর্থ প্রতীক, এক সময়ের গৌরব যা এখন ইতিহাসের গ্লানিতে পরিণত হয়েছে।
এখন সময় প্রশ্ন তোলার
ড. ইউনূসের অনুসারীরা নিশ্চয় বলবেন, এটা একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, একটি রাজনৈতিক চরিত্র হননের প্রয়াস। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সত্যিই ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে কেন তিনি বারবার জাতীয় সংলাপ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকেন?
জাতি এখন আর ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়ার মুডে নেই। জাতি এখন প্রশ্ন করতে জানে। এবং এ প্রশ্ন তোলা সময়ের দাবি—নোবেল কি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে? আন্তর্জাতিক খ্যাতি কি জাতীয় ব্যর্থতা আড়াল করার পর্দা হতে পারে?
শেষ কথা
সময় এসেছে ‘ইউনূস ইজ এন আইকন’ এই মনস্তাত্ত্বিক মোহ ভেঙে ফেলার। তাঁকে অব্যাহতভাবে প্রশ্ন করতে হবে, তাঁকে ঘিরে থাকা নৈতিক ধোঁয়াশা সরাতে হবে। কারণ ইতিহাস কাউকে ছাড়ে না—আর জাতির প্রত্যাশা কাউকে অন্ধ আনুগত্যের সুযোগ দেয় না।
তাঁর যদি সত্যিই কিছু দেবার থাকে জাতিকে, তবে সেটা এখন—এই মুহূর্তে—দায়িত্ব নিয়ে সামনে আসা, স্বচ্ছতা দেখানো এবং ব্যর্থতা স্বীকার করার মধ্যেই নিহিত।
রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com